ভারতীয় ফেন্সিডিলে তলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
ভারতীয় ফেন্সিডিলের প্রধান বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিশাল সীমান্তপথে প্রতিদিন অবৈধ উপায়ে নানাবিধ পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করলেও গত কয়েক দশক ধরে সর্বাধিক আসছে ফেন্সিডিল। ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল আসছে। এমন কোন দিন নেই যেদিন পত্রিকাগুলোর দিকে নজর দিলে ফেন্সিডিলসহ চোরাচালানি আটক হওয়ার সংবাদ চোখে না পড়ে। হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো সচিত্র প্রতিবেদনও পত্রিকাগুলোতে ছাপানো হচ্ছে। র্যা ব-পুলিশের বিশেষ অভিযান এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপতরের বিশেষ সভা আহবানও হচ্ছে। কিন্তু নেশাজাত তরল মাদকের এসব বোতল ভারত থেকে আমাদের দেশে প্রবেশের পরিমাণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ভারতীয় ফেন্সিডিল। এক সময় পুরাতন ঢাকার অলি-গলি ও পাড়া-মহল্লায় এই মাদক দ্রব্যটি প্রকাশ্যে সেবন ও বিক্রি হতে দেখা যেত। প্রতিবাদি ব্যক্তিকে নাজেহাল হতে হতো ফেন্সিডিল সেবণ, বিক্রেতা, মজুতদার, ও গডফাদারদের হাতে। মহিলা ও ছোট শিশুদেরকেও ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ ও জীবন ধ্বংসকারি এই ফেন্সিডিল বিক্রির ক্ষেত্রে। বর্তমানে পাড়া-মহল্লা ও অলি-গলি পেরিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজেও এর ব্যাপক বিস্তার দেখা যাচ্ছে। ফেন্সিডিলের পাশাপাশি মরফিন, প্যাথিডিন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশার উপকরণ ঔষধ বাংলাদেশের সর্বত্র গ্রাস করছে। কাশির জন্য ব্যবহৃত ফেন্সিডিল সিরাপ এক সময় ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত ও বৈধ ছিল। পরে দেশের তরুণ সমাজের কথা বিবেচনা করে ঔষধ নীতিতে নিষিদ্ধ করা হয় ফেন্সিডিল। বাংলাদেশ-ভারতের বিশাল সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেন্সিডিলের কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি ফেন্সিডিলে নেশাজাত উপাদানই মিশানো হচ্ছে বেশী। অধিকাংশ কারখানা বাংলাদেশ ঘেঁষে ভারত সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে।ভারত থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল বাংলাদেশে পাঠানোর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য আছে। একটি হচ্ছে অবৈধ উপায়ে এদেশ থেকে মাদক দ্রব্যটি বিক্রি করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়া। অপরটি হচ্ছে বাংলাদেশের যুব সমাজকে পরিকল্পিতভাবে নেশার জগতে ঠেলে দিয়ে যুবশক্তিকে শেষ করে দেয়া। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফেন্সিডিলের আগ্রাসন পূর্ণোদ্যমে চলছে। দেশে বিডিআর বিদ্রোহ হওয়ার পর বিভিন্ন সীমান্তে বিডিআর বাহিনীর নজরদারি কিছুটা ভাটা পড়ে। এই বিডিআর বিদ্রোহই প্রতিবেশী ভারতের জন্য সীমান্ত পথে বাংলাদেশে লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল পাঠানোর জন্য প্রচুর উদ্যম দিতে থাকে। সম্প্রতি গোটা বাংলাদেশই আজ ভেসে যাচ্ছে ভারতীয় ফেন্সিডিলে। তবে মাদক দ্রব্যের সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালানের বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। ইতোপূর্বে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা ফেন্সিডিল চোরাচালান ও সেবনের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শ্রেণীর কিশোর-তরুণরাও মেতে উঠেছে ফেনসি সেবনে। ‘ফেনসিখোর' হিসেবে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে এদেশের তরুণসমাজ। দীর্ঘদিন পানের কারণে ভগ্নস্বাস্থ্য, লিভার ও হার্টের ক্ষতিসহ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে ফেনসিসেবীরা। নেশার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অনেকে চুরি ও ছিনতাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। ফলে দেশের আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে।
গত ১ বছরে সীমান্ত পাহারাদার বিডিআর প্রায় ৯ লাখ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করেছে। পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ১ বছরে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে ২৩,১২৮টি। মাদক উদ্ধারের পর পুলিশ মামলা নিলেও দুর্বল চার্জশীট এবং ঘটনা চাপিয়ে যাওয়ার কারণে মাদক মামলায় আসামীরা একদিকে জেলে যায়, অন্যদিকে জামিন পেয়ে পুনরায় ফেন্সিডিল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। আবার মহাজোট সরকারের দলের সদস্য হওয়াতে অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে পুলিশ ধরতেও পারছে না। ধরলেই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও হর্তাকর্তার তদ্বির শুরু হয়ে যায়। প্রকৃত মাদক বিক্রেতা ও গডফাদাররা সবসময় থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল মাদক ব্যবসায়ে প্রভাবশালীরা অনেক টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। রাজনীতি, প্রশাসন সবকিছুকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চুটিয়ে ব্যবসা করছে ও প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাচ্ছে। দেশ ও সমাজের অসীম ক্ষতির দিকে অনৈতিক এসব ব্যবসায়ীদের কোন খেয়াল নেই। সীমান্ত থেকে রাজধানীতে হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল প্রবেশে কতগুলো চেকপোস্ট ও প্রশাসনিক এলাকা পড়ছে। ফেন্সিডিল ব্যবসায়ীরা প্রতি পদে টাকা দিয়ে অবৈধ এসব মাদক অনবরত ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে দিচ্ছে। ঘাটে ঘাটে উৎকোচ দেয়ার কারণে যে ফেন্সিডিল সীমান্ত এলাকায় ১ বোতল বিক্রি হয় ১০০/১৫০ টাকায়, তা সীমানা পেরিয়ে রাজধানী কিংবা আশেপাশের এলাকায় বিক্রি হয় ৫০০/৬০০ টাকায়। পরিবহন খরচ ও অসাধু মহলে চাঁদা প্রদানের পরও প্রতি বোতল ফেন্সিডিলে ২০০/২৫০ টাকা লাভ থাকে। মাদক বিক্রেতারা বিক্রি করে বোতল প্রতি কমিশন পায়। কিন্তু এসব ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা গ্রেফতারকৃতদেরকে মোটা অংকের টাকা খরচ করে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের নাম যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে পুলিশকে ম্যানেজ করে রাখে।
দেশের ১২টি সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাদক পাচারের বৃহত্তম রুট কুমিল্লা সীমান্ত এলাকা। কুমিল্লার বিবির বাজার, রসুলপুর, রাজ্যপুর বড় জ্বালা, চৌদ্দগ্রামের উজিরপুর, গোমরা বাড়ি, খোলাপাশা, জগন্নাথ দীঘি, বেতিয়াবা, কাইছুটি, চৌয়াবা, সুয়াগঞ্জ বুড়িচংয়ের সংকুচাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শশীদল, নয়নপুর সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে ফেন্সিডিল। ১৬টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার ৭৪ কিলোমিটার সীমানা ভারতের সাথে জড়িত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন বানের জলের মত ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। জেলার ৮০ কিমি সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে প্রতিদিন। কসবা, আখাউড়া ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ সীমানায় রয়েছে নিরাপদ সড়ক। কসবার মাদলা, কালিকাপুর, আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ, গোসাইরস্থল কর্নেল বাজার, বাউতলা, আবদুল্লাহপুর, আজমপুর সদর উপজেলার সিঙ্গার বিল, মেরাসানী, নলঘড়িয়া, নয়াবাদী সীমান্ত এলাকা ফেন্সিডিল প্রবেশের নিরাপদ রুট।
ফেনী সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন আসছে মাদক। জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, সোনাগাজী সীমানার নদীপথে মাদক আসছে অহরহ। কক্সবাজার রুটের টেকনাফ, উখিয়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে। জয়পুরহাট রুটের হিলি সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে। ঝিনাইদহ রুটের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেষপুর এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে।
দিনাজপুর, নওগাঁ, যশোর ও রাজশাহী দিয়ে প্রতিদিন বস্তা ভর্তি ফেন্সিডিল আসছে। মাদক ব্যবসার সাথে দিন দিন নারীরা জড়িত হচ্ছে। যারা এক সময় বাসা বাড়িতে কিংবা গার্মেন্টসে কাজ করত তাদের অনেকে মাদক বহরের সাথে জড়িত হচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকরাও সীমান্ত থেকে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে দিচ্ছে ফেন্সিডিল। মাদক পাচার করে পরিবহনগুলো প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাসই মাদক-পাচারের নিরাপদ পরিবহন।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠা ফেন্সিডিল কারখানাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে বিডিআরের পক্ষ থেকে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়া হয় গত মার্চে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে এই তালিকা বিএসএফ-এর হাতে তুলে দিয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। বিডিআরের মহাপরিচালক বলেন যে, বিএসএফের কাছে যেসব কারখানার তালিকা দেয়া আছে সেসব কারখানা বন্ধ হলে ফেন্সিডিল পাচার অনেক কমে যাবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মিডিয়া কর্মীরা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অফিসে যোগাযোগ করলে হাইকমিশনের কর্তাব্যক্তিরা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় নিষিদ্ধ ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের একটি যৌথ ইশতেহারে সই করেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মাদক পাচার নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারকেও সই করে। অথচ বাস্তবতার সাথে এসব সই এর কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সই শুধু সই এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
ফেন্সিডিলের বন্যায় দেশ তলিয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যুব সমাজ। এখনই এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায থেকে মাঠপর্যায়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করা না হলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। অনতিবিলম্বে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের সাথে ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অসংখ্য ফেন্সিডিলের কারখানাগুলো। এজন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকার-টু-সরকার আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের তরুণ সমাজকে ফেন্সিডিলের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। ফেন্সিডিলসহ যে কোন মাদক পাচার প্রতিরোধে সুষ্ঠু ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
-মোঃ আব্দুল আলিম
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ভারতীয় ফেন্সিডিল। এক সময় পুরাতন ঢাকার অলি-গলি ও পাড়া-মহল্লায় এই মাদক দ্রব্যটি প্রকাশ্যে সেবন ও বিক্রি হতে দেখা যেত। প্রতিবাদি ব্যক্তিকে নাজেহাল হতে হতো ফেন্সিডিল সেবণ, বিক্রেতা, মজুতদার, ও গডফাদারদের হাতে। মহিলা ও ছোট শিশুদেরকেও ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ ও জীবন ধ্বংসকারি এই ফেন্সিডিল বিক্রির ক্ষেত্রে। বর্তমানে পাড়া-মহল্লা ও অলি-গলি পেরিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজেও এর ব্যাপক বিস্তার দেখা যাচ্ছে। ফেন্সিডিলের পাশাপাশি মরফিন, প্যাথিডিন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশার উপকরণ ঔষধ বাংলাদেশের সর্বত্র গ্রাস করছে। কাশির জন্য ব্যবহৃত ফেন্সিডিল সিরাপ এক সময় ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত ও বৈধ ছিল। পরে দেশের তরুণ সমাজের কথা বিবেচনা করে ঔষধ নীতিতে নিষিদ্ধ করা হয় ফেন্সিডিল। বাংলাদেশ-ভারতের বিশাল সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেন্সিডিলের কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি ফেন্সিডিলে নেশাজাত উপাদানই মিশানো হচ্ছে বেশী। অধিকাংশ কারখানা বাংলাদেশ ঘেঁষে ভারত সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে।ভারত থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল বাংলাদেশে পাঠানোর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য আছে। একটি হচ্ছে অবৈধ উপায়ে এদেশ থেকে মাদক দ্রব্যটি বিক্রি করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়া। অপরটি হচ্ছে বাংলাদেশের যুব সমাজকে পরিকল্পিতভাবে নেশার জগতে ঠেলে দিয়ে যুবশক্তিকে শেষ করে দেয়া। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফেন্সিডিলের আগ্রাসন পূর্ণোদ্যমে চলছে। দেশে বিডিআর বিদ্রোহ হওয়ার পর বিভিন্ন সীমান্তে বিডিআর বাহিনীর নজরদারি কিছুটা ভাটা পড়ে। এই বিডিআর বিদ্রোহই প্রতিবেশী ভারতের জন্য সীমান্ত পথে বাংলাদেশে লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল পাঠানোর জন্য প্রচুর উদ্যম দিতে থাকে। সম্প্রতি গোটা বাংলাদেশই আজ ভেসে যাচ্ছে ভারতীয় ফেন্সিডিলে। তবে মাদক দ্রব্যের সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ চোরাচালানের বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। ইতোপূর্বে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা ফেন্সিডিল চোরাচালান ও সেবনের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শ্রেণীর কিশোর-তরুণরাও মেতে উঠেছে ফেনসি সেবনে। ‘ফেনসিখোর' হিসেবে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে এদেশের তরুণসমাজ। দীর্ঘদিন পানের কারণে ভগ্নস্বাস্থ্য, লিভার ও হার্টের ক্ষতিসহ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে ফেনসিসেবীরা। নেশার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অনেকে চুরি ও ছিনতাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। ফলে দেশের আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে।
গত ১ বছরে সীমান্ত পাহারাদার বিডিআর প্রায় ৯ লাখ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করেছে। পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ১ বছরে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে ২৩,১২৮টি। মাদক উদ্ধারের পর পুলিশ মামলা নিলেও দুর্বল চার্জশীট এবং ঘটনা চাপিয়ে যাওয়ার কারণে মাদক মামলায় আসামীরা একদিকে জেলে যায়, অন্যদিকে জামিন পেয়ে পুনরায় ফেন্সিডিল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। আবার মহাজোট সরকারের দলের সদস্য হওয়াতে অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে পুলিশ ধরতেও পারছে না। ধরলেই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও হর্তাকর্তার তদ্বির শুরু হয়ে যায়। প্রকৃত মাদক বিক্রেতা ও গডফাদাররা সবসময় থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল মাদক ব্যবসায়ে প্রভাবশালীরা অনেক টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। রাজনীতি, প্রশাসন সবকিছুকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চুটিয়ে ব্যবসা করছে ও প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাচ্ছে। দেশ ও সমাজের অসীম ক্ষতির দিকে অনৈতিক এসব ব্যবসায়ীদের কোন খেয়াল নেই। সীমান্ত থেকে রাজধানীতে হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল প্রবেশে কতগুলো চেকপোস্ট ও প্রশাসনিক এলাকা পড়ছে। ফেন্সিডিল ব্যবসায়ীরা প্রতি পদে টাকা দিয়ে অবৈধ এসব মাদক অনবরত ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে দিচ্ছে। ঘাটে ঘাটে উৎকোচ দেয়ার কারণে যে ফেন্সিডিল সীমান্ত এলাকায় ১ বোতল বিক্রি হয় ১০০/১৫০ টাকায়, তা সীমানা পেরিয়ে রাজধানী কিংবা আশেপাশের এলাকায় বিক্রি হয় ৫০০/৬০০ টাকায়। পরিবহন খরচ ও অসাধু মহলে চাঁদা প্রদানের পরও প্রতি বোতল ফেন্সিডিলে ২০০/২৫০ টাকা লাভ থাকে। মাদক বিক্রেতারা বিক্রি করে বোতল প্রতি কমিশন পায়। কিন্তু এসব ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা গ্রেফতারকৃতদেরকে মোটা অংকের টাকা খরচ করে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের নাম যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে পুলিশকে ম্যানেজ করে রাখে।
দেশের ১২টি সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ বোতল ফেন্সিডিল বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাদক পাচারের বৃহত্তম রুট কুমিল্লা সীমান্ত এলাকা। কুমিল্লার বিবির বাজার, রসুলপুর, রাজ্যপুর বড় জ্বালা, চৌদ্দগ্রামের উজিরপুর, গোমরা বাড়ি, খোলাপাশা, জগন্নাথ দীঘি, বেতিয়াবা, কাইছুটি, চৌয়াবা, সুয়াগঞ্জ বুড়িচংয়ের সংকুচাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শশীদল, নয়নপুর সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে ফেন্সিডিল। ১৬টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলার ৭৪ কিলোমিটার সীমানা ভারতের সাথে জড়িত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন বানের জলের মত ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। জেলার ৮০ কিমি সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে প্রতিদিন। কসবা, আখাউড়া ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ সীমানায় রয়েছে নিরাপদ সড়ক। কসবার মাদলা, কালিকাপুর, আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ, গোসাইরস্থল কর্নেল বাজার, বাউতলা, আবদুল্লাহপুর, আজমপুর সদর উপজেলার সিঙ্গার বিল, মেরাসানী, নলঘড়িয়া, নয়াবাদী সীমান্ত এলাকা ফেন্সিডিল প্রবেশের নিরাপদ রুট।
ফেনী সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন আসছে মাদক। জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, সোনাগাজী সীমানার নদীপথে মাদক আসছে অহরহ। কক্সবাজার রুটের টেকনাফ, উখিয়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে। জয়পুরহাট রুটের হিলি সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল প্রবেশ করছে। ঝিনাইদহ রুটের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেষপুর এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে।
দিনাজপুর, নওগাঁ, যশোর ও রাজশাহী দিয়ে প্রতিদিন বস্তা ভর্তি ফেন্সিডিল আসছে। মাদক ব্যবসার সাথে দিন দিন নারীরা জড়িত হচ্ছে। যারা এক সময় বাসা বাড়িতে কিংবা গার্মেন্টসে কাজ করত তাদের অনেকে মাদক বহরের সাথে জড়িত হচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকরাও সীমান্ত থেকে দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছে দিচ্ছে ফেন্সিডিল। মাদক পাচার করে পরিবহনগুলো প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাসই মাদক-পাচারের নিরাপদ পরিবহন।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠা ফেন্সিডিল কারখানাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে বিডিআরের পক্ষ থেকে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়া হয় গত মার্চে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে এই তালিকা বিএসএফ-এর হাতে তুলে দিয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। বিডিআরের মহাপরিচালক বলেন যে, বিএসএফের কাছে যেসব কারখানার তালিকা দেয়া আছে সেসব কারখানা বন্ধ হলে ফেন্সিডিল পাচার অনেক কমে যাবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মিডিয়া কর্মীরা ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অফিসে যোগাযোগ করলে হাইকমিশনের কর্তাব্যক্তিরা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় নিষিদ্ধ ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশের একটি যৌথ ইশতেহারে সই করেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মাদক পাচার নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারকেও সই করে। অথচ বাস্তবতার সাথে এসব সই এর কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সই শুধু সই এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
ফেন্সিডিলের বন্যায় দেশ তলিয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে যুব সমাজ। এখনই এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায থেকে মাঠপর্যায়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করা না হলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। অনতিবিলম্বে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের সাথে ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা অসংখ্য ফেন্সিডিলের কারখানাগুলো। এজন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকার-টু-সরকার আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের তরুণ সমাজকে ফেন্সিডিলের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। ফেন্সিডিলসহ যে কোন মাদক পাচার প্রতিরোধে সুষ্ঠু ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
-মোঃ আব্দুল আলিম
No comments:
Write comments