Flickr

Friday, 30 July 2010

একটি বিক্ষিপ্ত সংলাপ

কিছু ঘটনা ও একটি বিক্ষিপ্ত সংলাপ
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সামরিক বেসামরিক গোয়েন্দাদের দক্ষতা ও কার্যকারিতা সাম্প্রতিককালে বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে পিলখানায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে ইতিহাসে তার নজির বিরল। এতে বাংলাদেশ সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ রাইফেলস-এর প্রধান ও উপ-প্রধানসহ সেনাবাহিনীর প্রায় পাঁচ ডজন মেধাবী ও চৌকষ কর্মকর্তা মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। এদের অনেকের স্ত্রী সন্তানরাও খুনীদের হত্যা ও পাশবিক লালসা থেকে রেহাই পাননি। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সুপরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞ ও বিদ্রোহের কোনও আভাস আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কেউই দিতে পেরেছেন বলে সরকারীভাবে আমরা জানতে পারিনি। আবার দিলেও হয়তো তা কাজে লাগানো হয়নি। আবার এই হত্যাযজ্ঞের তদন্তের জন্য গঠিত কমিটিগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী তদন্ত কাজে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাদের সহযোগিতাও করেনি। আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি এবং আর্মির তরফ থেকে গঠিত কমিটি উভয়েই বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য আরো সম্প্রসারিত তদন্তের সুপারিশ করেছে। সরকার তা না করে দেশব্যাপী বিডিআর জওয়ানদের বিচার শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে আবার অভিযুক্ত জওয়ানদের মধ্যে ৮০ জন জওয়ান রিমান্ডের নির্যাতনে নির্মমভাবে প্রাণ হারানোর অভিযোগও উঠেছে। এই অভিযোগ অনুযায়ী নিহত ব্যক্তিরা প্রকৃত ঘটনা জানতো এবং তারা জীবিত থাকলে বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের কুশীলবদের অনেকেরই নাম পরিচয় বেরিয়ে আসত, যার ফলে ক্ষমতাসীন অনেক রাঘব বোয়ালই ফেঁসে যাবার আশঙ্কা ছিল। বিচার বহির্ভূত এই মর্মান্তিক হত্যার দায় সরকারকেই বহন করতে হবে বলে দেশবাসী মনে করেন। এখানে যে প্রশ্নটি উঠেছে এবং বার বার আমাদের বিবেককে তাড়া দিচ্ছে তা হচ্ছে আমাদের সামরিক, বেসামরিক ও আধাসামরিক গোয়েন্দারা এই সময় কি করেছেন। বিডিআরকে ধ্বংস করে দেয়া হলো, আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতীক সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়া হলো, গোয়েন্দারা টের পেলেন না এটা কেমন করে হয়? আবার তারা থাকতে ভারতীয় গোয়েন্দারা সার্বক্ষণিক ঘটনার অগ্রগতি অবনতি মনিটরিং করলো কিভাবে? জাতির প্রতি তাদের জবাবদিহিতা কি? সরকার তাদের কৈফিয়তও তলব করলেন না; দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাদের কারোর চাকরি গেল না, জরিমানাও হলো না, এটা কি গ্রহণযোগ্য? মানুষের মনে দিন দিন এ ধরনের প্রশ্নের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা এই একটি ঘটনা (বা দুর্ঘটনা) শুধু আমাদের সরকারের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকেও অনিশ্চিত করে তুলেছে। আমাদের বর্ডার এখন অরক্ষিত। প্রতিবেশী দেশের হার্মাদ বাহিনীর অত্যাচার, হামলা ও লুটপাট ও খুন, রাহাজানিতে সীমান্তবাসীদের জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। কেউ কেউ আবার মনে করছেন যে, সরকার আধিপত্যবাদী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পরিকল্পিতভাবে আর্মি বিডিআরকে অকার্যকর করে রাখছেন; ক্ষমতার স্বার্থে তাদের যতটুকু ব্যবহার করার করছেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন যখন আসছে তখন তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন অথবা জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অকার্যকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আমি জানি না মানুষের এই ধারণা কতটুকু সত্য, তবে এটা বুঝি যে, এর শতভাগও যদি সত্য হয় তাহলে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এই সরকারের কাছে নিরাপদ থাকতে পারে না। নিরাপদ যে নয়, তার লক্ষণও ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে, ইদানিংকালে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাঙা এবং এসব দলের নেতাকর্মীদের নির্মূলের কাজে সরকার গোয়েন্দাদের এত ব্যস্ত রেখেছেন যে, তারা আসল কাজ ভুলে গেছেন।
রাষ্ট্রের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি অপরিহার্য উপাদান প্রয়োজন। অগ্রাধিকার ক্রম অনুযায়ী এর প্রথমটি হচ্ছে আর্মি ও দেশরক্ষা বাহিনী, দ্বিতীয়টি জাতীয় সংহতি, তৃতীয় জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চতুর্থ উপাদান হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর প্রশাসন। এই সরকার আমাদের আর্মি এবং দেশ রক্ষা বাহিনীকে যে অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন তাতে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর মত অবস্থানে তারা আছেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ সংশয় দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাযজ্ঞের পর পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা নিয়ে তারা কাজ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। সীমান্তে বৈদেশিক হামলা প্রতিহত করার অধিকার তাদের নেই। বিদেশীরা আমাদের ভূখন্ড দখল করে সেখানে ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদ করে, ফসল লুট করে, মাছ ধরে নিয়ে যায়, বেসামরিক সীমান্তরক্ষীরা তাদের প্রতিরোধ করে, এলাকা পাহারা দেয়, আমাদের রক্ষীদের প্রতিরোধের হুকুম নেই। বিডিআর প্রধান অকুস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এর জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। এর অর্থ কি? আমাদের আর্মী ও সীমান্ত বাহিনীকে কি অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে? বিদেশী আগ্রাসন প্রতিরোধের ক্ষমতাই যদি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনই বা কি? হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তৈরি, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত প্রভৃতিসহ অন্যান্য ত্রাণ ও পূর্ত কাজে তাদের সহযোগিতা মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে কিন্তু তা তাদের মূল পেশার বিকল্প হতে পারে না। দলীয় রাজনীতির নোংরা ব্যবহার সেনাবাহিনীকে কলংকিত করুক এবং এভাবে তারা ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলুক এটা জাতির কাম্য নয়। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, সরকার তাই করছেন এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। দ্বিতীয়তঃ এই সরকার দেশব্যাপী হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক চেতনাকে উস্কিয়ে দিয়ে যে হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন তাতে খোদা না করুক দেশ ও জাতির উপর যদি কোনও হামলা আসে তা হলে ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা করার সামর্থ্য ও সম্ভাবনা দিন দিন আমরা হারিয়ে ফেলছি। রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের নির্মূল ও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার যে মহোৎসব এখন চলছে আমার দৃষ্টিতে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। এর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ' বিচারের ফরমায়েসী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কসরত। সাধারণ মানুষ এতদিন এ ব্যাপারে নির্বিকার ছিল। এখন অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন বিষয়টি কি। যুদ্ধাপরাধ কি, নিজামী, মুজাহিদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী এরা যুদ্ধাপরাধী হয় কি করে? প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সংখ্যাও কম নয়। তারা আইন পড়েননি। তারা মনে করেন, স্বাধীনতা অর্জন, ভূখন্ডের নিরাপত্তা রক্ষা, বিদেশী হামলা প্রতিরোধ অথবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কিংবা এলাকা দখল কিংবা পুনরুদ্ধারের জন্য দু'টি দেশের মধ্যে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয় তার নাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধে দু'টি সেনাবাহিনী জড়িত থাকে এবং যুদ্ধরত সেনা বাহিনীর কেউ যদি মানবতা বিরোধী কোনও অপরাধ করে, বেসামরিক লোককে হত্যা করে, তাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয় অথবা তাদের বাড়ী ছাড়া করে কিংবা কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে আটকে রাখে, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করে তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধী বলে বিবেচিত হন। বাংলাদেশে যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে তারা যুদ্ধরত কোনও বাহিনীর কখনো কোনও সদস্য ছিলেন না এবং গত ৪০ বছরে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অপপ্রচার ছাড়াও কোনও থানায় সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবেও কোনও মামলা হয়নি। আবার অপরাধী কখনো তার অপরাধী চরিত্রকে ঢেকে রাখতে পারে না। অভিযুক্ত এই নিরপরাধ রাজনীতিকরা যদি প্রকৃত অর্থে অপরাধীই হতেন তাহলে গত চার দশকে অবশ্যই তাদের কাজকর্মে এই অপরাধের অভিব্যক্তি দেখা যেতো। তারা তাদের স্ব স্ব এলাকায় নয় শুধু, সারাদেশে রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক কাজকর্ম করেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, ভোট পেয়েছেন, অনেকে এমপি হয়েছেন, কেউ কেউ মন্ত্রীত্বও করেছেন। তাদের দীর্ঘ ও বিস্তৃত সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী কোনও অপরাধের অভিযোগ উঠেনি, প্রমাণিত হয়নি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, দুর্নীতির অভিযোগও কেউ আনতে পারেনি, কেয়ারটেকার সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তন্ন তন্ন করেও তার সন্ধান পায়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা ৪০ বছর আগের বানোয়াট অপরাধের জন্য তাদের অভিযুক্ত করছে? আমার এক সহকর্মী বন্ধু এককালে ছাত্রলীগের প্রথম সারির লাঠিয়াল ছিলেন। পরে তিনি রক্ষী বাহিনীর মেজর হয়েছিলেন। মেজর সৈয়দ কামালুদ্দিন। তিনি বলতেন আওয়ামী লীগ করলে মাথার বুদ্ধি হাঁটুতে চলে আসে। সম্ভবত যুদ্ধাপরাধের মামলার কারণও তাই। উদ্দেশ্য দু'টি, রাজনৈতিক প্রতিদ্বনিদ্বদের নির্মূল করা এবং ক্রমবিকাশমান ইসলামী আদর্শ এবং ইসলামী রাজনীতিকে নেতৃত্বশূন্য করে এদেশের বুকে ধর্ষক বাজিকরদের ভবিষ্যতকে নিষ্কণ্টক করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সরকার দেশের ধর্মভীরু সকল হক্কানী আলেম ওলামা, মাদরাসা শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, রাজনীতিবিদ সকলকেই জঙ্গী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। কোনও পুরোহিত পাদ্রী তাদের তালিকায় নেই। কারুর কাছে ইসলামী বইপত্র পেলেই বলা হচ্ছে জেহাদী বই পাওয়া গেছে এবং পুলিশ তা তুলে এনে অবমাননা করছে। বৃটিশরা যখন এদেশ শাসন করতো তখন এদেশে বিধর্মী শাসন প্রচলিত ছিল। তাদের আমলেও কুরআন হাদিস এবং আলেম উলামাদের এই এ ধরনের অবমাননা হতো কিনা সন্দেহ রয়েছে। ধর্ম ও আদর্শ মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে বিকশিত করে। ধর্মছাড়া মূল্যবোধ সৃষ্টি ও চরিত্র গঠনের দ্বিতীয় কোনও পন্থা নেই। আর আদর্শ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ছাড়া কোনও জাতি টিকে থাকতে পারে না। আমাদের সরকার ও সরকারি দল ধর্ম, ধর্মীয় মূলবোধ এবং নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। জাতির বিবেক এখানে কন্ঠরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
একইভাবে জন প্রশাসনও আজ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। নিরপেক্ষ মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে। দলীয় আনুগত্য, নিয়োগ পদোন্নতি ও পদায়ন-পোস্টিং এর মুখ্য নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনে জুনিয়রকে সিনিয়র এবং সিনিয়রকে জুনিয়র এবং মেধার স্থান দলীয় আনুগত্য দখল করায় সরকারি দফতরগুলো এখন কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুর পরিবর্তে বিশৃক্মখলা ও চক্রান্তের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জনপ্রশাসন আর পুলিশ প্রশাসনই বলুন দলীয় ক্যাডারদের কথামতোই তাদের উঠবস করতে হয়। তাদের কথা না শুনলে পুলিশ কর্মকর্তা আর প্রশাসনিক কর্মকর্তা কেউই ক্যাডারদের নির্যাতন মারধর থেকে রক্ষা পান না। এর জন্য বিচারও নেই। ফলে উপজেলা থেকে সচিবালয় পর্যন্ত সর্বত্র হতাশা-অনিশ্চয়তার কালো ছায়া গ্রাস করে নিয়েছে। জনপ্রশাসন তার নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। অদক্ষতা ও দুর্নীতি দৈনন্দিন জীবনের অংশে পরিণত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে। ধর্ষণ, খুন, গুম, রাহাজানি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ আইন-শৃক্মখলার সীমাহীন অবনতি মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের নিরাপত্তাকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। মানুষের সামনে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারাণ্টিও নেই। আমি রাষ্ট্রের কার্যকারিতা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য চারটি উপাদানের কথা বলেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত: এই চারটি উপাদানই আজ হুমকির মুখে। এই অবস্থায় দেশের ভবিষ্যত নিয়ে দেশবাসী উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। তাদের এই উদ্বেগ উৎকণ্ঠাকে প্রতিরোধে রূপান্তর করে দেশকে রাহুমুক্ত করার দায়িত্ব বিরোধীদল সরকারিদলের দেশপ্রেমিক অংশের। তারা যাতে তাদের সে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার জন্য দেশব্যাপী হামলা-মামলা, খুন-নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের দলীয় কোন্দলে সংঘটিত একটি হত্যাকান্ডকে অছিলা করে দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে ক্র্যাক ডাউন, বিএনপি উৎখাতের সরকারি পরিকল্পনা, বড়াইগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যা, সিরাজগঞ্জের ট্রেন দুর্ঘটনা ও হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা এবং সর্বশেষ রূপগঞ্জের ঘটনাকে আমি একইসূত্রে গাঁথা বলে মনে করি। রূপগঞ্জের ঘটনায় ভূমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সেনা ক্যাম্পে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, হেলিকপ্টারযোগে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্ধার রাতারাতি ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার অভিব্যক্তি হতে পারে না। একটা কথা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। সেনাবাহিনীর হাউজিং-এর জন্য জমি কিনতে দালালের দরকার হবে কেন? আবার এজন্য ২৪টি পরগনার জমি বিক্রি ও রেজিস্ট্রি বন্ধই বা করে দেয়া হবে কেন? ইতোপূর্বে ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির জন্য জমি সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি আমি পুক্মখানুপুক্মখরূপে তলিয়ে দেখেছি। কোথাও এ ধরনের প্রক্রিয়া আমার নজরে পড়েনি। আরেকটি বিষয়ও এখানে আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে। ডিজিডিএফআই ও অন্যান্য সেনা কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের সাথে এ ব্যাপারে মিটিং করতে গেলেন কেন এবং এই মিটিং-এর পরপরই এলাকাবাসীর ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপান্তরিত হলো কেন? গোয়েন্দারা এর কোনো আভাস দিতে পারলো না কেন? এটা কি পরিকল্পিত? দৈনিক প্রথম আলোর অনুসন্ধানী রিপোর্ট অনুযায়ী রূপগঞ্জে জমির বর্তমান বাজার মূল্য বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৭০ লাখ টাকা অথচ সেনাবাহিনী হাউজিং-এর জন্য এই জমি বিঘাপ্রতি ১৪/১৫ লাখ টাকা দরে বিক্রি করতে একটি মহল জমির মালিকদের বাধ্য করছিল। এই মহলটির পরিচয়ও তারা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জায়েদ আলী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেক নেতা তারেক হচ্ছে এই দালাল চক্রের হোতা। এ তথ্য থেকে রূপগঞ্জ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে পড়ে। তারা যে দালালী করে অর্থবিত্ত উপার্জনের একটি উৎস খুঁজে পেয়েছিলেন এতে সন্দেহ নেই। তবে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর রুদ্ররোষকে সেনাবাহিনী এবং বিএনপির দিকে ঠেলে দিয়ে তারা যে অপরাধ করেছেন তা অমার্জনীয়। ঘটনার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল আলম হানিফ এর জন্য বেগম জিয়াকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছেন। মামলার পর এখন হয়ত বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলসমূহের নেতাকর্মীদের ধর-পাকড় শুরু হবে। তাদের জেলে পুরে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে সরকারি দল নিজের কু-কর্ম ও দুঃশাসন ঢাকা দিতে পারায় স্বস্তির ঢেকুর তুলবেন। এই ঢেকুর যে শেষ পর্যন্ত জীবন বিধ্বংসী বিষমে পরিণত হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? দেশের মানুষ আর বেশি ঘুমিয়ে থাকবেন বলে আমার মনে হয় না।

Friday, 23 July 2010

ভারতীয় ফেন্সিডিলে তলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতীয় ফেন্সিডিলে তলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
ভারতীয় ফেন্সিডিলের প্রধান বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিশাল সীমান্তপথে প্রতিদিন অবৈধ উপায়ে নানাবিধ পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করলেও গত কয়েক দশক ধরে সর্বাধিক আসছে ফেন্সিডিল। ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল আসছে। এমন কোন দিন নেই যেদিন পত্রিকাগুলোর দিকে নজর দিলে ফেন্সিডিলসহ চোরাচালানি আটক হওয়ার সংবাদ চোখে না পড়ে। হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো সচিত্র প্রতিবেদনও পত্রিকাগুলোতে ছাপানো হচ্ছে। র্যা ব-পুলিশের বিশেষ অভিযান এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপতরের বিশেষ সভা আহবানও হচ্ছে। কিন্তু নেশাজাত তরল মাদকের এসব বোতল ভারত থেকে আমাদের দেশে প্রবেশের পরিমাণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ভারতীয় ফেন্সিডিল। এক সময় পুরাতন ঢাকার অলি-গলি ও পাড়া-মহল্লায় এই মাদক দ্রব্যটি প্রকাশ্যে সেবন ও বিক্রি হতে দেখা যেত। প্রতিবাদি ব্যক্তিকে নাজেহাল হতে হতো ফেন্সিডিল সেবণ, বিক্রেতা, মজুতদার, ও গডফাদারদের হাতে। মহিলা ও ছোট শিশুদেরকেও ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ ও জীবন ধ্বংসকারি এই ফেন্সিডিল বিক্রির ক্ষেত্রে। বর্তমানে পাড়া-মহল্লা ও অলি-গলি পেরিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজেও এর ব্যাপক বিস্তার দেখা যাচ্ছে। ফেন্সিডিলের পাশাপাশি মরফিন, প্যাথিডিন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশার উপকরণ ঔষধ বাংলাদেশের সর্বত্র গ্রাস করছে। কাশির জন্য ব্যবহৃত ফেন্সিডিল সিরাপ এক সময় ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত ও বৈধ ছিল। পরে দেশের তরুণ সমাজের কথা বিবেচনা করে ঔষধ নীতিতে নিষিদ্ধ করা হয় ফেন্সিডিল। বাংলাদেশ-ভারতের বিশাল সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেন্সিডিলের কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি ফেন্সিডিলে নেশাজাত উপাদানই মিশানো হচ্ছে বেশী। অধিকাংশ কারখানা বাংলাদেশ ঘেঁষে ভারত সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে।ভারত থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল বাংলাদেশে পাঠানোর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য আছে। একটি হচ্ছে অবৈধ উপায়ে এদেশ থেকে মাদক দ্রব্যটি বিক্রি করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়া। অপরটি হচ্ছে বাংলাদেশের যুব সমাজকে পরিকল্পিতভাবে নেশার জগতে ঠেলে দিয়ে যুবশক্তিকে শেষ করে দেয়া। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফেন্সিডিলের আগ্রাসন পূর্ণোদ্যমে চলছে। দেশে বিডিআর বিদ্রোহ হওয়ার পর বিভিন্ন সীমান্তে বিডিআর বাহিনীর নজরদারি কিছুটা ভাটা পড়ে। এই বিডিআর বিদ্রোহই প্রতিবেশী ভারতের জন্য সীমান্ত পথে বাংলাদেশে লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল পাঠানোর জন্য প্রচুর উদ্যম দিতে থাকে। সম্প্রতি গোটা বাংলাদেশই আজ ভেসে যাচ্ছে ভারতীয় ফেন্সিডিলে। তবে মাদক দ্রব্যের সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালানের বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। ইতোপূর্বে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা ফেন্সিডিল চোরাচালান ও সেবনের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শ্রেণীর কিশোর-তরুণরাও মেতে উঠেছে ফেনসি সেবনে। ‘ফেনসিখোর' হিসেবে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে এদেশের তরুণসমাজ। দীর্ঘদিন পানের কারণে ভগ্নস্বাস্থ্য, লিভার ও হার্টের ক্ষতিসহ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে ফেনসিসেবীরা। নেশার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অনেকে চুরি ও ছিনতাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। ফলে দেশের আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে।
গত ১ বছরে সীমান্ত পাহারাদার বিডিআর প্রায় ৯ লাখ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করেছে। পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ১ বছরে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে ২৩,১২৮টি। মাদক উদ্ধারের পর পুলিশ মামলা নিলেও দুর্বল চার্জশীট এবং ঘটনা চাপিয়ে যাওয়ার কারণে মাদক মামলায় আসামীরা একদিকে জেলে যায়, অন্যদিকে জামিন পেয়ে পুনরায় ফেন্সিডিল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। আবার মহাজোট সরকারের দলের সদস্য হওয়াতে অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে পুলিশ ধরতেও পারছে না। ধরলেই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও হর্তাকর্তার তদ্বির শুরু হয়ে যায়। প্রকৃত মাদক বিক্রেতা ও গডফাদাররা সবসময় থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল মাদক ব্যবসায়ে প্রভাবশালীরা অনেক টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। রাজনীতি, প্রশাসন সবকিছুকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চুটিয়ে ব্যবসা করছে ও প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাচ্ছে। দেশ ও সমাজের অসীম ক্ষতির দিকে অনৈতিক এসব ব্যবসায়ীদের কোন খেয়াল নেই। সীমান্ত থেকে রাজধানীতে হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল প্রবেশে কতগুলো চেকপোস্ট ও প্রশাসনিক এলাকা পড়ছে। ফেন্সিডিল ব্যবসায়ীরা প্রতি পদে টাকা দিয়ে অবৈধ এসব মাদক অনবরত ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে দিচ্ছে। ঘাটে ঘাটে উৎকোচ দেয়ার কারণে যে ফেন্সিডিল সীমান্ত এলাকায় ১ বোতল বিক্রি হয় ১০০/১৫০ টাকায়, তা সীমানা পেরিয়ে রাজধানী কিংবা আশেপাশের এলাকায় বিক্রি হয় ৫০০/৬০০ টাকায়। পরিবহন খরচ ও অসাধু মহলে চাঁদা প্রদানের পরও প্রতি বোতল ফেন্সিডিলে ২০০/২৫০ টাকা লাভ থাকে। মাদক বিক্রেতারা বিক্রি করে বোতল প্রতি কমিশন পায়। কিন্তু এসব ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা গ্রেফতারকৃতদেরকে মোটা অংকের টাকা খরচ করে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের নাম যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে পুলিশকে ম্যানেজ করে রাখে।
দেশের ১২টি সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাদক পাচারের বৃহত্তম রুট কুমিল্লা সীমান্ত এলাকা। কুমিল্লার বিবির বাজার, রসুলপুর, রাজ্যপুর বড় জ্বালা, চৌদ্দগ্রামের উজিরপুর, গোমরা বাড়ি, খোলাপাশা, জগন্নাথ দীঘি, বেতিয়াবা, কাইছুটি, চৌয়াবা, সুয়াগঞ্জ বুড়িচংয়ের সংকুচাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শশীদল, নয়নপুর সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে ফেন্সিডিল। ১৬টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার ৭৪ কিলোমিটার সীমানা ভারতের সাথে জড়িত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন বানের জলের মত ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। জেলার ৮০ কিমি সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে প্রতিদিন। কসবা, আখাউড়া ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ সীমানায় রয়েছে নিরাপদ সড়ক। কসবার মাদলা, কালিকাপুর, আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ, গোসাইরস্থল কর্নেল বাজার, বাউতলা, আবদুল্লাহপুর, আজমপুর সদর উপজেলার সিঙ্গার বিল, মেরাসানী, নলঘড়িয়া, নয়াবাদী সীমান্ত এলাকা ফেন্সিডিল প্রবেশের নিরাপদ রুট।
ফেনী সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন আসছে মাদক। জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, সোনাগাজী সীমানার নদীপথে মাদক আসছে অহরহ। কক্সবাজার রুটের টেকনাফ, উখিয়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে। জয়পুরহাট রুটের হিলি সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে। ঝিনাইদহ রুটের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেষপুর এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে।
দিনাজপুর, নওগাঁ, যশোর ও রাজশাহী দিয়ে প্রতিদিন বস্তা ভর্তি ফেন্সিডিল আসছে। মাদক ব্যবসার সাথে দিন দিন নারীরা জড়িত হচ্ছে। যারা এক সময় বাসা বাড়িতে কিংবা গার্মেন্টসে কাজ করত তাদের অনেকে মাদক বহরের সাথে জড়িত হচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকরাও সীমান্ত থেকে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে দিচ্ছে ফেন্সিডিল। মাদক পাচার করে পরিবহনগুলো প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাসই মাদক-পাচারের নিরাপদ পরিবহন।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠা ফেন্সিডিল কারখানাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে বিডিআরের পক্ষ থেকে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়া হয় গত মার্চে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে এই তালিকা বিএসএফ-এর হাতে তুলে দিয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। বিডিআরের মহাপরিচালক বলেন যে, বিএসএফের কাছে যেসব কারখানার তালিকা দেয়া আছে সেসব কারখানা বন্ধ হলে ফেন্সিডিল পাচার অনেক কমে যাবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মিডিয়া কর্মীরা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অফিসে যোগাযোগ করলে হাইকমিশনের কর্তাব্যক্তিরা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় নিষিদ্ধ ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের একটি যৌথ ইশতেহারে সই করেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মাদক পাচার নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারকেও সই করে। অথচ বাস্তবতার সাথে এসব সই এর কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সই শুধু সই এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
ফেন্সিডিলের বন্যায় দেশ তলিয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যুব সমাজ। এখনই এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায থেকে মাঠপর্যায়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করা না হলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। অনতিবিলম্বে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের সাথে ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অসংখ্য ফেন্সিডিলের কারখানাগুলো। এজন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকার-টু-সরকার আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের তরুণ সমাজকে ফেন্সিডিলের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। ফেন্সিডিলসহ যে কোন মাদক পাচার প্রতিরোধে সুষ্ঠু ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
-মোঃ আব্দুল আলিম

Wednesday, 21 July 2010

সরকারের চাল-কেরামতি

কিছুদিন ধরে চালের দাম লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। গত ১২ দিনে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকা। সরু চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। খুচরা বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৩/৩৫ টাকা দরে। চাল কিনতে গিয়ে মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে। অথচ বাংলাদেশের স্বাভাবিক নিয়মে এ সময় চালের দাম কিছুটা হলেও কমে যাওয়ার কথা। কারণ, মাত্র কিছুদিন আগে বোরো ধান বাজারে এসেছে। তাছাড়া সরকার ঘোষণা দিয়েছিল এবার বোরোর নাকি ‘বাম্পার ফলন' হয়েছে! অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে নতুন চাল আসছে না বলে চালের দাম আরো বাড়তে পারে। এদিকে দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বেসরকারি হিসাবে দেশে প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা যেখানে ৫০ হাজার টন সেখানে সরকারের কাছে বর্তমানে মজুদ রয়েছে মাত্র পাঁচ লাখ টনের মতো। এই পরিমাণ চাল দিয়ে ১০ দিনের চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব নয়। ‘বাম্পার ফলন' হয়েছে বলে সরকার যে প্রচারণা চালিয়েছে তথ্যাভিজ্ঞরা তাকেও ‘চালবাজি' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তথ্য-পরিসংখ্যান দেখিয়ে তারা বলেছেন, বাস্তবে আউশ, আমন ও বোরোর মধ্যে কোনো একটিরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হয়নি। উৎপাদন বরং অনেক কম হয়েছে।
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, সরকার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত কোনো খবরই কাউকে জানতে দিচ্ছে না। টিসিবি পর্যন্ত একেবারে নীরব হয়ে গেছে। কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন শুধু খাদ্যমন্ত্রী। এতদিন ধরে মুখে লম্বা কথা শুনিয়ে আসার পর প্রচন্ড খাদ্য সংকটের মুখোমুখি এসে খাদ্যমন্ত্রী অতি সম্প্রতি আংশিকভাবে সত্য স্বীকার করেছেন। তিনি তাই বলে নিজেদের ব্যর্থতার কথা বলেননি, সব দোষ চাপিয়েছেন মিল মালিকদের ওপর। বলেছেন, মিল মালিকরা চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেনি বলেই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সেই সাথে মিল মালিকদের কষে একখানা ধমকও দিয়েছেন। গত রোববার তিনি বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ না করলে মিল মালিকদের সনদ বাতিল করা হবে। অন্যদিকে ধমকের চমৎকার জবাব দিয়েছেন মালিকরা। মিল মালিকদের সংগঠনের নেতা বলেছেন, দেশে প্রায় ১৭ হাজার মিল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার মিল সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। মন্ত্রী যদি এতজনের সনদ বাতিল করেন তাহলে সরকার চাল পাবে কোথায়? ওই নেতা প্রসঙ্গক্রমে জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে সরকারের কাছে ২ লাখ ৬০ হাজার টন চাল সরবরাহ করেছেন। তারা আরো বলেছেন, বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে আগের দামে সরকারকে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সরকার যদি ধান কিনে দেয় তাহলে তারা চাল করে দেবেন।
এভাবেই খাদ্য পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতির চাপে খাদ্যমন্ত্রী বিদেশ থেকে চাল আমদানির ঘোষণা দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু এরও তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারে একদিকে খাদ্যের দাম বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে বিশেষ করে ভারত নিজেই রয়েছে তীব্র খাদ্য সংকটে। দেশটিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ৭০ লাখ টন গম কিনতে হয়েছে। তাছাড়া আমদানির বিষয়টি এমন সহজ নয় যে, খাদ্যমন্ত্রী চাইলেই দু'চার দিনের মধ্যে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য হুড়মুড় করে বাংলাদেশের বাজারে ঢুকে পড়বে। এজন্য কম করে হলেও তিন থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় দরকার। ততোদিনে মানুষের জিহবা বেরিয়ে পড়বে। ১৯৭৪ সালের মতো দুর্ভিক্ষে মারা যাবে হাজার হাজার মানুষ।
আমরা মনে করি, সমগ্র বিষয়টিকে বাস্তবতার আলোকে পর্যালোচনা করা দরকার। এতে দেখা যাবে, সবকিছুর মূলে রয়েছে সরকারের ত্রুটি ও ব্যর্থতা; যাকে সরকারের ‘চাল-কেরামতি' হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সরকার এ বছর ধান-চালসহ বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১২ লাখ টন। কিন্তু কিনতে পেরেছে মাত্র ৪ লাখ টনের মতো। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার মওসুমের একেবারে শেষদিকে এসে সংগ্রহমূল্য প্রতি কেজিতে তিন টাকা বাড়িয়েছিল। কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি। সরকার দাম বাড়ানোর ফলে উল্টো বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। ঠিক তখনই মিল মালিকরা সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছেন। খাদ্যমন্ত্রী মিল মালিকদের ওপর দোষ চাপালেও তার সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, গোড়ায় গলদটুকু সরকারই করেছিল। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত নিয়ম যেখানে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে নেয়া, আওয়ামী লীগ সরকার সেখানে এবার হঠাৎ করে মিল মালিকদের হাতে ধান সংগ্রহের দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছিল। সরকারের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল দলীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ হাসিল করে দেয়া। এই সুযোগে দালাল ও ফড়িয়াদের মাধ্যমে মিল মালিকরা কৃষকদের যথেচ্ছভাবে হয়রানি ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার বানিয়েছেন। সরকার যদি মিল মালিকদের কাছ থেকে কেনার পরিবর্তে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কিনতো তাহলে একদিকে কৃষকরা লাভবান হতে পারতো, অন্যদিকে সরকারকেও এভাবে বেকায়দায় পড়তে হতো না। কিন্তু দলীয় ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি করতে গিয়ে সরকার কৃষকদের প্রতি চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে। তাদের কাছ থেকে ধান কেনেনি। অন্যদিকে যাদের স্বার্থে পদক্ষেপ নেয়া সেই মিল মালিকরা শুধু বিপদেই ফেলেননি, সরকারের দুরবস্থারও সুযোগ নিয়েছেন।
ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিত অযথা বিবাদে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া এবং সমঝোতার মাধ্যমে নতুন করে মূল্য নির্ধারণ করা। এই মূল্য অবশ্যই বিদেশ থেকে আমদানির চাইতে অনেক কম হবে। তাছাড়া সময়ও বেঁচে যাবে। সরকারকে একই সঙ্গে অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে ভারতে চালের চোরাচালান প্রতিহত করতে হবে। কারণ খাদ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন ভারতে চালের দাম বাড়ায় চোরাচালানও বহুগুণে বেড়ে চলেছে। সুতরাং চোরাচালান প্রতিহত করতেই হবে। আমাদের বিশ্বাস, চোরাচালান প্রতিহত করার পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ী ও চোরাচালানীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলে এবং মিল মালিকদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা গেলে চালের বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। সংকট কেটে যাবে, চালের দামও আর বাড়বে না। সরকারকে একই সঙ্গে কৃষকের কাছ থেকে কিছুটা বেশি দাম দিয়ে হলেও ধান কেনার পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, সরকার দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠবে এবং চালের দাম কমিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে।

Tuesday, 20 July 2010

লিখতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে কলম

লিখতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে কলম। জট পাকিয়ে যাচ্ছে ভাবনা-চিন্তায়। লিখেই যখন জীবন ধারণ করি তখন না লিখতে পারার বেদনা মনকে পীড়িত করে বৈ কি। এই পীড়ন মস্তিষ্কেও ঘর বাঁধে। তখন দেখাতেও হেরফের ঘটে যায়। ঝাপসা হয়ে আসে নজর। অতি দেখার প্রবণতাও উঠে আসে মাঝে মধ্যে। চারপাশে যে ধরনের আলামত প্রত্যক্ষ করছি তাতে করে সঞ্চারিত হচ্ছে ভীতি, দেহ ও মনে। সত্য বলতে গেলেও ভয়, লিখতে গেলেও ভয়। যেমন স্বাধীনতার শুরুর কয়েকটা বছর দিনাতিপাত করেছিল দেশবাসী। একটা অস্বস্তি আর ভীতিকর সময় ছিল তখন। সময় নাকি চলে যায়, সময় কিন্তু আবার ফিরেও আসে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। স্বস্তিহীনতার সাথে সাথে সম্ভ্রমহীন সময়ের ভিতর যেন একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছি। হায়া-শরম-বিবেক কিছুরই অবশিষ্ট থাকছে না আর। নিরীহ মানুষজনদের জন্য এটা দুঃসময় না সুসময় ভবিষ্যতই নির্ণয় করবে বিষয়টি। কি লিখবো আর কি লিখবো না, দ্বনদ্বটা সেখানে নয়। মোটকথা লিখতেই মন চাইছে না। চারপাশে লেখার অন্তহীন বিষয়। অতি ভোজন যেমন পেটের জন্য ক্ষতিকর, ঠিক তেমনি অতি বিষয় যতিহীনতার লক্ষণ। এই তো সেদিন নিমতলীতে কত উচ্ছবল সংসার পুড়ে ছাই হলো, অবসান ঘটলো একশত ঊনিশটি জীবনের। মরণযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আরো কতজন। এখন আমাদের বোধ জাগ্রত হয়েছে। রাসায়নিক পদার্থের গুদাম আবাসিক এলাকায় থাকবে কি থাকবে না সেই সিদ্ধান্তের অাঁচল ধরে এতকাল পর টানাহেঁচড়া। সীলগালা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে কর্তাব্যক্তিরা। কোনো প্রকার সময় না দিয়ে হুটহাট সব সীলগালা মেরে দিলেতো মুশকিল। রাসায়নিক সরঞ্জামের অভাবে যে অন্য রকম বিপদও আসতে পারে সেই বোধটাওতো থাকা দরকার। পুরান ঢাকা ঘিঞ্জি এলাকা, জরাজীর্ণ দালান-কোঠা, এই বুঝি পড় পড়। হতশ্রী রাস্তা-ঘাট। কর্তাব্যক্তিদের আলাপ-সালাপ শুনে মনে হচ্ছে এসব এই মাত্র তাদের নজরে এলো। কোনো রকম অঘটন ঘটলেই ঘুম থেকে জাগেন কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রী-আমাত্যরা। তাই জীবনানন্দ দাসের মতো বলতে হয় ‘এতদিন কোথায় ছিলেন নাটোরের বনলতা সেন!'
বেগুনবাড়িতে দালান ভেঙে প্রাণ হারালো পঁচিশ-ছাবিবশজন। এই পড়ে যাবার প্রক্রিয়াটিতো আর একদিনে শুরু হয়নি, বেশ ক'দিন যাবতই হেলাহেলির ব্যাপারটি ঘটছিল হয়তো। কিন্তু নজর দেয়ার ফুরসত কারো ছিল না। এলাকার বাসিন্দাদের, না কর্তৃপক্ষের। যা হবার তাই হলো। আকাশ ভেঙে বাজ পড়ার মতো দালান ভেঙে মাথায় পড়লো।
আচমকা ‘আমার দেশ' পত্রিকা বন্ধের সরকারি ঘোষণা, সম্পাদককে গারদেপুরা, রিমান্ডের নামে শারীরিক নির্যাতন দেশবাসীর মাথায় আকাশ ভেঙে বাজ পড়ার মতোই আর একটি খবর উঠে এলো প্রায় সমসময়ে। এই অন্যায় এবং অশোভন খবরটি দেশের যেকোনো বিবেকসম্পন্ন নাগরিককে বিচলিত করা স্বাভাবিক। মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিরই অংশ। কিন্তু ‘আমার দেশ' সংক্রান্ত ব্যাপারটিতে বর্তমান সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি এমন মত দেশের বিজ্ঞজনরা ব্যক্ত করেছেন। এটি যে সরকারের হিংসাত্মক আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ সে মতও তারা উচ্চারণ করেছেন লেখায়, কথায়। ভিন্নমত থাকতেই পারে। তাই ভিন্নমতিদের টুটি চেপে ধরাটা কোনো সভ্য চিন্তার কর্ম নয়। কিন্তু সেই কর্মটিই করা হচ্ছে হর-হামেশা, অভব্যভাবে।
একেবারেই ঠুনকো অজুহাতে চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার বন্ধ করে দিলো সরকার। যমুনা টিভি'র চোখেও পট্টি বাঁধা হলো। বলা হলো খামোশ! ভিন্নমতে এতটা অসহিষ্ণু হলেতো মুশকিল। একদিকে ঘোষণা হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রবাহের পক্ষে, অন্যদিকে বন্ধ করা হচ্ছে বিপক্ষ মতের পত্রিকা-চ্যানেল। এই যে আচরণের বৈপরিত্য তা একটি সুসরকারের জন্য স্থিতিপ্রদতো নয়ই, দেশ ও জনগণের জন্যও স্বস্তিপ্রদ নয়। সাবেক আমলে অর্থাৎ মইন-ফখরুদ্দীনের অবৈধ সময়ে এমনি করে সিএসবি নামের টিভি স্টেশনটি বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। সেই ধারাবাহিকতাই যেন এখন প্রবাহমান দেশে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে আমাদের উত্তরণটা ঘটলো কোথায়! মুখে গণতন্ত্র আর আচরণে স্বৈরতন্ত্র কেবল শাসক কেন, দেশের জন্যও বয়ে আনে অমঙ্গল। চারপাশে যখন এমন দৃশ্য অবলোকন করি তখন বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। থেমে থাকে কলম। লেখার ইচ্ছাতেই কিসের যেন কামড় অনুভূত হয়, বেদনা অনুভব করি। তাই লেখার বিষয় বিবেচনায় বিভ্রাটে পড়তে হয়।
দেশের বিদ্যাপীঠগুলোতে যখন দেখি জ্ঞানসন্ধানীদের বিপরীতে ‘বন্যবরাহের' বিচরণ অবাধ, তখন কষ্টের অন্ত থাকে না। যে হাতে থাকবে বই, খাতা আর কলম সে হাত শোভিত এখন নানা নামের অস্ত্রে। একজন আর একজনের ছিঁড়ে নিচ্ছে কলিজা-হাড়-মাংস। সবই হচ্ছে রাজনীতির নামে। যখন খবর আসে এসব অনাচারের সাথে কতিপয় শিক্ষকেরও সায় আছে, তখন আর কলম ধরতে ইচ্ছে হয় না, রাগে-ঘৃণায়। ভয়তো আছেই। রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নাকি এমন ‘বরাহনৃত্য' দেশের সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রচার-প্রপাগান্ডা এমনটাই। এমন প্রচার দীর্ঘ সময় থেকেই। কথায় আছে ‘যা রটে কিছু না কিছু বটে।' এসবের বিপক্ষে প্রবল কোন প্রতিরোধ নেই। প্রতিবাদের কণ্ঠও ক্ষীণ। এমন চললে তো শিক্ষার ঘরেও আগুন জ্বলতে থাকবে। যে জন্য গত চল্লিশবছরও তেমন কোন অর্জন লক্ষ্যযোগ্য নয় এই এলাকায়। খুন-খারাবি আর অসভ্যতা ছাড়া। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা বন্ধ হচ্ছে শিক্ষালয় হুটহাট। কৃষকের সন্তানকে আবার কৃষিতে ফিরিয়ে দেবার প্রক্রিয়া কিনা এটি কে জানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে কলকাতার বাবুরা বলেছিলেন, বাংলাদেশে তো এগ্রিকালচারই আছে সেখানে আবার কালচারের কী প্রয়োজন। কলেজ-ভার্সিটির সাম্প্রতিক আলামত দেখে মনে হচ্ছে কারা যেন এগ্রিকালচারের পাঠ শিখাচ্ছে আমাদের। লিখতে গেলে তো বিষয় হিসেবে এসবই চলে আসে। তাই লেখালেখিতে মন সায় দেয় না। সত্য ভাষণে দুশমন বাড়ে। যে বিডিআর-এর নাম শুনলেই শত্রুর হৃদকম্পন শুরু হয়ে যেত সেই বিডিআর-এর শিরদাড়া ভেঙ্গে দেয়া হলো আচমকা। নিধন করা হলো সেনাবাহিনীর চৌকস সব সেনাঅফিসার। বিডিআর ‘বিদ্রোহ'-এর নেপথ্যনায়ক কারা এ তথ্য চাপাই পড়ে থাকলো। বিচারের নামে প্রহসনের প্রহেলিকা চলল। এখন আবার হঠাৎ তাও বন্ধ। সেনাসদস্যদের মনে যদি শাস্তি আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া যায় তখন তো এরা সীমান্ত রক্ষার পরিবর্তে নিজেকে রক্ষায়ই বেশি ব্যস্ত থাকবে। বিডিআর-এর অভ্যন্তরে এমনি একটা অজানা আতঙ্কের প্রাসাদ তৈরি করে ফেলেছে আমাদের যারা চিরদুশমন, তারা। বিভীষণদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং সহযোগিতাই এমন কান্ড ঘটার ইতিহাস অনেক। বিডিআর সেনা নিধনের প্রক্রিয়াটি এ দেশীয় বিভীষণদেরই কূটচালের কর্ম! বিভীষণদের আখের মঙ্গলজনক নয়। মীরজাফরদের অন্তিম সময়গুলোর কাহিনী কি অজানা কারো। সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশীদের ওপর ‘চানমারি' করে প্রায় প্রতিদিন, লাশ হয় জনাকয়েক বাংলাদেশী। বিপরীতে আমাদের কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। প্রতিবাদ করলেও কণ্ঠ এতটাই ক্ষীণ যে, সে আওয়াজ বাতাসেই মিলিয়ে যায়। বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে ঠেকেছে ‘ভাসুরের নাম মুখে আনতেই যেন বারণ।' অন্যদিকে বন্ধুত্বের উষ্ণতায় শার্ট-প্যান্ট-গেঞ্জি সবই অর্পণ করছি বন্ধুর করকমলে। কেবল আন্ডারওয়ারটা দিতে পারছি না লজ্জায়-শরমে। একদিন হয়তো তাও অর্পণে দ্বিধা করব না। চারপাশে যা আলামত এসে জমা হচ্ছে, তাতে তো এর বাইরের কিছু ভাবা যাচ্ছে না। তাই মনঃপীড়ায়, হতাশায় আর অপমানে লেখালেখির পাঠ চুকিয়ে ফেলার কথাই ভাবছি। বলতে গেলে তো বিষয় হিসেবে এদের নিয়েই টানাটানি করতে হবে। যেখানে মানিলোকের মান রাখতে আমরা ব্যর্থ, মিথ্যা এবং অসত্য মামলায় জড়িয়ে দৈনিক ‘আমার দেশ' সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডের নামে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এমন অন্যায়ের বিপক্ষে শক্ত কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ওঠে না, তাও ভয়ে আতঙ্কে তখন লেখার ইচ্ছাটাই উবে যায়। নীমতলীতে আগুন লাগে, বেগুনবাড়ীতে দালান ভেঙে মাথায় পড়ে- এসব কিসের আলামত তা দেশবাসী উপলব্ধি করতে পারে না। এই না পারার কারণেই সবার কপালেই এমন আগুন। অন্যায়-অবিচারের দালান ভেঙে পড়ছে মাথায়। লিখতে গেলে তো আগুনের কথায় আসতে হবে, দালান ভাঙার খবর দিতে হবে। লিখলে কি অন্যায়ের আগুন থামবে? না, হেলেপড়া অবিচারের দালানটি সোজা করা যাবে। যদি তা করা সম্ভব না হয় তবে লেখে কী লাভ!

Friday, 16 July 2010

নিপীড়নে সরকারি পাশবিকতা : মানবাধিকার ও বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি নৈবেদ্য?

নিপীড়নে সরকারি পাশবিকতা : মানবাধিকার ও বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি নৈবেদ্য?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিপীড়ন এখন সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। ক্ষমতা মদমত্তরা কোনো কথা চিন্তা না করে এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিদেশি প্রভুদের ইঙ্গিতে যাচ্ছেতাই জুলুম-অত্যাচারের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। লক্ষ্য : নিজেদের রাজনীতি বাদে সকল রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা। গণতন্ত্রের কবর রচনাকারী বাকশালী পদ্ধতি তারা পুনঃপ্রবর্তনে রত রয়েছেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ' শ্লোগান সর্বস্ব স্বৈরাচারী ‘বাকশাল' পদ্ধতি যেরূপ জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রহিতকরণসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ব্যবস্থা করেছিল- অধুনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘এক নেতা এক দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ' নামক জংলী একদলীয় শাসনের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে। সচিবালয়ের ‘দেশপ্রেমিক দক্ষ ঈমানদার' সচিব, যুগ্ম-সচিব, উপ-সচিবদের ওএসডি কিংবা অবসর প্রদানের মাধ্যমে ফোর্থ গ্রেডেড আওয়ামী কর্মকর্তাদের শূন্যস্থান পূরণের দ্বারা ‘হবু চন্দ্র রাজা, গবু চন্দ্র...' মার্কা প্রশাসনের বিরামহীন অসাধুতা ও লুটপাটে জাতি আজ অতিষ্ঠ। দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের তোড়ে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে থানা-পুলিশ-প্রশাসন-শিক্ষা বিভাগ সর্বত্রই লুণ্ঠনের মচ্ছব চলছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের কথা চিন্তা না করে আগ্রাসী ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকে দেশীয় ভূখন্ড ব্যবহারের ও চট্টগ্রাম-খুলনা সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের একতরফা সম্মতি দেয়া হয়েছে। দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রসমূহ বাস্তবায়নের একমাত্র প্রতিবন্ধক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিসমূহ। তাই ২৭ জুনের সফল হরতালের পর এরা হামলে পড়েছে বিএনপি ও জামায়াতের ওপর। লক্ষ্য- দেশপ্রেমিক প্রতিবাদী শক্তিসমূহকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা। ক্ষমতাসীনরা বোঝে যে, মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা পেলে এরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো সবখান থেকেই ছিটকে পড়বেন। তাই তারা গণতান্ত্রিক ছদ্মাবরণে চূড়ান্ত স্বৈরাচারের ভূমিকায় নেমেছে। নিজেদের অপকর্মের কোন সমালোচনাই তারা সহ্য করছে না। অধিকাংশ প্রিন্টেড ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাদের গুণগানে(?) রত থাকলেও গুটিকয়েক বিরোধী পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়া আসুরিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে তারা বন্ধ করে দিচ্ছে। তার মর্মান্তিক শিকার হলো চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের সমর্থক হওয়ায় সরকারের তীব্র রোষানলে বন্ধ করা হয়েছে জনমনে গ্রথিত দৈনিক আমার দেশ। সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে তড়িৎ গতিতে। সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দেশ-বিদেশের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক চৌকষ ব্যক্তিত্ব। তিনি জোট সরকারের আমলে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় জ্বালানি উপদেষ্টা ও বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র একটি সরকার বিরোধী দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিধায় তাকে একটির পর একটি মামলায় জড়িয়ে ১২ দিনের অমানবিক রিমান্ডের আওতায় এনে তার ওপর পাশবিকভাবে শারীরিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে। মনে হয় : মানবাধিকার কিংবা শিষ্টাচার শব্দটি ক্ষমতাসীনরা কস্মিনকালেও শোনেনি। চক্ষুলজ্জাও তাদের নেই! রিমান্ডের নামে এই স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্বকে উলঙ্গ করে নির্মম নির্যাতন করে বেহুঁশ করা হয়েছে। এই হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী গণতন্ত্রের নমুনা! আওয়ামী নেতৃত্ব এখন হরতাল শব্দটির ব্যাপারে ভীষণই প্রতিবাদমুখর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম ও আওয়ামী যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফসহ ক্ষমতাসীনদের কর্তা ব্যক্তিরা হরতালের বিরুদ্ধে নসিহত করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। অথচ এই আওয়ামী লীগের আহবানে দেশে ৫৭৩ দিনের হরতাল পালিত হয়েছে- ইতিহাস তার সাক্ষী। কথিত আছে : তাদের ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে হরতাল সফল করতে দোতলা যাত্রীবাহী বাসে গান পাউডারের সহায়তায় আগুন ধরিয়ে দেশব্যাপী আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে মামলা দায়ের হয়েছিল। হরতাল যদি প্রতিবাদের প্রতিবাদের ভাষা হয়-- তবে পিকেটিং করাটাও গণতান্ত্রিক অধিকার। গত ২৭ জুনের সকালে পিকেটিংরত বিএনপি'র ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সামনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ কমান্ড যেভাবে বর্বরোচিতভাবে পিটিয়ে আহত করেছে, তা মর্মান্তিক। মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যতই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ-যুবলীগের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করলেও পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে যৌথ গেস্টাপো বাহিনীর রুদ্র আচরণের কোন তদন্তের ব্যবস্থাই তিনি করেননি। হরতালের কয়েকদিন পূর্বে যুবলীগের সভায় ‘হরতাল করবে যারা, লাশ হয়ে ফিরবে তারা' শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় মিছিল প্রদক্ষিণ করেছে। অথচ-সরকার কিছুই জানে না, কিম্বা তাদের দায়দায়িত্ব আমরা নেব না' সর্বস্ব মন্তব্য জাতি সর্বৈবভাবে মিথ্যাচার হিসেবেই জানে ও বোঝে। ‘রিমান্ড' শব্দটি এখন জনমনে ছড়িয়ে পড়া একটি আতঙ্কের নাম। গত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে ক্ষমতালি≈y মইন-উ-আহমেদের টিএফআই সেলে যে নির্মম নির্যাতন রাজনীতিবিদদের উপর চালানো হচ্ছিল-- একই কায়দায় এই সরকার রিমান্ড নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের অপকর্মের সাড়ে পাঁচ হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নির্লজ্জের মত বিরোধীদের শতশত মামলায় জড়ানো হচ্ছে। দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রত্যাহৃত মামলায় হাজার হাজার খুনী-সন্ত্রাসী জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে-- আতঙ্কের জনপদে রূপ নিয়েছে বাংলাদেশ। বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ ও বরেণ্য রাজনীতিবিদদের মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডের উৎসব (?) চালানো হচ্ছে। মাননীয় হাইকোর্টের ১৯৯৩ সালের নির্দেশনা ও ২০০৩ সালের বিচারপতি হামিদুর রহমানের রায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। দেশীয় বরেণ্য রাজনীতিবিদদের উপর সরকারি পাশবিক নির্মমতার বিরুদ্ধে আইন আদালত নীরব! অথচ এই আইন আদালতই জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল! সন্ত্রাস ও যুদ্ধপীড়িত পাকিস্তানের উচ্চ আদালত যেরূপ স্বৈরাচারী পারভেজ মোশাররফ ও পরবর্তী ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল-- সেরূপ সাহসী ও বুক চিতানো পদক্ষেপের অভাবে দেশের বিচার ব্যবস্থায় জনমনে প্রকট আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। ‘রিমান্ড' মানেই আইনী সহায়তায় সরকার বিরোধীদের গেস্টাপো কায়দায় গরু পেটানোর এক মহড়ায় পরিণত হয়েছে। ডিবি অফিসে সুস্থ লোক হেঁটে যায়-- বেরোয় স্ট্রেচারে কিম্বা মুমূর্ষু অবস্থায়। উচ্চতর আদালত স্যুয়োমটো কিম্বা অন্য কোনোভাবে জানতে চাইলো না আসামীর পরিণতির কথা। ফলে সরকারি বর্বরতা বেড়েই যাচ্ছে দাবানলের মত। ধর্মীয় অবমাননার মিথ্যা মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো: মুজাহিদ ও বিশ্ববরেণ্য মুফাচ্ছিরে কোরআন ও নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে বিভিন্ন হাস্যকর মামলায় ১৬ দিন করে রিমান্ড আদেশ দিয়েছে মুখ্য মহানগর আদালত। এসব বরেণ্য ব্যক্তির জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত-- কিন্তু পুলিশ ও সরকারি পিপি ও অ্যাটর্নীদের আবেদনের তাৎক্ষণিক রায় পেয়ে যাচ্ছে সরকার পক্ষ! ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার সহমর্মীতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। প্রতিহিংসা প্রতিহিংসারই জন্ম দেয়। মনে রাখা দরকার-- এ সরকারই শেষ সরকার নয়। যুগযুগান্তরের ফেলে রাখা বিদ্বেষ দেশ গড়ার কোন উপকারেই আসবে না।
পাদটীকা : ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মামলায় জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ ও যুদ্ধাপরাধ মামলা দেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হলো: মূল ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধপরাধীদের দেশে এনে বিচার না করে শুধুমাত্র জামায়াত নেতাদের বিচার কি রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত নাকি বন্ধু রাষ্ট্রের চরণতলে নৈবেদ্য হেতু এ আয়োজন-- তা কিন্তু ভেবে দেখার সময় এসেছে। ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে এজাহারভুক্ত আসামীদের বিচার শেষে মাত্র ৭৫৩ জনের সাজা হয়েছিল। প্রায় ৪০ বছর পর পুনরায় তদন্ত করে বিচার-জনমনে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। -আবুল কাশেম মজুমদার

Wednesday, 14 July 2010

মন্ত্রীদের বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকান্ড

গত ১০ জুলাই বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ছাত্রলীগকে লক্ষ্য করে বলেন, তারা যেন নিজেদের মধ্যে মারামারি না করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর চড়াও হয়। আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম আয়োজিত ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের অতি দ্রুত বিচার ও জাতীয় উন্নয়ন বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ’’ শীর্ষক এক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ নির্দেশ দেন। সংবাদটি নয়াদিগন্ত, প্রথম আলো, মানবজমিনসহ প্রায় সবক'টি জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই মন্ত্রীর নির্দেশের কিয়দংশও এ পর্যন্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগরা বাকী রাখে নাই। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হতে এ পর্যন্ত আঠারটি মাসে তারা ন্যূনতম এমন কোন অপকর্ম বাদ রাখেনি যা তাদেরকে নতুন করে কাউকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। সরকার বিরোধী দল নির্যাতনের যে এজেন্ডা নিয়ে এগুচ্ছিল ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইতোমধ্যে প্রায় অনেকাংশই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। এমন কোন দিন হয়তবা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে কোন না কোন পত্রিকা বা চ্যানেলে তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত না হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এর সব ক'টি তাদের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি সংবলিত খবর। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো-
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে প্রহার, ছাত্রলীগ নেতা কারাগারে (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারী)।
ফিরে দেখা ২০০৯ : চট্টগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের আধিপত্যের লড়াই (যুগান্তর, ৬ জানুয়ারী)।
রাজশাহী পলিটেকনিক বন্ধ, ছাত্রলীগের সাতজন বহিষ্কার, ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রমৈত্রীর নেতা খুন (প্রথম আলো ৮ জানুয়ারী)।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় এবার সাংবাদিক আহত (প্রথম আলো ১২ জানুয়ারী)।
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র আটকিয়ে টাকা আদায় ছাত্রলীগ নেতাদের (প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারী)।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সভাপতির হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত, কক্ষ ভাংচুর, ভর্তির কাজ বন্ধ (নয়া দিগন্ত ৩১ জানুয়ারী)।
অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে/ঢাকা কলেজের সম্মানে ভর্তি কাজ বন্ধ, ইডেনে অনিয়ম (প্রথম আলো ১ফেব্রুয়ারী)।
ছাত্রলীগের ভর্তি সন্ত্রাস কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি বন্ধ (সমকাল, ২ ফেব্রুয়ারী)।
মধ্যরাতে ঢাবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলি, আহত ৩৫ (সমকাল, ৩ ফেব্রুয়ারী)।
চাঁদাবাজি-অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা থেমে নেই (প্রথম আলো ৪ ফেব্রুয়ারী)।
ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা (নয়াদিগন্ত, ৫ ফেব্রুয়ারী)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগের সমঝোতা (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারী)।
পাবনা প্রেসক্লাবে ছাত্রলীগের হামলা ও ভাংচুর (যুগান্তর, ১৫ ফেব্রুয়ারীা)।
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ আহত ১০ (প্রথম আলো ১৬ ফেব্রুয়ারী)।
ভান্ডারিয়ায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ১ (নয়া দিগন্ত, ২০ ফেব্রুয়ারী)।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়/ছাত্রলীগের দুই পক্ষে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত ১০ (প্রথম আলো, ১মার্চ)।
ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেলের টেন্ডার ছিনতাই করেছে ছাত্রলীগ (নয়াদিগন্ত, ৫ মার্চ)।
দেহব্যবসা নিয়ে ইডেনে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১০ (আমার দেশ, ১৩ মার্চ)।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী বিশ্ববিদ্যালয়/ছাত্রলীগের আন্দোলনে তিন মাস বন্ধ (প্রথম আলো, ১৪ মার্চ)।
ঢাকা কলেজে ৫৭ গুলি উদ্ধার/ ছাত্রলীগের সংঘর্ষের নেপথ্যে সিট দখল ও চাঁদা-বাণিজ্য (প্রথম আলো ১৮ মার্চ)।
কেক কাটা নিয়ে সংঘর্ষ/বাকৃবিতে প্রক্টরের মাথা ফাটিয়েছে ছাত্রলীগ (আমার দেশ, ১৮ মার্চ)।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নষ্টের জন্য ছাত্রলীগই দায়ী-৩১পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের অভিমত (নয়াদিগন্ত ২৪মার্চ)।
রাবিতে ছাত্রী লাঞ্ছনাকারী ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার ১০ মিনিটেই মুক্তি (যুগান্তর, ৪ এপ্রিল)।
টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ সংঘর্ষে নিহত ১ আ'লীগ নেতার বাড়ি ভাংচুর, মহাসড়ক অবরোধ (নয়া দিগন্ত ৪ এপ্রিল)।
দিনাজপুরে ১৪ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে দুই পক্ষের হাঙ্গামা, পঞ্চগড়ে ছাত্রলীগ নেতা খুন (প্রথম আলো ৯ এপ্রিল)।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রলীগ (প্রথম আলো, ৯ এপ্রিল)।
ঝুট ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, রাজধানীতে দিনদুপুরে ছাত্রলীগ নেতা খুন (সমকাল, ১৪ এপ্রিল)।
ঢাবি এলাকায় শিক্ষক-তরুণীরা লাঞ্ছিত, জড়িত ছাত্রলীগ (সমকাল, ১৬ এপ্রিল)।
ডাস্টবিন শৌচাগারও ইজারা নিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতারা (প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল)।
ছাত্রলীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন: আ'লীগকে পাঁচ শিক্ষাবিদ নেতা, (নয়াদিগন্ত, ২২ এপ্রিল)।
এ এসআইকে পিটিয়েছে জবির ছাত্রলীগ কর্মীরা (যুগান্তর, ৭ মে)।
সিলেট পলিটেকনিকে ছাত্রলীগের ধারালো অস্ত্রের মহড়া ঃ গুলি (যুগান্তর, ১৬ মে)।
আদালতে এক ডাকাতের স্বীকারোক্তি, ফকিরহাট ছাত্রলীগের এক নেতার নেতৃত্বে ডাকাতি করতে যাই (প্রথম আলো)।
ইবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ গুলি, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা (যুগান্তর, ২৮ মে)।
সিলেট ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ২০ (যুগান্তর, ৯ জুন)।
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্র (প্রথম আলো, ১৮ জুন)।
ছাত্রলীগের চাপে ভর্তি বন্ধ, অধ্যক্ষ লাঞ্ছিত পাবনায় দুই কলেজের শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন (প্রথম আলো, ২৪ জুন)।
কক্সবাজারে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সম্মেলন পন্ড (ইত্তেফাক, ২৬ জুন)।
রাবিতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ সংঘর্ষে আহত ২ (ইত্তেফাক ২৭ জুন)।
ছাত্রলীগের হুমকির মুখে আজিজুল হক কলেজে ভর্তি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ (নয়াদিগন্ত, ২৫ জুন)।
হরতালে ছাত্রলীগের চন্ডমূর্তি। দায় নেবে না আওয়ামী লীগ : আশরাফ (কালের কন্ঠ, ২৮ জুন)।
র্যা ব-পুলিশের পোশাকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করা হয়েছে (নয়াদিগন্ত, ২৯ জুন)।
রাবিতে ছাত্রলীগের হাতে জাসদ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অবরুদ্ধ (যায়যায়দিন, ৩ জুলাই)।
জাবি ফের রক্তাক্ত : ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, গুলি: আহত অর্ধশত (কালের কন্ঠ, ৬ জুলাই)।
ইবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ : আহত ২০ (যুগান্তর, ৯ জুলাই)।
বাকৃবি ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ (নয়াদিগন্ত, ১০ জুলাই)।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, উপরোক্ত শিরোনামগুলো প্রতিনিয়ত যাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রীমহোদয় ঠিক এমন একটি গ্রুপকে উসকিয়ে দিলেন অন্যদের সাথে সংঘর্ষ করার জন্য। একজন মন্ত্রীর নিকট সব নাগরিকই সমান হওয়ার কথা ছিল। দুর্ভাগা জাতির আজ দুর্ভাগা মন্ত্রী। তার এ নি©র্দশে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। একটু নজর দিলেই যে কেউ বুঝতে পারবেন কোন কারণে আজ ছাত্রলীগের অপকর্ম দিন দিন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে যাই বলুন আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে মনে করি এসব অপকর্মের জন্য সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা অধিকন্তু বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী-এমপিদের এ ধরনের উসকানীই বহুলাংশে দায়ী। বর্তমান সরকার ক্ষমতা লাভের মাত্র ২৫ দিনের মাথায় যখন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যায়ে ছাত্রলীগ অস্ত্রের মহড়া দিল এবং অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে বহু হতাহত হলো তখন তো তাদের বিরুদ্ধে কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় নাই। কিছুদিনের জন্য এদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল মাত্র। তাতে এসব সন্ত্রাসীদের কী ক্ষতি হলো দলীয় কার্যক্রম বন্ধ হলেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ ছিলনা কখনো। যার কারণে পরবর্তীতে উক্ত প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বহু শিরোনাম মিডিয়ায় এসেছে। সর্বশেষ ৭ জুৃলাই ঐ প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ওদের একগ্রুপ অন্যগ্রুপের কয়েকজনকে চারতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়ার ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কোন কোন পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে আবারো ছাত্রলীগ লাগামহীন। এসব শিরোনাম দেখলে মনে হয় ছাত্রলীগ কোন মানুষের সংগঠন নয়। মনে হয় এটি অনিয়ন্ত্রণযোগ্য কোন অদৃশ্য শক্তির নাম, যে তাকে দমন বা নিয়ন্ত্রণ করতে যাবে সেই শেষ হয়ে যাবে। আসলে কী তাই? না, মোটেও না। এদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কখনো করা হয়নি। নিয়ন্ত্রণের নামে যা করা হয়েছে তা মূলত তাদের উসকিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ হতে সরে দাঁড়িয়েছেন। যার ফলে গৃহে অবস্থানকারী সন্তানের চেয়ে ত্যাজ্য পুত্রের দুষ্টুমী কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আগেতো প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে তাদের ডেকে সতর্ক করতেন কিন্তু এখন সাংগঠনিক পদে না থাকায় তাও করছেন না। ফলে তারা দিন দিন স্বেচ্ছাচারী হতেই থাকছে। গত ২৭ জুন হরতালের দিন বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সমগ্র দেশে তারা যে ত্রাস সৃষ্টি করছিল তা বিবেক সম্পন্ন প্রতিটি মানুষকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। হরতাল বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। হরতালের সফলতা বা ব্যর্থতার মাধ্যমে সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন যাচাই করার সুযোগ থাকে। সরকার বার বার বলেছিল তারা হরতালে বাধা দিবে না। অথচ হরতাল যাতে সফল না হয় সেজন্য ১৫ জুন থেকেই সমগ্র দেশ থেকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করতে থাকে এবং বিভিন্ন পুরনো মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামীদের তালিকায় ঢুকাতে থাকে। হরতালের দিন সরকারের পুলিশ বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী হিসেবে ছাত্রলীগ বিরোধী দলের নেতাদের উপর যে নৃশংস অত্যাচার করছে তা কোন সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। অথচ ইতিহাস থেকে প্রতিয়মান হয় যে এ ধরনের কোন ঘটনা না ঘটলেও আওয়ামী লীগ হরতালের আগের রাত থেকেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। গাড়িতে আগুন দিয়ে শাহবাগ মোড়ে একরাতেই ১৩ জন মানুষকে হত্যা করেছিল। এছাড়াও গাড়ী ভাংচুর এবং পুলিশের ওপর হামলা করার জন্য কুংফু কারাতে বাহিনীও নামাত। কিন্তু এবার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দেড় বছরের শাসনামলে বিরোধীদলের প্রথম হরতালে তারা ঐ ধরনের কোন সহিংস পথেই যায়নি। মাসাধিক কাল থেকে তারা সাধারণ মানুষের সাথে গণসংযোগ করেছে। তারা সর্বস্তরের মানুষকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, কোন কারণে এই হরতাল।
বিরোধীদল বার বার বলে আসছিল যে এ হরতাল হবে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। আর হয়েছিলও তাই। সরকারের অপশাসনের প্রতিবাদে গোটা দেশের মানুষ স্বত:স্ফুর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। আমরা মনে করেছিলাম চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারী দলের ভরাডুবি এবং ২৭ জুন হরতাল পালন থেকে সরকার পজেটিভ কিছু শিক্ষা নিবে। কিন্তু সরকার তার কোন অনুসন্ধানের ধার ধারেনি। বরং জনগণের প্রতি তার ক্ষোভ কয়েকমাত্রা বৃদ্ধি করে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই উঠে পড়ে লেগেছে। আর তা বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ বাহিনীর সাথে ছাত্রলীগ-যুবলীগও যৌথভাবে আজ মাঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ যেমন এক আতংকের নাম তেমনি বাহিরেও এমন কোন অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। হরতালের দিন শাহবাগ মোড়ে সংসদ সসদ্য শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানির উপর ছাত্রলীগ একটি জংগী মিছিল নিয়ে হামলা চালায় আর পুলিশ ছাত্রলীগকে সহায়তা করে এবং উল্টো আহত লোকদেরকেই গ্রেফতার করে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আববাসের বাড়িতে ঢুকে র্যা বের পোশাকে যারা নিরীহ মহিলাগুলোকে বেদম লাঠিচার্জ করল তারা তো আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য হতে পারে না। যে ঘটনার মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিএনপি নেতারা দাবি করেছে র্যা বের পোশাকে লাঠিপেটাকারী সবাই ছাত্র ও যুব লীগের সন্ত্রাসী। যদি তা সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশে যে নোংরা ও উচ্ছৃখল রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করা হলো তা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এক অশনি সংকেত হয়ে থাকবে। হরতালে ছাত্রলীগের তান্ডব নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন ছাত্রলীগের এসব অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবেনা। কারণ এরা এখন আলাদা সংগঠন। যদি তাই হয় তাহলে এদের অপকর্মের জন্য কেন প্রশাসনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয় না। কোন অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ওরা এসব জঘন্য অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। কোন কোন জায়গায় দেখা যাচ্ছে যে পুলিশ ছাত্রলীগের কর্মীকে ডাকাতির কাজে গ্রেফতার করছে মুহুর্তের মধ্যে ওপর মহলের ফোনে ঐ ডাকাতকে থানায় না নিয়ে মোটর সাইকেলে নিরাপদে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে। পুলিশ ডাকাত গ্রেফতার করলে কোন ক্ষমতাবলে ছাত্রলীগ মিছিল নিয়ে থানা ভাংতে যায়। যেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরীহ একটি ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে চিরুনী অভিযান চালিয়ে সমগ্র দেশ থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং রিমান্ড দেয়া হলে উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত নয় এমন অসংখ্য লোককে গ্রেফতার ও হয়রানি করা হচ্ছে। হয়তবা এই ঘটনায় সরকার তাদের বাকী মেয়াদ পর্যন্ত ঐ বিরোধী সংগঠনটির ওপর নির্যাতন হয়রানি চালিয়ে যাবে। কোন কোন মন্ত্রী-এমপিরা উক্ত সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করারও দাবি তোলেন। কিন্তু ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে কেন এমনটি দেখছিনা। ছাত্রলীগের অপকর্মের দায় আওয়ামী লীগ নেবেনা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই ঘোষণার মাত্র তিনদিনের মাথায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-আলম হানিফ বলেন, দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হবে আর ছাত্রলীগ-যুবলীগ ঘরে বসে থাকবে তা হতে পারে না। এ কথার মাধ্যমে হানিফ সাহেব মূলত ছাত্রলীগকে মাঠেই রাখতে চান। আর সরকারও মূলত ছাত্রলীগকে বর্তমান রূপেই দেখতে চান। কারণ ১০ই জুলাই পাটমন্ত্রী ছাত্রলীগকে বিরোধী দলের উপর অত্যাচারের লাইসেন্স প্রদান করেছেন। পাট মন্ত্রীর এমন চিন্তা করা বোধ হয় ঠিক হবে না যে ছাত্রলীগ ইচ্ছা করেই বিরোধী দলের সাথে সংঘর্ষে কম লিপ্ত হচ্ছে। ব্যাপারটি নির্ভর করছে বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর অত্যধিক দেশপ্রেমের উপর। কারণ আজ ছাত্রলীগ যা করছে তার যদি সিকি ভাগও বিরোধী সংগঠনগুলো মোকাবিলা করতো তাহলে দেশের জন্য বারটা বেজে যেত। তাই দেশের জন্য এটা বিরাট নিয়ামত যে বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনগুলো অতিমাত্রায় সহনশীল। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বুঝানো যায়। গত ২৯ জুন সরকার জামায়াতে ইসলামীর তিন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে আদালতে নিয়ে অভিনব কায়দায় নতুন নতুন মামলা দাঁড় করিয়ে জনপ্রতি ১৬ দিন করে রিমান্ড মন্জুর করাল। এ প্রহসনটা বাংলাদেশে আর কখনো হয়নি যে এক ধরনের মামলায় এরেস্ট তাও আবার জামিন হয়ে গেলে নতুন নতুন মামলা দিয়ে শ্যেন এরেস্ট দেখিয়ে এক নাগাড়ে ১৬ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করানো হয়েছে। আদালতের ভিতরে চলছিল যখন এমন কান্ড ঠিক তখন আদালতের বাইরে চলছিল ছাত্রলীগের জঙ্গী তান্ডব। পুলিশ-র্যা ব, ছাত্রলীগ-যুবলীগ চতুর্মুখী হামলা চালিয়ে জামাত শিবিরের প্রায় ৭০ জন নেতাকর্মীকে আহত করে গ্রেফতার করল। যদি কেউ অন্যায় করে তাহলে প্রশাসনের লোক হিসেবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু ছাত্রলীগ-যুবলীগ এরা প্রশাসনের কি? ঐ দিন যদি ছাত্রশিবির পাল্টা প্রতিবাদে নামতো তাহলে অবস্থাটা কি হতো সেখানে। বিরোধীদল অভিযোগ করেছে বর্তমান সরকার পুলিশ বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি দলীয় ক্যাডারের ন্যায় নগ্ন ব্যবহার করছে। ছাত্রলীগ আর পুলিশ দুটোকে এখন আলাদা করা যায় না। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো যখন ইচ্ছা করে হোক আর যেকোন কৌশলে হোক ছাত্রলীগ হতে দূরে সরে থাকতে চাচ্ছে যাতে তাদের সাথে সংঘর্ষ না বাঁধে। তখন মন্ত্রীর এমন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশকে সংঘর্ষের পথে আরো বেশি ঠেলে দিবে। ছাত্রলীগ কোনদিনই শান্ত ছিলনা। এদের অশান্ত করার জন্য বিরোধী দলের উপর লেলিয়ে দিতে হবে না। ছাত্রলীগের সাথে জড়িতদের বর্তমান মানানসই এক নতুন ধাঁচে গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিক কোন সাংগঠনিক আচরণই তাদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আদর্শ ভাবাবেগ দূরে থাক সাধারণ চক্ষুলজ্জা যা যেকোন সংগঠনের নেতা কর্মীদের মধ্যে থাকে তাও নাই এদের মাঝে।
সবশেষে বলতে চাই এদেশটা আমাদের সবার। এ ভূখন্ডটাকে অশান্ত রাখলে সময়ের পরিবর্তনে কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোন খারাপ রাজনীতির দৃষ্টান্ত যদি আজ তৈরি করা হয় তাহলে তা সহজে মুছে যাবেনা। বরং তা একটি সময়ে দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বিপরীতক্রমে যদি কেউ ভাল কোন উদাহরণ স্থাপন করে যায় তাও দেশের কল্যাণেই আসবে। আমাদের দেশের নেতা-নেতৃদের এটাই বড় সমস্যা যে তারা ক্ষমতায় একবার আসতে পারলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চিন্তা মাথায় কখনো আসেনা। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো এ পর্যন্ত কোন সরকারই নির্বাচনের মাধ্যমে পরপর দুই মেয়াদ ক্ষমতায় আসতে পারে না। অর্থাৎ ক্ষমতার পালা বদল হবে এটাই স্বাভাবিক। সবাইকে এ সত্যটা উপলদ্ধি করে চলতে হবে।

Tuesday, 6 July 2010

গণতন্ত্র, আমরা বা তৃতীয় বিশ্ব

গণতন্ত্র বিভিন্ন দেশে ও সমাজে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শে চলমান। গণতন্ত্রের খাঁটি আদর্শ বুঝাতে আমরা সততই আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি সবাই তুলে ধরি। সেই উক্তিই যেনো গণতন্ত্রের বিকাশ,পরিচ্ছর্যা আর উন্নয়ন-বর্ধনশীলতার মাপকাঠি। সত্যিইতো, গণতন্ত্র মানুষের জন্য,মানুষের দ্বারা,মানুষের উপর। কিন্তু এই মানুষ বা জনগোষ্ঠী কারা ? আফ্রিকার আদিম মানুষের কাছে কি এই উক্তি গ্রহণযোগ্য ? অবশ্যই না। কেননা, আধুনিক এই সংজ্ঞা তাদের উপরই প্রযোজ্য, যারা মন আর মননশীলতায় আধুনিক।

 আমরা বা তৃতীয় বিশ্ব, ব্রিটেন এবং আমেরিকার গণতন্ত্রকে অনুকরণীয় বলে মনে করি। আর তা অনুসরণে আমাদের শ্রম,মেধা আর অর্থ ব্যয় করে অসারতা ছাড়া আমাদের ঝুড়িতে গণতন্ত্রের একটি দানাও সংগ্রহ করতে পারিনি। কিন্তু কেন পারিনা, এর কারণ খুঁজে দেখার দায়ভার এড়িয়ে চলি। একটি জনগোষ্ঠী আর রাষ্ট্র একই মুদ্রার দুই পিঠ এবং সরকার এর পরিচালক। কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায় উভয়ের। যে সমাজে দায়বদ্ধতা উপেক্ষিত, সেই সমাজের উন্নয়ন কোনমতেই সম্ভব নয়।

 আমাদের সমাজে সবাই শিক্ষিত নয় মানি। কিন্তু বিট্রেন-আমেরিকার সব নাগরিক কি উচ্চ শিক্ষিত ? সে সব দেশেও স্বল্প-শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত লোকের অভাব নেই। তবুও তাদের গণতন্ত্র আজ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে পাকা আসন গেঁড়ে সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণটা কি ? কারণ- কর্মসংস্থান। যে সমাজে কর্মসংস্থান নেই, সেই সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা সুদূর পরাহত। তাই গণতন্ত্র বা রাজতন্ত্রই বলুন এর প্রথম পাঠ, কর্মসংস্থান।

 উন্নত বিশ্ব তাই নানান চিন্তা-গবেষণা করে সাধারণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এমনভাবে বেঁধে দিয়েছে যে, কাজ ছাড়া উন্নত জীবনধারণ অসম্ভব। আর এই কর্মের পেছনে জুড়ে দেয় নানান ট্যাক্স-কর ইত্যাদি। এই ব্যবস্থায় একদিকে বেকারত্ব লাঘব করে, অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনগণের টাকায় ফান্ড সমৃদ্ধ করে সরকার জনসেবায় ব্রতী হয়। সুতরাং সাধারণ মৌলিক জন চাহিদা মেটাতে সরকারের তেমন হিমশিম খেতে হচ্ছেনা। আর এই ব্যবস্থায় একজন নাগরিক নিয়মিত কাজ না করলে তার জীবনের চাকার গতিময়তা হ্রাস পাবে বিধায় কাজে ফাঁকি দেয়ার চিন্তা মাথায় আনতে পারেনা।

 এতে দেখা যায় কাজে শ্রেণী বৈষম্য উপেক্ষিত এবং সকল নাগরিক সম মর্যাদায় রাষ্ট্র কর্তৃক সমাদৃত। তাই সকলেই সকলের কাজের প্রতি যত্নবান এবং অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে রাষ্ট্র ছাড়া কেহ কারো কর্ম বা পরিধি বিষয়ে মননিবেশ করার চিন্তা-চেতনা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগে রাষ্ট্র বা সরকার একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করে জনসেবায় অধিকতর মনোযোগী হয় এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করিয়া থাকে। এতে রাষ্ট্রতন্ত্রের সাথে লেজুড়বৃত্তি গজিয়ে উঠতে পারেনা, যা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশেই পরিলক্ষিত হয়।

দেশ পরিচালনায় গণতন্ত্র একটি আদর্শ পন্থা, তা আধুনিক বিশ্বেও সর্ব্জন স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের সাথে এর তফাৎ এই যে, আমরা নিয়তই ভিন্নমত সহ্য করতে পারিনা। যেহেতু ক্ষমতা আমার, সেহেতু আমার মতামতই শেষ কথা। কিন্তু উন্নত বিশ্বে ঠিক তেমনটা আমরা দেখতে পাইনা। সে সব দেশে দলীয় লেজুড়বৃত্তি না থাকায়, দলীয় হয়েও দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পিছপা হয়না। আবার বিরোধীদলের ভাল পরামর্শ বা সমালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে ক্ষমতাসীনরা লজ্জাবোধ করেনা। এতে প্রমাণিত হয়, তাদের গণতন্ত্রে দলীয়তন্ত্র নেই। তাই প্রত্যেক সদস্যই স্বাধীন মতামতের প্রবক্তা।

 কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। তাই গণতন্ত্রের সূফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনা। কেননা, আমি যে দলই করিনা কেন, নেতা-নেত্রীর মতামতই শেষ কথা। এখানে আমার মতামতের গুরুত্ব না থাকায় দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা ছাড়া আমার অবস্থান ধরে রাখা দূরুহ। সুতরাং আমাকে টিকে থাকার জন্য “ইয়েস” বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এতে গণতন্ত্রের লেবাসে প্রচ্ছন্ন স্বৈরতন্ত্র বিরাজ করে। যাকে এককথায় সংজ্ঞায়িত করলে বলতে পারি-তথাকথিত গণতন্ত্র। এহেন অবস্থায় দলতন্ত্রের ছত্রছায়ায় পেশী শক্তির উন্মেষ ঘটে। তখন ঐ পেশী শক্তি নিজেদের স্বার্থে নানা পেশাজীবী সংগঠন সৃষ্টি করতে উৎসাহী হয়। আর দলীয় লেজুড়বৃত্তি এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার খাতিরে সরকার এদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে। ইহাতে পেশীশক্তি বেপরোয়া হয়ে সমাজের সকল স্তরে থাবা বসায়। একটি রাষ্ট্রের এমন অবস্থায় দেশে নানান সুবিধাবাদী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। তারা নিজেদের ফায়দা হাসিল করিবার লক্ষ্যে যে কোন অপরাধ করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে না। তখন রাষ্ট্রের বেতনভূক্ত সুযোগ সন্ধানি কর্মচারি-কর্মকর্তা ঐ সব পেশীশক্তির সাথে হাত মিলিয়ে মূল্যবোধের অবক্ষয় আর নৈতিকতার স্খলনে সীমাহীন অপরাধ, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ইহাতে রাষ্টের প্রকৃত মালিকদের অসহায়ত্ব বেড়ে যায় এবং ভোগান্তিকেই নিয়তি মেনে নিয়ে চলতে থাকে।

 সুতরাং বেকারত্ব দূরীকরণ বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে যতদিন না জাতিকে মর্যাদাশীল করে গড়ে তুলতে পারবো, ততদিন আমরা সেই তিমিরেই থেকে যাবো। পরিশেষে কাব্যরূপে দুটো কথা বলেই শেষ করছি—“গণতন্ত্র যখন দেখি/দলতন্ত্রে মিলায় হাত।স্বৈরতন্ত্র রূপে তখন/বাড়ে দেশে রক্তপাত। 

Thursday, 1 July 2010

লাশের মিছিল জাতি শোকাহত

লাশের মিছিল জাতি শোকাহত
গত ৫ জুন দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘‘নবাব কাটরায় লাশের মিছিল, লেলিহান আগুন কেড়ে নিলো ১১৭ জনের প্রাণ।’’ গা শিউরে উঠারমত শিরোনাম। ঘটনা ৩রা জুন, পুরান ঢাকার নিমতলী ট্র্যাজেডি। স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে কেউ বলেছেন, ট্রান্সফরমার থেকে আবার কেউ বলছেন কেমিকেল গোডাউন থেকে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এলাকার ট্রান্সফরমারটি প্রায়ই বিস্ফোরিত হতো। তখন এলাকাবাসী চাঁদা দিয়ে অসংখ্যবার সেটি মেরামত করেছেন। তাদের অভিযোগ বিদ্যুৎ বিভাগের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। অন্যদিকে কেমিকেল গোডাউন অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এসব দাবি সত্ত্বেও কেমিকেল গোডাউন অন্যত্র সরানো হয়নি। যদি ট্রান্সফরমার থেকে আগুন লেগে থাকে তাহলে বিদ্যুৎ বিভাগের গাফিলতির কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটলো তার দায়িত্ব কি বিদ্যুৎ বিভাগ নেবে? অন্যদিকে কেমিকেল গোডাউন থেকে যদি আগুন লেগে থাকে তাতে অত বড় দুর্ঘটনা ঘটলো এর দায় কি কেমিকেল গোডাউনের কর্তৃপক্ষ নেবে? ঘটনার মাত্র দুই দিন পূর্বে বেগুনবাড়ী ট্র্যাজেডি জাতি ভুলতে না ভুলতেই পুরান ঢাকায় ঘটে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ‘‘নিমতলী ট্র্যাজেডি’’।
ঘটনা পরিদর্শনে গেলেন মন্ত্রী-এমপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অবাক হয়ে দেখলেন সব কিছু। কারো কারো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল পানি। কিন্তু একটিও মৃতপ্রাণও কি কেউ ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন? সে সামর্থ্য কারো নেই। ঘোষণা করা হলো একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক। দেশের মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অনুষ্ঠিত হলো নিহতদের রূহের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত। কোনো ঘটনা ঘটলে জাতি শুনতে পায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বাড়িঘরের অবৈধ স্থাপনা, ফায়ার সার্ভিসের জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব, পরিবেশ ছাড়পত্রের অভাব, রাজউকের অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ ইত্যাদি ইত্যাদি এক বোঝা নীতিবাক্য। এসব নীতিবাক্য জাতি কোনভাবে গ্রহণ করে তা আমার জানা নেই। কেননা, একটি ভবন যখন তৈরি হয় তখন কি উক্ত সংস্থার সদস্যের কারো চোখে পড়ে না? ফায়ার সার্ভিসের জন্য প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থা নেই-এ কথাটি কি শুধু আগুন লাগার মুহূর্তের জন্য প্রযোজ্য। ঢাকায় যেভাবে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, মানুষের বসবাস বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে যেকোনো সময় আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য সরকার, ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রয়োজনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন জায়গায় কূপ খননের মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করতে পারে যেহেতু ঢাকা মহানগরী একটি যান্ত্রিক শহর। তাই মুহূর্তের মধ্যে যেকোনো স্থানে পানি সরবরাহ করতে পারে।
বেগুনবাড়ীর যে ভবনটি ধসে পড়েছে তার পাশের আরেকটি ভবন বাঁকা হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে এই ভবনটিও ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুরান ঢাকার হাজার হাজার ভবন রয়েছে যেগুলো বহু আগে তৈরি। যেগুলোর স্থায়িত্ব অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। দেখলেই মনে হয় যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই ভবনগুলোর ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেবে? নাকি আবার জাতি দেখবে বেগুনবাড়ী বা নিমতলীর মতো ট্র্যাজেডি। তাই বেগুনবাড়ী ও নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সরকার, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জাতি আশা করে।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter