Flickr

Thursday, 30 December 2010

টিআইবি ও সিনেটর বুজম্যানের বার্তা সরকার উপলব্ধি করবে কী?

Posted by   on

টিআইবি ও সিনেটর বুজম্যানের বার্তা সরকার উপলব্ধি করবে কী?
মামলার হাত থেকে বোধহয় আর কারোরই রক্ষা নেই। এবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই দিনে তিনটি মামলা করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর করা মামলাগুলোর মধ্যে কুমিল্লার আদালতে দায়ের করা মামলা ওইদিনই খারিজ হয়ে যায়। তবে চট্টগ্রামের মামলা দুটিতে টিআইবির কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির হওয়ার সমন জারি করা হয়। টিআইবি প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক জরিপ রিপোর্টের কারণে মামলা তিনটি হয়। জরিপ রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৭ সালে বিচার বিভাগে দুর্নীতির যে অবস্থা ছিল, ২০১০-এ তার আরও অবনতি ঘটেছে। বিচার বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতে পরিণত হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টারা টিআইবির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ বলছেন, সরকারের ইমেজ নষ্ট করার জন্য এই রিপোর্ট করা হয়েছে। কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই টিআইবি জরিপের উদ্দেশ্য। কিন্তু টিআইবির ওপর সরকারের এত ক্ষোভের কারণ কী? টিআইবি তো একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করে আসছে বহু বছর ধরে। সরকারের বিভিন্ন সেবাখাতের ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার ও মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেন তারা। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, টিআইবির প্রতিবেদন শতভাগ নির্ভুল। কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা বাধাগ্রস্ত করা টিআইবির উদ্দেশ্য হয় কেমন করে? আর বিচার বিভাগের দুর্নীতির কথা কি এই প্রথম প্রকাশিত হলো? খোদ প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন ক'দিন আগে। তিনি বলেছেন, জেলা জজ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে পেশকারদের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক এটর্নি জেনারেল ও সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হকের বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের অনিয়ম সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্টেই শুধু বলা হয়নি, এর আগে বর্তমান প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ অনেকেই বলেছেন। তবে আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে- দেশের মানুষ এখনও বিচার বিভাগকে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে থাকে। এটাই হচ্ছে বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ভরসা। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। বিচার বিভাগের মর্যাদা যাতে আর ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে সবারই নজর দেয়া উচিত।
ব্যারিস্টার রফিকুল হক যথার্থই বলেছেন, বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সহযোগিতা করতে পারে সরকার। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতার পরিবর্তে সরকার যদি বিচার বিভাগে বিদ্যমান দুর্নীতিকেই অস্বীকার করতে চায় এবং কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ রিপোর্টকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত হবে কেমন করে?
সরকারের মন্ত্রীরাতো বললেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই টিআইবির জরিপের উদ্দেশ্য। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইতোমধ্যে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার জবাবদানে সরকার কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কতটা সাফল্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন? প্রসঙ্গত এখানে একটি পত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জন বুজম্যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা এক চিঠিতে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আটকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ করেছেন। তিনি এই বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করলেও ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) এ্যাক্টকে ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। গত ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে নবনির্বাচিত সিনেটর জন বুজম্যান বলেন, স্বচ্ছ বিচারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে মানদন্ড রয়েছে তা বাংলাদেশের আইনটিতে অনুপস্থিত বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটির বিষয়ে সবচেয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্য ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন, দ্য ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না এবং এই আইনের মাধ্যমে তাদের যে সাজা প্রদান করা হবে তার বিরুদ্ধেও তারা কোন প্রতিকার চাইতে পারবেন না- বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যক্তির মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে যাই থাকুক না কেন, এই জাতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইনে। অন্যান্য অপরাধ-আইনের ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য তা এই অ্যাক্টের ক্ষেত্রে রাখা হয়নি। আইনটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও রাখা হয়নি, যা সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার হরণের মাধ্যমে করা হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান বলে যে মৌলিক বিধান আছে তাও এখানে খর্ব করা হয়েছে। বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের এবং স্বচ্ছ করার জন্য এই আইনের সংশোধন খুবই জরুরি। সিনেটর বুজম্যান আরো বলেন, এই আইন ও বিচারকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না মর্মে যে বিধান রাখা হয়েছে তা-ই আইনটিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ বিচারের পরিপন্থী করে তুলেছে।
আইনটি যেহেতু যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের আগে প্রণীত হয়েছে, তাই ২০০২ সালে প্রণীত রোম-সংবিধি অনুযায়ী আইনটি সংস্কার করা উচিত। কারণ বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সিনেটর বুজম্যান বলেন, প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচার কাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিতর্ক বাড়বে। সিনেটর বুজম্যান আরো বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো বিষয়ের সাথে জড়িয়ে জামায়াতের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, এতে আইনটির রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, যেহেতু আপনার সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের একনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত, সেহেতু জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করাই হলো ট্রাইব্যুনালের প্রথম কাজ, এ বিশ্বাসই সমাজে এখন বিদ্যমান। আইনটির যথাযথ সংশোধন করে এবং নিরপেক্ষ ও ভয়-ভীতিমুক্ত বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আপনার সরকার ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখবে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেবে বলে আমরা আশা করি। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক বিচার অঙ্গনের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহের কারণে তারা সবাই উদ্বিগ্ন যে, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হতে পারে। বুজম্যান তার চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আইনটি যথোপযুক্ত সংশোধন করে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় আনার বিষয়ে আপনার সরকার উদ্যোগ নিলে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। আপনাদের এ প্রক্রিয়ায় আমার অফিস যদি কোনো সহায়তা করতে পারে বলে আপনারা মনে করেন, তাহলে দয়া করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে কোনো দ্বিধা করবেন না। জানি না প্রধানমন্ত্রীর অফিস এই চিঠির কি জবাব দেবে। আর '৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন কিংবা আটককৃতদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করবে কি না তাও আমরা জানি না। তবে আমরা এ কথা নিশ্চিতভাবে জানি যে, কোন আইনকে শুধু মুখে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বললেই তা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়ে যায় না। আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ হলেই কোন আইন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে পারে। আর কোন আইন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি বিচার কার্যক্রমও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি বিচার কাজে অগ্রসর হয় তাহলে যুদ্ধাপরাধ বিচারের উদ্যোগটি একটি যৌক্তিক পরিণতি পেতে পারে। কিন্তু এখন দেখার বিষয় হলো বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পথে অগ্রসর হবে নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হবে- যেমনটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সিনেটর জন বুজম্যান।
আমরা এখনো একথা বিশ্বাস করতে চাই যে, দেশের সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম, দেশ ও জনগণের কল্যাণে আন্তরিক। আর কল্যাণ ব্রতের এমন অভিযাত্রায় সফল হতে হলে প্রয়োজন পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনের যথা আচরণ। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসনের কথাও উল্লেখ করতে হয়। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো-কাঙ্ক্ষিত কাজগুলো কোন একক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায় না। কাজগুলো সুনির্দিষ্ট এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও সুনির্দিষ্ট। দেশ ও জনগণের কল্যাণ চাইলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে দায়িত্ব পালনে। এমন অভিযাত্রায় ব্লেম-গেমের কোনো সুযোগ নেই। আর দায়িত্ব পালনের কাঙ্ক্ষিত পথে হাঁটতে হলে প্রথমেই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকে। কারণ দেশ ও জনগণের কল্যাণে দায়িত্ব পালনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যুদ্ধাপরাধ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ যে সব ইস্যু বিরাজ করছে, সেই সব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ও ন্যায্য পরিণতি লাভে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসিকতা পরিহার করা। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে কতটা এগিয়ে আসে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter