Flickr

Monday, 24 September 2012

গণতন্ত্রের ধারা!

Posted by   on

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এরশাদ সাহেবের পতনের পর দেশে গণতন্ত্রের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তা অব্যাহত গতিতে চলবে এমন একটি আশা আমরা পোষণ করেছিলাম। আরম্ভটা ভালোই হয়েছিল। তবুও শেখ হাসিনার সূক্ষ্ম কারচুপি মন্তব্যটি কিঞ্চিৎ প্রশ্নের সঞ্চার করেছিল। তারপর নির্বাচনে একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ, একবার আওয়ামী লীগ অন্যবার বিএনপি ক্ষমতার আসনে বসেছিল। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা ভালো হওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি কারণ, পার্টি দুটো গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। এক ধরনের 'প্রেসিডেন্টশিয়াল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট' দুটি দলই ক্ষমতার বলে চালিয়েছে। এটি কেন হলো? উত্তরটা সহজ। নেতৃত্বে যিনি সর্বেসর্বা সেই খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দায়ী। কারণ, তারা নির্বাচনে তৃণমূল থেকে পরীক্ষিত কর্মী বা নেতা না নিয়ে নির্বাচনে আমলাদের (সামরিক ও বেসামরিক) প্রাধান্য দিয়ে মনোনয়ন দান করেছিলেন। অর্থ ও ক্ষমতার কথাভেবে এবং এসব নেতা শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। এরা দেশ সেবা করার জন্য দলে যোগদান করেননি। তারা ক্ষমতা ও ধনের জন্য রাজনীতিতে এসেছিলেন। পরীক্ষিত তৃণমূল থেকে নেতাকর্মী না নেয়ার জন্য দল থেকে আদর্শ লোপ পেল। ফলে ঘুষ ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেল দেশ। দলগুলোর অঙ্গসংগঠনগুলো টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে দলবাজি করা শুরু করল। সরকারি জমি দখল হয়ে গেল। দখল হলো রেলওয়ের জমি। নদীও দখল থেকে নিষ্কৃতি পেল না। চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পেল এবং এটা এমন হলো যে বখরা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারি শুরু হলো। এ এক অদ্ভুত চিত্র। দলের শাসন লোপ পেল।

  
বলাবাহুল্য, দুর্নীতির এই বল্গাহীন তা-বে আদর্শবাদ, নৈতিকতা, সততা লোপ পেল। পাল্লা দেয়া শুরু হলো কে কতভাবে দুর্নীতি করতে পারে। ঘুষ গ্রহণ করতে পারে। দুই দলের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুণীজন আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। মরহুম মোজাফফর আহমদ থেকে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক সরকারকে সতর্ক করে দেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ভালো কথা কোনো দলই শুনতে রাজি নন।

 আর একটি দিক লক্ষ্য করা যায়। দলের ভেতরেও গণতন্ত্রের চর্চা লোপ পেল। পার্টি প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একজনই। এ ঐতিহ্য বন্ধ হলো না। ফলে একক নেতৃত্বে সর্বেসর্বা ব্যক্তিটি সবার কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করেন তা হচ্ছে আনুগত্য। আনুগত্য না দেখালে দলে ঠাঁই নেই কোনোকালেই।

 রাজনীতিতে এইসব চক্র থাকাতে যে গণতন্ত্র অব্যাহত গতিতে চলত তা থেমে গেল। ফলে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দলের সর্বেসর্বা। তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই অন্যান্য নেতা কথা বলে। বক্তব্য রাখে। বিবৃতি দেয়। এছাড়া আরেকটি কারণ আছে, ভোট ধরতে পারবে কে? দুই নেত্রীর কারিশমা ভোট ধরার উপায়। কাজেই দলের নেতারা তাদের ওপর নির্ভরশীল। নির্ভরশীল হলে নেতা বা নেত্রীর মধ্যে 'ইগোইজম' সৃষ্টি হয়।

 তখন সবাই রাজা নন। একজনই রাজা এ রাজার রাজত্বে। আর একটি দিক বিবেচনায় নিতে হয়। ছোট ছোট যে বামপন্থী দল আছে তা দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করেছে। তাদের কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। ভোটে দাঁড়ালেও ভোট পাবে কিনা সন্দেহ। তবুও সুধীজনের প্রত্যাশা যতটুকু ক্ষমতা আছে তা নিয়ে এ সব দল লড়বে। কিন্তু না, তারা আত্মসমর্পণ করে। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। বামপন্থী চেতনার অবসান হয়। দক্ষিণমুখী চেতনার জন্য তারা বিসর্জন দেয় আদর্শ। দলে যে ভিড়ল তার প্রধান কারণ, ক্ষমতা, দুএকটা পদ, কিংবা মন্ত্রিত্ব। তাই দিলীপ বাবু কমিউনিস্ট হয়ে আওয়ামী লীগে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। এতে তার আদর্শ তার চোখে বিসর্জিত হয়নি।

 এ প্রসঙ্গে পরিবারতন্ত্রের কথা বলা যেতে পারে। গেল কয়েকবছর ধরে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে 'মাইনাস' করার কথা বলা হচ্ছে। ১/১১-এর সময় বড় করে, এখন ছোট করে। কিন্তু যারা বলছেন তারা হয়তো ভুলে যান এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একদিনে চেপে বসেনি। এটা বলা চলে সেই '৭১-৭২ থেকে। শেষ মুজিবের সময় থেকে। নইলে আওয়ামী লীগের নেতার তো অভাব ছিল না। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, নজরুল ইসলামের পরও অনেক ছিলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীর কথা বলতে পারি। তা কেউ না হয়ে শেখ হাসিনা নেতা হলেন কেন? নেতারাই তো তাকে বানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। গৃহবধূ থেকে টেনে এনে তাকে নেতা বানানো হলো এবং এরা দুজনই নেতা বনে তো গেলেন। নির্বাচনে তাদের নামেই তো ভোট আসে। অন্য কারো নামে নয়। অবশ্য নির্বাচনে যিনি দাঁড়াচ্ছেন তার ওপরও কিছুটা নির্ভর করে। মনে রাখা ভালো, ভারতের মতো দেশেও পরিবারতন্ত্র ঘোচাতে পারেনি। নির্বাচনে নেহরুর বংশই ভোটার টানে। ফলে বিজয়। কাজেই রিস্ক নিয়ে লাভ কী? ওখানে চেষ্টা তো কম হয়নি। সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করা যায়নি বিজেপির জন্য। কিন্তু নেতৃত্ব তো তার হাতে, কংগ্রেসের নেতৃত্বের কথা বলছি।

 এই প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী এরশাদের প্রসঙ্গ আনতে হয়। তার ৯ বছরের শাসনামলে দুর্নীতির যে বিষবাষ্প বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল তার তুলনা হয় না। গণঅভ্যুত্থানে তার পতনের পর তিনি ডাস্টবিনে চলে যাবেন এ রকমই আশা করা হয়েছিল। যে আশা সঙ্গত ও যৌক্তিক কিন্তু না, তিনি অবিশ্বাস্য মেধা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থান করে নিলেন। কাউকে ভাই ডেকে, কাউকে বোন ডেকে। তালবাজ এরশাদ তালমতই শেখ হাসিনাকে বোন ডেকে তার দলে ভিড়লেন। যদিও প্রত্যাশা মেটেনি, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি, তবুও তিনি আছেন এবং তার মর্যাদা বেড়ে গেল ভারতের আমন্ত্রণে। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেসের সভানেত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। নিশ্চিত এটা, ভারত সেকেন্ড ফ্রন্ট খুলেছে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে, আর প্রথম ফ্রন্ট আওয়ামী লীগ। বস্তুত, এরশাদ ধরে নিয়েছেন খালেদা জিয়া যেমন একরোখা তাতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থায় নির্বাচন করবেন না, তখন বিরোধী পক্ষের ভূমিকায় এরশাদ ছাড়া আর কে আছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে আর তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হবেন এবং নেতা হয়েও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যাবেন। রাজনৈতিক দাবাখেলায় সব সময় সব সাধ মেটে না। কিন্তু কখনো কখনো মিটে যায়। কে জানে এরশাদ সাহেবের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কি না।


 দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের বীজটি উপ্ত হয়ে শাখা-প্রশাখা মেলে ফলে ফুলে বৃক্ষ হয়ে উঠবে এ আশা বাতুলতা। তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র নামেই, কারণ একবার নির্বাচন হয়। নির্বাচন শেষে আবার পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন হয়। এর নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের এই ধারা দুটি দলই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মেনে চলে এবং জনগণকে যে সব ওয়াদা দেয় তা অপূর্ণই থেকে যায়। মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, জনসেবা _এর কিছুই পায় না। মানুষ অবাক হয়ে দেখে কীভাবে ক্ষমতাসীন দলটি সব কিছু ভুলে গেল। তাই মাঝে মাঝে শুনতে হয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, ওই দুজন থেকে এরশাদ সাহেবই তো ভালো। কত বড় আঘাত পেলে ও নিরাশ হলে জনগণ এরকম কথা বলতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবশ্য এতে এসে যায় না। তারা ভাবে তাদেরই জয় হবে। জনস্বার্থ রক্ষিত হোক কিংবা না হোক। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে যে 'যুদ্ধ' চলছে কীভাবে তার মীমাংসা হবে সেটাই প্রশ্ন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটার গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে বিশ্বাস হয় না। তাহলে কি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মীমাংসা হবে। তাতে কি মঙ্গল হবে দেশের?
তা হলে কি গণতন্ত্রের চর্চার সামান্যতম ধারাটি যা আছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে। লাভ হবে কার?

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter