Flickr

Monday, 27 December 2010

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের মুখ ও মুখোশ

Posted by   on

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর সবচেয়ে কঠিন সংকটের মুখোমুখি। উপমহাদেশ থেকে যারা দ্রাবিড়ীয়-বৌদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস করে বৌদ্ধদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং যারা ইসলামের আগমন, সম্প্রসারণ এবং মুসলিম উত্থানকে কখনও মেনে নিতে পারেনি এবং যাদের কট্টর সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতা মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় পরিচিতি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে নিতে বাধ্য করেছে, তারাই আজ দিল্লীর শাসন-কর্তৃত্ব দখল করে আমাদের সামনে এই সংকট তৈরি করেছে।
ভারত দৃশ্যত: স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও অভ্যন্তরীণভাবে তার জাতীয় নীতি অ-হিন্দু জাতি-ধর্ম-নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের স্বাধীন বিকাশের বিরোধী এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভারত বিলুপ্ত ঔপনিবেশিক বৃটিশ শক্তির উত্তরাধিকার। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জ্ঞাতিভাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাই ভারতের উঠতি পরাশক্তির দোসর। এই সুযোগে ভারত এ অঞ্চলে তার ‘অখন্ড ভারত মাতার' ডকট্রিন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভয়ঙ্করভাবে আগ্রাসী এবং অপ্রতিদ্বনদ্বী। ৯/১১-এর পর মার্কিন ‘নিওকনরা' যেমন আফগানিস্তানে হামিদ কারজাইয়ের মতো পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি ১/১১-এর পর নয়াদিল্লী-বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী নীল নকশার কভারে তাদের অনুগত একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। এটি এখন আর কোন রাজনৈতিক সন্দেহ বা ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর বাস্তবতা ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতীয় কূটনীতিকদের গোপনীয় নথিতেও প্রমাণ হয়েছে।
উইকিলিকস যে হাজার হাজার নথি ফাঁস করেছে, তাতে বাংলাদেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তন, সরকারের প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তা নীতি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি পরিবর্তনে ত্রি-শক্তির অশুভ অাঁতাতে গড়ে ওঠা এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরকারের বাধ্যবাধকতা তাই শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। উইকিলিকস প্রকাশিত তথ্যে তার জবাবও অবশ্য পাওয়া গেল। এদিকে অসময়ে উইকিলিকস যে তথ্য ফাঁস করেছে, তা সরকারকে শুধু বিব্রতই করেনি, সরকারের মুখোশও উন্মোচিত করে দিয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারের নামে মাদরাসা শিক্ষার বনেদী ঐতিহ্য, ইসলামী চেতনা ও পরিচয় বিলুপ্তকরণের বিরুদ্ধে তৌহিদবাদী তৃণমূল জনগণ যখন আন্দোলন-প্রতিরোধ-হরতালের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে, তখনই উইকিলিকস জানালো যে, শিক্ষানীতিকে ইসলামমুক্ত করে তাকে পশ্চিমা ধাঁচে সাজানোর বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় ইঙ্গ-মার্কিন সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। ভারত এতে ঘি ঢেলেছে। সাথে ‘প্রগতিশীল' [ভাড়ায় খাটা] রাজনীতিক-সামাজিক শক্তি, পরাশ্রয়ী এনজিও-ব্যবসায়ীরা মদদ যুগিয়েছে। ‘অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল' বাংলাদেশ গড়তে তারা ইসলামী চেতনা ও শিক্ষা-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বিদায় করে যাদুঘরে পাঠানোর আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। কেননা, ইসলামবর্জিত সেক্যুলার বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক সীমানা না থাকলে তা ভারতের আধিপত্যবাদী থাবার নীচে সহজে গুটিয়ে যাবে বলে তারা মনে করেন।
ভারতে হিন্দু মিলিট্যান্ট বা উগ্র হিন্দুবাদী সশস্ত্রগোষ্ঠী তৈরি করছে কারা? খোদ আমেরিকায় ইভানজেলিক খৃস্টানদের মতো উগ্র বর্ণবাদী জনগোষ্ঠী তৈরি করছে কারা? এজন্য ভারতে হিন্দুত্বের দীক্ষাদানকারী গীতা-বেদ-উপনিষদ বা বৃটেনে বাইবেলকে কেউ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি। মুসলমানদের কুরআনসম্পৃক্ততা ও ইসলামী ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অনুসরণেই ওদের যতো আপত্তি ও আতঙ্ক। ইসলাম সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নিরপরাধ মানুষ হত্যা বা জনকল্যাণে নিবেদিত কোন সম্পদ ধ্বংসের কোন এযাযত-অধিকার কাউকে দেয়নি। ইসলামের নাম ব্যবহার করে যদি এসব কেউ করে, তবে তাতে ইসলামের ওপর কলঙ্ক আরোপ করা যায় না। আবার ইসলামের প্রতিপক্ষগোষ্ঠী জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের গোপন কারখানায় ভাড়াটে কিছু নামধারী মুসলমানদের জঙ্গি কার্যক্রম তথা মানুষ হত্যা ও আত্মঘাতী বোমাবাজিতে লিপ্ত করে ইসলামকে কলঙ্কিত করার চাতুরিও চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ যেমন গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ-একনায়কতন্ত্র চালিয়ে গণতন্ত্রকে অকার্যকর ও গণবিরোধী প্রমাণ করে থাকে, তেমনি ইসলামও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী-যায়নবাদীদের ত্রিশক্তির চক্রান্তের শিকার হয়ে কলঙ্কিত হচ্ছে। এ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজত করার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তেছে, তাদের সীমাবদ্ধতা ও অদক্ষতা মুসলমানদের সবচেয়ে বিপন্ন ও দিশাহীন জাতিতে পরিণত করেছে। মুসলমানরা জঙ্গি না হয়েও জঙ্গিবাদের দায়ে চিহ্নিত। ইসলাম-মুসলমানের পরিচয়ের সাথে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে সমার্থক করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই। পাকিস্তানে যারা স্বাধীন ভূখন্ডে ইসলামের পরিচয় নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদেরকে ‘তালেবান জঙ্গি' বানিয়ে নির্বিচার গণহত্যার শিকার বানানো হয়েছে। ৯/১১-এর পর আফগানিস্তান দখলের সময় মার্কিন ড্রোন বিমান মিসাইল নিক্ষেপ করে যেভাবে সিভিলিয়ান আফগান মুসলমানদের নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল, ঠিক একইভাবে মার্কিন মিসাইলবাহী ড্রোন বিমানগুলো পাকিস্তান ভূখন্ডে নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষ মারছে। হালে অবশ্য মার্কিন সমরবিদরা পাকিস্তান ভূখন্ডে তাদের ড্রোন বিমান হামলার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে যারা ইসলামী চেতনা ও বিশ্বাসকে আত্মিক টানে, ঐতিহ্যের ধারায় ধারণ ও লালন করেন এবং যারা ভারতীয় নাশকতা-আগ্রাসন থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদের দোসর হিসেবে নির্মূলের টার্গেট করা হয়েছে। এর ছবক এসেছে দিল্লী থেকে।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয় পারস্পরিক জনগণের কল্যাণে, জাতীয় স্বার্থে। তাই রাষ্ট্রীয় দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি বা যে কোন সমঝোতা স্মারক হতে হবে উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ। কিন্তু এ বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে এসেছেন, তা উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ নয়। আর এ জন্যই সরকার গোপনীয়তা ও লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতের সাথে চুক্তির ব্যাপারে সরকারের অপরাধবোধ না থাকলে এই লুকোচুরির কোন প্রয়োজন হতো না। ভারতের কাছে অসম শর্তে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ তুলে দেয়ার যে কথা আমরা এতকাল লিখে আসছি, তাকে যারা ভারত ফোবিয়া বা পাকিস্তানপন্থী মানসিকতা হিসেবে সরলীকরণ করতে চেয়েছেন, তাদের মুখোশটাও উইকিলিক্স-ফাঁস করে দিয়েছে। প্রথমত: উইকিলিক্স উল্লেখ করেছে যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে ভারত খুবই স্বস্তি অনুভব করেছে। কারণ ভারত মনে করেছে, তার জাতীয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ শেখ হাসিনা অবসান ঘটাবেন। দ্বিতীয়তঃ শেখ হাসিনা এবং নয়াদিল্লী কর্তৃপক্ষ উভয়ই তাদের সম্পর্কের অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা প্রচারের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনার সরকার ভারতের ‘নিরাপত্তা ডকট্রিনের' কাছে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তা তুলে দেবার বিষয়টি আড়াল করতে কার্যতঃ ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নিয়ে সন্ত্রাস মোকাবিলায় ‘আঞ্চলিক' টাস্কফোর্সের প্রস্তাব করেন। এখানে ‘আঞ্চলিক' শব্দটি প্রতীকী। দ্বি-পাক্ষিকতা তথা ভারতমুখিতা আড়াল করার ভড়ং। ভারত জঙ্গি, সন্ত্রাস ও তার অভ্যন্তরীণ ইনসার্জেন্সী দমনে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের সাথে ভূটানের কায়দায় যৌথ সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। ইতোপূর্বে কোন সরকারই এ প্রস্তাবে সায় না দিলেও ১/১১-এর সেনা সমর্থিত সরকার ভারতের এই টোপ নীতিগতভাবে গিলে ফেলে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ভারত-প্রযোজিত ও পরিকল্পিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়ে আসা আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তিমূলে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে দেশের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ বন্ধক দিয়ে এসেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জনের তারবার্তার উদ্ধৃতি দিয়ে উইকিলিক্স- তাই লিখেছে, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে দিল্লীর উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। এতে ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী সন্তোষ প্রকাশ করেন।' তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে নিরাপত্তা সহায়তার উন্নতি করা হবে ভারতের প্রধান অগ্রাধিকার। ... ভারত বুঝতে পারে, শেখ হাসিনা খুব বেশি ভারতপন্থী' এই অভিযোগকে আড়াল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঞ্চলিক টাস্ক্ফোর্সের প্রস্তাব দিক।’’ অন্যদিকে ভারতীয় হাই কমিশনার এর গুরুত্ব নিয়ে বাগাড়ম্বর করে বলেন, ‘‘এই টাক্সফোর্স হবে কাজের। এটা আঞ্চলিক কোন কথামালার দোকান হবে না।’’
দেখা যাচ্ছে, ‘আঞ্চলিক টাস্কফোর্স' শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশ সরকারের মৌলিক কোন প্রস্তাব নয়। এটি নিরাপত্তা ও জঙ্গিদমন ইস্যুতে বাংলাদেশকে ভারতের গিলে ফেলার বিষয়টি আড়াল করার কুশলী প্রচারণামাত্র। ভারত একইভাবে উপ-আঞ্চলিক জোট নামে আর একটি প্রতারণার চাদর বিছিয়েছে। এতে নেপাল ও ভূটানকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা হচ্ছে। দুটি দেশই- ভারতের ভূমি দ্বারা বেষ্টিত বা ল্যান্ডলক্ড এবং ভারতের সামরিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার বাইরে বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিকভাবে এই তথাকথিত জোট থেকে কোন সুবিধা নিতে পারবে না। সরকারের তৃতীয় ক্যামোফ্লেজ কৌশল হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর গণচীন সফর এবং গণচীনের সাথে সংযোগ সড়ক উন্মোচনের পুরনো পরিকল্পনা তুলে ধরা। ঢাকায় কূটনীতিকদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে নয়াদিল্লীর কূটনৈতিক চালবাজি বলে ধারণা রয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরও ইন্ডিয়ান ডিপ্লোমেটিক ডকট্রিনেরই আর একটি দৃশ্যপট। এদিকে উইকিলিক্স-এ ভারতের সাথে সরকারের মাখামাখির কথা প্রকাশের পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর করণীয় নির্ধারক জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন। ‘জাতীয় নিরাপত্তার' বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত-নাশকতার সম্ভাব্যতা নিয়ে আতংকজনক কথাবার্তা বলছেন।
জাতীয় নিরাপত্তা বলতে সরকারের মাথায় কিছু আছে কিনা, সেটাই জনগণের প্রশ্ন। বরং বাংলাদেশের অভিভাবকত্ব ও জিম্মাদারী ভারতের হাতে তুলে দেবার সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে যারা দেশপ্রেমিক চেতনায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রস্তুত, তাদেরকেই জাতীয় নিরাপত্তার শত্রু হিসেবে টার্গেট করে বিনাশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার জাতীয় স্বাধীনতা বিকানোর স্বাধীনতাকে অবাধ ও নিরংকুশ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: ‘‘ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশ হতে পারে চীন ও ভারতের সংযোগ সেতু।' [সমকাল, ২২ ডিসেম্বর, ২০১০] এর আগে অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছেন : ‘বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবেই ট্রানজিট রাষ্ট্র।' ড. মশিউর ইন্ডিয়ান লবীস্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। অর্থমন্ত্রীও একই ঘটনার তাত্ত্বিক বলেই এটা বলতে পারছেন।
সাবেক প্রধামন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার তাৎপর্যপূর্ণ চীন সফরকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা চীনকে জড়িয়ে আশাবাদের চটকদার কথা বলে তাদের ভারতমুখিতাকে আড়াল করতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের হাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার চাবিকাঠি তুলে দিয়ে তাঁর তাৎপর্যহীন চীন সফরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এসেছেন। চীনারা এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য, ভারত-মার্কিন সখ্যতা, পাক-ভারত-বৈরিতার রসায়ন ভালোই জানে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত গণচীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি। বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চীন সফরের নিকটপূর্ব সময়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী জিয়াবাও ভারত সফর করে পাকিস্তানও সফর করেন। তাঁর এ সফরকে ভারতীয়রা প্রতিরক্ষা ও সামরিক স্ট্র্যাটেজিক পর্যায়ে পাকিস্তানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফরকে এ অঞ্চলের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন। বিশেষ করে চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তানের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের কর্ম-কৌশলের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানানো এবং পাকিস্তানের ওপর বহিঃশক্তির হামলার সময় চীনাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ভারতের বৈরিতা ও ভারত-মার্কিন ঐক্যে চীনকে কনফ্রন্ট করার বিরুদ্ধে একটি সাক্ষাৎ সতর্কবার্তা। এরপর থেকে মার্কিন সমরনায়করা জঙ্গিদমনের নামে পাকিস্তানে ড্রোন বোমা হামলা চালিয়ে গণহত্যায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ভারতীয় তাত্ত্বিকরা মনে করেন, পাকিস্তানে মার্কিন অর্থ সাহায্য বন্ধ করে পাকিস্তানকে তারা পরিত্যাগ করলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। গণচীনের অভয় ও প্রশ্রয় সে আশঙ্কাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
আসছে জানুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসার আগেই ভারত তাদের সকল প্রাপ্য বুঝে নিতে চায়। চুক্তির এক বছরের মাথায় ভারত তার বিজয়-উৎসব পালন করতে চায়। আওয়ামী লীগ ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কতদূর যেতে পারে, তার একটা নমুনা তারা বিগত বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনাহত্যার সময় দেখিয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনায় ভারতের কাঙ্ক্ষিত ও ঘনিষ্ঠ সরকারের যাতে গণেশ উল্টে না যায়, তার বিরুদ্ধে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব বাবু হুঁশিয়ারি জানানো ছাড়াও ত্রিশ হাজার ভারতীয় স্ট্রাইকিং ফোর্স ও যুদ্ধ বিমান তৈরি রাখার কথা জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নিরাপত্তায় বাংলাদেশের জাতীয় সেনাবাহিনীর চেয়ে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর কেন নির্ভর করেছিলেন, উইকিলিকস-এর তথ্য থেকে তার কিছু আভাষ পাওয়া যায়। আবারও কোন নাশকতা-বিপদের আশঙ্কায় তারা বাইরের দেশের সেনাদের ডাকবেন কিনা, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এ ব্যাপারে কৌতূহলী। বিএনপি'র মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ঘন ঘন নাশকতার আতঙ্ক শুনে বাংলাদেশকে সিকিম কিংবা আফগানিস্তান বানানোর চক্রান্ত চলছে কিনা, এমন প্রশ্ন করেছেন।
জাতীয়তাবাদী ইসলামী শক্তির অবিসম্বাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান এবং চারদলীয় জোটের স্বাধীনতা রক্ষার নব পর্যায়ের আন্দোলনকে সরকার উন্নয়ন বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের রাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করে বিভ্রান্তি বিস্তার করছে। তবে এটাও তারা ভারতীয় থিংকট্যাংক থেকে ধার করে নিয়েছে। কিন্তু পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে সরকার জনমত বিভ্রান্ত করতে পারছে না। ‘সাউথ এশিয়ান এনালিস্ট'-গ্রুপের ইন্ডিয়ান থিঙ্কট্যাংক ভাস্কর রায় তার লেখা পেপার নম্বর ৩৮৬৭ ’’ইভর্টমবহ মত ঈটভথফটঢণ্রদ মযযম্রর্ধধমভ : ওপ. ঔট্রধভট বর্ল্র ইর্ড’’- এ (১৯ জুন ২০১০) যেসব ছবক দিয়েছেন, বিরোধী দলের সাথে সরকার সেই ভাষায়ই কথা বলছে এবং বিরোধীদল নির্মূলে ভারতীয় প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সকল নোংরা ও বর্বর পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করছে। ভয় দেখিয়ে, নির্যাতন করে দিল্লী-বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন নস্যাৎ করতে চায়। তারা ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াকে ‘মূর্খতা' বলেও উপহাস করতে শুরু করেছে। তবে ভারতের পুতুল সরকারের দেশ বিক্রির চক্রান্তের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সূচিত গণজাগরণে ভারত শঙ্কিত না হলে তাদের আতঙ্ক ছড়ানোর কোন প্রয়োজন হতো না। ভারতের তল্পী বহন করে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে যেখানে ‘অবতার' হিসেবে তারা পূজা-অর্চনা করতে শুরু করেছে, সেখানে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মাফিয়া কিংডমের' সম্রাজ্ঞীর অপবাদ দিতেও ভারতীয় প্রচার কুশলীদের বিবেকে বাধে না। এমনকি তারেক রহমানকে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী ভারতীয় মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের দোসর হিসেবে অপবাদ দিয়ে ভারত আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে বিপদগামী করতে চায়।
ভারতের সাথে আমরা যুদ্ধ চাই না, বিবাদও চাই না। আমরা চাই, সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর নির্ভরশীল সমঝোতা ও বন্ধুত্ব। সর্বভারতীয় আধিপত্যবাদ বা ‘অখন্ড' ভারত গড়ার গিনিপিগ হবার জন্য বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি।
ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা মনে রাখতে হবে, ৪০ বছর আগে পাকিস্তান পরিত্যাগ করে আসলেও বাঙালি মুসলমানরাই ছিলেন পাকিস্তান তৈরির মূল কারিগর। পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে ভারত মাত্র ৯ মাসের জন্য নিজ প্রয়োজনে আমাদের বন্ধু-সহকর্মী হতে এগিয়ে এসেছিল। পরবর্তী ৪০ বছরে বাংলাদেশের কয়েকটি জেনারেশন ভারতকে যেভাবে দেখেছে ও পেয়েছে, তাতে বন্ধুত্বের বিশ্বাস তো ভারতের ওপর ন্যস্ত করা যায় না। যারা কাঁটাতার দিয়ে সীমান্ত ঘিরে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে অবজ্ঞা ও অবমাননা করে আসছে, যারা হিংস্র বৈরিতায় সীমান্তে প্রতিনিয়ত আমাদের নিরস্ত্র ভাইবোনদের হত্যা করছে, আমাদের ভূমি জবর দখল করে নিচ্ছে, তাদের বন্ধুত্বে কারও আস্থা নেই। যারা পানি আগ্রাসন-অর্থনৈতিক আধিপত্য, ট্রানজিট-করিডোরের বর্শাফলকে বাংলাদেশের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে উদীয়মান ব্যাঘ্র-রাষ্ট্রকে দিল্লীর বশংবদ সেটেলাইট রাষ্ট্র বানাতে চায়, তাদের বন্ধুত্বের মেকী আবাহনের বিরুদ্ধে নবীন প্রজন্মের প্রতিরোধ দেখার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণকে ধর্মহীন, কর্মহীন, স্বপ্নহীন, আদিকালের চাষা-ভূষার প্রজন্মে পরিণত করার চাণক্য কুটিলতার কাছে যারা নতজানু হতে চায় না, তাদের বিরুদ্ধে দিল্লী ও তার বশংবদ সরকারের অঘোষিত গৃহযুদ্ধকে স্বাধীনতা রক্ষায় আর একটি প্রতিরোধ মহাসংগ্রামই হয়তো ঢাকা কেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানদের নবীন প্রজন্মের ভাগ্যলিপি। '৪৭ পর্বের ভূখন্ডগত স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং দাদার ভূমিতে দাঁড়িয়ে সম্পত্তি বাটোয়ারা হিস্যায় যে স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা উত্থিত হয়েছে, তার সুরক্ষায় নবীন প্রজন্মের কাছেও আর একটি আত্মত্যাগের ডাক এসেছে। এ সত্য আমরা যতো শীঘ্র তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো, ততোই জাতীয় সংকট উপলব্ধির সফলতা আসবে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়ে এক নেত্রীকে কোলে তুলে, অন্যনেত্রীকে শত্রুর নিশানায় বিনাশ করার রাম ও বাম রাজনীতির এই অভিশাপ থেকে মুক্তির পথই হোক জাতীয় রাজনীতির আরাধনা।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter