Flickr

Thursday, 30 December 2010

টিআইবি ও সিনেটর বুজম্যানের বার্তা সরকার উপলব্ধি করবে কী?

টিআইবি ও সিনেটর বুজম্যানের বার্তা সরকার উপলব্ধি করবে কী?
মামলার হাত থেকে বোধহয় আর কারোরই রক্ষা নেই। এবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একই দিনে তিনটি মামলা করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর করা মামলাগুলোর মধ্যে কুমিল্লার আদালতে দায়ের করা মামলা ওইদিনই খারিজ হয়ে যায়। তবে চট্টগ্রামের মামলা দুটিতে টিআইবির কর্মকর্তাদের আদালতে হাজির হওয়ার সমন জারি করা হয়। টিআইবি প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক জরিপ রিপোর্টের কারণে মামলা তিনটি হয়। জরিপ রিপোর্টে বলা হয়, ২০০৭ সালে বিচার বিভাগে দুর্নীতির যে অবস্থা ছিল, ২০১০-এ তার আরও অবনতি ঘটেছে। বিচার বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতে পরিণত হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপদেষ্টারা টিআইবির বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ বলছেন, সরকারের ইমেজ নষ্ট করার জন্য এই রিপোর্ট করা হয়েছে। কেউ বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই টিআইবি জরিপের উদ্দেশ্য। কিন্তু টিআইবির ওপর সরকারের এত ক্ষোভের কারণ কী? টিআইবি তো একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করে আসছে বহু বছর ধরে। সরকারের বিভিন্ন সেবাখাতের ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার ও মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেন তারা। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, টিআইবির প্রতিবেদন শতভাগ নির্ভুল। কিছু ভুল-ত্রুটি থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা বাধাগ্রস্ত করা টিআইবির উদ্দেশ্য হয় কেমন করে? আর বিচার বিভাগের দুর্নীতির কথা কি এই প্রথম প্রকাশিত হলো? খোদ প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন ক'দিন আগে। তিনি বলেছেন, জেলা জজ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে পেশকারদের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক এটর্নি জেনারেল ও সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হকের বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের অনিয়ম সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্টেই শুধু বলা হয়নি, এর আগে বর্তমান প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ অনেকেই বলেছেন। তবে আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে- দেশের মানুষ এখনও বিচার বিভাগকে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে থাকে। এটাই হচ্ছে বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ভরসা। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। বিচার বিভাগের মর্যাদা যাতে আর ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে সবারই নজর দেয়া উচিত।
ব্যারিস্টার রফিকুল হক যথার্থই বলেছেন, বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সহযোগিতা করতে পারে সরকার। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতার পরিবর্তে সরকার যদি বিচার বিভাগে বিদ্যমান দুর্নীতিকেই অস্বীকার করতে চায় এবং কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ রিপোর্টকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত হবে কেমন করে?
সরকারের মন্ত্রীরাতো বললেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই টিআইবির জরিপের উদ্দেশ্য। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইতোমধ্যে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার জবাবদানে সরকার কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কতটা সাফল্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন? প্রসঙ্গত এখানে একটি পত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জন বুজম্যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা এক চিঠিতে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আটকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার অভিযোগ করেছেন। তিনি এই বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করলেও ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) এ্যাক্টকে ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। গত ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে নবনির্বাচিত সিনেটর জন বুজম্যান বলেন, স্বচ্ছ বিচারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে মানদন্ড রয়েছে তা বাংলাদেশের আইনটিতে অনুপস্থিত বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটির বিষয়ে সবচেয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্য ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন, দ্য ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না এবং এই আইনের মাধ্যমে তাদের যে সাজা প্রদান করা হবে তার বিরুদ্ধেও তারা কোন প্রতিকার চাইতে পারবেন না- বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যক্তির মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে যাই থাকুক না কেন, এই জাতীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইনে। অন্যান্য অপরাধ-আইনের ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য তা এই অ্যাক্টের ক্ষেত্রে রাখা হয়নি। আইনটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও রাখা হয়নি, যা সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার হরণের মাধ্যমে করা হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান বলে যে মৌলিক বিধান আছে তাও এখানে খর্ব করা হয়েছে। বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের এবং স্বচ্ছ করার জন্য এই আইনের সংশোধন খুবই জরুরি। সিনেটর বুজম্যান আরো বলেন, এই আইন ও বিচারকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না মর্মে যে বিধান রাখা হয়েছে তা-ই আইনটিতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ বিচারের পরিপন্থী করে তুলেছে।
আইনটি যেহেতু যুগোশ্লাভিয়া ও রুয়ান্ডা যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের আগে প্রণীত হয়েছে, তাই ২০০২ সালে প্রণীত রোম-সংবিধি অনুযায়ী আইনটি সংস্কার করা উচিত। কারণ বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সিনেটর বুজম্যান বলেন, প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচার কাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিতর্ক বাড়বে। সিনেটর বুজম্যান আরো বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো বিষয়ের সাথে জড়িয়ে জামায়াতের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, এতে আইনটির রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, যেহেতু আপনার সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ দলের একনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত, সেহেতু জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করাই হলো ট্রাইব্যুনালের প্রথম কাজ, এ বিশ্বাসই সমাজে এখন বিদ্যমান। আইনটির যথাযথ সংশোধন করে এবং নিরপেক্ষ ও ভয়-ভীতিমুক্ত বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আপনার সরকার ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখবে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নেবে বলে আমরা আশা করি। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠনের উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক বিচার অঙ্গনের অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহের কারণে তারা সবাই উদ্বিগ্ন যে, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হতে পারে। বুজম্যান তার চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আইনটি যথোপযুক্ত সংশোধন করে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় আনার বিষয়ে আপনার সরকার উদ্যোগ নিলে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। আপনাদের এ প্রক্রিয়ায় আমার অফিস যদি কোনো সহায়তা করতে পারে বলে আপনারা মনে করেন, তাহলে দয়া করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে কোনো দ্বিধা করবেন না। জানি না প্রধানমন্ত্রীর অফিস এই চিঠির কি জবাব দেবে। আর '৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন কিংবা আটককৃতদের মৌলিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সরকার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করবে কি না তাও আমরা জানি না। তবে আমরা এ কথা নিশ্চিতভাবে জানি যে, কোন আইনকে শুধু মুখে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বললেই তা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়ে যায় না। আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ হলেই কোন আইন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে পারে। আর কোন আইন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি বিচার কার্যক্রমও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি বিচার কাজে অগ্রসর হয় তাহলে যুদ্ধাপরাধ বিচারের উদ্যোগটি একটি যৌক্তিক পরিণতি পেতে পারে। কিন্তু এখন দেখার বিষয় হলো বিচার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পথে অগ্রসর হবে নাকি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হবে- যেমনটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সিনেটর জন বুজম্যান।
আমরা এখনো একথা বিশ্বাস করতে চাই যে, দেশের সরকার, বিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম, দেশ ও জনগণের কল্যাণে আন্তরিক। আর কল্যাণ ব্রতের এমন অভিযাত্রায় সফল হতে হলে প্রয়োজন পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনের যথা আচরণ। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসনের কথাও উল্লেখ করতে হয়। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো-কাঙ্ক্ষিত কাজগুলো কোন একক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তায় না। কাজগুলো সুনির্দিষ্ট এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও সুনির্দিষ্ট। দেশ ও জনগণের কল্যাণ চাইলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে দায়িত্ব পালনে। এমন অভিযাত্রায় ব্লেম-গেমের কোনো সুযোগ নেই। আর দায়িত্ব পালনের কাঙ্ক্ষিত পথে হাঁটতে হলে প্রথমেই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে সরকারকে। কারণ দেশ ও জনগণের কল্যাণে দায়িত্ব পালনে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যুদ্ধাপরাধ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ যে সব ইস্যু বিরাজ করছে, সেই সব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ও ন্যায্য পরিণতি লাভে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসিকতা পরিহার করা। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এ ক্ষেত্রে কতটা এগিয়ে আসে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Wednesday, 29 December 2010

ঋণ শাপে বর না বরে শাপ?

ঋণ শাপে বর না বরে শাপ?
এন.জি.ও (N.G.O) Non Government Organisation বলতে আমরা বুঝি বেসরকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। আমরা জানি দীর্ঘদিন হল এন.জি.ও গুলো বাংলাদেশে দরিদ্র নিপীড়িত দুঃস্থ, পিছে পড়া অধিকার বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৬কোটি মানুষই এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত। বাংলার সকল দরিদ্র জনগণের ঘরে ঘরে এদের কর্মকান্ড ছড়িয়ে পড়েছে। জানা যায়, এন.জি.ও-এর নিকট থেকে বর্তমানে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। অনেকের মতে আরও বেশী হতে পারে। এর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এন.জি.ও গুলো গরীবের বন্ধু, অসহায় শ্রেণীর জন্য বর ইত্যাদি প্রচারিত হওয়ার পর থেকে তথায় গরীব দুঃখী লোকের ভিড় লেগে গেছে। এন.জি.ও সংস্থার দ্বারা বিপদগ্রস্ত অসহায় লোক উপকার পাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে (এন.জি.ও) তাদের সুদের হার বেশী হওয়ায় বরে শাপে হয়ে গেছে। সুদের হার কমান এবং কিস্তির মেয়াদ বেশী করা একান্ত প্রয়োজন যেমন মাসিক কিস্তি হলে ভাল হয়। তাহলে হতভাগ্য দরিদ্র শ্রেণী উপকৃত হতে পারবে এবং এন.জি.ও গুলোর সুনাম অর্জিত হবে। আর অধিক দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ মাপের পদ্ধতি রাখা দরকার। আরও দরকার ঋণের টাকা গ্রহণের তারিখ হতে কমপক্ষে ২ মাস পরে কিস্তি আদায়ের ব্যবস্থা করা। যেহেতু কোন ব্যক্তি যখন অর্থনৈতিক সংকটের সমস্যায় পতিত হয় তখন উপায়ন্তর না পেয়ে অপরের নিকট থেকে ঋণ পাওয়ার লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে তার সমস্যা সমাধানের জন্য বা চাহিদা মেটানোর জন্য অপর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পেতে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে। এভাবে অর্থ নেয়াকে ঋণ বলে। ঋণের প্রতিশব্দ হতে পারে কর্জ, ধার, দেনা, হাওলাত ইত্যাদি। এই ঋণ কোথায় পাওয়া যায়, তা গ্রাম-বাংলার অধিকাংশ লোকই জানেন। যেমন ধনী শ্রেণীর লোকের কাছে ঋণ, ব্যাংকের কাছে ঋণ এবং এন.জি.ও গুলোর কাছে ঋণ। ধনী শ্রেণীর লোকদের কাছে এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ পাওয়া কঠিন কাজ। কারণ ধনী শ্রেণীর কাছ থেকে ঋণ নিলে চড়া সুদ দিতে হয় এবং ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয়। উপরন্তু সাধারণ মানুষ ধনীক শ্রেণীর কাছে এবং ব্যাংকের কাছে যেতে সাহস পায় না। ফলে সাধারণ লোকজন সহজ পন্থার দিকে এগুতে বাধ্য হয়। এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানগুলো ল্যান্ড মর্গেজ বা সম্পত্তি বন্ধক ছাড়াই কিস্তিভিত্তিক ঋণ দেয়ার জন্য ব্যবস্থা চালু করেছে। সাধারণ মানুষ সহজ পদ্ধতির ঋণ সম্মোহনীর টানে এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ পাওয়াকে আশীর্বাদ স্বরূপ বর মনে করছে এবং দলে দলে লোকজন ঝুঁকে পড়ছে। বিষয়টি আমরা সাধারণ ভাষায় বলতে পারি-বরশীতে যেমন কেঁচো লাগিয়ে পানিতে ফেললে পানির মধ্যে কেঁচো আলো ছড়িয়ে মাছকে আকৃষ্ট করে। ক্ষুধার্ত মাছ ঐ কেঁচোকে খাদ্য হিসাবে খেতে এসে আটকে যায়। তদ্রুপ ঋণ নামক বরশীতে দরিদ্র লোকেরা ঋণ গ্রহণ করে আটকে যাচ্ছে। ঋণের জন্য স্বাধীনভাবে চলাফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঋণের কারণে আরাম আয়েশ হারাম হয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু, বান্ধব, আনন্দ ভ্রমণ জীবন থেকে দূর হয়ে যাচ্ছে। সার্বক্ষণিক চিন্তা আর চিন্তা। সাপ্তাহিক কিস্তির চিন্তা। এন.জি.ও প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় স্তব্ধ করেছে জীবন যাত্রা। কিস্তির টাকা পরিশোধ না করতে পেরে অনেকে দেশে-বিদেশে আত্মহত্যা করেছে। ভিটা ছাড়া হয়েছে, বাসস্থানের টিন খুলে নিয়ে গেছে, গরু, ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। এরূপ ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। মুরুববীদের মুখে শোনা যায় যে, সেই লোক সবচেয়ে বেশী সুখী যার কোন ঋণ নেই। ঋণে জর্জরিত লোক হলো সবচেয়ে দুখী লোক। ঋণ মানুষকে পঙ্গু করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে ঋণের ভাল দিকটা খুব কম। পক্ষান্তরে ঋণের বিপক্ষের সমর্থক বেশী। অনেকের মতে ঋণ এসেছিল আমাদের দেশে আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে দেখা যাচ্ছে ঋণ হচ্ছে এক প্রকার অভিশাপ অর্থাৎ ঋণ শাপে বর না হয়ে বরে শাপ রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
সামাজিকভাবে ধর্মীয়ভাবে ঋণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দেখা যায় যে, ঋণ হচ্ছে মন্দের ভাল অর্থাৎ মন্দকে যদি আমরা একটি বিষধর সর্প মনে করি। তাহলে দেখা যায়, একজন সাপুড়ে তার জীবন বাঁচার তাগিদে বিষধর সর্প নিয়ে খেলা করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আবার ঐ বিষধর সাপের হাতেই অনেক সময় সাপুড়ের মৃত্যুও হতে দেখা গেছে। কাজেই ঋণ নিয়ে অনেকেই উপকৃত হয়েছে এরকম উদাহরণও আছে। তবে তা নগণ্য হতে পারে। হ্যাঁ, তবে একটি কথা বলা যায়-দক্ষ সাপুড়ে যেমন সাপ নিয়ে খেলা করে অর্থ উপার্জন করে দিবিব সংসার চালিয়ে আরাম আয়েশে আনন্দে দিন কাটায়, সাপ নিয়ে খেলা করায় তার কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু অদক্ষ সাপুড়ে সাপ নিয়ে খেলা করতে করতে অনেক সময় সাপের হাতে মৃত্যু হয়। দক্ষ সাপুড়ের সংখ্যা কম, তদরূপ ঋণ নিয়ে যারা সঠিকভাবে সঠিক পথে সঠিক পরিকল্পনায় কাজ করছে তারাই দক্ষ সাপুড়ের মত লাভবান হতে পেরেছে। আর অ-দক্ষের অবস্থা হয় শোচনীয়, করুণা, মর্মস্পর্শী এবং মৃত্যুপথের যাত্রী ছাড়া আর কিছু নয়। এই ঋণের বিষয় নিয়ে সারাদেশব্যাপী আলাপ আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে চলছে। পত্র-পত্রিকায়, বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে। অত্র বিষয় নিয়ে সুধী সমাজ, গবেষক, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী মহোদয়গণ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বক্তৃতা, ভাষণ, আলোচনা পর্যালোচনা করে চলেছেন।
যেমন-মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন ‘‘দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যর্থ ক্ষুদ্রঋণ দানকারী এন.জি.ওগুলো’’ (দৈনিক সংবাদ তারিখ-০৭/১১/১০)। আরও বলেছেন ‘‘ক্ষুদ্র ঋণের চোরাবালিতে অসংখ্য মানুষ নিমজ্জিত’’। (কালের কণ্ঠ, তারিখ-০৭/১/১০ ইং), সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহিদ বলেন, ‘‘ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে সাফল্য অর্জন হয়নি। তাই ক্ষুদ্র ঋণের প্রয়োজন নেই। তিনি আরও বলেন, ঋণের টাকা আদায়ের জন্য ঘরের টিন খুলে নেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। (দৈনিক কালের কণ্ঠ, তারিখ-০৮/১১/২০১০) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দারিদ্র বিমোচনের নামে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দরিদ্র মানুষের রক্ত চুষে খাওয়া হচ্ছে। এ ঋণ নিয়ে কেউ দরিদ্রতা থেকে সর্বাত্মক মুক্তি পাননি। গরীব মানুষের রক্ত চুষে বেশি দিন টেকা যায় না। সেইটাই প্রমাণিত হয়েছে। (দৈনিক কালের কণ্ঠ,তারিখ-০৬/১২/১০ ইং)
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি যে, স্বাধীনতার পূর্বে সাধারণ মানুষ কেবল ক্ষুধার জ্বালায় এক মুঠো ভাতের চেষ্টা করে আসছিল। প্রয়োজনে তারা মহাজনের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে জীবন যাপনের চেষ্টা করত। চড়া সুদে মহাজনের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে পরে আর ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে সর্বশান্ত হয়েছে বহু কৃষক পরিবার। এর বহু নমুনা আছে। এই লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও শোষিত কৃষক প্রজার মুক্তি দাতা হিসেবে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে আবির্ভুত হয়েছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। শেরে বাংলা কৃষক ও প্রজা সাধারণের প্রাণের বন্ধু ছিলেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঋণ শালিশী বোর্ড গঠন করে বঞ্চিতদের, কৃষকদের, দরিদ্র শ্রেণীর লোকজনদের ঋণ থেকে বাঁচার পথ বের করে দিয়েছিলেন। তিনি দরিদ্র মানুষকে ঋণ থেকে মুক্ত করেছিলেন। এই মুহুর্তে আমাদের দেশে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের মত জনদরদী মানুষ প্রয়োজন। ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র মানুষকে আত্মনির্ভর করে তোলা। কিন্তু সে ঋণ যদি দরিদ্র মানুষের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দেয় তবে ঐ ঋণের প্রয়োজন কি?

Tuesday, 28 December 2010

বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত দেখতে চাই

বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত দেখতে চাই
দেশের বিচার বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাত হিসেবে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে দেশে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছে। টিআইবির রিপোর্টের ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মন্ত্রী ও সরকারি ঘরানার লোকজন। আর টিআইবির রিপোর্টকে বাস্তবভিত্তিক বলে বিবেচনা করছেন খ্যাতিমান আইন বিশেষজ্ঞসহ দেশের সচেতন মহল।
বিচার বিভাগ দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং সমাজকে মানুষের বাসযোগ্য রাখার ব্যাপারে বিচার বিভাগের গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না। অন্যকথায় বলা যায়, বিচার বিভাগই হলো মানুষের শেষ ভরসাস্থল। বিচার বিভাগকে মানুষ শুধু সম্মানই করে না, একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠান বলেও মনে করে থাকে। তাই বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে মানুষ তখন শুধু অবাক হয় না, মর্মাহতও হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, টিআইবির মত প্রতিষ্ঠান এখন জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে বলছে, দেশের বিচার বিভাগ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাত। সরকার অবশ্য বিষয়টি মানতে নারাজ। উল্টো মন্ত্রীরা এখন টিআইবিকে নানাভাবে মন্দ বলছেন। এমন কি টিআইবিকে যুদ্ধাপরাধীদের মদদগার হিসেবে চিহ্নিত করারও প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এমন ধারার তৎপরতায় কি টিআইবির জরিপ মিথ্যা প্রমাণিত হবে? আসলে একটি জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে তো বস্তুনিষ্ঠ আর একটি জরিপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ পথে অগ্রসর না হয়ে শুধু বিষোদগারের মাধ্যমে কি সরকার বিচার বিভাগের ইমেজ সমুন্নত করতে সক্ষম হবে। পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, বিচার বিভাগ নিয়ে মানুষের মনে এতদিন যে প্রশ্ন তৈরি হয়ে আসছিল টিআইবির রিপোর্টে তা ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি নিজেও বলেছেন, জেলা জজ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে পেশকারের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, সরকারি দল বরাবরই টিআইবি রিপোর্টকে ‘ষড়যন্ত্রের অংশ' মনে করে প্রত্যাখ্যান করে, আর বিরোধী দল তা গ্রহণ করে থাকে। এ থেকেও রিপোর্টের বাস্তবতা উপলব্ধি করা যায়। প্রসঙ্গত এখানে সাবেক এটর্নি জেনারেল ও সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের অনিয়ম সম্পর্কে টিআইবির রিপোর্টেই শুধু বলা হয়নি, এর আগে বর্তমান প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ অনেকেই বলেছেন। তবে আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে-- দেশের মানুষ এখনও বিচারবিভাগকে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করে থাকে। এটাই হচ্ছে বিচারবিভাগের সবচেয়ে বড় ভরসা। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব বিচার বিভাগেরই। বিচার বিভাগের মর্যাদা যাতে আর ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকে সবারই নজর দেয়া উচিত। আমরাও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত দেখতে চাই। অবশ্য এখন আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে প্রয়োজন হবে কিছু কাজও। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কাঙ্ক্ষিত কাজে কতটা নিষ্ঠাবান হন সেটাই দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার

নূহ (আঃ)-এর কিস্তি পরিষ্কার আওয়ামী লীগ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার
হযরত নূহ (আঃ)-এর কিস্তির গল্প পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে। আল্লাহর এই নবীর সম্প্রদায়ের পথভ্রষ্ট লোকেরা যখন তার নবুয়তকে অস্বীকার করে তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করলো, আল্লাহর পথ নির্দেশকে অস্বীকার করে অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনকে সামাজিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত করলো এবং নূহ (আঃ) তাদের সৎপথে ফিরিয়ে আনার সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেন তখন তিনি আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন। আল্লাহ তাদের উপর গযব নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং নূহ (আঃ) কে প্রলয়ঙ্করী বন্যার খবর দিয়ে একটি বিশাল জাহাজ তৈরির নির্দেশ দিলেন যাতে করে আল্লাহর অনুগত বান্দা এবং পশু-পাখীদের তাতে তুলে প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কখন সেই মহাপ্লাবন আসবে তাও তিনি তার নবীকে জানিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘‘যখন নির্দেশ আসবে, উনুন বিস্ফোরিত হবে এবং সেখান থেকে প্রবল বেগে তরল পদার্থ বের হতে থাকবে’’ তখন নৌকায় তুলে নেবে এক জোড়া করে প্রত্যেক প্রাণী, তোমার পরিবার, তবে পূর্বে যার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আছে সে নয়। আর তুমি জালেমদের ব্যাপারে আমাকে বলো না, তারা ডুববে। যখন তুমি তোমার সাথীদের নিয়ে নৌকায় উঠবে, তখন বলবে সকল প্রশংসা তো আল্লাহর, যিনি জালেম সম্প্রদায় থেকে উদ্ধার করলেন এবং বল আমাকে, হে আমার রব আমাকে কল্যাণকরভাবে অবতরণ করাও আর তুমিই সর্বোত্তম অবতরণকারী’’ (সূরা মু'মিনুন)।
হযরত নূহ (আঃ) কাঠ দিয়ে বিশাল জাহাজ তৈরি করেছিলেন। এই জাহাজ দেখে তার সম্প্রদায়ের বিভ্রান্ত লোকদের উন্মত্ততা আরো বেড়ে গেল। তারা তাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। তারা নূহ (আঃ)-এর কাছে গিয়ে বললো, আমরা যদি আমাদের আচরণ ও জীবন পদ্ধতির সংশোধন না করি তাহলে তুমি আমাদের মহা বিপর্যয়ের ভয় দেখিয়েছ। আমরা এই বিপর্যয় এখনি দেখতে চাই, তুমি তা নিয়ে আস। তা না হলে আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করবো। তারা নূহকে অবিশ্বাস করলো। তাদের ধারণা, টাইগ্রীস নদী বিধৌত মেসোপটেমিয়া অববাহিকার উজানে সমুদ্র থেকে প্রায় ৮০০-৯০০ মাইল দূরে একটি ভূখন্ড প্লাবিত হয়ে সমুদ্রের রূপ ধারণ করবে এবং তার উপর নূহের তৈরি জাহাজ সদৃশ সুবিশাল এই নৌকা ভাসবে, এটি নিতান্তই হাস্যকর একটি বিষয়। এই নৌকাকে তারা আরো হাস্যকর করার জন্য গণশৌচাগারে পরিণত করলো। নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই গিয়ে সেখানে পায়খানা পেশাব করা শুরু করলো। নূহ বিদ্বেষ তাদের এতই চরমে উঠলো যে, তার তৈরি নৌকায় তারা পায়খানা পেশা করাকে পুণ্যের কাজ বলে মনে করতে থাকলো। পায়খানা পেশাবে নৌকা শেষ পর্যন্ত কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেল। এই অবস্থায় বয়সের ভারে ন্যুব্জ শতবর্ষী রোগাক্রান্ত এক বৃদ্ধা নাতি-নাতনীর সাহায্য নিয়ে এই পুণ্যে শরিক হবার জন্যে নৌকার কিনারে গিয়ে যেই বাহ্য করতে বসলো তখনি শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে মলের ভেতর পড়ে গেল। তার সাথী নাতি-নাতনীরা হায় হায় করতে লাগলো। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো যে, এই বৃদ্ধা মলে ডুবে তার সকল প্রকার জ্বরা, ব্যাধি ও শারীরিক অসামর্থ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে যৌবনের উচ্ছবলতা ও শক্তি সামর্থ্য ফিরে পেয়েছে। সে নৌকা থেকে নেমে তার আরোগ্যের কথা সবাইকে জানিয়ে দিল। মুহূর্তে খবরটি ছড়িয়ে পড়লো। নূহের কিস্তির মল এক মহৌষধে পরিণত হলো। আবাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মল ভরা কিস্তিতে শরীর ভেজানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো। হাজার হাজার লোক এভাবে কিস্তির মল গায়ে মেখে রোগমুক্ত হতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, গায়ে মাখার জন্য মল আর পাওয়া গেল না। তখন লোকজন নৌকা ধুয়ে সে পানি গায়ে মাখল এবং একই ফল পেলো। এভাবে নৌকাটি সম্পূর্ণ পাক-পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত ছিল। মহান আল্লাহ তাদের দিয়েই তার নির্দেশে তার নবীর তৈরি কিস্তি পরিষ্কার করালেন যারা তাকে অপবিত্র করেছিল।
ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলামের গ্রেফতার, রিমান্ড, নির্যাতনের কথা পাঠকরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। জামায়াতের অন্যান্য নেতাদের ন্যায় মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার এক ঠুনকো ও বানোয়াট মামলায় তাকে গত আগস্ট মাসে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীকালে গোয়েন্দা অফিসে বসে তার বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলা রুজু করা হয় এবং তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। বলাবাহুল্য, ইতোপূর্বে জনাব রফিকুল ইসলাম খানকে সরকার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও স্থল, নৌ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিদেশ যাত্রা বন্ধের লক্ষ্যে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জনাব খান চার বছরের শিশু ছিলেন এবং তার পিতা স্বয়ং একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয় এবং সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষয়টি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার তার বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ মামলা না দিয়ে অপরাপর মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় তাকে হয়রানি করা অব্যাহত রেখেছে। সব মামলায় জামিন পাওয়া সত্ত্বেও জেলগেট থেকে পুনরায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ঐসব মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি এমন একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে রিমান্ড চাওয়া হয় এবং বলা হয় যে, তিনি গত ১৩ নবেম্বর আরামবাগে নটরডেম কলেজের কাছে সদলবলে গিয়ে যাত্রীবাহী বাসের উপর হামলা করেছেন, ভাঙচুর করেছেন এবং নিজ হাতে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।
আদালতে পুলিশ অফিসারের এই বক্তব্য সরকারি উকিলরাও জোরালোভাবে সমর্থন করায় এই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জনাব খানের আইনজীবীরা আদালতে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করে অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং জানান যে, বর্ণিত সময়ে জনাব রফিকুল ইসলাম খান গ্রেফতার অবস্থায় জেল কাস্টোডিতেই ছিলেন। অর্থাৎ অভিযোগটি পুরোপুরিভাবে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পুলিশ কর্মকর্তার আনীত অভিযোগ যে মিথ্যা তা আদালতেই প্রতিপন্ন হয়েছে। আদালত এ প্রেক্ষিতে রিমান্ড আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, একজন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা ও প্রতিহিংসামূলক একটি অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া ও তা সমর্থন করার জন্য আদালত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। দেশের প্রচলিত ফৌজদারী দন্ডবিধি অনুযায়ী এটা তাদের প্রাপ্য ছিল, তারা আদালতের পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করেছেন। তাদের শাস্তি না দেয়ায় আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিভাবে সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের অন্ধ করে দেয় এবং তাদের বিবেক-বিবেচনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তার আরেকটি দৃষ্টান্ত দেখলাম অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায়। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ তার নাগরিকত্বের বিরোধিতা করে আদালতে নিবেদন পেশ করে বলেছিল যে অধ্যাপক গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতায় দেশে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির ন্যায় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এর প্রমাণ হিসেবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু রিপোর্ট এবং জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল টিক্কা খানের সাথে তার সাক্ষাতের একটি ছবি আদালতে পেশ করা হয়েছিল। বিচারপতি ইসমাইল উদ্দিন সরকার তার রায়ের ২৪-২৫ পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে তার মন্তব্য ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন এভাবে,
“The petitioner (Prof. Golam Azam) also challenged the authenticity of some of the events mentioned in the subsequent publications. Except some news item and one photographs showing that the petitioner net General Tikka Khan or General Yahdya Khan there is nothing to directly implicate the petitioner in any of the atrocities alleged to have been perpetrated by the Pakistan Army or their associates, the Rajakars, Al Badrs or the Al Shams… We do not find anything that the petitioner was in any way directly involved in perpetrating the alleged atrocities during the war of independence.” বিজ্ঞ বিচারপতির মন্তব্য ও বিশ্লেষণ এখানে অত্যন্ত পরিষ্কার। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীর সহযোগিতায় সংঘটিত নির্যাতনের স্বপক্ষে পেশকৃত দলিল দস্তাবেজ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রেক্ষাপটে মাননীয় আদালতের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যুদ্ধপরবর্তী প্রকাশনাসমূহে উল্লেখিত কতিপয় ঘটনার সত্যতা ও যথার্থতাকে আবেদনকারী (অর্থাৎ অধ্যাপক গোলাম আযম) চ্যালেঞ্জ করেছেন। জেনারেল টিক্কা খান অথবা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাতের ছবি ও কতিপয় নিউজ আইটেম ছাড়া আবেদনকারী অধ্যাপক গোলাম আজমকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস-এর কথিত নির্যাতনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ছাড়া কোনওভাবে সরাসরি জুলুম-নির্যাতন ও বর্বরোচিত কোন কাজে জড়িত ছিলেন এমন কিছু আমরা পাইনি (অনুচ্ছেদ নং ১২৬)।
বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন কোনও অপরাধের সাথে যখন তাকে সম্পৃক্ত করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয় তখন এটর্নি জেনারেল পুনরায় তার স্বাধীনতা পরবর্তী আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন যে হাইকোর্ট ডিভিশনে তিনি পর্যাপ্ত কাগজপত্র দাখিল করতে পারেননি। আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি অধ্যাপক আবু সায়িদ লিখিত একটি পুস্তকের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান যে, অধ্যাপক গোলাম আযম হজ্বের পরে (১৯৭২-৭৩) একটি রাজনৈতিক-সামরিক মিশন নিয়ে সউদী আরব সফর করেছেন এবং সউদী সরকার ও লিবীয় সরকারকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তার অভিযোগের সমর্থনে এটর্নি জেনারেল জামায়াত কর্তৃক প্রকাশিত একটি পুস্তকও আদালতে পেশ করেন। পুস্তকটি অধ্যয়ন করে দেখা যায় যে অধ্যাপক গোলাম আযম বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফর করেছেন এবং নবসৃষ্ট বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। এই পুস্তকের বর্ণনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে সহযোগিতার লক্ষ্যে তিনি এমনকি রাবিতা-ই-আলমে ইসলামীর মাধ্যমে এসব দেশ থেকে আর্থিক সাহায্যও সংগ্রহ করেছেন। এই অবস্থায় বিজ্ঞ আদালত এটর্নি জেনারেল অভিযোগকে গালগল্পভিত্তিক অভিহিত করে (hearsay) পেশকৃত প্রমাণপত্র প্রত্যাখ্যান করেছেন। এখন পাঠকরাই বলুন, আওয়ামী লীগের অভিযোগ আইন ও সততার ধোপে টিকে কিনা। আওয়ামী লীগ করলে আইনজীবী হোক আর রাজনীতিবিদ সম্ভবত: ফ্যাসীবাদ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তাদের উন্মাদ করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে তোলে। কেউ কেউ বলে তাদের মাথার বুদ্ধি হাঁটুতে নেমে আসে। রফিকুল ইসলাম খান ও অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় তারা তার প্রমাণ দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধের মামলাসমূহেও তারা উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে সেই প্রমাণ দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
সরকারের হাতে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে, মন্ত্রী মিনিস্টারদের এই ধরনের ঘোষণার প্রেক্ষাপটে জামায়াতের পাঁচ জন শীর্ষ নেতাকে ছয় মাস আগে গ্রেফতার করা হয়। অদ্যাবধি তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটাররা সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ তৈরি করতে পারেননি। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের নামে প্রহসনও হয়েছে। কথিত অকুস্থল থেকে ৭/৮ মাইল দূরের বাসিন্দা দলীয় কর্মীদের এনে তদন্ত দলের সামনে সাক্ষ্য দেয়া হয়েছে। এমন লোক সাক্ষ্য দিয়েছেন যারা ঘটনার সময় শিশু ছিলেন। সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের নিয়ে প্রসিকিউটার সাহেবরা তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়েছেন, তা জয় করেছেন, মিডিয়ার সামনে তা তুলে ধরেছেন। এলাকার নিরপেক্ষ লোকদের কাছে ঘেঁষতে দেননি। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে ট্রায়ালটা ট্রাইব্যুনাল আদালতের নয়, রাস্তায় বা মিডিয়াতে হবে। অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবীদের কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। সত্য কথা বললে আইনজীবীরাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার শিকার হচ্ছেন। অভিযুক্ত রাজনীতিক, আলেম-উলামা তাদের আত্মীয়-স্বজন, আইনজীবী সবাই এখন সরকারি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দেশ-বিদেশের সাথে তাদের যোগাযোগ করতে দেয়া হচ্ছে না। গোয়েন্দারা তাদের অনুসরণ ও হয়রানি করছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেশে তারা পাচ্ছে না, বিভিন্ন রাষ্ট্রের আর্কাইভ থেকে সেগুলো সরকার জোগাড় করার চেষ্টা করছেন। তার এই তথ্যটি অদ্ভুত। অপরাধ ঘটেছে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আর তার প্রমাণ রয়েছে এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা আমেরিকার বিভিন্ন দেশের আর্কাইভে। মাথা খারাপ হয়ে যায়নি এ ধরনের কেউ কি একথা বিশ্বাস করতে পারেন? যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে বিচার নিয়ে, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে এবং অভিযুক্ত ও সম্ভাব্য অভিযুক্তদের নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন তাতে এই ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। মামলা দিয়েও সরকার আশ্বস্ত হতে পারছেন বলে মনে হয় না। রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে অভিযুক্ত নেতাদের চরিত্র হননের লক্ষ্যে যে কসরৎ পরিলক্ষিত হচ্ছে কোনও সভ্য দেশে তা দেখা যায় না। বিচার যদি রাস্তায় আর মিডিয়ায় করতে হয় তাহলে আদালতের প্রয়োজন কি? আবার বিচার বিভাগ সম্পর্কে টিআইবি যে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তা দেখার পর বিবেকসম্পন্ন যে কেউই এখন বলতে বাধ্য হবে যে, এই দেশে এই সরকারের আমলে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। ইনসাফ ও আদলের পরিবেশ এখানে অনুপস্থিত। কাজেই যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক কোনও বিচারালয়ে অনুষ্ঠিত হওয়াই বাঞ্চনীয়। আমার মনে হচ্ছে সরকার যে পথে যাচ্ছে, স্বখাত সলিলেই তাদের ডুবতে হবে। আওয়ামী লীগের মল আওয়ামী লীগেই পরিষ্কার করবে। দুনিয়াকে ধোঁকা দেয়ার কাজ বেশি দিন চলতে পারে না।
শেখ মুজিবর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেছিলেন। এ জন্য ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যকারিতা সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকা গত ২৫ ডিসেম্বর' বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার সময় যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী নিরেনবার্গের পরামর্শ নিয়েছিলেন শীর্ষক একটি নিবন্ধ ছেপেছে, এই নিবন্ধে কি পরিস্থিতিতে এবং কোন দর্শনের ভিত্তিতে শেখ মুজিবর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা বিধৃত করা হয়েছে। ক্ষমাও বিচারের একটা অংশ। শেখ মুজিবের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার মরহুম পিতা প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাকে অস্বীকার করে মূল যুদ্ধাপরাধীদের পরিবর্তে তার এ দেশীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পিতার আমলে প্রণীত আইনে বিচার শুরু করেছেন। তার প্রজ্ঞার প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু বিচার কয়বার হয়। তার শাসনামলের দু'বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। দালাল আইনে এ দেশে কাদের কাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাদের তালিকা অদ্যাবধি তারা তৈরি করতে পারেননি। যাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই কখনো থানায় আসেনি ৪০ বছর পর মরা হাড়গোড় দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাতে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। এতে যেমন স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতিমালা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হচ্ছে তেমনি জনমনে ক্ষোভ বিক্ষোভও দানা বেঁধে উঠছে। হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস সৃষ্টি প্রভৃতির মাধমে সরকারি দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রতিদিনই যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাহাড় সৃষ্টি করে চলেছে সেখানে ৪০ বছর আগের মানবতাবিরোধী অপরাধের বানোয়াট অভিযোগে রাজনৈতিক প্রতিদ্বনদ্বীদের বিচারের নামে প্রহসন ক্ষমতাসীনদের দেউলিয়াপনাই শুধু নয়, আধিপত্যবাদী শক্তির ছত্রছায়ায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের নির্লজ্জ অনুশীলন বলেই মনে হয়।
যুদ্ধাপরাধ আইনে স্বচ্ছ বিচারের বিশ্বস্বীকৃত মানদন্ডের অনুপস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে মার্কিন সিনেটর জজ বুজম্যান সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে একটা চিঠি লিখেছেন। চিঠিটির বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী ঘরানার পত্রিকাগুলো সম্ভবত: লজ্জায় তা ছাপেনি। এর আগে আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশনসহ বিশ্বের খ্যাতনামা আইনজ্ঞ এবং যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ এর বিভিন্ন ত্রুটি ও অমানবিক ধারার উল্লেখ করে সংশোধনীর সুস্পষ্ট সুপারিশ পেশ করেছিলেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের প্রতিনিধি ড. স্টিফান ফ্রোয়েন প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, "The trial must meet the international standareds and due process must be ensured where an accused has the right to depend and appel. It should be an open trial and observers have access to it. Some journalists from Europe world come to see and report the trial proceedings." এর অর্থ সোজা। বিচারের আন্তর্জাতিক মান বজায় না থাকলে এই বিচার ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিচার প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থন ও আপিলের সুবিধা থাকতে হবে। এই বিচার হতে হবে উন্মুক্ত এবং তাতে পর্যবেক্ষকদের উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইউরোপের কিছু সাংবাদিকও বিচার প্রক্রিয়া দেখার ও রিপোর্ট করার জন্য এতে উপস্থিত থাকবেন। তার প্রস্তাবকে আমি চমৎকার প্রস্তাব বলে মনে করি। সরকার এক্ষেত্রে যে জট সৃষ্টি করেছেন তা তাদেরই এখন খুলে দিতে হবে।

সাংস্কৃতিক গোলামী চুক্তির বাস্তবায়ন

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছরের শুরুতে ভারত সফরে গিয়ে সে দেশের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি করে এসেছেন। এর মধ্যে অন্যতম একটি চুক্তি হল ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি। এর মাধ্যমে ভারত তার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করেছে। ভারতের অপসংস্কৃতিতে বাংলাদেশের বাজার এখন সয়লাব হয়ে আছে। আমাদের সরকার মহোদয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের দরজা ভারতের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে আসল। ভারতের সাথে করা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ট্রানজিট চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রথমেই বিরোধীদলকে দমনের পথ বেছে নিলেন। কেড়ে নিলেন তাদের মিছিল, মিটিংসহ গণতান্ত্রিক সব অধিকার। তাদেরকে গৃহবন্দী করে সরকার একের পর এক চুক্তি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ জন্য সরকার বিরোধীদলের শীর্ষ নেতাদেরকে খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে গ্রেফতার করে বিনা অপরাধে কারাগারে ফেলে রাখছে। আমরা জানতে পারছি ভারত সরকার নাকি বাংলাদেশের দেখাশুনার জন্য সে দেশের প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীকে দায়িত্ব দিয়েছে। আমাদের সরকার এখন প্রণব বাবুর দিক-নির্দেশনার আলোকেই দেশ চালাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার মূলত ভারতের পরিকল্পনা। কাদেরকে কখন কিভাবে গ্রেফতার করতে হবে এর ছক ভারত নির্বাচনের পরই এঁকে দিয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে। ভারত শুধু আমাদের সম্পদ লুট আর সীমানা দখলের পরিকল্পনাই করেনি। বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করতে তারা সুদূর প্রসারী এক সূক্ষ্ম পরিকল্পনাও করেছে। যার বাস্তব প্রমাণ বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি। এর মাধ্যমে ভারত তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে ভারতের সাথে করা সাংস্কৃতিক চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু করছে। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হলো আমাদের এই বাংলাদেশ। এদেশে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করে আসছে দেশীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি ইসলামী সংস্কৃতির চর্চাও। অপসংস্কৃতির উত্তাল সাগরের মধ্যেও এদেশে গড়ে উঠেছে বহু ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন। যারা সুস্থ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার তাদেরকে সহযোগিতা না করে উল্টো তাদের চলার পথে কাঁটা ছড়িয়ে দিতে শুরু করছে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তাদের জাতিসত্তার পরিচয় তুলে ধরতে চায়। কিন্তু আমরা হলাম এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আমদানি করা সংস্কৃতির পূজা করতেই আমরা বেশি ভালবাসি। পাশ্চাত্যের লেংটা সংস্কৃতির চর্চা করে আমরা এখন লেংটা হয়ে পথে বসেছি। সংস্কৃতি চর্চার নামে দেশে আজ যা চলছে তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। একটি মুসলিম দেশে সংস্কৃতির নামে যে ধরনের অশ্লীল বেহায়াপনা চালু হয়েছে তা আমাদের জাতিসত্তাকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা যেন একেবারে ভুলে গিয়েছি আমাদের পরিচয় ও অতীত ইতিহাস। আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের কিছু গোলাম রয়েছে যারা সর্বদাই এ কাজে আমাদের তরুণ-তরুণীদেরকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। তারা মুসলমান নামটা ধারণ করে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাশ্চাত্যের লেংটা সংস্কৃতি বিস্তারের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের টার্গেট আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েও যুব সমাজের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেয়া। আর হচ্ছেও তাই। জাতি হিসাবে আমরা আজ একেবারে পঙ্গু। বাসা থেকে বের হয়ে এক কিলোমিটার পথ হাঁটলে এর মধ্যে কমপক্ষে ৩/৪টি সিডির দোকান পড়ে। যেগুলোতে রাখা হয় শুধু চরিত্র বিধ্বংসী অশ্লীল সিনেমা ও নাটকের সিডি। আর এখন তো হলো আকাশ সংস্কৃতির যুগ। ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের দোকান থেকে সিডি নিতে হয় না। ডিসের মাধ্যমে টেলিভিশনেই সবকিছু তারা দেখতে পায়। দেশী-বিদেশী অনেক স্যাটেলাইট টিভি দেখার সুযোগ রয়েছে। সুন্দরী মেয়েদের লেংটা ছবি দেখতে কার ভাল না লাগে। আর তার সাথে যদি থাকে আরেকজন সু-দর্শন পুরুষ তাহলে তো হয়ে যায় গুড-বেটার-বেস্ট। লজ্জা-শরম বলতেও একটা কথা ছিল। কিন্তু তাও আজ সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে। আজকালের নাটক সিনেমাগুলোতে যা ইচ্ছে, নায়িকা এমন ধরনের শর্ট পোশাক পরে যাতে তার গোপন অঙ্গগুলো পুরুষে দেখতে পায়। একটা ছেলে একটা অর্ধনগ্ন সুন্দরী মেয়েকে জড়ায়ে ধরে চুমু খাচ্ছে, দুইজনে মিলে ঢলাঢলি করছে, শরীরের কাপড় খুলে পড়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্যগুলো আমাদের মুসলিম পরিবারের সদস্যরা বসে বসে দেখছে। এমনকি মা-বাবা, ভাই-বোন একসাথে বসে আনন্দের সহিত এগুলো উপভোগ করে। ছি....। তাদের কী একটুও লজ্জা করে না। এ নোংরা দৃশ্যগুলো দেখার পর তারা চোখাচোখি বসে কথা বলে কিভাবে। এই সমস্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা কিভাবে ভাল মানুষ হবে। এগুলো দেখার পর একটা ছেলে বা মেয়ে কোনভাবেই সুস্থ থাকতে পারে না। আর বিদেশী সিনেমাগুলোতে তো নায়ক-নায়িকারা পর্দার সামনে হাজির হয় একেবারে উলঙ্গ হয়ে। ভেঙ্গে পড়েছে আজ পরিবার ব্যবস্থা। অধিকাংশ পরিবারগুলোতে এখন শান্তি নেই। অশান্তির আগুন যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। ছেলেমেয়েরা আজকাল মা-বাবা বা মুরববীদের কথায় চলে না। তারা এখন অনুসরণ করে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদেরকে। নায়িকা কোন পোশাকটা পরে নৃত্য করেছে সেটাই তারা পরবে। নায়িকা কিভাবে কথা বলেছে তারাও ছেলেদের সাথে সেভাবে বলার চেষ্টা করে। মূলত সিনেমার নায়ক-নায়িকারাই হলো এখন ছেলেমেয়েদের পথ চলার আদর্শ। আমার কাছে এমন অনেক পরিবারের তথ্য আছে যাদের ছেলে-মেয়েরা এই নোংরা সংস্কৃতি চর্চার কারণে এখন সম্পূর্ণভাবে বিপথগামী হয়ে পড়ছে। মা-বাবা এখন শুধু চোখের পানি ফেলে আর আল্লাহর কাছে দোয়া করে। এই নোংরা সংস্কৃতি এখন মোবাইলের মাধ্যমে সমাজে ভাইরাসের মত ছড়াচ্ছে। অশ্লীল গান-বাজনার জন্য এখন আর সিডির দোকানে যাওয়া লাগে না। মোবাইলের মেমোরিতেই শতশত গান লোড করার ব্যবস্থা রয়েছে। তারপরেতো এমপি থ্রি ফোর নামের কতগুলো রেকর্ডার বাজারে আছেই। দুঃখজনক বিষয় হলো বাচ্চাদের খাবারের বিভিন্ন কোম্পানির চকলেট এবং আচারের প্যাকেটগুলোতেও সুন্দরী মেয়েদের অর্ধনগ্ন ছবি ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের চরিত্র নষ্ট করার জন্য যা দরকার সব ষড়যন্ত্রই আজ করা হচ্ছে। যার দরুণ সমাজব্যবস্থা আজ একেবারে ধ্বংসের পথে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে যারা স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের নৈতিকতা গঠনের জন্য কাজ করছে সরকার তাদেরকেও এগুতে দিচ্ছে না। ইসলামী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য আমাদের সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী এদেশের ইসলামী ভাবধারায় পরিচালিত একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। যারা দীর্ঘদিন যাবত সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করে আসছে। সংগঠনটি দেশ-বিদেশে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। একটা জাতি হয়ে তার নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তারা তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা গানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে দেশের প্রতি ভালবাসা ও দেশাত্ববোধ সৃষ্টি করেছে। তারা যেখানে একটি সুস্থ জাতি গঠনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। সেখানে জাতির অভিভাবক রাষ্ট্র শক্তি তাদের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
গত ১৪ নবেম্বর গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে সাইমুমের পক্ষ থেকে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাদের সব আয়োজন শেষ। কয়েকশ' টিকেটও বিক্রি হয়ে গেছে। বিকাল হওয়ার সাথে সাথে লোকজনের আসা শুরু হলো। হঠাৎ করেই পুলিশের বাধা। এখানে অনুষ্ঠান করতে দেয়া হবে না। পুলিশী বাধায় পন্ড হয়ে যায় সাইমুমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মানুষ বুঝে উঠতে পারেনি সরকার কেন বাধা দিচ্ছে। এখানেতো জামায়াত-শিবিরের কোন নেতা এসে ভাষণ দেবে না। পরে সাইমুমের পরিচালকের কাছে ফোন করে জানতে পারলাম তারা কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অনুমতি নিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তির কথা বলে তাদেরকে অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। সরকারের নিকট আমাদের জানার অধিকার আছে তারা রাষ্ট্রের এমন কি ক্ষতি করেছিল যে, আপনারা তাদেরকে বাধা দিলেন। এর মাধ্যমে এটা বুঝা যাচ্ছে যে, দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ করে সরকার ভারতের সাথে করা সাংস্কৃতিক গোলামী চুক্তির বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। গত ১০ ডিসেম্বর শাহরুখ খানের কিং খান লাইভ ইন ঢাকা-এর মাধ্যমে সরকার সংস্কৃতির চুক্তি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছে। ভারত নাকি প্রতিনিয়ত সরকারের উপর চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করে আসছে। ভারতকে খুশি করতে সে দেশের বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের দিয়েই সূচনা করলেন। শাহরুখের অনুষ্ঠানের পর দেশের বিশিষ্টজনরা তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছে। দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে বাহিরের নোংরা সংস্কৃতি চালুর ষড়যন্ত্র করছে বলে বুদ্ধিজীবী মহল মনে করছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকরাও ভারতের নায়িকাদের লেংটামী দেখে হতভম্ভ হয়ে গেছে। যারা পরিবার পরিজন নিয়ে গিয়েছিল এমন কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মাথাও নাকি নিচু হয়ে গিয়েছিল। অন্তর শোবিজ নামের একটি সংগঠন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। একটি মুসলিম দেশে সংস্কৃতির নামে এ ধরনের বেহায়াপনা দেখানোর সাহস তারা কোথায় পেল? এর পিছনে যে সরকারের হাত রয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সরকারের পরিকল্পনার আলোকেই অন্তর শোবিজ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শাহরুখের পর এবার নাকি তারা ওয়াকা ওয়াকা খ্যাত বিশ্বের অন্যতম হট সিঙ্গার-পারফর্মার শাকিরাকে আনার পরিকল্পনা করছে। শাহরুখের সফল অনুষ্ঠানে তারা নাকি বেজায় খুশি।
গত ১৭ ডিসেম্বরের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অন্তর শোবিজের পক্ষ থেকে নাকি শাকিরার মুখপাত্রের সাথে তাদের কথা হয়েছে। আগামী মার্চে তারা শাকিরাকে ঢাকার মঞ্চে তুলতে পারবে বলে আশা করছে। শাহরুখ মাতিয়ে গেছে ঢাকা আর শাকিরা এসে মাতাবে সারাদেশ। রাণী মুখার্জীর ছড়িয়ে যাওয়া উত্তাপ শেষ হওয়ার আগেই তারা আনবে শাকিরাকে। শাকিরার অগ্নিঝরা শরীরের উত্তাপ হয়তোবা আরো বেশি হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েদের শরীরে এখন যে পোশাকটুকু আছে অন্তর শোবিজ এখন তাও খুলে নেয়ার ব্যবস্থা করতেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মত একটি ধর্ম চর্চার প্রতিষ্ঠানও আজ সরকারের চক্রান্তের শিকার। পাশ্চাত্যের নোংরামী এখন এখানেও ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা হলেন মসজিদের ইমাম সাহেবগণ। সেই ইমামদের সামনেও আজ সরকার বিদেশী নর্তকীদের নিয়ে নাচ-গানের আয়োজন করছে। সারাদেশ থেকে ইমাম সাহেবরা আসেন প্রশিক্ষণ নিতে কিভাবে একটি শান্তিময় সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষার মাধ্যমে কিভাবে ছেলে-মেয়েদেরকে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা যায়। অসামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকতে মানুষকে কিভাবে সচেতন করা যায়। কিন্তু সরকার করছে এর উল্টোটা। ইমাম প্রশিক্ষণে এখন নাচগানের আয়োজন করা হচ্ছে। এর চেয়ে ন্যক্কারজনক আর নির্লজ্জ কাজ কী হতে পারে। এ জন্য সরকার বেছে নিয়েছে বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী মুসলমান নামধারী ভন্ড শামীম আফজালকে। এই কুলাঙ্গারকে মুসলমানদের মাথার উপর বসিয়েছে। সেখানে বসে সে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। আঘাত করে যাচ্ছে মুসলমানদের মূল চেতনার উপর। এসবই হচ্ছে বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনার আলোকে। সাধারণ মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন- দেশে এগুলো কী হচ্ছে? সরকার কী এই মুসলিম দেশটির নাম-নিশানা সব মুছে দেবে? সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সরকার যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন ভারতের বস্তাপচা লেংটা সংস্কৃতি এদেশের মানুষ কখনো গ্রহণ করবে না। ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংসের হীন চক্রান্ত থেকে সরকার যদি সরে না আসে তাহলে, জনগণ যেকোন সময় রাস্তায় নেমে আসতে পারে।

Monday, 27 December 2010

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের মুখ ও মুখোশ

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর সবচেয়ে কঠিন সংকটের মুখোমুখি। উপমহাদেশ থেকে যারা দ্রাবিড়ীয়-বৌদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস করে বৌদ্ধদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে এবং যারা ইসলামের আগমন, সম্প্রসারণ এবং মুসলিম উত্থানকে কখনও মেনে নিতে পারেনি এবং যাদের কট্টর সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীলতা মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় পরিচিতি প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে নিতে বাধ্য করেছে, তারাই আজ দিল্লীর শাসন-কর্তৃত্ব দখল করে আমাদের সামনে এই সংকট তৈরি করেছে।
ভারত দৃশ্যত: স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও অভ্যন্তরীণভাবে তার জাতীয় নীতি অ-হিন্দু জাতি-ধর্ম-নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের স্বাধীন বিকাশের বিরোধী এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভারত বিলুপ্ত ঔপনিবেশিক বৃটিশ শক্তির উত্তরাধিকার। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জ্ঞাতিভাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাই ভারতের উঠতি পরাশক্তির দোসর। এই সুযোগে ভারত এ অঞ্চলে তার ‘অখন্ড ভারত মাতার' ডকট্রিন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভয়ঙ্করভাবে আগ্রাসী এবং অপ্রতিদ্বনদ্বী। ৯/১১-এর পর মার্কিন ‘নিওকনরা' যেমন আফগানিস্তানে হামিদ কারজাইয়ের মতো পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনি ১/১১-এর পর নয়াদিল্লী-বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী নীল নকশার কভারে তাদের অনুগত একটি পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। এটি এখন আর কোন রাজনৈতিক সন্দেহ বা ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর বাস্তবতা ইঙ্গ-মার্কিন-ভারতীয় কূটনীতিকদের গোপনীয় নথিতেও প্রমাণ হয়েছে।
উইকিলিকস যে হাজার হাজার নথি ফাঁস করেছে, তাতে বাংলাদেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তন, সরকারের প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তা নীতি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি পরিবর্তনে ত্রি-শক্তির অশুভ অাঁতাতে গড়ে ওঠা এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরকারের বাধ্যবাধকতা তাই শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। উইকিলিকস প্রকাশিত তথ্যে তার জবাবও অবশ্য পাওয়া গেল। এদিকে অসময়ে উইকিলিকস যে তথ্য ফাঁস করেছে, তা সরকারকে শুধু বিব্রতই করেনি, সরকারের মুখোশও উন্মোচিত করে দিয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার সংস্কারের নামে মাদরাসা শিক্ষার বনেদী ঐতিহ্য, ইসলামী চেতনা ও পরিচয় বিলুপ্তকরণের বিরুদ্ধে তৌহিদবাদী তৃণমূল জনগণ যখন আন্দোলন-প্রতিরোধ-হরতালের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে, তখনই উইকিলিকস জানালো যে, শিক্ষানীতিকে ইসলামমুক্ত করে তাকে পশ্চিমা ধাঁচে সাজানোর বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় ইঙ্গ-মার্কিন সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। ভারত এতে ঘি ঢেলেছে। সাথে ‘প্রগতিশীল' [ভাড়ায় খাটা] রাজনীতিক-সামাজিক শক্তি, পরাশ্রয়ী এনজিও-ব্যবসায়ীরা মদদ যুগিয়েছে। ‘অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল' বাংলাদেশ গড়তে তারা ইসলামী চেতনা ও শিক্ষা-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বিদায় করে যাদুঘরে পাঠানোর আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। কেননা, ইসলামবর্জিত সেক্যুলার বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতিক সীমানা না থাকলে তা ভারতের আধিপত্যবাদী থাবার নীচে সহজে গুটিয়ে যাবে বলে তারা মনে করেন।
ভারতে হিন্দু মিলিট্যান্ট বা উগ্র হিন্দুবাদী সশস্ত্রগোষ্ঠী তৈরি করছে কারা? খোদ আমেরিকায় ইভানজেলিক খৃস্টানদের মতো উগ্র বর্ণবাদী জনগোষ্ঠী তৈরি করছে কারা? এজন্য ভারতে হিন্দুত্বের দীক্ষাদানকারী গীতা-বেদ-উপনিষদ বা বৃটেনে বাইবেলকে কেউ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি। মুসলমানদের কুরআনসম্পৃক্ততা ও ইসলামী ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অনুসরণেই ওদের যতো আপত্তি ও আতঙ্ক। ইসলাম সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নিরপরাধ মানুষ হত্যা বা জনকল্যাণে নিবেদিত কোন সম্পদ ধ্বংসের কোন এযাযত-অধিকার কাউকে দেয়নি। ইসলামের নাম ব্যবহার করে যদি এসব কেউ করে, তবে তাতে ইসলামের ওপর কলঙ্ক আরোপ করা যায় না। আবার ইসলামের প্রতিপক্ষগোষ্ঠী জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের গোপন কারখানায় ভাড়াটে কিছু নামধারী মুসলমানদের জঙ্গি কার্যক্রম তথা মানুষ হত্যা ও আত্মঘাতী বোমাবাজিতে লিপ্ত করে ইসলামকে কলঙ্কিত করার চাতুরিও চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ যেমন গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ-একনায়কতন্ত্র চালিয়ে গণতন্ত্রকে অকার্যকর ও গণবিরোধী প্রমাণ করে থাকে, তেমনি ইসলামও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী-যায়নবাদীদের ত্রিশক্তির চক্রান্তের শিকার হয়ে কলঙ্কিত হচ্ছে। এ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজত করার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তেছে, তাদের সীমাবদ্ধতা ও অদক্ষতা মুসলমানদের সবচেয়ে বিপন্ন ও দিশাহীন জাতিতে পরিণত করেছে। মুসলমানরা জঙ্গি না হয়েও জঙ্গিবাদের দায়ে চিহ্নিত। ইসলাম-মুসলমানের পরিচয়ের সাথে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসকে সমার্থক করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই। পাকিস্তানে যারা স্বাধীন ভূখন্ডে ইসলামের পরিচয় নিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদেরকে ‘তালেবান জঙ্গি' বানিয়ে নির্বিচার গণহত্যার শিকার বানানো হয়েছে। ৯/১১-এর পর আফগানিস্তান দখলের সময় মার্কিন ড্রোন বিমান মিসাইল নিক্ষেপ করে যেভাবে সিভিলিয়ান আফগান মুসলমানদের নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল, ঠিক একইভাবে মার্কিন মিসাইলবাহী ড্রোন বিমানগুলো পাকিস্তান ভূখন্ডে নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষ মারছে। হালে অবশ্য মার্কিন সমরবিদরা পাকিস্তান ভূখন্ডে তাদের ড্রোন বিমান হামলার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে যারা ইসলামী চেতনা ও বিশ্বাসকে আত্মিক টানে, ঐতিহ্যের ধারায় ধারণ ও লালন করেন এবং যারা ভারতীয় নাশকতা-আগ্রাসন থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদের দোসর হিসেবে নির্মূলের টার্গেট করা হয়েছে। এর ছবক এসেছে দিল্লী থেকে।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয় পারস্পরিক জনগণের কল্যাণে, জাতীয় স্বার্থে। তাই রাষ্ট্রীয় দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি বা যে কোন সমঝোতা স্মারক হতে হবে উন্মুক্ত এবং স্বচ্ছ। কিন্তু এ বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে এসেছেন, তা উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ নয়। আর এ জন্যই সরকার গোপনীয়তা ও লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতের সাথে চুক্তির ব্যাপারে সরকারের অপরাধবোধ না থাকলে এই লুকোচুরির কোন প্রয়োজন হতো না। ভারতের কাছে অসম শর্তে জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ তুলে দেয়ার যে কথা আমরা এতকাল লিখে আসছি, তাকে যারা ভারত ফোবিয়া বা পাকিস্তানপন্থী মানসিকতা হিসেবে সরলীকরণ করতে চেয়েছেন, তাদের মুখোশটাও উইকিলিক্স-ফাঁস করে দিয়েছে। প্রথমত: উইকিলিক্স উল্লেখ করেছে যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে ভারত খুবই স্বস্তি অনুভব করেছে। কারণ ভারত মনে করেছে, তার জাতীয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ শেখ হাসিনা অবসান ঘটাবেন। দ্বিতীয়তঃ শেখ হাসিনা এবং নয়াদিল্লী কর্তৃপক্ষ উভয়ই তাদের সম্পর্কের অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা প্রচারের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনার সরকার ভারতের ‘নিরাপত্তা ডকট্রিনের' কাছে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তা তুলে দেবার বিষয়টি আড়াল করতে কার্যতঃ ক্যামোফ্লেজের আশ্রয় নিয়ে সন্ত্রাস মোকাবিলায় ‘আঞ্চলিক' টাস্কফোর্সের প্রস্তাব করেন। এখানে ‘আঞ্চলিক' শব্দটি প্রতীকী। দ্বি-পাক্ষিকতা তথা ভারতমুখিতা আড়াল করার ভড়ং। ভারত জঙ্গি, সন্ত্রাস ও তার অভ্যন্তরীণ ইনসার্জেন্সী দমনে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের সাথে ভূটানের কায়দায় যৌথ সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। ইতোপূর্বে কোন সরকারই এ প্রস্তাবে সায় না দিলেও ১/১১-এর সেনা সমর্থিত সরকার ভারতের এই টোপ নীতিগতভাবে গিলে ফেলে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ভারত-প্রযোজিত ও পরিকল্পিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়ে আসা আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তিমূলে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে দেশের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ বন্ধক দিয়ে এসেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জনের তারবার্তার উদ্ধৃতি দিয়ে উইকিলিক্স- তাই লিখেছে, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে দিল্লীর উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। এতে ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী সন্তোষ প্রকাশ করেন।' তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টিকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে নিরাপত্তা সহায়তার উন্নতি করা হবে ভারতের প্রধান অগ্রাধিকার। ... ভারত বুঝতে পারে, শেখ হাসিনা খুব বেশি ভারতপন্থী' এই অভিযোগকে আড়াল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঞ্চলিক টাস্ক্ফোর্সের প্রস্তাব দিক।’’ অন্যদিকে ভারতীয় হাই কমিশনার এর গুরুত্ব নিয়ে বাগাড়ম্বর করে বলেন, ‘‘এই টাক্সফোর্স হবে কাজের। এটা আঞ্চলিক কোন কথামালার দোকান হবে না।’’
দেখা যাচ্ছে, ‘আঞ্চলিক টাস্কফোর্স' শেখ হাসিনা বা বাংলাদেশ সরকারের মৌলিক কোন প্রস্তাব নয়। এটি নিরাপত্তা ও জঙ্গিদমন ইস্যুতে বাংলাদেশকে ভারতের গিলে ফেলার বিষয়টি আড়াল করার কুশলী প্রচারণামাত্র। ভারত একইভাবে উপ-আঞ্চলিক জোট নামে আর একটি প্রতারণার চাদর বিছিয়েছে। এতে নেপাল ও ভূটানকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা হচ্ছে। দুটি দেশই- ভারতের ভূমি দ্বারা বেষ্টিত বা ল্যান্ডলক্ড এবং ভারতের সামরিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার বাইরে বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিকভাবে এই তথাকথিত জোট থেকে কোন সুবিধা নিতে পারবে না। সরকারের তৃতীয় ক্যামোফ্লেজ কৌশল হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর গণচীন সফর এবং গণচীনের সাথে সংযোগ সড়ক উন্মোচনের পুরনো পরিকল্পনা তুলে ধরা। ঢাকায় কূটনীতিকদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে নয়াদিল্লীর কূটনৈতিক চালবাজি বলে ধারণা রয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরও ইন্ডিয়ান ডিপ্লোমেটিক ডকট্রিনেরই আর একটি দৃশ্যপট। এদিকে উইকিলিক্স-এ ভারতের সাথে সরকারের মাখামাখির কথা প্রকাশের পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীর করণীয় নির্ধারক জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন। ‘জাতীয় নিরাপত্তার' বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত-নাশকতার সম্ভাব্যতা নিয়ে আতংকজনক কথাবার্তা বলছেন।
জাতীয় নিরাপত্তা বলতে সরকারের মাথায় কিছু আছে কিনা, সেটাই জনগণের প্রশ্ন। বরং বাংলাদেশের অভিভাবকত্ব ও জিম্মাদারী ভারতের হাতে তুলে দেবার সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে যারা দেশপ্রেমিক চেতনায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রস্তুত, তাদেরকেই জাতীয় নিরাপত্তার শত্রু হিসেবে টার্গেট করে বিনাশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ সরকার জাতীয় স্বাধীনতা বিকানোর স্বাধীনতাকে অবাধ ও নিরংকুশ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: ‘‘ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশ হতে পারে চীন ও ভারতের সংযোগ সেতু।' [সমকাল, ২২ ডিসেম্বর, ২০১০] এর আগে অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছেন : ‘বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবেই ট্রানজিট রাষ্ট্র।' ড. মশিউর ইন্ডিয়ান লবীস্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। অর্থমন্ত্রীও একই ঘটনার তাত্ত্বিক বলেই এটা বলতে পারছেন।
সাবেক প্রধামন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার তাৎপর্যপূর্ণ চীন সফরকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা চীনকে জড়িয়ে আশাবাদের চটকদার কথা বলে তাদের ভারতমুখিতাকে আড়াল করতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের হাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার চাবিকাঠি তুলে দিয়ে তাঁর তাৎপর্যহীন চীন সফরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এসেছেন। চীনারা এ অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য, ভারত-মার্কিন সখ্যতা, পাক-ভারত-বৈরিতার রসায়ন ভালোই জানে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত গণচীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি। বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চীন সফরের নিকটপূর্ব সময়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী জিয়াবাও ভারত সফর করে পাকিস্তানও সফর করেন। তাঁর এ সফরকে ভারতীয়রা প্রতিরক্ষা ও সামরিক স্ট্র্যাটেজিক পর্যায়ে পাকিস্তানের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফরকে এ অঞ্চলের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন। বিশেষ করে চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তানের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের কর্ম-কৌশলের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানানো এবং পাকিস্তানের ওপর বহিঃশক্তির হামলার সময় চীনাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ভারতের বৈরিতা ও ভারত-মার্কিন ঐক্যে চীনকে কনফ্রন্ট করার বিরুদ্ধে একটি সাক্ষাৎ সতর্কবার্তা। এরপর থেকে মার্কিন সমরনায়করা জঙ্গিদমনের নামে পাকিস্তানে ড্রোন বোমা হামলা চালিয়ে গণহত্যায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ভারতীয় তাত্ত্বিকরা মনে করেন, পাকিস্তানে মার্কিন অর্থ সাহায্য বন্ধ করে পাকিস্তানকে তারা পরিত্যাগ করলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। গণচীনের অভয় ও প্রশ্রয় সে আশঙ্কাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
আসছে জানুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসার আগেই ভারত তাদের সকল প্রাপ্য বুঝে নিতে চায়। চুক্তির এক বছরের মাথায় ভারত তার বিজয়-উৎসব পালন করতে চায়। আওয়ামী লীগ ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কতদূর যেতে পারে, তার একটা নমুনা তারা বিগত বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনাহত্যার সময় দেখিয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনায় ভারতের কাঙ্ক্ষিত ও ঘনিষ্ঠ সরকারের যাতে গণেশ উল্টে না যায়, তার বিরুদ্ধে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব বাবু হুঁশিয়ারি জানানো ছাড়াও ত্রিশ হাজার ভারতীয় স্ট্রাইকিং ফোর্স ও যুদ্ধ বিমান তৈরি রাখার কথা জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নিরাপত্তায় বাংলাদেশের জাতীয় সেনাবাহিনীর চেয়ে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর কেন নির্ভর করেছিলেন, উইকিলিকস-এর তথ্য থেকে তার কিছু আভাষ পাওয়া যায়। আবারও কোন নাশকতা-বিপদের আশঙ্কায় তারা বাইরের দেশের সেনাদের ডাকবেন কিনা, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এ ব্যাপারে কৌতূহলী। বিএনপি'র মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ঘন ঘন নাশকতার আতঙ্ক শুনে বাংলাদেশকে সিকিম কিংবা আফগানিস্তান বানানোর চক্রান্ত চলছে কিনা, এমন প্রশ্ন করেছেন।
জাতীয়তাবাদী ইসলামী শক্তির অবিসম্বাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান এবং চারদলীয় জোটের স্বাধীনতা রক্ষার নব পর্যায়ের আন্দোলনকে সরকার উন্নয়ন বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের রাজনীতি হিসেবে চিহ্নিত করে বিভ্রান্তি বিস্তার করছে। তবে এটাও তারা ভারতীয় থিংকট্যাংক থেকে ধার করে নিয়েছে। কিন্তু পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে সরকার জনমত বিভ্রান্ত করতে পারছে না। ‘সাউথ এশিয়ান এনালিস্ট'-গ্রুপের ইন্ডিয়ান থিঙ্কট্যাংক ভাস্কর রায় তার লেখা পেপার নম্বর ৩৮৬৭ ’’ইভর্টমবহ মত ঈটভথফটঢণ্রদ মযযম্রর্ধধমভ : ওপ. ঔট্রধভট বর্ল্র ইর্ড’’- এ (১৯ জুন ২০১০) যেসব ছবক দিয়েছেন, বিরোধী দলের সাথে সরকার সেই ভাষায়ই কথা বলছে এবং বিরোধীদল নির্মূলে ভারতীয় প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সকল নোংরা ও বর্বর পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করছে। ভয় দেখিয়ে, নির্যাতন করে দিল্লী-বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন নস্যাৎ করতে চায়। তারা ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াকে ‘মূর্খতা' বলেও উপহাস করতে শুরু করেছে। তবে ভারতের পুতুল সরকারের দেশ বিক্রির চক্রান্তের বিরুদ্ধে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সূচিত গণজাগরণে ভারত শঙ্কিত না হলে তাদের আতঙ্ক ছড়ানোর কোন প্রয়োজন হতো না। ভারতের তল্পী বহন করে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে যেখানে ‘অবতার' হিসেবে তারা পূজা-অর্চনা করতে শুরু করেছে, সেখানে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মাফিয়া কিংডমের' সম্রাজ্ঞীর অপবাদ দিতেও ভারতীয় প্রচার কুশলীদের বিবেকে বাধে না। এমনকি তারেক রহমানকে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী ভারতীয় মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের দোসর হিসেবে অপবাদ দিয়ে ভারত আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে বিপদগামী করতে চায়।
ভারতের সাথে আমরা যুদ্ধ চাই না, বিবাদও চাই না। আমরা চাই, সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর নির্ভরশীল সমঝোতা ও বন্ধুত্ব। সর্বভারতীয় আধিপত্যবাদ বা ‘অখন্ড' ভারত গড়ার গিনিপিগ হবার জন্য বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি।
ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা মনে রাখতে হবে, ৪০ বছর আগে পাকিস্তান পরিত্যাগ করে আসলেও বাঙালি মুসলমানরাই ছিলেন পাকিস্তান তৈরির মূল কারিগর। পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে ভারত মাত্র ৯ মাসের জন্য নিজ প্রয়োজনে আমাদের বন্ধু-সহকর্মী হতে এগিয়ে এসেছিল। পরবর্তী ৪০ বছরে বাংলাদেশের কয়েকটি জেনারেশন ভারতকে যেভাবে দেখেছে ও পেয়েছে, তাতে বন্ধুত্বের বিশ্বাস তো ভারতের ওপর ন্যস্ত করা যায় না। যারা কাঁটাতার দিয়ে সীমান্ত ঘিরে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে অবজ্ঞা ও অবমাননা করে আসছে, যারা হিংস্র বৈরিতায় সীমান্তে প্রতিনিয়ত আমাদের নিরস্ত্র ভাইবোনদের হত্যা করছে, আমাদের ভূমি জবর দখল করে নিচ্ছে, তাদের বন্ধুত্বে কারও আস্থা নেই। যারা পানি আগ্রাসন-অর্থনৈতিক আধিপত্য, ট্রানজিট-করিডোরের বর্শাফলকে বাংলাদেশের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে উদীয়মান ব্যাঘ্র-রাষ্ট্রকে দিল্লীর বশংবদ সেটেলাইট রাষ্ট্র বানাতে চায়, তাদের বন্ধুত্বের মেকী আবাহনের বিরুদ্ধে নবীন প্রজন্মের প্রতিরোধ দেখার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণকে ধর্মহীন, কর্মহীন, স্বপ্নহীন, আদিকালের চাষা-ভূষার প্রজন্মে পরিণত করার চাণক্য কুটিলতার কাছে যারা নতজানু হতে চায় না, তাদের বিরুদ্ধে দিল্লী ও তার বশংবদ সরকারের অঘোষিত গৃহযুদ্ধকে স্বাধীনতা রক্ষায় আর একটি প্রতিরোধ মহাসংগ্রামই হয়তো ঢাকা কেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানদের নবীন প্রজন্মের ভাগ্যলিপি। '৪৭ পর্বের ভূখন্ডগত স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং দাদার ভূমিতে দাঁড়িয়ে সম্পত্তি বাটোয়ারা হিস্যায় যে স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা উত্থিত হয়েছে, তার সুরক্ষায় নবীন প্রজন্মের কাছেও আর একটি আত্মত্যাগের ডাক এসেছে। এ সত্য আমরা যতো শীঘ্র তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো, ততোই জাতীয় সংকট উপলব্ধির সফলতা আসবে। বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়ে এক নেত্রীকে কোলে তুলে, অন্যনেত্রীকে শত্রুর নিশানায় বিনাশ করার রাম ও বাম রাজনীতির এই অভিশাপ থেকে মুক্তির পথই হোক জাতীয় রাজনীতির আরাধনা।

Sunday, 26 December 2010

শেখ মুজিব জেনেশুনে যুদ্ধাপরাধ বিচার পরিহার করেছিলেন

এই সরকারের দুই বছর পূর্ণ হতে চললো। আর মাত্র ১০ দিন পর শেখ হাসিনার রাজত্বের দুই বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এই দুই বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে কন্যা শেখ হাসিনা পিতা শেখ মুজিবের অনেক নীতি থেকে দৃষ্টিকটু ভাবে বিচ্যুত হয়েছেন। বিশেষ করে দালাল আইন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে শেখ হাসিনা তার পিতার অনুসৃত নীতি থেকে সম্পূর্ণ ইউ টার্ন করেছেন। অথচ শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগ এবং সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক। তার অঙ্গুলি হেলনেই সরকারের এবং আওয়ামী লীগের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগে এবং সেই সুবাদে বাংলাদেশ সরকারের কার্যপরিচালনায় দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি দাঁত বসাবার ক্ষমতা রাখা তো দূরের কথা, সাহসও পান না। অনুরূপভাবে শেখ মুজিবও ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। তিনিও তার দল এবং সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শেখ মুজিবের আমলে তিনিই অর্থাৎ শেখ মুজিবই ছিলেন আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবই ছিলেন বাংলাদেশ। দল এবং সরকারের ক্ষমতার এলাকায় দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির ভাগ বসাবার কোনো সুযোগই ছিল না। সুতরাং একথা বলা যায় যে, যে সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শেখ হাসিনা তার পিতার অনুসৃত নীতি থেকে সরে আসছেন সেগুলো তিনি সজ্ঞানে এবং সচেতনভাবেই করে আসছেন। একটু আগে আমি বলেছি যে শেখ হাসিনা দুইটি ইস্যুতে পিতার পথ থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু একটু আগে আমার হাতে আরেকটি ইংরেজি পত্রিকা এলো। এখন দেখছি, তিনি অন্তত তিনটি ইস্যুতে তার পিতার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। এসব বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি অথবা ‘দৈনিক সংগ্রাম' নিজস্ব কোন খবর পরিবেশন করছি না। এ ব্যাপারে আমাদের কোন মন্তব্য করার আগে আমরা সংগ্রামের সম্মানিত পাঠক ভাই-বোনদের খেদমতে দুইটি খবর পরিবেশন করছি। খবর দুইটি ছাপা হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ‘আমাদের সময়ে' এবং ২৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘হলিডে' পত্রিকায়। উভয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের একটি বিরাট অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। আমি সম্পূর্ণ সচেতন যে উদ্ধৃতিগুলো খুব বড় হয়ে যাবে। তৎসত্ত্বেও নিরপেক্ষতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে সেই উদ্ধৃতি আমাকে দিতেই হচ্ছে। অন্যথায় আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বিষ্টতার অভিযোগে আশঙ্কা থেকে যাবে।
দৈনিক ‘আমাদের সময়ে' যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে সেটির শিরোনাম ‘‘বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমার সময় যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী নিরেনবার্গের পরামর্শ নিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, স্বাধীনতা ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে আছে তার অবদান।’’ পত্রিকাটির একজন সংবাদদাতা কানাডার টরেন্টো থেকে সংবাদটি পাঠিয়েছেন। আইনজীবী নিরেনবার্গ তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধটির শিরোনাম, Negotiating Bangladesh Independence. ওয়েবসাইটটির শিরোনাম, http://www.negotiation.com দৈনিক ‘আমাদের সময়ে' এ সম্পর্কে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তার এক স্থানে বলা হয়েছে, The war in Bangladesh ended quickly once neighbouring India invaded Pakistan. India had captured a great many Pakistani prisoners of war and turned them over to the new government of Bangladesh. These prisoners included all of the troops whose slaughter of the citizens of Bangladesh had started.
Shortly after the fighting ended, the new Bangladeshi president, Sheikh Mujib (who now recognized me as his lawyer), sent me a diplomatic pouch in which he asked for my advice on how to conduct war-crimes trials. In considering the best solution for the new nation of Bangladesh, I recalled an article I had read in the December 1969 issue of Psychology Today. The article had described the effectiveness of unilateral gestures in pushing forward stalled negotiations--specifically, in reference to the way President John F. Kennedy had handled the aftermath of the Cuban Missile Crisis. বঙ্গানুবাদ : ভারত যখন সরাসরি পাকিস্তান আক্রমণ করে তখন অতি দ্রুত বাংলাদেশ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ভারত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে বাংলাদেশের নতুন সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পরই বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব আমার কাছে কূটনৈতিক চ্যানেলে একটি বার্তা পাঠান। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে তিনি আমাকে তার আইনজীবীর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ঐ বার্তায় তিনি আমার কাছে পরামর্শ চান- কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিচালনা করা যায়। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম সমাধান হিসেবে আমি স্মৃতিচারণ করলাম একটি নিবন্ধের, যা ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘সাইকোলজি টুডে' নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। এই নিবন্ধে দেখানো হয়েছে, কিভাবে আলাপ-আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে একতরফা শুভেচ্ছার নিদর্শন শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির এই ধরনের একতরফা শুভেচ্ছার নিদর্শনমূলক পদক্ষেপ সেই মহাসংকটের সমাধান করেছিল। অতঃপর কিভাবে ঐ সংকটের আলোকে যুদ্ধাপরাধ সমস্যার সমাধান করা যায় সে সম্পর্কে মিঃ নিরেনবার্গ বলছেন, Might a similar strategy help improve the relationship between Bangladesh and Pakistan? I sent the incisive article about the value of unilateral gestures to Sheikh Mujib along with a startling suggestion. Now, I knew that these prisoners of war (I think there were 30,000 to 35,000 of them) had murdered hundreds of thousands of people in Bangladesh--and Sheikh Mujib had witnessed these atrocities with his own eyes. Nonetheless, I asked Sheikh Mujib to consider the unthinkable: letting all of these prisoners go free. Nothing like this had ever been done in the aftermath of a civil war--especially in such an eye-for-an-eye, tooth-for-a-tooth culture. Yet I asked him to consider what effect such a gesture would have on the attitude of various countries throughout the world toward Bangladesh.
The Sheikh was a consummate politician and he quickly recognized the value of such a dramatic gesture. The small fact that I planted the idea of an alternative to the War Crimes trials can not in any way detract from the courage, foresight, and creativity of Sheikh Mujib, who accepted my proposal, nurtured it, and made it grow. As a result, every nation in the world recognized them, respected them, and did whatever they could to help them. It was a masterful move on the part of the Sheikh. With one gesture, he had changed the climate of a stalled, defensive negotiation and nurtured a new atmosphere of respect and trust.
I later heard Mujibur Rahman speak to the Asian Society in New York. Dramatically rubbing his fingers together as though dropping grains of sand to the floor, Sheikh Mujib ironically claimed of the prisoners of war, "I let them slip through my fingers." Maybe so. But by letting them go, he had created a favourable impression that dramatically improved his nation's standing in the world community. বঙ্গানুবাদ, ‘‘অনুরূপ একটি কৌশল কি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারে? আমি আলোচ্য অনুসন্ধানী নিবন্ধটি তার কাছে পাঠাই এ জন্য যাতে এই নিবন্ধের অন্তর্নিহিত অর্থ তিনি বুঝতে পারেন এবং একতরফা শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে সুনির্দ্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আমি জানতাম যে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার যুদ্ধবন্দী বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের নির্যাতন এবং বর্বরতার কথা শেখ মুজিব জানেন। তৎসত্ত্বেও তার কাছে আমি একটি অবিশ্বাস্য প্রস্তাব পাঠালাম। সেটি হলো, এই সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে তিনি মুক্ত করে দিতে পারেন কিনা। আমি জানতাম যে, যে সবদেশে ‘দাঁতের বদলে দাঁত' এবং ‘চোখের বদলে চোখে'র সংস্কৃতি চালু আছে সেখানে সকলকে ক্ষমা করে দেয়া একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তৎসত্ত্বেও তার কাছে আমি এজন্যই এই প্রস্তাবটি দিয়েছিলাম যে যদি তিনি এই কাজটি করতে পারেন তাহলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে।
শেখ মুজিব ছিলেন একজন চৌকস রাজনীতিবিদ। এই ধরনের একটি নাটকীয় পদক্ষেপের মূল্য তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে বিকল্প ব্যবস্থাটি আমি তার কাছে উত্থাপন করি সেটি কিন্তু শেখ মুজিবকে তার সাহস, দূরদৃষ্টি এবং বিচক্ষণতা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করেনি। তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং সেটিকে লালন করেন। তারপর তিনি সেই প্রস্তাবটি কার্যকর করেন। এর পরিণতিতে পৃথিবীর প্রতিটি জাতি তাকে স্বীকৃতি দেয়, তাকে সম্মান করে এবং তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য তাদের যা কিছু করার ছিল তার সবকিছুই তারা করে। শেখ মুজিবের পক্ষে এটি ছিল একটি মাস্টার স্ট্রোক। শুভেচ্ছার একটি মাত্র নিদর্শন দিয়ে, অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে, তিনি আটকে যাওয়া আলাপ-আলোচনার অর্গল খুলে দেন এবং সমগ্র পরিবেশকে আস্থা ও সম্মানের পরিবেশে রূপান্তরিত করেন।
পরবর্তীতে শেখ মুজিব নিউইয়র্কে অবস্থিত এশিয়ান সোসাইটিতে যে বক্তৃতা করেন সেটি আমি শুনেছি। বক্তৃতার সময় তিনি নাটকীয়ভাবে তার আঙ্গুলগুলো ঘষছিলেন। মনে হচ্ছিল, আঙ্গুল ঘষে ঘষে তিনি যেন মেঝেতে ধূলিকণা ফেলছেন। এটি করতে করতে তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধবন্দীদেরকে আমি আমার এই আঙ্গুলসমূহের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি।’’ হয়তো তাই। তবে তাদেরকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে শেখ মুজিব পৃথিবীর সামনে এমন একটি নজীর সৃষ্টি করলেন যে নজীরটি বিশ্ব সভায় নাটকীয়ভাবে তার দেশের মান মর্যাদা বৃদ্ধি করলো।’’
দুই
‘আমাদের সময়ের' আলোচ্য সংবাদে অতঃপর বলা হয়েছে, ‘‘ঐকমত্যের দর্শনে আলোকিত, বিশ্বখ্যাত ‘পাইওনিয়র ইন নেগোশিয়েশন' এবং যুক্তরাষ্ট্রে ‘বেস্ট সেলিং অথার' হিসেবে সমধিক পরিচিত বর্তমানে নিউইয়র্কে বসবাসকারী ৮৬ বছর বয়স্ক এই অসুস্থ আইনজীবী জেরার্ড আই নিরেনবার্গ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে রেখেছেন এক অমূল্য অবদান। তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, একাত্তরে নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের বিদ্রোহী কূটনীতিকদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন রোধ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র রফতানি প্রতিহত করা এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাক্টর রফতানি, ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য জাতিসংঘের চালবাহী জাহাজ তদারকিতে তাঁর মেধা, শ্রম ব্যয় করেছেন। এই কথাগুলো ওই নিবন্ধে বিধৃত আছে। তবে যে বিষয়টিতে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তার কাছে কূটনৈতিক চ্যানেলে পরামর্শ চেয়েছিলেন, সেটি ছিল যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়।’’ আজ সেই বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
তিন
শেখ মুজিব কেন তার কথা শুনেছিলেন তারও একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় রিপোর্টটির শুরুতে। শুরুতে সেই সময় শেখ মুজিবের বিদেশী আইন উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দানকারী মিঃ নিরেনবার্গ বলেছেন, 'In my long career as a litigator and negotiator, few accomplishments have made me more proud than my work on behalf of the emerging nation of Bangladesh in the early 1970s. When Pakistan jailed the leader of the Bangladesh’s independence movement, I applied pressure on the U.S. State Department to free him. When the nation needed peace, I helped stop U.S. shipments of arms into the region. When its people needed food, I helped secure relief from the United Nations. And when the nation needed legitimization, I helped it gain admission into the U.N. বঙ্গানুবাদ: ‘‘আইনজীবী এবং নেগোসিয়েটর হিসেবে আমার এই সুদীর্ঘ জীবনে আমি যত সাফল্য অর্জন করেছি তার মধ্যে আমি গর্ব অনুভব করি ১৯৭০ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের জন্য আমি যে কাজ করেছি তার জন্য। যখন পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাকে জেলে নিক্ষেপ করে তখন তার মুক্তির জন্য আমি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ওপর চাপ সৃষ্টি করি। বাংলাদেশের জন্য যখন প্রয়োজন ছিল শান্তি, তখন আমেরিকা সেদেশে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ পাঠাচ্ছিল। ঐ জাহাজ পাঠানো বন্ধ করায় আমি সাহায্য করি। যখন বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজন ছিল খাদ্যের, তখন আমি জাতিসংঘের মাধ্যমে সেখানে ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে সাহায্য করি। আর যখন বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল বৈধ স্বীকৃতির, তখন আমি দেশটিকে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত করায় সাহায্য করি।
চার
সুপ্রিয় পাঠক-পাঠিকা ভাই-বোনেরা, ইতোমধ্যেই লেখাটি বড় হয়ে গেল। তাই দালাল আইনের পুনরুজ্জীবন এবং বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে আসামের একটি পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সে সম্পর্কে আজ আলোচনা করার স্থান হলো না। উলফার সর্বাধিনায়ক পরেশ বড়ুয়ার পুত্রের অপহরণ অথবা বাংলাদেশে আরো দুইজন উলফা নেতার অন্তর্ধান সম্পর্কে ভারতীয় পত্রিকায় যে খবর উঠেছে সে সম্পর্কেও আলোচনা করার কোন সুযোগ হলো না। তবে আগামীতে এ সম্পর্কে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। আজকে শুধু এটুকু বলতে চাই যে শেখ মুজিবই দালাল আইনে সকলকে ক্ষমা করে দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির পথ খুলে দিয়েছিলেন। তার কন্যা শেখ হাসিনা সেই আইন পুনরুজ্জীবিত করে তার পিতার নীতিকে বাতিল করছেন এবং জাতীয় বিভাজন নীতি অনুসরণ করছেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে শেখ মুজিব কোন হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু তার কন্যা শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে ভারতীয়দের সপক্ষে হস্তক্ষেপ করছেন এবং উলফা নেতাদেরকে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আরো পরিষ্কার। ওপরে যে সুদীর্ঘ আলোচনা করা হলো সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে শেখ মুজিব সুস্থ মস্তিষ্কে, সজ্ঞানে এবং সুচিন্তিতভাবেই যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিহার করেছিলেন। যেখানে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে শেখ মুজিব জেনে শুনে মুক্ত করে দিয়েছেন সেখানে তার কন্যা শেখ হাসিনা ৩৮ বছর পর জেনে শুনে বাংলাদেশের এমন সব রাজনৈতিক নেতাকে এই অভিযোগে গ্রেফতার করেছেন যারা একাধিকবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তারা মন্ত্রীও হয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগও নেই। এত পরিচ্ছন্ন তাদের রেকর্ড। ৩৮ বছর পর এই ইস্যুতে তিনি তার পিতার নীতিকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছেন। এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের নির্দেশ আসে সীমান্তের ওপার থেকে।                     

নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেন, মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি আর এই শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষার। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোক দুর্নীতির সাথে জড়িত। তারা প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণ করলেও নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি। ফলে আমাদের দেশ ও দেশের মানুষ অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। সমাজ, দেশ ও জাতিকে উন্নত করতে হলে প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতার বিধানকেও অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।
বর্তমান সময়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উন্নত পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সংঘর্ষ-সংঘাত, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ যেসব অনাচার লক্ষ্য করছি সেই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নৈতিক শিক্ষার কথা উল্লেখ করে সময়ের দাবি পূরণ করেছেন। শুধু দ্বনদ্ব-সংঘাত-হানাহানিই নয়, বর্তমান সময়ের ছাত্রদের একাংশকে ইভটিজিং-এর মত ঘৃণিত অপরাধের সাথেও জড়িত থাকতে দেখা যায়। আর বর্তমান সময়ে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা-প্রকৌশলসহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে আমাদের শিক্ষিত সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আসলে কিছু গ্রন্থ বা সিলেবাস রপ্ত করে ডিগ্রি অর্জন করা গেলেও তাতে মানুষ কাঙ্ক্ষিত মানুষে পরিণত হয় না। এজন্য প্রয়োজন হয় নৈতিক শিক্ষার এবং মূল্যবোধ বিকাশের। অথচ বর্তমান সময়ে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। যখন আমরা সংকটে পড়ি বা নানা ঘটনায় সমাজ বিপর্যস্ত হয় তখন যেন আমরা ঠেকায় পড়েই নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে থাকি। অথচ পৃথিবীর ইতিহাস এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, মানুষের সমাজে যখন ধর্মীয় প্রণোদনায় নৈতিক শিক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে তখনই কাঙ্ক্ষিত মানুষ গড়ে উঠেছে এবং সমাজে পড়েছে তার ইতিবাচক প্রভাব। বর্তমান সময়ে মানব জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করলেও নৈতিক শিক্ষাকে অবহেলার কারণে আমরা না পাচ্ছি কাঙ্ক্ষিত মানুষ, না পাচ্ছি কাঙ্ক্ষিত সমাজ। এ কারণেই চোখ ধাঁধানো বর্তমান সভ্যতায় এত অশান্তি ও হাহাকার, এত অবিশ্বাস ও এত অনাচার।
শিক্ষার দীর্ঘ পরিক্রমায় মনীষীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানের কথা ব্যক্ত করেছেন। যেমন কেউ বলেছেন, ‘পশুপাখি সহজেই পশুপাখি কিন্তু মানুষ সহজে মানুষ নয়।' কেউ বলেছেন, ‘শিক্ষার লক্ষ্য হলো শরীর, মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্য বিকাশ'। মন ও আত্মার বিকাশই হলো মানুষের প্রকৃত বিকাশ। আর এই বিকাশের জন্যই প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। বর্তমান সভ্যতার বাস্তবতায় আমরা যদি ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে উন্নত জীবন চাই তাহলে আমাদের আবার ফিরে আসতে হবে নৈতিক শিক্ষার আলোকিত ভুবনে। তাই এখন শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজন প্রায়োগিক শিক্ষার সাথে নৈতিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন। মেধাবী ছাত্রদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ এই বিষয়টি আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু আমাদের সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি উপলব্ধি করেন কিনা এবং কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Tuesday, 30 November 2010

মুজিব সরকারের অভিজ্ঞতাকে কেন উপেক্ষা?

মুজিব সরকারের অভিজ্ঞতাকে কেন উপেক্ষা?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে গতি আনতে দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীরা গত শনিবার নয়াদিল্লীতে দু'টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। এক চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের শূন্যরেখা বরাবর দু'টি সীমান্ত হাট বসবে। অন্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশের পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি অন্যদেশের সীমান্ত পেরিয়ে মূল ভূ-খন্ডের ২০০ মিটার পর্যন্ত ভেতরে আসতে পারবে। ‘সীমান্তহাট' চালুর বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তিতে বলা হয়েছে, সপ্তাহে একদিন করে হাট বসবে। বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি ও আইন মেনেই সীমান্তরেখার দুইপাশে বসবে এই হাট। এখানে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো কর আদায় করা হবে না। একজন ব্যবসায়ী দিনে ৫০ মার্কিন ডলারের বেশি পণ্য কেনাবেচা করতে পারবেন না। বাংলাদেশী ও ভারতীয় মুদ্রায় পণ্য বেচাকেনা করা যাবে। সীমান্ত হাটে বেচার জন্য ১৩টি স্থানীয় স্তরে উৎপাদিত ও তৈরি কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প, ফুল, শুকনো মাছ, গামছা, লুঙ্গি, কাঠের জিনিস, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রভৃতি চিহ্নিত করা হয়েছে। পুরো হাটের নিরাপত্তা ও তত্ত্বাবধানে যৌথভাবে থাকবে বিডিআর ও বিএসএফ। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই সীমান্ত হাট দু'টি চালু হয়ে যাবে বলে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দশর্মা সংবাদ সম্মেলনে জানান।
বর্তমানে দু'টি হাটের ব্যাপারে চুক্তি হলেও হাটের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৮টি করা হবে বলে জানা গেছে। আমরা জানি, কোন চুক্তি করার সময় সাধারণত অনেক ভাল কথা বলা হয়ে থাকে। যেমন এবারও বলা হয়েছে, চুক্তির ফলে দু'দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে গতি আসবে এবং ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতিও কমতে পারে। তবে পর্যবেক্ষকমহল চুক্তিকালীন চমৎকার সব কথামালায় উৎসাহিত হতে তেমন আগ্রহী নন। এর কারণ অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা। স্বাধীনতা লাভের পর এ পর্যন্ত ভারতের সাথে যতগুলো চুক্তি হয়েছে তার কোনটাতেই লাভবান হতে পারেনি বাংলাদেশ। প্রসঙ্গত: ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি, ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ১৯৮৩ সালের তিস্তার পানি বণ্টন এডহক চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়া দু'দেশের মধ্যে আরো অনেক পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, কিন্তু এর কোনটার মাধ্যমেই বাংলাদেশ লাভবান হতে পারেনি, বরং ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে। এ কারণে এবারের চুক্তির ব্যাপারেও আশাবাদী হতে পারছেন না পর্যবেক্ষক মহল।
প্রসঙ্গত: এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্ডার-হাট বা বর্ডার-ট্রেড আমাদের জন্য নতুন কোন বিষয় নয়। ১৯৭২ সালে সীমান্ত বাণিজ্যের লক্ষ্যে বর্ডার-ট্রেড চুক্তি হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ জাতির স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই ভারতের সাথে বর্ডার-ট্রেড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি অনুসারে উভয় দেশের ১৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট পণ্য অবাধে আনা-নেওয়া ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। আর বর্ডারহাটই এইসব পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান কেন্দ্র ছিল। তবে এই চুক্তির ক্ষতিকর ফল ফলতে দেরি হয়নি। ফলে শেখ মুজিব সরকার এই চুক্তি বাতিল করতে বিলম্ব করেনি। যদিও ভারত সরকার ঐ চুক্তি অব্যাহত রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের মতামত উপেক্ষা করার মত সাহস তখন ভারতের ছিল না। কিন্তু ক্ষতিকর সেই চুক্তির ফাঁদে বাংলাদেশের বর্তমান দুর্বল সরকার কেন পড়তে গেল সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে। শেখ মুজিব সরকার যেই চুক্তি বাতিল করেছিল, সেই চুক্তিতে শেখ হাসিনার সরকার আবার আবদ্ধ হওয়ার আগে দশবার ভাবা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, ভাবনা-চিন্তার জন্য সময় নেওয়ার পরিবর্তে হাসিনা সরকার এখন ভারতের সাথে দ্রুতগতিতে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করার জন্য উৎসাহী। কিন্তু এমন উৎসাহের কারণ কী? দেশপ্রেমিক অন্যান্য সচেতন নাগরিকের মত বিডিআর-এর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমানও ভারতের সাথে ‘সীমান্ত হাট' চুক্তিতে খুশি নন। তিনি মনে করেন, এই হাটকে কেন্দ্র করে ভারতীয় নিম্নমানের বিষাক্ত পণ্যের বিস্তার ঘটবে বাংলাদেশে, হাটকে ইস্যু করে ভারতীয় পণ্য অবাধে প্রবেশ করবে বাংলাদেশে, শুধু কি তাই-- ভারতীয় চররাও ছাড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়বে এদেশে, আর ব্যবসার নামে তারা অনাকাঙ্ক্ষিত অন্য ব্যবসাও করতে পারে-- যা হবে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক। আর এই বিষয়টি আমরা কী করে ভুলবো যে, বর্ডার-ট্রেড চুক্তি করার পরও শেখ মুজিব ক্ষতির কারণে তা বাতিল করেছিলেন। তাই প্রশ্ন জাগে, কীসের তাড়নায় পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে ব্যর্থ হলেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী?

হরতাল ও রাজপথের আন্দোলন কি অপরিহার্য?

বিএনপি আহূত আজকের হরতাল নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও তার সহোদরের মধ্যে অভূতপূর্ব এক অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। সরকার এই হরতাল প্রতিহত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং ইতোমধ্যে দেশব্যাপী বিএনপি জামায়াতের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। হরতালের ব্যাপারে সরকার ও সরকারি দলকে মাঠে ময়দানে যত সক্রিয় দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলকে তত সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে না। যতটুকু সক্রিয় তাদের হবার কথা ছিল সরকারের পুলিশ বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা তাতেও বাধার সৃষ্টি করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন যে সরকারের নেতাকর্মীরা যেখানে আজীবনই হরতালের সাথে বসবাস করেছে, হরতালই যাদের জীবনযাত্রার অংশ ছিল তারাই হরতালের বিরোধিতা করছে এবং জোরের সাথে বলছে যে, এই হরতালের পেছনে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া জাতীয় কোন ইস্যু নেই। বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ সম্প্রতি বলেছিলেন যে, হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার এই সরকারের নেই। দৈনিক যুগান্তর তার এই মন্তব্যটিকে জনমত জরিপে নিয়ে আসে। এতে দেখা যায় যে, জরিপে অংশগ্রহণকারীগণ ৯৭ শতাংশ লোকই তার সাথে একমত। এটি সরকারের একটি পরাজয় বলেই আমার ধারণা।
সরকারের একজন মন্ত্রী বিএনপিকে হরতাল না করে সংসদে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শটি আমার কাছে ভালই মনে হয়েছে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতাকে সামনে রাখতে এর মধ্যে আমি ফলপ্রসূ কিছু দেখতে পাই না। এই সংসদের আমলেই বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাসী একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছে এবং ৫৭ জন আর্মি অফিসার খুন হয়েছেন, তাদের পরিবারের উপর অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে। আমাদের সংসদে এ বিষয়ে কোনও আলোচনা হতে দেখা যায়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী গত জানুয়ারি মাসে দিল্লী গিয়ে অনেকগুলো চুক্তি করেছেন, ভারতকে ট্রানজিট, করিডোর, বন্দর, গ্যাস, কয়লা ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে এসেছেন। সংসদে এ সম্পর্কে আলোচনা হয়নি এবং চুক্তির শর্তাবলী সংসদকে অবহিত করা হয়নি। একইভাবে ভারতকে ট্রানজিট ফি মওকুফ করা হচ্ছে তাও সংসদে আসেনি। এই অবস্থায় সংসদের তুলনায় রাজপথই বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলেই দেশবাসী মনে করেন। তাদের সামনে যে ইস্যুগুলো রয়েছে দেশ ও জাতির অস্তিত্বের জন্য সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রথমটি হচ্ছে আধিপত্যবাদ। সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে আধিপত্যবাদের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ধারণা। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সেনাবাহিনীর উপর হামলা হয়েছে, আমাদের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিডিআর বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যত সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রু বাহিনীর হাতেও তত কর্মকর্তা নিহত হয়নি। মেধাবী ও চৌকষ এসব কর্মকর্তাকে খুন করে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে পঙ্গু ও অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে। পরিকল্পিত এই হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক মন্ত্রী, এমপি গোপন বৈঠক করার তথ্য প্রমাণপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একজন এমপি টেলিভিশন চ্যানেলে পিলখানার তিন কিলোমিটার এরিয়ার মধ্যে অবস্থিত সকল বাড়িঘর খালি করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন; বিডিআর হেডকোয়ার্টার এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং এভাবে এলাকায় অন্ধকার ও জনমানবশূন্য করে বিদ্রোহী ও ঘাতকদের পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। সরকার এ ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা ছিল ন্যক্কারজনক। সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সরকারি ব্যর্থতার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল এবং তারা এই ষড়যন্ত্রের mastermind-দের খুঁজে বের করার জন্য অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করেছিল। একইভাবে সামরিক বাহিনীর তদন্ত রিপোর্টেও Terms of Reference-এর ত্রুটি দেখিয়ে প্রকৃত তথ্য উ ঘাটনের সমস্যা তুলে ধরে আরো তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিল কিন্তু সরকার অজানা ভয়ে সে পথে আগায়নি এবং সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত ও বশংবদ এক কর্মকর্তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে এনে তাকে দিয়ে ফরমায়েশী তদন্তের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দেয়ার একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এই তদন্তের প্রক্রিয়ায় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রায় ৯০ জন বিডিআর সদস্য প্রাণ হারান। অভিযোগ উঠেছে যে, এদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেননা এই হত্যাকান্ডের সাথে সরকারি দল ও বিদেশী একটি শক্তির সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তাদের কাছে তথ্য প্রমাণ ছিল। আমাদের সীমান্ত এখন অরক্ষিত। বিএসএফএর লোকদের মেহেরবানীর উপর আমাদের নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে। তাদের ইচ্ছামত বাংলাদেশী লোকদের তারা হত্যা করছে, প্রতিবাদ করার সাহসও আমাদের নেই। তাদের ছত্রছায়ায় ভারতীয়রা এসে আমাদের জমি দখল করছে, চাষাবাদ করছে, ফসল, গরু, ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, মাছ নিচ্ছে আমরা কিছুই করতে পারছি না। খোলা সীমান্ত দিয়ে মাদক আসছে, চরিত্র বিধ্বংসী ইয়াবা আসছে এবং আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চোরাচালান তথা অবৈধ সীমান্ত বাণিজ্য আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, আমাদের তামাশা দেখা ছাড়া আর কোনও করণীয় নেই। বিগত কুরবানীর ঈদের সময় ভারতীয় গরুর অস্বাভাবিক সমাগম সীমান্ত এলাকায় আমাদের চাষীদের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তারা তাদের মোটাতাজা করা পশুর দাম পায়নি। সীমান্ত খোলা থাকায় ভারতীয় পণ্যের বন্যায় আমাদের জাতীয় অর্থনীতি এখন বিপর্যয়ের মুখে, দেশ কার্যতঃ ভারতের বাজারে পরিণত হচ্ছে। মাদকসামগ্রী ও ভারতীয় সংস্কৃতির অপপ্রভাব আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষ সেনা কর্মকর্তাদের প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার চায়, সেনাবাহিনীকে তার সার্বভৌম অবস্থানে ফিরে পেতে চায় এবং আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তি চায়। আমরা ভারতকে বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, প্রভু হিসেবে নয়। বন্ধুত্বের অর্থ যে দাসত্ব নয় তাদেরকে তা বুঝিয়ে দেয়ার দরকার রয়েছে।
মহাজোট সরকারের লীড এজেন্সি আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার তালিকায় যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েছিল তার মধ্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন, জ্বালানি সংকট নিরসন তথা বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহের উন্নতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রভৃতি ছিল মুখ্য। সরকারের অগ্রাধিকার বর্ণিত এই বিষয়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার ব্যর্থতা সুস্পষ্ট। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ছাড়াও সরকারের সৃষ্ট মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নিজেই বলছেন, বাংলাদেশে এখন মানবাধিকার বলতে কিছু নেই, মানুষের জীবন ও সম্পদ, সম্মান কোন কিছুরই এখন নিরাপত্তা নেই। এই সরকারের আমলে লাম্পট্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে। বখাটে লম্পটরা শুধু মেয়েদেরই শিকার বানাচ্ছে না, তাদের মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, শিক্ষক প্রতিবেশী যারাই তাদের লালসা পূরণে বাধা দিচ্ছে অথবা প্রতিবাদ করছে তাদেরই নির্মমভাবে প্রহার করছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মেরেই ফেলছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত করেও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। মেয়েরা শংকিত। দেশব্যাপী এই মহামারির কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, এর সাথে শতকরা নববই ভাগ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত। সরকার তাদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত ও সহানুভূতিশীল। ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিয়ে তারা তাদের লাম্পট্য চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত: যে দলের নেতাকর্মীরা ধর্ষণের ন্যায় জঘন্য অপরাধ করে প্রকাশ্যে শততম ধর্ষণের উৎসব উদযাপন করতে পারে তাদের হাতে দেশের নারী সমাজ নিরাপদ থাকতে পারে না। এই দলেরই ছাত্র সংগঠনের বালিকা শাখার নেত্রীদের বিরুদ্ধে দেহব্যবসার অভিযোগ উঠেছে। ইডেন ও বদরুন্নেছা কলেজসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় মহিলা কলেজগুলোর ছাত্রীরা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছে যে, এই সংগঠনের নেত্রীরা ছাত্রনেতা-রাজনৈতিক নেতাসহ ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের মনোরঞ্জনে জুনিয়র ছাত্রীদের বাধ্য করে। তাদের আদেশ অমান্য করলে হল থেকে বের করে দেয় এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। অনৈতিক কাজে ছাত্রীদের বাধ্য করার এই ঘটনাগুলো নজিরবিহীন এবং আওয়ামী লীগ সরকার অদ্যাবধি এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এর ফলে তাদের দাপট শুধু অপ্রতিরোধ্য হয়নি সারাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে।
জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বত্র নির্লজ্জ দলীয়করণ বর্তমানে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দলীয় আনুগত্য এখন পদোন্নতি-পোস্টিং-এর প্রধান শর্তে পরিণত হয়েছে। দক্ষতা, যোগ্যতা, দেশপ্রেম, চাকরি জীবনের কৃতিত্ব ও নিরপেক্ষ আচরণ অযোগ্যতা হিসেবে এখন চিহ্নিত হচ্ছে। যারা আওয়ামী লীগ করে না, দল নিরপেক্ষভাবে জনগণের খেদমতে বিশ্বাসী তারা চিহ্নিত হচ্ছে পাকিস্তানপন্থী, বিএনপি, জামায়াতপন্থী হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সম্প্রতি কোনও প্রকার রাখঢাক ছাড়াই ঘোষণা করেছেন যে, জনপ্রশাসনে পাকিস্তানপন্থীরা পদোন্নতি পাবে না। আমি বাংলাদেশের নাগরিক জন্মসূত্রে, পূর্বপুরুষ সূত্রে, খাজনা, ট্যাক্স দেই এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সরকারি চাকরিতে এসেছি, খাঁটি বাংলাদেশী হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী কোনও দলের নয় এবং এখানে দল করা, দলের আশ্রয় নেয়া, দলকে চাঁদা দেয়া নিষিদ্ধ। সরকার এই নিষিদ্ধ কাজে এখন উৎসাহ শুধু দিচ্ছে না যারা তা করছে তাদের পুরস্কৃতও করছে। বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা পাকিস্তানী হন কি করে? ভারত কর্তৃক স্থল ও নৌ ট্রানজিট ব্যবহারের জন্য ফি আদায়ের সুপারিশ করে নথিতে নোট দেয়ার জন্য, না সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের পাখির ন্যায় গুলী করে হত্যা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানোর প্রস্তাব করার অপরাধে? জলাতঙ্ক রোগীর ন্যায় সরকার এখন দুটি আতঙ্কের শিকার হয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। এর একটি হচ্ছে পাকিস্তান আতঙ্ক, অন্যটি ধর্মাতঙ্ক। যে কেউ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করবে, আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যে নিষ্ক্রিয় থাকবে অথবা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবে এ সরকারের দৃষ্টিতে এ দেশে থাকার এবং রাজনীতি করার তার কোনও অধিকার নেই। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের আগে প্রতি পরিবারের কমপক্ষে একজনকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে তারা এখন প্রকাশ্যে ঘোষণা করছেন যে, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে সরকারি চাকরি দেয়া হবে না এবং কার্যত তাই করছেন। চাকরি এখন সোনার হরিণ। ক্ষমতাসীনরা এই সুবিধাকে উপার্জনের মাধ্যম করে নিয়েছেন। কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা না হলে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকের চাকরি পাওয়া যায় না। পিয়ন দারোয়ানের চাকরিও ঘুষ না দিলে হয় না। পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি পেতে হলে ৮/১০ লাখ টাকা লাগে। সরকারের একজন উপদেষ্টা কোনও প্রকার রাখ ঢাক না করেই ঘোষণা করেছেন, টাকা যদি নিতেই হয় নিজের লোকদের থেকেই টাকা নিয়ে চাকরি দেয়া হবে। জামায়াত বিএনপির লোকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার দরকার কি? দেশে কর্মসংস্থানের বাজার এখন আক্রা, বিদেশের দ্বার রুদ্ধ। সরকারের অযোগ্যতা ও কূটনৈতিক অদক্ষতা জনবল রফতানির বাজারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। জনগণ তাদের সামনে পরিত্রাণের কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছে না। জনপ্রশাসনকে যে বিশৃক্মখল অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে তা থেকে আশু উত্তরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ হচ্ছে বিদ্যমান প্রশাসনের অবস্থা। পাবলিক সার্ভিস কমিশন নতুন যে জনবল নিয়োগ করছে তাতেও মেধার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যকে প্রধান নিয়ামক হিসেবে দেখা হচ্ছে। চাকরি প্রার্থীর ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতো কি না, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক ছিল, বিএনপি-জামায়াত কিংবা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ অন্য কোনো দলের সমর্থক ছিল কি না এসব বিষয়কেও তুলে আনা হচ্ছে। আবার প্রার্থীরা শুধু আওয়ামী লীগ হলে হবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, আওয়ামী লীগ হবার পাশাপাশি যদি অমুসলিম বিশেষ একটা সম্প্রদায়ের লোক হয় তাহলে ডাবল বোনাস পাবার যোগ্য হয়। নন-গেজেটেড কর্মচারী নিয়োগের বেলায়ও সাধারণ মানুষের ছেলে-মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা নিয়োগ পরীক্ষা হতে দিচ্ছে না, হল ভাংচুর করছে, সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর করে পরীক্ষা ভন্ডুল করে দিচ্ছে। সরকার এ ক্ষেত্রে শুধু নির্বিকার নয়, অপরাধীদের অপরাধ কর্মের উৎসাহদাতার ভূমিকাও পালন করছে। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
শিক্ষাঙ্গন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রলীগের অপরাধ তৎপরতা দেশ-বিদেশে এখন আলোচনার বিষয়বস্তু। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এর নিন্দা করে এই অঙ্গ-সংগঠনটির সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। একাধিক জাতীয় দৈনিক ক্ষমতাসীনদের এই ছাত্র সংস্থাটির অপকর্মের দৃষ্টান্ত ও ফিরিস্তি দিয়ে বিশেষ রিপোর্ট, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এমনকি বিশেষ সাপ্লিমেন্টও প্রকাশ করেছে। ‘‘প্রধানমন্ত্রী, এদের সামলান’’ শিরোনাম দিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা ছাত্রলীগের অপকর্ম রোধ এবং মারাত্মক অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু লোক দেখানো দু'একটা এরেস্ট ছাড়া আর কিছু হয়নি। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, ভর্তি বাণিজ্য- অনৈতিক এমন কোনও কর্মকান্ড নেই যার সাথে ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্র সংগঠনটির সম্পৃক্ততা নেই। তাদের কর্মকান্ডে দেশব্যাপী মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। কিন্তু দেশবাসী কি দেখছে? এদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা তাদের সংযত করার পরিবর্তে সরকার অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃক্মখলা বাহিনীকে তাদের বশংবদ বানিয়ে দিচ্ছে। প্রতিপক্ষের ওপর তারা সশস্ত্র হামলা করছে, তাদের পেছনে পুলিশ এসে নির্যাতিতদের এরেস্ট করছে। কোথাও ছাত্রলীগ পুলিশের অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে কাজ করছে, আবার কোথাও পুলিশী একশানের পর ছাত্রলীগ প্রতিপক্ষের ওপর আবার হামলা করছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। পক্ষান্তরে ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে মহড়া দেয়া সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে কিছুই করতে দেখা যায় না। বরং সরকারকে এখানে দুটি মারাত্মক কাজ করতে দেখা যায়। এক. ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের পুলিশ ও আইন-শৃক্মখলা বাহিনীতে absorb করা; দুই. তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া। অভিযোগ উঠেছে গত ২২ মাসে পুলিশসহ আইন-শৃক্মখলা বাহিনীতে যত লোক নিয়োগ করা হয়েছে তার ৯০ শতাংশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো থেকে এসেছে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে ছাত্রলীগের কর্মকান্ডকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তারা গত অক্টোবর মাসে ইউনিয়ন পর্যায়ে কনভেনশন অনুষ্ঠান শুরু করেছে এবং এতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও অংশ নিচ্ছে। অপকর্ম দোষে দুষ্ট ও স্বয়ং আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিন্দিত ও স্বীকৃতি প্রত্যাহৃত এই সংগঠনটির নেতৃত্ব বাছাইয়ের এক প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত হাস্যাস্পদভাবে এক সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে নেতৃত্ব প্রার্থীদের রক্ত ও পেশাবের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার নিয়ম চালু করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সরকার তাদের অপকর্ম প্রতিহতও করেনি বরং সারাদেশে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। এর অর্থ কি এ দাঁড়ায় না যে সরকারের নীল-নকশাতেই তারা কাজ করছে এবং প্রতিদ্বনদ্বীদের নির্মূলে এই অপশক্তিকে তারা অস্ত্র সজ্জিত করে ব্যবহার করছে? এখন তো অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যেখানে অপরাধ-অপকর্ম সেখানেই ছাত্রলীগ। তাদের সাথে এখন শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার্থীর কোনও সম্পর্ক নেই। দেশ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়।
দেশজুড়ে চলছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাস। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যার সামান্য নমুনা বেগম জিয়াকে বাড়ি থেকে উৎখাতের মধ্যদিয়ে দেশবাসী দেখেছে। গুপ্ত হত্যা, পুলিশ হেফাজতে খুন, আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম, ছিনতাই, ডাকাতি, হানাহানি, মারামারি দেশব্যাপী এখন ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে এখন এমন সব ভয়ঙ্কর অপরাধ হচ্ছে যা ইতঃপূর্বে মানুষ শোনেনি। ইভটিজিং, নারী নির্যাতন নতুন মাত্রা পেয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী সন্ত্রাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহীরা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হিন্দু সম্প্রদায়সহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মামলাবাজি নিত্যনতুন কৌশলে বন্দি নির্যাতন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলের সরকারি অপপ্রয়াস ও অঙ্গীকার এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পরিচালিত তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ এজেন্ডা বাস্তবায়নের বিদেশী পরিকল্পনা। ধর্মকে যারা আফিম তুল্য বলে মনে করেন, স্রষ্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে যারা জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য বলে গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্র পরিচালনায় তারাই এখন আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে এই দেশকে ধর্মহীন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীর অশ্লীল ব্যালে নৃত্যের দৃশ্য যারা পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন তাদের কাছে এখন পরিষ্কার যে সরকার কোন্ ধরনের ইসলাম চায়। সরকারের দৃষ্টিতে আমাদের হক্কানী আলেম উলামারা এখন গোমরাহ, ইসলামের ব্যাখ্যা করেন মদ্যপ মন্ত্রী ও সুরঞ্জিতের মত ব্যক্তিরা। তাদের দৃষ্টিতে আলেম উলামা, মাদরাসার ছাত্র, দাড়ি টুপিওয়ালা ধার্মিক ব্যক্তি মাত্রই জঙ্গি এবং এদের উৎখাত করার জন্য প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতায় তারা একটি টাস্কফোর্সও গঠন করেছেন। এই অবস্থায় এ দেশের মুসলমানরা কি বসে থাকবেন? ধর্ম, ধর্মীয় বিশ্বাস, নীতি নৈতিকতা কোনটাই আজ এই সরকারের কাছে নিরাপদ নয়। এর নিরাপত্তা বিধানে জাতিকেই এগিয়ে আসতে হবে।
দ্রব্যমূল্য ও মানুষের জীবনযাত্রার অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। ১০ টাকা সের চাল আর বিনা পয়সায় সার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যাবার দু'মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এই প্রতিশ্রুতি অস্বীকার করে। চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিএনপি জোটের আমলে যে চালের দাম কেজি প্রতি ১৪ টাকা ছিল তা এখন অন্যূন ৩৫ টাকায় উঠেছে। আঠার টাকা কেজি দরের চাল এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল, রসুন, পিঁয়াজ, মসল্লা, তরিতরকারি এমন কোনও পণ্য নেই যার মূল্য তিন থেকে দশ গুণ বৃদ্ধি পায়নি। দুই শয়নকক্ষের যে ঘর ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা তা এখন ১০ হাজার টাকায় উঠেছে। যে দূরত্বে ১০ টাকা ভাড়ায় রিকশা যেতো সে দূরত্বে এখন ত্রিশ টাকা দিতে হয়। বাস ভাড়া, ট্রেন ভাড়া, লঞ্চ ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দামসহ বাড়েনি এমন পণ্য ও সেবা সামগ্রী নেই। অথচ এর তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় ১০ শতাংশও বাড়েনি। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলে থাকাকালে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অভিযোগ তুলে ৪ দলীয় জোট সরকার তার মেয়াদকালে ১৮৬০০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। এখন গত ২২ মাসে তার সরকার ও দল কত লক্ষ কোটি টাকা উপার্জন করেছেন তার হিসাব দেয়ার সময় সম্ভবত এসেছে। তার মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন তবে তা ভাঙ্গা যাবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে সরকারি দল ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশবাসীর সামনে আন্দোলন ছাড়া আর কি কোন বিকল্প আছে?
বিদ্যুৎ গ্যাসের সংকট সরকার নিরসন করতে পারেনি। নিজের অযোগ্যতা ও দুর্নীতি ঢাকার জন্য এখনো তারা জোট সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন। এই খাতগুলো এখন প্রতিবেশী দেশের কব্জায় আবদ্ধ। ক্ষমতার বিনিময়ে ক্ষমতাসীনরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যে বাংলাদেশের গ্যাস ও কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ভারত আমাদের দেশে বিদ্যুৎ রফতানির জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রস্তুতির আমরাও অংশীদার। জনগণ কি এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকতে পারে? বিদ্যুতের অভাবজনিত লোডশেডিং এ তাদের জীবন এখন বিপন্ন, কলকারখানার উৎপাদন বিঘ্নিত, নতুন কারখানা তৈরি বা সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া বন্ধ, ফলে স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হার মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে এবং বেকার সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার এ ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত। কাজেই পরিত্রাণের উপায় দেশবাসীকেই বের করতে হবে।
এই সরকারের দুর্নীতি দমন তৎপরতা সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। সরকারের এমন কোনও খাত নেই যেখানে এখন দুর্নীতি নেই। এ ব্যাপারে বদরুদ্দীন ওমরের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, সমাজে আজ যেভাবে সব ধরনের দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি তার শেকড় বিস্তার করেছে এর মূল কারণ ১৯৭২ সাল থেকে সরকারি পর্যায়ে ও সরকারের লোকজনদের দ্বারা ঘটতে থাকা দুর্নীতি, ১৯৭২ সালে সরাসরি লুটপাট দিয়ে শুরু হলেও ক্রমেই তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। লুটপাট এখন বাংলাদেশে এক সুসংগঠিত ব্যাপার। লুটপাটকে দায়মুক্তি দিয়ে এই সরকার পার্লামেন্টে আইনও করেছে। বলাবাহুল্য, ৭২ সালের সরকার আর বর্তমান সরকার একই দলের ও চরিত্রের সরকার। বৃটিশ রাজ পরিবারের রাজা বা রাণী ছাড়া আর কারুর দায়মুক্তি নেই কিন্তু আমাদের দেশে আছে বলে মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির কথা বলা এখানে মহাপাপ। বললে মানহানির মামলা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হলে তার বিচার হয় না, তা প্রত্যাহার হয়ে যায়। এই অবস্থায় দেশ যদি দুর্নীতির আখড়া না হয়, তাহলে কি হবে? দেশের মানুষ যদি তা না চান তাহলে পথে নামা ছাড়া বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।

Wednesday, 10 November 2010

ঈশ্বরের অস্তিত্ব

বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মাঝে মাঝে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছেন। আর এর কারণ অলৌকিক কিছু নয়। তিনি বেশ কয়েকবার তার নতুন ধারণা বা তত্ত্ব দিয়ে মানুষের মাঝে বিস্ময়ের সৃস্টি করেছেন মাত্র। সম্প্রতি স্টিফেন হকিং তার দ্যা গ্রান্ড ডিজাইন বইতে মত প্রকাশ করেন, মহাবিশ্ব ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি, নিজে থেকেই এই বিশ্ব তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, হকিং পূর্বে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন এবং জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তার নতুন বই-এ তিনি বলেছেন, বিগ ব্যাং ছিলো পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী অবশ্যাম্ভাবী একটা ঘটনা। তিনি ১৯৮৮ সালে তার বেস্ট সেলিং অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম বইতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিলেন এভাবে বিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের ভূমিকা আছে

দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন বইতে স্টিফেন হকিং বলেন, শূন্যতা থেকেই অবশ্যম্ভাবীরূপে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে পারে, কেননা তাতে অভিকর্ষ শক্তির নিয়ম কার্যকর রয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিই এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ, আর সেকারণেই মহাবিশ্ব টিকে আছে, আমরা টিকে আছি। আর মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরের আলো জ্বালানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

স্টিফেন হকিং এর সাম্প্রতিক এ বক্তব্যে বিশ্বজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। পূর্বে বিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের ভূমিকা আছে বক্তব্যে ঈশ্বরে বিশ্বাসীগণ তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বক্তব্যে নাস্তিকতায় বিশ্বাসীগণ সস্থি প্রকাশ করলেও প্রচন্ড সমালোচনা করছেন ঈশ্বরবাদীগণ। তবে এ ধরনের বক্তব্যকে অনেকেই বাণিজ্যিক কারণ হিসেবে খুজে পেয়েছেন।

Monday, 8 November 2010

১০ টাকা কেজি'র চাল নিয়ে কথা চালাচালি এবং সরকারের আদমছুরত

১০ টাকা কেজি'র চাল নিয়ে কথা চালাচালি এবং সরকারের আদমছুরত
সরকারের অহংকার, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জনগণ তাদের পাঁচ বছরের জন্য শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ‘দিনবদলের ডিজিটাল' বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জাদুর চেরাগ তাদের হাতে আছে। পাঁচ বছরে না হলে আরও ৫ বছর তারা জনগণের থেকে ভালবাসার দাবিতেই ছিনিয়ে নিতে পারবেন। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে মৃদুকণ্ঠে কেউ কেউ মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাই করার দাবি জানিয়েছেন। এটাকে সরকারের গলাবাজ-স্তাবকরা ‘মামা বাড়ির আব্দার' বলে উপহাস করেছেন। কেউ কেউ সংসদে এসে অনাস্থা প্রস্তাব ‘মুভ' করতে বলেছেন।
মোক্ষম কথা! সংসদীয় রাজনীতিতে সরকার পতনের জন্য ‘নো কনফিডেন্স' বিল মুভ করাই রেওয়াজ। সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন থাকায় সরকারী দল কনফিডেন্টলি নো-কনফিডেন্স বিল আনতে বিরোধী দলকে টুইস্টিং করতেই পারে। তবে জনমতের ওপর সরকারের আস্থা থাকলে এবং গণতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্ট থাকলে বিরোধী দলকে বোল্ড করতে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়াই তাদের উচিত। মধ্যবর্তী নির্বাচনেই উভয় দলের রাজনীতিতে টিকে থাকার একটা ফায়সালা হয়ে যেতে পারে। সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতে বিরোধীদলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের যেসব বায়বীয় অভিযোগ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আনছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনে তারও একটা শান্তিপূর্ণ নিত্তি হতে পারে। প্রতিটি সংসদীয় সরকারের মেয়াদকালেই অবরোধ, ভাংচুর, হরতাল, নৈরাজ্য, সংঘাত, হত্যা, নির্যাতন, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটে। এগুলো ঔপনিবেশিক আমলের রেওয়াজ। সরকার ও বিরোধী দল সংসদ ও সংসদের বাইরে মিলে-মিশে সমঝোতায় রাষ্ট্র শাসনের গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করতে না পারায় রাজনীতি ক্রমশ ধোঁয়াশে ও সংঘাতমুখী হয়ে উঠেছে। এর বিকল্প হচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার সাংবিধানিক মেয়াদের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত ক্ষমতার গদি অাঁকড়ে থাকতে অভ্যস্ত। গণতন্ত্রের ক্যারিশমা দেখাতে গিয়ে তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফাঁদে পড়বে না। সুতরাং বিরোধীদল যদি শেখ হাসিনার মতো ‘আঙ্গুল বাঁকা করে', বা ‘ঝাঁকি দিতে' না পারে, তাহলে তাদের কাছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি না তোলাই ভালো।
তবে মধ্যবর্তী নির্বাচন যদি ‘মামাবাড়ির আব্দার' না হয়, তাহলে ক্ষমতাও কারো চিরস্থায়ী ইজারা বা পৈতৃক সম্পত্তি নয়। ক্ষমতায়নের মূল শক্তি জনগণ। জনগণ ম্যান্ডেট দিয়ে কোন ভুল করেননি এবং জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে সরকার তাদের সেবক না হয়ে দানব হতে পারে না। সত্যি আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দিয়ে জনগণ কোন পাপ করে থাকলে তার প্রায়শ্চিত্তের জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনে মুক্তি চান। জনগণ সরাসরি পার্লামেন্টে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করা বা দাবি-দাওয়া জানিয়ে সরকারকে সুপথ দেখাতে পারে না। জনগণের প্রতিবাদ ও দাবি জানানোর দুটি মাধ্যম আছে। একটি সভা-সমাবেশ-প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানানো। অন্যটি সংবাদপত্র। প্রথমটি জনগণের অরহিতকর সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। দ্বিতীয়টির সাথে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জড়িত। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, সাংবাদিকরা গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন, তবে অপপ্রচার করা যাবে না। সরকার ও বিরোধী দলের যেমন ভিন্ন ভিন্ন নীতি-অবস্থান রয়েছে, তেমনি গঠনমূলক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নিয়েও ঐকমত্য আশা করা যায় না। এক দলের কাছে যা ‘অপপ্রচার' অন্যদলের কাছে তা গঠনমূলক সমালোচনাও হতে পারে। গণতন্ত্র হচ্ছে শত ফুল ফোটা ও শত মতের বিকাশের অবারিত সুযোগ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই গণতন্ত্রের সারবত্তা।
সরকার ও বিরোধী দলের মতের বাইরেও তৃতীয় কোন মতও থাকতে পারে। মতে মতে মতান্তর হয়। কিন্তু মতান্তর নিয়ে সংঘাতের বিপদটাই ভয়ঙ্কর। একের মত যখন অন্যের ওপর জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হয়, অথবা অন্যের মত প্রকাশ যখন ফ্যাসিবাদী জিঘাংসায় হরণ করা হয়, তখনই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে গণতন্ত্র অক্কা পায়।
‘দিনবদলের ডিজিটাল' সরকার গণতন্ত্রের যে ফ্যাসিবাদী রূপান্তর ঘটিয়ে বিগত ১৮/১৯ মাস ধরে দেশবাসীকে নাগরদোলায় ওলট-পালট করছেন, তাতে জনগণের অবস্থা দাঁড়িয়েছে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।' সুতরাং মধ্যবর্তী নির্বাচনটা এখন জনগণেরই দাবি।
মার্কিন মুলুকে সিনেট ও কংগ্রেসের [প্রতিনিধি পরিষদ] সাম্প্রতিক মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভরাডুবি ঘটেছে। কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা-সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের কাছে। এই পরাজয়ের পুরো দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন এবং রিপাবলিকানদের সাথে রাষ্ট্র-সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তিনি কম্প্রোমাইজ করে চলার প্রস্তাব তথা নীতিমালা ঘোষণা করেছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরাজয়ের ক্লান্তি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা ‘বৃহৎ' গণতন্ত্রের দেশ ভারত সফরে এসেছেন। ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ডেমোক্র্যাট দলের জনপ্রিয়তায় ধসের দায়বহন করে অনুজ্জ্বল একটা ইমেজ নিয়ে তিনি ভারতে এসেছেন। তবে এটা তাঁর পূর্বনির্ধারিত সফর।
ভারতেও মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজীর রয়েছে। তবে ভারতে গণতন্ত্রের উপরিভাগে যে চকচকে রংয়ের প্রলেপ, তার নিচে রয়েছে কলংক-দাগ এবং কদর্যতার ক্ষত-চিহ্ন। এই নিয়েই ভারত জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদে ‘ভেটো' শক্তির অধিকারী স্থায়ী সদস্য হতে চায়। পত্রিকান্তরের খবর : ভারতের নিরাপত্তা পরিষদ-সদস্যপদ অর্জনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মদদ দেবে। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব অবশ্যই ওবামা-মনমোহনের আলোচনার বিশেষ জায়গা জুড়ে থাকবে। প্রেসিডেন্ট ওবামার নিরাপত্তার অজুহাতে মার্কিন নৌ-বাহিনীর রণতরী আরব সাগরে মুম্বাই উপকূলে টহল দিতে শুরু করেছে। এটা ভারত-মার্কিন ভবিষ্যৎ সামরিক ‘মর্দামীর' একটা আগাম মহড়া বলেই অনেকে মনে করেন। এতে স্বীয় নিরাপত্তায় চীন এবং চীনের সাথে তলে তলে সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা পাকিস্তানের জন্য সতর্ক বার্তাও রয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ভারতকে এ অঞ্চলের একক মোড়ল হিসেবে তাকে ইজারাদার বানিয়ে যায়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী। ভারত-মার্কিন মদদে নিজেকে যতোই শক্তিশালী ও বেপরোয়া ভাবুকনা কেন, এর প্রতিক্রিয়ায় তার জন্য যে ধরনের মানবিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, তা-ও তাকে সামলাতে হবে। ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণ্য গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত একটি দেশের ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। এটা তাকে করতে হচ্ছে গান্ধীজির ‘অহিংস' নীতি ও পন্ডিত নেহেরুর কিংবদন্তীর জোট নিরপেক্ষ নীতির মসৃণ গালিচা পদদলিত করে। অবশ্য ভয়ংকর গণহত্যার রক্তাক্ত ইতিহাসের খলনায়ক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ সাহেবের উত্তরসূরী প্রেসিডেন্ট ওবামা রাষ্ট্রীয় সকল অপকর্ম ও গণহত্যার কলঙ্ক নিয়ে রাজঘাটে ‘মহাত্মা' গান্ধীর সমাধিতেও শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছেন। গান্ধীজি তার হত্যাকারী উগ্র জনসংঘ নেতা নাথুরাম গডসে-কে ক্ষমা করতে পারলেও লাখো লাখো নিরপরাধ শিশু-নারী-পুরুষের ঘাতক দেশের প্রেসিডেন্ট ওবামার পদার্পণে হয়তো আত্মায় পীড়ন অনুভব করবেন। তবে ভারতের বিশ্বশক্তি হবার জন্য গান্ধীজিকে এতটুকু ত্যাগ স্বীকার না করলেই বুঝি চলে না! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের নিরাপত্তা পরিষদে সদস্যপদ লাভের জন্য আগাম সমর্থন ব্যক্ত করে এসেছেন। ভারত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হলে বাংলাদেশ অন্তত : ‘মোর চাচা চৌকিদার' বলে বড়াই করতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যবর্তী নির্বাচনে মার্কিন জনমতের এই ইউ-টার্নকে কীভাবে দেখছেন, আমরা জানি না। তবে ১৮/১৯ মাস আগে বাংলাদেশের জনগণ যে প্রেক্ষাপটে ও প্রত্যাশ্যয় আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দিয়েছে, সে অবস্থাটি এখন নেই। জনগণের পক্ষে সে কথাটিই বিরোধীদল বলছে। সংসদে ৩০০ আসনের মধে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ অর্থাৎ ৩০টি আসনের অধিকারী হলেও ভোটপ্রাপ্তির অনুপাত বিরোধীদলের ৩০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার যতো দক্ষ ও সফলই হোক না কেন, ক্ষমতার হানিমুনের আমেজ তাদের বেশিদিন স্থায়ী হয় না। স্বভাবগতভাবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণী এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট, সরকারের নিন্দুক। সাধারণ মানুষও অল্পসময়ে বেশি পেতে চায়। ফলে সরকারের পক্ষের জনমত উল্টোমুখী হতে সময় লাগে না। উল্টো জনমতের সবটুকু বিরোধীদলের পক্ষে না আসলেও সরকারের পক্ষে আর তারা নেই এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে তারা আওয়ামী লীগকে দ্বিতীয় দফায় যে ভোট দেবে না, এটা ধরে নেয়া যুক্তিযুক্ত। প্রতিদিন দেশের গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের নীতি-অবস্থান ও সফলতা-ব্যর্থতা, দক্ষতা-অদক্ষতার ওপর যেসব অনলাইন জরিপ চালাচ্ছে, তার শতকরা ৮০ ভাগই সরকারের বিপক্ষে থাকে। এটাকে যদি জনমতের প্রতিফলন হিসেবে ধরে নেই, তাহলে সরকার সংখ্যালঘিষ্ট জনমতের ওপর চাপাবাজি-সন্ত্রাসের জোরে দাঁড়িয়ে আছে। সংসদীয় সংখ্যাতাত্তিক অহমিকার শুভঙ্করের ফাঁকি প্রকৃত জনমতকে রিফ্লেক্ট করে না।
আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের ‘নিঃসঙ্গ শেরপা'র মতো দল ও সরকারের বাড়াবাড়ি ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বিবেকের প্রহরীর মতো যা কিছু বলছেন, তা ‘হাইব্রীড' আয়ামী লীগারদের দাপটে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গুরুত্বহীন প্রলাপ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এককালের নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রবীণ সাংবাদিক ফকির আবদুর রাজ্জাক ওবায়দুল কবীরকে সমর্থন করে লিখেছেন: ‘‘সাধারণ মানুষ, সমর্থক গোষ্ঠী ও কর্মীরা ধৈর্য রাখতে পারছে না। তারা এখনই সুফল হাতে পেতে চায়। এ চাওয়ায় অস্বাভাবিকতা সকলেও অন্যান্য নয়। অতীতে যারা দেশের এজরুরি খাতগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগায়নি, তারা দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়নি সত্যি, কিন্তু এ সরকারের বিলম্বেতেও জনগণ খুশি নয়।
ওবায়দুল কাদের এসব অগণিত ধের্যহারা মানুষের মনের কষ্ট হৃদঙ্গম করেই ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের অভ্যন্তরে থেকেও বেসুরো বক্তব্য রেখে তার নিজের মনের দুঃখ প্রকাশ করেছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর সার্বিক অবস্থা যে ভালো না, তা সরকার গঠনের পর থেকেই রাজনীতি সচেতন মানুষ লক্ষ্য করেছে। সরকারও দলের মধ্যে ন্যূনতম বিভাজন বা পার্থক্য তৈরি করে দলের স্বাভাবিক সাংগঠনিক গতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে নেতারা। এ ব্যাপারে দলের সভানেত্রী মাঝেমধ্যে চেষ্টা করেও এখনো সফল হতে পারেনি। দলের জন্য জরুরি ছিল একজন সার্বক্ষণিক সাধারণ সম্পাদকের। কিন্তু সেখানেও মন্ত্রিত্ব ও সম্পাদক একত্রিত হয়ে কেবল নৈরাজ্যই বাড়িয়ে চলেছে। সময় আসলেই দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন দল ও সরকারের ব্যাপারে মূলত শেখ হাসিনাকেই কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, সব ব্যর্থতার দায়ভার অন্য কেউ নয়, তাঁর ওপরই বর্তাবে। [আত্মসংযম, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির সেই কথা- ফকীর আবদুর রাজ্জাক, সংবাদ, ৬/১১/১০] সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার নেতা বি. চৌধুরী বলেছেন : ‘কিছু এমপি এবং থানার গারোগা এক হয়েছে আপনাকে [প্রধানমন্ত্রী] ডুবাবার জন্য। তারা বিভিন্ন স্থানে হ্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হয়রানি ও দুর্নীতি সবই তারা করছে। শিক্ষা না নিলে শেখ হাসিনার সরকারের জন্য ওবামার নির্বাচনী ফলাফলের পরিণতি হওয়া বিচিত্র নয়। (ইনকিলাব, ৬.১১.১০]
প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলের অপপ্রচার মোকাবিলা তথা সরকারের সাফল্য জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য তৃণমূল পর্যায়ের দলীয় নেতাদের ব্রীফ করেছেন। তাদের জন্য রাজনৈতিক ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছেন। তবে আমরা মনে করছি, বিরোধীদলকে মোকাবিলার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একাই একশ। তাঁর সাথে আছেন সৈয়দ আশরাফ, সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, শামসুল হক টুকু, এডভোকেট কামরুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম হানিফ প্রমুখের মতো চ্যাম্পিয়ন শব্দ সন্ত্রাসীরা। এরা শতকণ্ঠে কোরাসে অশ্রাব্য শব্দ চয়নে বিরোধী দলকে হাইকোর্ট দেখিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলকে গাল-মন্দ দেবার জন্য দলীয় নেতাদের জিহবাকে ধারালো করার জন্য প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছেন। তাও ভালো। তাহলে এবার পুলিশী সন্ত্রাস ও দলীয় ‘সোনার ছেলেদের' তান্ডব থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রেহাই দিন! যা করার শব্দ-সন্ত্রাসেই করুন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর চালাবেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ১০ টাকা কেজি দরে চাল ও বিনামূল্যে সার দেবার কথা তিনি বা তাঁর দল-বলেননি। এটা বিরোধী দলের অপপ্রচার। নির্বাচনের সময় তাঁরা কে কী বলেছেন, বিরোধী দল বা মিডিয়া তা স্মরণ রাখলেও সাধারণ মানুষ কী তা মনে রাখে? ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেবার প্রসঙ্গ টেনে এনে প্রধানমন্ত্রী একটি বিস্মৃত রাজনৈতিক বকাওয়াজকে চাঙ্গা করলেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পের নায়িকা কাদম্বিনী যেমন মরিয়া প্রমাণ করেছিল যে, এর আগে তার মৃত্যুর খবরটি ছিল ভুয়া, তেমনি প্রধানমন্ত্রী ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবার কথা অস্বীকার করে প্রমাণ করলেন যে, তিনি কথাটি আসলেই বলেছিলেন। আর বলেছিলেন বলেই অপরাধপ্রবণ উপলব্ধি থেকে তিনি তাঁর ঐ বেফাঁস উক্তিটির কবর দিতে চান। কিন্তু কোথায়, কখন শেখ হাসিনা ১০ টাকা কেজি চাল ও বিনামূল্যে সার দেবার কথা বলেছেন, তা উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করলে প্রধানমন্ত্রীর দুর্বল স্মৃতিশক্তি ফিরে আসতেও পারে। প্রধানমন্ত্রীর মুখে এতটা স্থুল কথা শোভা পায় না। বরং এ কথা না তুললেই তিনি ভালো করতেন। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ার কথা শেখ হাসিনা যখন বলেছিলেন, তখন সাধারণ মানুষও তাঁর কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, সরকার অন্ততঃ ১৫/২০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াতে পারবে। কিন্তু খোলা বাজারে সরকার যে নিম্নমানের চাল বিক্রি করছে তার কেজিও ২৪ টাকা। এ চাল সংগ্রহ করতে সময় ও ভোগান্তি ছাড়াও ওজনে সঠিক হয় না। ফলে কার্যত এর দামও কেজি প্রতি প্রায় ৩০ টাকাই পড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী এর আগে বলেছেন, চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকলে চালের কেজি ৮০ টাকা হতো। জনগণের প্রশ্ন, সেটা কীভাবে? অনেকে মনে করেন, তখন আওয়ামী লীগই বাজার ম্যানপুলেট করে এটা করতো। তবে এবারে সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট শক্তিশালী হওয়ায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোন হাত নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান সিন্ডিকেট অস্বীকার করলেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের মধ্যে সিন্ডিকেট ঢুকে গেছে। সিন্ডিকেট সরকারের লেজ না মাথায় উঠে বসেছে তা তিনি বলেননি। চাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কথা উল্টে ফেললেন, তাতে হয়তো আর কিছুদিন পর বলবেন, তিনি ‘দিনবদলের' কথাও তিনি বলেননি। আদালত প্রধানমন্ত্রীকে ‘হট হেটেড' বললেও জনগণ তাঁর কাছে ওজনদার কথাই আশা করেন।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সতীশচন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সম্প্রতি রিপোর্টার্স ইউনিটের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন : প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের ব্যক্তিদের নিয়ে আমি ভীত । ...বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কিছু হয়ে গেলে দল থাকবে, তবে আওয়ামী লীগ যে কোথায় যাবে বলা মুসকিল। বঙ্গবন্ধু ও ৪ নেতার আশপাশের লোকদের সহায়তায় তাদের হত্যা করা হয়েছিল। (আমাদের সময়, ৬-১১-১০)
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এমকে আনোয়ার প্রশ্ন করেছেন, শেখ হাসিনা দেশে ফেরার ১৩ দিনের মাথায় কেন নিহত হন জিয়া? তদন্ত করলে বোঝা যাবে, শহীদ জিয়ার হত্যাকান্ডের জন্য কে দায়ী। তবে জিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে ছদ্মবেশে শেখ হাসিনা আখাউড়া সীমান্ত পথে আবারও কেন ভারত যেতে চেয়েছিলেন, সে রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি এবং ১৯৮২ সালে নির্বাচিত বিএনপি সরকার উৎখাত করে সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন : ‘আই এ্যাম নট আনহ্যাপী।'
বিএনপি এককভাবে ও জোটগতভাবে এক দশক ক্ষমতায় থেকেও জিয়া হত্যায় আন্তর্জাতিক কানেকশন ও সিভিলিয়ান ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করতে পারেনি। এটা তাদের ব্যর্থতা। ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই কেন বলেছিলেন, মুজিব হত্যার বদলা নিতে জিয়া হত্যার গোপন মিশনে অনুমোদন চেয়ে ‘র' তাঁর কাছে ফাইল উপস্থাপন করলে তিনি তাতে অনুমোদন দেননি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিংবা বেসরকারি আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত দল নিয়োগ করে বিএনপি কেন জিয়া হত্যায় ভারত ও তাদের দেশীয় এজেন্টদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে পারেনি।
শেখ হাসিনা প্রশ্ন তুলেছেন : স্বামীর হত্যাকারীর দেয়া বাড়ি বেগম খালেদা জিয়া নিলেন কিভাবে? তাহলে এরশাদ জিয়া হত্যাকারি বলেই কি প্রধানমন্ত্রী তাকে অাঁচলের আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করছেন? এ প্রশ্ন কেউ করলে তাকে কি দোষ দেয়া যাবে? এরশাদ তার নিজের সম্পত্তি জিয়া পরিবারকে দেননি। সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত তিনি কার্যকর করেছেন মাত্র। জিয়া হত্যার খুনিকে গলার মালা করে রাখবেন, আর শহীদ জিয়াকে দেয়া সেনাবাহিনীর বাড়িটি কেড়ে নিয়ে বর্তমান সরকার সেনাবাহিনী ও জনগণের আবেগকে পদপিষ্ট করতে চাইছে। এ বাড়ি ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা দেখানোর চেয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা কি আরও মহৎকর্ম নয়?
মুদ্রাযুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শংকাগ্রস্ত করে তুলছে
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter