Flickr

Thursday, 20 August 2015

ভিন্নমতাবলম্বন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা

Posted by   on


গত কয়েক দিনে সংঘটিত ঘটনাবলি কার্যত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধাগুলো কোথায়, এ ক্ষেত্রে সরকার ও রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করে। ভিন্নমতাবলম্বন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে ব্যক্তিস্বাধীনতার একটি অবিভাজ্য অংশ, তা বলাবাহুল্য, আর তা যুক্ত জীবনের স্বাধীনতার সঙ্গে। সে কারণে বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে, ৩২ অনুচ্ছেদে এ দুই বিষয়কে একই বাক্যের মধ্যে ধারণ ও বিবৃত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ আমরা গত কয়েক দিনে যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথে বাধানিষেধের কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, তেমনি প্রত্যক্ষ করি জীবনের নিরাপত্তাহীনতার দিকও।
আমরা দেখেছি, সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে ঢাকায় আটক করে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় আটক হিসেবে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তাঁর শারীরিক অসুস্থতাকে অবজ্ঞা করে, পুলিশ প্রবিধান বিবেচনায় না নিয়ে তাঁকে পরানো হয়েছে হাতকড়া। তিনি অভিযোগ করেছেন, থানায় তাঁকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সবাই জানেন—একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তাঁর জামিন পাওয়ায় আমরা অনেকেই হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় তাঁর জামিন হয়েছে, তাতেও অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম হবে। একই সময় আমরা দেখি যে সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে পুলিশ আটক করেছে। শওকত মাহমুদ বিএনপির সমর্থকই শুধু নন, তিনি দলের প্রধান খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাও। আদর্শ ঢাকা আন্দোলন নামের একটি সংগঠনের সদস্যসচিব হিসেবে তিনি ওই সংগঠনের একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য যাওয়ার সময় তাঁকে আটক করা হয়। সংগঠনটিকে সংবাদ সম্মেলনও করতে দেওয়া হয়নি। সংগঠনটি সংবাদ সম্মেলন করে গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘কারচুপি’র প্রমাণ হাজির করবে বলে বলা হয়েছিল। শওকত মাহমুদকে আটকের পর বলা হয়েছে যে বিএনপির ডাকা অবরোধের সময় গাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাঁকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে কেন তাঁকে একটি সংবাদ সম্মেলনের আগের মুহূর্তে আটক করার প্রয়োজন দেখা দিল।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের আওতায় আনা এটাই প্রথম মামলা নয়, যেমন বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর মামলাও এটা নতুন নয়। তারপরও প্রবীর সিকদারের আটকের ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের অবদানের কথা সবার জানা। প্রবীর সিকদার সরকার-সমর্থক, একসময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বিদেশ সফর করেছেন, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের বিষয়ে কারও মনে সন্দেহের অবকাশ নেই; তদুপরি তিনি ২০০১ সালে সন্ত্রাসীদের হামলায় একটি পা হারিয়েছেন। তাই তাঁর আটকের ঘটনা অনেককেই, বিশেষ করে সরকারের সমর্থকদের বিস্মিত করেছে। এ আটকের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আমরা শুনতে পাই, বিশেষ করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্যগুলো লক্ষণীয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী কোনো বিবেকবান মানুষের আর শান্ত হয়ে থাকার অবস্থা নেই; তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ঘটনাটিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু অন্য পক্ষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেছেন, এ আইনে মামলার কারণে প্রবীর সিকদারকে আটক করার বিকল্প ছিল না। তাঁর পক্ষে যিনি এ মামলা করেছেন, তাঁর প্রতি যে মন্ত্রীর সমর্থন আছে, সেটা স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে অনেকে এ ঘটনাকে দলের অভ্যন্তরীণ কলহ-কোন্দলের প্রকাশ বলেই অনুমান প্রকাশ করছেন; গত কয়েক বছরে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্বের খবর সবাই অবহিত আছেন। এখানে আঞ্চলিক পর্যায়ের কলহগুলোর কায়া বা ছায়া যাঁরা দেখতে পান, তাঁদের হয়তো স্মরণে থাকবে যে ১৯৭৪ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ লাল বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ইত্যাকার বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে, কারও কারও মতে, জিয়া জীবিত থাকা অবস্থাতেই বিএনপির ভেতরে যে কলহের সূচনা হয়েছিল, তার পরিণতিও ভালো হয়নি। অতিমাত্রায় দুর্বল বিরোধী দলের উপস্থিতির পটভূমিকায় ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার কোন্দল দেশের জন্য ইতিবাচক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয় না।
প্রবীর সিকদারের প্রতি আচরণের বিষয়ে যতটা প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই, শওকত মাহমুদের বিষয়ে ততটা প্রতিক্রিয়া এখনো চোখে পড়েনি। অনেকে তাঁকে কেবল একটি দলের সদস্য বলে বিবেচনা করছেন, সেটা একটা কারণ বলে মনে হয়। কিন্তু আমার ধারণা, এ বিবেচনা ইতিবাচক নয়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা দরকার যে প্রবীর সিকদারের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে যেমন আমার ঐকমত্য নেই, তেমনি নেই শওকত মাহমুদের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গেও। কিন্তু যে বিবেচনায় আমি মনে করি আমাদের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটা সামঞ্জস্য রাখতে হবে, সেটা সুস্পষ্ট করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যে সময় তিনি প্রবীর সিকদারের সঙ্গে আচরণে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, সে সময় তিনি এটাও বলেছেন যে ‘আবারও বলতে চাই, সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা একটি প্রতিষ্ঠান। সবাইকে এই জিনিসটি বুঝতে হবে, একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রতিষ্ঠান যেতে পারে না।’ তাঁর এ বক্তব্য আটক সাংবাদিক শওকত মাহমুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এমন অনুমানের কারণ নেই, কিন্তু একে এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশও নেই।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারা জারি হওয়ার আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু এর প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে কার্যত হয়েছে বাছবিচার; সর্বক্ষেত্রে একইভাবে একই নৈতিক অবস্থান থেকে প্রতিবাদের অভাব রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এর নিয়মিত এবং ইচ্ছেমাফিক ব্যবহারের পথ তৈরি করে দিয়েছে। সে কারণে তথ্যমন্ত্রী ৫৭(২) ধারা বাতিলের দাবিকে এক কথায় নাকচ করে দিতে পেরেছেন। তিনি সম্ভবত অনুমান করেন যে এ দাবি ভবিষ্যতে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ক্ষীণ হয়ে আসতে পারে। অন্যান্য আইনের ক্ষেত্রেও আমরা তার অন্যথা দেখি না। কিন্তু উভয়ই যে ভিন্নমত প্রকাশের পথে বাধা তৈরি করছে, এটি উপলব্ধি করা দরকার।
গত কয়েক দিনের সংঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে সাম্প্রতিক কালে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার লেখক অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে তিনজনকে আটক করার ঘটনা। তাদের আটকের ঘটনা আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ভিন্নমত প্রকাশের পথে আরেকটি বাধা হচ্ছে চরমপন্থী চিন্তাভাবনা। অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থার একটি ধারা ধর্মকে কেবল আশ্রয়ই করে না, তাকে ব্যবহার করে হত্যার বৈধতা দেওয়ার জন্যও। ভিন্নমত অবলম্বন এবং তা প্রকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাধা যেমন কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না; তেমনি এ ধারাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যখন এ ধরনের চিন্তার আদলে মত প্রকাশের সীমা নির্ধারণের কথা বলা হয়, তখন তা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র যদি ভিন্নমত প্রকাশের সব পথই বন্ধ করে দেওয়ায় উদ্যোগী হয়, তবে সেই রাষ্ট্রের চরিত্র আমরা কীভাবে বর্ণনা করব?
এ কারণেই এ প্রশ্নটা উত্থাপন করা জরুরি যে গত কয়েক দিনে আমরা আরও দেখেছি যে শিশু নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতা আরজু মিয়া, মাঠ দখলের লড়াইয়ে গর্ভবতী মা এবং তাঁর জঠরে থাকা শিশুকে গুলিবিদ্ধ করার অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক নেতা আজিবর শেখ, জাতীয় শোক দিবসের র্যালিতে হত্যাকাণ্ডের মামলার সন্দেহভাজন আসামি জাকির হোসেন মারা গেছেন বন্দুকযুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো গুরুতর সন্দেহ নেই, কিন্তু রাষ্ট্র যে তাঁদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত জীবনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে, সেটা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে এখন যে আলোচনা, তার একটা কারণ যে এই নিহত ব্যক্তিরা সরকারি দলের সদস্য বা সমর্থক। এসব হত্যাকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলেই বর্ণনা করে এবং তা–ও যে গত কয়েক বছরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা বলাই বাহুল্য। এ বিষয়ে পরিসংখ্যান সহজলভ্য। তদুপরি এখন একজন মন্ত্রী যখন একে ‘অ্যাকশন’ ও ‘সরকারি অবস্থান’ বলে বর্ণনা করেন, তখন তা সবার জন্যই উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতি সমর্থন দেওয়ার লোকের অভাব নেই। এত দিন সরকারের সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো রকম দ্বিধা ছিল না। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হবে কি না, সেটা লক্ষ করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁদের অবস্থানের পরিবর্তন হোক অথবা না হোক, এটা বোঝা জরুরি যে রাষ্ট্রের হাতে নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা তুলে দিলে তা জীবন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে ওঠে। এ প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থানের বদলে বাছবিচারের কৌশল শেষ পর্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter