১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের অজুহাতে এদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) বসবাসরত সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় যারা ভারতে অবস্থান করেছিল তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তিরূপে গণ্য করা হয়। পরে উল্লেখ করা হয়, '১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ তারিখের মধ্যে যেসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক ভারতে চলিয়া যায় বা ভারতে অবস্থান করে এবং উক্ত তারিখ হইতে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার পর্যন্ত যারা ভারতে গমন করিয়াছে তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়।' কিন্তু ওই তারিখের পরে যেসব নাগরিক পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসেছে তাদের সম্পত্তিও ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। সরকারের খাতায় (রেজিস্ট্রারে) তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি লেখা থাকায় তাদের কাছ থেকে খাজনাও নেয়া হয়নি। এমনকি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি অবমুক্ত না করে অর্পিত সম্পত্তি নামে বহাল রাখা হয়। জরিপকালীন সময়েও এসব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন এক শ্রেণীর লোক তহশিলদারদের উৎকোচ দিয়ে সংখ্যালঘুদের আনাচে-কানাচের সম্পত্তি খুঁজে বের করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করে। শুধু তাই নয় এদেশে বসবাসরত হিন্দুদের সম্পত্তি কোনো অজুহাত ছাড়াই গ্রামকে গ্রাম অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করা হয়। খাজনা নেয়াও বন্ধ রাখা হয়। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। একজন মুসলমান ভারতে বা আমেরিকায় গেলে তার সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয় না। অথচ একজন হিন্দু বিদেশে গেলে তার সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয়। এ কেমন আইন? একই দেশে দুই রকম আইন যা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে বসবাসরত জার্মান নাগরিকদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি করা হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর পরই তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। জার্মানরা ছিল ভিন্ন দেশের নাগরিক। তা সত্ত্ব্বেও তাদের সম্পত্তি যুদ্ধ শেষের পর পরই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়, শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তান এ দুষ্কর্ম করেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কেন নানা অজুহাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করল? সরকারের আমলারা এবং রাজনৈতিক নেতারা শত্রু সম্পত্তি নামের সোনার খনি থেকে কোটি কোটি টাকা উদরস্থ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সরকারকেও ন্যায্য পাওনা রাজস্ব থেকে এরা বঞ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য (২০০১) সালের ১৬ নাম্বার আইন পাস করেছিল। কিন্তু পরে চারদলীয় জোট বিএনপি ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্ত করার কোনো প্রয়োজনই তারা মনে করেনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে পুনরায় অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য ২০১১ সালের ২৩ নাম্বার আইন জারি করে অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির ঘোষণা দেয় এবং অর্পিত সম্পত্তির মালিকরা কীভাবে অবমুক্তির জন্য আবেদন করবেন তারও নির্দেশনা গেজেট মাফিক দেয়া হয়। দেখা যায় যে, খ তফসিল বর্ণিত সম্পত্তির গেজেট বিগত ১৪-০৫-১২ তারিখে প্রকাশিত হয়। যদিও আইন অনুসারে গেজেট প্রকাশের তারিখ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য জেলা কমিটির বরাবর আবেদন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় উক্ত গেজেট প্রকাশিত হওয়ার ২ মাস পর সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয় এ গেজেট এসে পেঁৗছে। ফলে জনগণ মাত্র ২ মাসের সময় পায় আবেদন দাখিলের। তাছাড়া অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির কথা দেশের আপামর জনগণের ৭৫% ভাগই এখনো জানে না। দেশের টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র এবং গ্রামাঞ্চলে মাইক বা ঢোলসহরতের মাধ্যমে বহুল প্রচার প্রয়োজন। তাছাড়া সময়ের বেড়াজালে না আটকিয়ে যতদিন অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির প্রয়োজন ততদিনই নিজ দেশের প্রজাদের জমি অবমুক্তিকরণের সুযোগ দিতে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।
No comments:
Write comments