Flickr

Thursday, 20 August 2015

মেজর জেনারেল মনজুরের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে প্রসহন

Posted by   on

 প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর মেজর জেনারেল মনজুর সপরিবারে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে পুলিশ হেফাজত থেকে সেনা হেফাজতে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এই দাবির পক্ষে অনেক প্রামাণ্য সাক্ষ্য-দলিল আছে। কিন্তু এই লেখার বিষয় সেই ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করা নয়। সেটা আদালতের এখতিয়ার। আমরা শুধু প্রশ্ন তুলতে চাই, বহুল আলোচিত মনজুর হত্যা মামলাকে আরও কত দিন রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হবে? ন্যায়বিচারের আশায় জেনারেল মনজুরের স্বজনদের আরও কত দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে? কারণ, গত ১৩ আগস্ট মনজুর হত্যা মামলার অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে পেশ না করে এ জন্য আরও সময় চেয়েছে। আদালত আবেদন মঞ্জুর করেছেন, অধিকতর তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ‘সর্বশেষ’ তারিখ নির্ধারণ করেছেন আগামী ১২ নভেম্বর।
দুই দিন আগেই সারা দেশে জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা স্মরণ করে জাতি শোক যাপন করেছে। সেই সঙ্গে স্বস্তিও প্রকাশ করা হয়েছে এ জন্য যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের হত্যাকারীদের বিচার অনেক দেরিতে হলেও সম্পন্ন হয়েছে, দণ্ডিত খুনিদের পাঁচজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। দণ্ডিত আরও ছয় খুনিকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ রকম সময়েই খবর বেরোল, মেজর জেনারেল মনজুর হত্যা মামলার বিচারের প্রক্রিয়া আরও এক দফা দীর্ঘায়িত হলো। এই দীর্ঘসূত্রতার ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ ও দুঃখজনক।
মেজর জেনারেল মনজুর খুন হওয়ার পর রাজনৈতিক কারণে তাঁর স্বজনেরা বিচার চাইতে পারেননি। দীর্ঘ ১৪ বছর পেরিয়ে গেলে তাঁর বড় ভাই ব্যারিস্টার আবুল মনসুর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, জেনারেল মনজুরকে ক্যাপ্টেন কাজী এমদাদুল হক নামের এক সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি যখন মামলাটি দায়ের করেন, তখন বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। মামলাটি দায়ের হওয়ার প্রায় তিন মাসের মাথায় ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ মনজুর হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র পেশ করে। তাতে সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদসহ পাঁচ সেনাসদস্যকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এরশাদের নির্দেশে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জেনারেল মনজুরকে হত্যা করে লাশ গোপন করার চেষ্টা করেন।
নব্বইয়ের শেষে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ১৯৯১ সালে নির্বাচিত বিএনপি সরকারের পুরো সময়ই এরশাদ কারাগারে ছিলেন। মনজুর হত্যা মামলার আসামি হিসেবে তাঁকে ১৯৯৫ সালে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলার অন্য দুই আসামি একজন সাবেক ব্রিগেডিয়ার ও একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলাটির ওপর স্থগিতাদেশ দেন। তারপর প্রথম মেয়াদের বিএনপি সরকার যত দিন ক্ষমতায় ছিল, তত দিন আর মামলাটি এগোয়নি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এরশাদ জামিনে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও সমর্থনের বিনিময়ে। তবে সে সময় মামলাটির কিছু অগ্রগতি হয়, বাদীর অনুরোধে এই মামলার জন্য বিশেষ কৌঁসুলি নিয়োগ করা হয়। ২০০১ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তখনো মামলার কিছুটা অগ্রগতি ঘটে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে মহাজোটের প্রধান দল হিসেবে। এরশাদের জাতীয় পার্টি সেই মহাজোটের অন্যতম শরিক। সুতরাং মনজুর হত্যা মামলার অগ্রগতি থেমে যায়। এভাবে চলে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সে বছরের জুলাই মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতি জাতীয় পার্টির সমর্থন চাইছিল আওয়ামী লীগ, কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টি তাতে রাজি হচ্ছিল না। তখন হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল মনজুর হত্যা মামলা। শুনানির তারিখ ঘোষিত হলো ১৮ জুলাই। শেষ মুহূর্তে এরশাদ গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানালেন। তারপর দেখা গেল শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য হলো ২৯ আগস্ট। ওই তারিখে এরশাদ আবারও সময় চেয়ে আবেদন করলে আবারও তাঁর আবেদন মঞ্জুর হয়। এরশাদ সময় পেতেই থাকেন, মামলার অগ্রগতি হয় না।
দেড় বছর ধরে সেই ‘অধিকতর তদন্ত’ আর শেষ হচ্ছে না। দফায় দফায় সময় চাওয়া হচ্ছে আর মামলা পেছাতেই থাকছে। এবার আদালত ‘সর্বশেষ’ তারিখ বেঁধে দিয়েছেন ১২ নভেম্বর। কিন্তু তারপরই যে মামলার রায় ঘোষিত হবে—এমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? কারণ, উভয় সরকারের আমলে মনজুর হত্যা মামলাকে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে। এ মামলার বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে এ পর্যন্ত ২২ বার!
কিন্তু রাজনীতিতে গতি আসে; মহাজোট সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে যেতে থাকে, সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ২০১৪ সালের শুরুতে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা চলে আসে। এরশাদের মনে জেগে ওঠে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ। ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট প্রবল সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করলে এরশাদও সরকারের সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি মন্তব্য করেন, আওয়ামী লীগ ‘সবচেয়ে ধিক্কৃত দল’। ১১ নভেম্বর এরশাদ বাংলাভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তা হলে জনগণ তাঁকে থুতু দেবে। ‘এর চেয়ে জেলেই মরে যাওয়া ভালো’ বলে তিনি মন্তব্য করেন। তখন মনজুর হত্যা মামলা আবার নড়েচড়ে ওঠে: ২০ নভেম্বর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের তারিখ ধার্য হয়। আর ওই তারিখ ঘনিয়ে আসার এক দিন আগেই, ১৮ নভেম্বর এরশাদ সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেন, তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন। এবার তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে না গেলে মানুষ থুতু দেবে। শুধু আমাকে নয়, সব রাজনীতিককেই জনগণ থুতু দেবে।’
তবু ২০ নভেম্বর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়; আদালত ২৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেন। সেদিন রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করে মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করার আবেদন জানালে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়নি মর্মে মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন প্রায় দুই মাস পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি। এসব ঘটতে থাকে নির্বাচনী রাজনীতির ডামাডোলের মধ্যে। ২৬ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলে এরশাদ ও তাঁর জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর এরশাদ হঠাৎ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন; তারপর কী যে হলো, একটা সময় দেশবাসী জানতে পেল এরশাদ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হলো, তখনো এরশাদ সিএমএইচে; তিনিসহ তাঁর দলের ৩৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হয়ে গেলেন। ১১ জানুয়ারি তিনি সিএমএইচ থেকে সংসদে গিয়ে শপথ নিয়ে আবার সেখানে ফিরে গেলেন। পরদিন বঙ্গভবনে গিয়ে মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়ে নিজের বাসভবনে ফিরে যান। ১৪ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান।
এদিকে মনজুর হত্যা মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এসেছিল; ২২ জানুয়ারি আদালত ঘোষণা করলেন মনজুর হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হবে ১০ ফেব্রুয়ারি। পরদিনই এরশাদ একটা বিবৃতি দিলেন: ‘তিক্ত অভিজ্ঞতাকে মুছে ফেলে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারিত তারিখের ১২ দিন আগে ২৯ জানুয়ারি আকস্মিকভাবে মনজুর হত্যা মামলার বিচারক পরিবর্তন করা হয়। ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষিত হলো না, নতুন বিচারক মামলার যুক্তিতর্ক নতুন করে শুনতে চাইলেন, ফলে মামলা আবার পেছাল। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ ‘অধিকতর তদন্তের’ আবেদন জানালে আদালত সেই আবেদন মনজুর করলেন। মামলা আবার পেছাল।
দেড় বছর ধরে সেই ‘অধিকতর তদন্ত’ আর শেষ হচ্ছে না। দফায় দফায় সময় চাওয়া হচ্ছে আর মামলা পেছাতেই থাকছে। এবার আদালত ‘সর্বশেষ’ তারিখ বেঁধে দিয়েছেন ১২ নভেম্বর। কিন্তু তারপরই যে মামলার রায় ঘোষিত হবে, এমন নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? কারণ, উভয় সরকারের আমলে মনজুর হত্যা মামলাকে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে। এ মামলার বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে এ পর্যন্ত ২২ বার!
মেজর জেনারেল মনজুরের চারটি সন্তান আছেন, তাঁর স্ত্রী আছেন, বড় ভাই আছেন, আছেন আরও অনেক স্বজন, বন্ধুবান্ধব, মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা। তাঁরা সবাই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান। তাঁদের বিচার পাওয়ার অধিকার প্রশ্নাতীত এক অধিকার। কিন্তু মনজুর হত্যা মামলাকে রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের প্রতি যে অশ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যে ‘প্রসহন’ ২০ বছর ধরে চলছে, তার অবসান হবে কবে?

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter