Flickr

Tuesday, 22 September 2015

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও সংখ্যালঘু তত্ত্ব

Posted by   on

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও সংখ্যালঘু তত্ত্ব

Untitled-1

বর্তমান বাংলাদেশে সংখ্যালঘু শব্দটি সরব, জোরালো এবং সুবিধাবাদী মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতাদের নিকট খুব প্রিয়। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এই দেশে মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের বসবাস। কিন্তু সংখ্যালঘু শব্দটি উচ্চারন হয়  বিশেষ করে হিন্দু সমাজের বেলায়। হিন্দু সমাজের উপর চলমান আক্রমণকে কেউ সহিংসতা, কেউ বলছেন সাম্প্রদায়িকতা, কেউ বলছেন রাজনৈতিক সহিংসতা। সবসময় যে কোন নির্বাচনের আগে ও পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাগুলো চালানো হয়, তাই একে রাজনৈতিক সহিংসতা বলা যায়। তবে এর মধ্যে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সহ অনেক বিষয় আছে।
একেক সময় একেকটি বিষয় নিয়ে হিন্দুদের উপর আক্রমন হয়। তবে সাম্প্রতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এদেশে হিন্দুরা না থাকলে কিছু কিছু মানুষ বেশ লাভবান হয়। তাছাড়া নির্বাচনে হিন্দুরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়, তা সবাই জানে। সাধারণত তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে তারা বি এন পি জামাতের আক্রমনের শিকার হয়, আবার আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলে আওয়ামী লীগের আক্রমনের শিকার হয়। গত নির্বাচনের পরের ঘটনাগুলো তাই প্রমান করে। সুবিধাবাদীরা চায় হিন্দুরা এ দেশ থেকে চলে যাক। ২০০১ সালে দেখা গেছে যারা তাদের পক্ষশক্তি,তা তারা ভালোভাবে দেখাতে চায়। এই লোক দেখানো কাজটি করতে গিয়ে দুই পক্ষের রাজনৈতিক লড়াইয়ের শিকার হন হিন্দু সমাজ।
অপ্রধান ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর ওপর সাম্প্রদায়িক আচরণ ও চাপ সারা বছরই থাকে। নির্বাচনের সময় তা তীব্র হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকেই আজ পর্যন্ত যেকোনো রাজনৈতিক চাপের বিরুদ্ধে সব সময় আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় থাকে। যেমন,যারা হিন্দুদের ওপর হামলা করতে চায়, তারা সক্রিয় হওয়ার পর অপর পক্ষ তো মাঠে থাকে। তারা তা প্রতিরোধ করে থাকে। নির্বাচনের সময় এই পাল্টা সক্রিয়তা কমে গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামীলীগ হিন্দুদের কে ভালো করে বুঝিয়ে দেয় তাদের কাছে সংখ্যালঘুদের জানমালের কোন নিরপত্তা নেই। এইক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ সবসময় মাঠে সক্রিয় থাকে। বর্তমানে সংখ্যালঘুদের পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার আওয়ামী সরকার ক্ষমতায়। তারপরও তাদের নিরপত্তা নেই।
২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সকল সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবে দেখা গেছে, পুলিশের তরফে কোনো প্রতিরোধ হয়নি। যদি হতো, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সহিংসতাকারীদের সংঘর্ষ হতো। অভয়নগরের সাংসদ, পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তার পরও তাঁরা সহিংসতা বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
যাঁরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁরা নিয়ম ও নির্দেশে পরিচালিত হন। সংখ্যা লঘুদের উপর আক্রমনের বিভিন্ন কারনের মধ্যে সম্পত্তি দখল অন্যতম। হিন্দুদের সম্পত্তি দখলে প্রায় সর্বদলীয় ঐক্য দেখা যায়। বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানীদের গভেশনায় দেখা গেছে যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বেশি থাকেন, হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের হিস্যাও তাঁদের বেশি।
ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৪৭-এর পর থেকে ধরলে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি—এই তিনটি দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় থেকেছে। সংখ্যালঘু আক্রমনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয় এক এবং অভিন্ন। আওয়ামী লীগের চিন্তা, কোনটি তাদের জন্য লাভজনক, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করা, নাকি রাজনৈতিক অবস্থান, ঐতিহাসিক দায় থেকে নিজেদের রক্ষা রক্ষা করা। বিশেষ করে সম্পত্তি দখল শুরু হয় ক্ষমতা লাভের পর। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, স্থানীয় সম্পর্কের সংঘাত ও নির্বাচনী রাজনীতি ব্যপকভাবে কাজ করে এবং দায়ীরা যে দলেরই হোক, কেউ তাদের শাস্তি দিতে চায় না। এখন পর্যন্ত কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন বিচার হয়নি। বরং হয়রানির শিকার হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা। ২০০১-এর পর যত আক্রমন হয়েছে সবগুলোতে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা হয়েছে। এইসব ঘটনার কোন বিচার হতে কেউ শুনেনি। এর জন্য বিচার বিভাগ দায়ী। বিচার বিভাগ যতদিন স্বাধীন হবে না ততদিন এই অপরাধ বাড়তে থাকবে।
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার সূত্রপাতের মুহূর্ত হিসেবে দেশভাগকে অনেকে দায়ী করেন। কিন্তু বর্তমান সাম্প্রদায়িকতার ধরনটা এখনো বদলায়নি। দেশভাগের অনেক আগে থেকে এখানে সাম্প্রদায়িকতা যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে রয়েছে। চর্যাপদে দেখা যায় বৌদ্ধদের ব্যাপারে হিন্দুদের ঘৃণা। এ দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের সময় ব্রাহ্মণেরা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার অনেক ঘটনা আছে। এরপর এই অঞ্চলে মুসলমান শাসকদের আমলে ধর্মান্তরকরণের ইতিহাস সব সময় শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, তা তো নয়। অনেকে বলে, এখানে তরবারির জোরে ধর্মান্তর হয়েছে। এ কথা পুরোপুরি যেমন ঠিক না, তেমনি একদম ভুলও নয়।
দেখা যাচ্ছে, উপকূলীয় ও সীমান্তবর্তী গ্রামে যেখানে হিন্দুদের বসতি বেশি এবং সেখানেই সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর উৎপত্তি বেশির ভাগই শহরে। দুই দেশের সাম্প্রদায়িকতার গড়নে পার্থক্য ভিন্ন।
১৯৪৭-এর দেশভাগের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা গিয়ে ভারতের সীমান্ত এলাকায় বসতি গড়েছে। আর ভারত থেকে আসা অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা ঢাকাসহ বড় শহরে বসতি গেড়েছে। ভারতের উচ্ছেদ হওয়া মুসলমানেরা শ্রমিক হিসেবে শহরাঞ্চলে জড়ো হয়েছে। এখানে পার্থক্য হচ্ছে, শহরাঞ্চলে বসবাস এবং শ্রমিক হওয়ার কারণে ভারতীয় মুসলমানেরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং লড়াই করতে পারছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রে তেমনটা আমরা দেখা যায় না।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চোখ দিয়ে দেখলে কে তাদের শত্রু, কে মিত্র?
তারা দেখে কে আমার জন্য কম ক্ষতিকারক। সেই হিসাব থেকেই তারা কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তির প্রতি সমর্থন জানায়। কেননা, সব রাজনৈতিক দলই তাদের কমবেশি ক্ষতি করেছে।
সহিংসতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের একটি যৌথ শক্তিতে পরিণত হতে হবে। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, হিন্দুরা নিজেরা যদি সংগঠিত হয়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়লে, সহিংসতার শিকার হলে ভারতে চলে যায়। কিন্তু ভারতের মুসলমানেরা তো সহিংসতার কবলে পড়লে পাকিস্তানে চলে যায় না। তারা লড়াই করে টিকে থাকে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে তারা। নীরব থেকে আরও বিপন্ন হলে তারা কী করবে, সেটা বিবেচনার বিষয় হয়। সহিংসতা এলাকার হিন্দুরা না হয় বড় ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচি নিতে পারেনি। কিন্তু ঢাকা শহরের দেড় কোটি অধিবাসীর মধ্যে যদি কমপক্ষে ১০ লাখও হিন্দু ধর্মাবলম্বী থাকে, তাদের মধ্যে দুই লাখ মানুষও যদি সারা দেশের সাম্প্রদায়িক হামলা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামত, তাহলে পুরো ঘটনাই অন্য রকম হয়ে যেত।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রয়েছে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মঞ্চ রয়েছে। তারা তো দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।
তাদের আন্দোলন অনেক দুর্বল। অনেকাংশে তারা রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির পরিচয় দেন। তাদের মধ্যে আছে অনেক বিভাজন। এটা করা উচিত না। সম্মিলিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ হলে হামলাকারী পক্ষ বা রাষ্ট্র সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রাজনীতি করার বিষয়টিকে অন্যভাবে ভাবত। সমাজ বিজ্ঞানী মোহাম্মদ রাফির মতে, অবশ্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাদের পক্ষে যারা আসবে, তাদের সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু তারা নিজেদের যাতে ওই আন্দোলনে প্রাধান্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সব মুসলমান তো খারাপ নয়। সংখ্যালঘুরা যদি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মাঠে নামে, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক মুসলমানকেও পাওয়া যাবে। তাই এই আন্দোলনে সবার আসার সুযোগও রাখতে হবে, একে নিছক সম্প্রদায়নির্ভর জোট করে রাখলে চলবে না।
সংখ্যালঘু আক্রমন বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা খুব প্রয়োজন। মানুষকে মানবতা বোধ শিখাতে হবে, তাদের মাঝে জাগ্রত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে মসজিদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিয়মিত আলোচনা করতে হবে। সরকারকে ভুমিকা রাখতে হবে বেশী। মিডিয়াতে এই শব্দ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তাদের মাথায় এই শব্দ ঢুকিয়ে দেয়া মানে তাদের করুনা করা। তারা করুনা চাই না। তারা এদেশে তাদের অধিকার নিয়ে বসবাস করতে চায়। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মত তারা ভোট দেয়। তারা সুবিচার পাও্য়ার অধিকার রাখে। তাদের নিয়ে রাজনীতি করা বন্ধ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি সক্রিয় থাকতে হবে, তাহলে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা এড়ানো যাবে। তাই সংখ্যা লঘু শব্দ টি চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। আমরা সবাই বাঙ্গালী। বাঙ্গালী জাতীয়তা বোধ নিয়ে এইদেশের জন্ম। যারা এই জাতীয়তা বোধ ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যা লঘু শব্দটি ব্যবহার করেন, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেন। বাঙ্গালী জাতীর দেশে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু বলতে কিছু নেই।

No comments:
Write comments
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter