Flickr

Wednesday, 21 July 2010

সরকারের চাল-কেরামতি

Posted by   on

কিছুদিন ধরে চালের দাম লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। গত ১২ দিনে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকা। সরু চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। খুচরা বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৩/৩৫ টাকা দরে। চাল কিনতে গিয়ে মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে। অথচ বাংলাদেশের স্বাভাবিক নিয়মে এ সময় চালের দাম কিছুটা হলেও কমে যাওয়ার কথা। কারণ, মাত্র কিছুদিন আগে বোরো ধান বাজারে এসেছে। তাছাড়া সরকার ঘোষণা দিয়েছিল এবার বোরোর নাকি ‘বাম্পার ফলন' হয়েছে! অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে নতুন চাল আসছে না বলে চালের দাম আরো বাড়তে পারে। এদিকে দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বেসরকারি হিসাবে দেশে প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা যেখানে ৫০ হাজার টন সেখানে সরকারের কাছে বর্তমানে মজুদ রয়েছে মাত্র পাঁচ লাখ টনের মতো। এই পরিমাণ চাল দিয়ে ১০ দিনের চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব নয়। ‘বাম্পার ফলন' হয়েছে বলে সরকার যে প্রচারণা চালিয়েছে তথ্যাভিজ্ঞরা তাকেও ‘চালবাজি' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তথ্য-পরিসংখ্যান দেখিয়ে তারা বলেছেন, বাস্তবে আউশ, আমন ও বোরোর মধ্যে কোনো একটিরই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হয়নি। উৎপাদন বরং অনেক কম হয়েছে।
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, সরকার খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কিত কোনো খবরই কাউকে জানতে দিচ্ছে না। টিসিবি পর্যন্ত একেবারে নীরব হয়ে গেছে। কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন শুধু খাদ্যমন্ত্রী। এতদিন ধরে মুখে লম্বা কথা শুনিয়ে আসার পর প্রচন্ড খাদ্য সংকটের মুখোমুখি এসে খাদ্যমন্ত্রী অতি সম্প্রতি আংশিকভাবে সত্য স্বীকার করেছেন। তিনি তাই বলে নিজেদের ব্যর্থতার কথা বলেননি, সব দোষ চাপিয়েছেন মিল মালিকদের ওপর। বলেছেন, মিল মালিকরা চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেনি বলেই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সেই সাথে মিল মালিকদের কষে একখানা ধমকও দিয়েছেন। গত রোববার তিনি বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ না করলে মিল মালিকদের সনদ বাতিল করা হবে। অন্যদিকে ধমকের চমৎকার জবাব দিয়েছেন মালিকরা। মিল মালিকদের সংগঠনের নেতা বলেছেন, দেশে প্রায় ১৭ হাজার মিল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার মিল সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। মন্ত্রী যদি এতজনের সনদ বাতিল করেন তাহলে সরকার চাল পাবে কোথায়? ওই নেতা প্রসঙ্গক্রমে জানিয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে সরকারের কাছে ২ লাখ ৬০ হাজার টন চাল সরবরাহ করেছেন। তারা আরো বলেছেন, বাজারে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে আগের দামে সরকারকে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সরকার যদি ধান কিনে দেয় তাহলে তারা চাল করে দেবেন।
এভাবেই খাদ্য পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতির চাপে খাদ্যমন্ত্রী বিদেশ থেকে চাল আমদানির ঘোষণা দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু এরও তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারে একদিকে খাদ্যের দাম বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে বিশেষ করে ভারত নিজেই রয়েছে তীব্র খাদ্য সংকটে। দেশটিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ৭০ লাখ টন গম কিনতে হয়েছে। তাছাড়া আমদানির বিষয়টি এমন সহজ নয় যে, খাদ্যমন্ত্রী চাইলেই দু'চার দিনের মধ্যে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য হুড়মুড় করে বাংলাদেশের বাজারে ঢুকে পড়বে। এজন্য কম করে হলেও তিন থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় দরকার। ততোদিনে মানুষের জিহবা বেরিয়ে পড়বে। ১৯৭৪ সালের মতো দুর্ভিক্ষে মারা যাবে হাজার হাজার মানুষ।
আমরা মনে করি, সমগ্র বিষয়টিকে বাস্তবতার আলোকে পর্যালোচনা করা দরকার। এতে দেখা যাবে, সবকিছুর মূলে রয়েছে সরকারের ত্রুটি ও ব্যর্থতা; যাকে সরকারের ‘চাল-কেরামতি' হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সরকার এ বছর ধান-চালসহ বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১২ লাখ টন। কিন্তু কিনতে পেরেছে মাত্র ৪ লাখ টনের মতো। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার মওসুমের একেবারে শেষদিকে এসে সংগ্রহমূল্য প্রতি কেজিতে তিন টাকা বাড়িয়েছিল। কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি। সরকার দাম বাড়ানোর ফলে উল্টো বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। ঠিক তখনই মিল মালিকরা সরকারের কাছে ধান-চাল বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসেছেন। খাদ্যমন্ত্রী মিল মালিকদের ওপর দোষ চাপালেও তার সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, গোড়ায় গলদটুকু সরকারই করেছিল। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত নিয়ম যেখানে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে নেয়া, আওয়ামী লীগ সরকার সেখানে এবার হঠাৎ করে মিল মালিকদের হাতে ধান সংগ্রহের দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিয়েছিল। সরকারের স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল দলীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ হাসিল করে দেয়া। এই সুযোগে দালাল ও ফড়িয়াদের মাধ্যমে মিল মালিকরা কৃষকদের যথেচ্ছভাবে হয়রানি ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার বানিয়েছেন। সরকার যদি মিল মালিকদের কাছ থেকে কেনার পরিবর্তে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কিনতো তাহলে একদিকে কৃষকরা লাভবান হতে পারতো, অন্যদিকে সরকারকেও এভাবে বেকায়দায় পড়তে হতো না। কিন্তু দলীয় ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি করতে গিয়ে সরকার কৃষকদের প্রতি চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে। তাদের কাছ থেকে ধান কেনেনি। অন্যদিকে যাদের স্বার্থে পদক্ষেপ নেয়া সেই মিল মালিকরা শুধু বিপদেই ফেলেননি, সরকারের দুরবস্থারও সুযোগ নিয়েছেন।
ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিত অযথা বিবাদে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া এবং সমঝোতার মাধ্যমে নতুন করে মূল্য নির্ধারণ করা। এই মূল্য অবশ্যই বিদেশ থেকে আমদানির চাইতে অনেক কম হবে। তাছাড়া সময়ও বেঁচে যাবে। সরকারকে একই সঙ্গে অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে ভারতে চালের চোরাচালান প্রতিহত করতে হবে। কারণ খাদ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন ভারতে চালের দাম বাড়ায় চোরাচালানও বহুগুণে বেড়ে চলেছে। সুতরাং চোরাচালান প্রতিহত করতেই হবে। আমাদের বিশ্বাস, চোরাচালান প্রতিহত করার পাশাপাশি অসৎ ব্যবসায়ী ও চোরাচালানীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হলে এবং মিল মালিকদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা গেলে চালের বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। সংকট কেটে যাবে, চালের দামও আর বাড়বে না। সরকারকে একই সঙ্গে কৃষকের কাছ থেকে কিছুটা বেশি দাম দিয়ে হলেও ধান কেনার পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, সরকার দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠবে এবং চালের দাম কমিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter