Flickr

Sunday, 30 December 2012

টাকার বিনিময়ে খুন

এ ধরনের খুনের ঘটনা দেশের সামাজিক অস্থিরতারও একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে বলে আমাদের ধারণা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় দেশে অপরাধমূলক কর্মকা-ের বৃদ্ধি ঘটছে।

সাত হাজার টাকার বিনিময়ে সিলেটে এক রাজমিস্ত্রিকে খুন করেছে ভাড়াটে খুনিচক্র। এ খুনের ঘটনায় পুলিশের হাতে আটক রোম্মান নামের এক ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে ৪ জন মিলে এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন মিডিয়ার প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীসহ সারা দেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভাড়াটে খুনিরা। তারা গুলি করে বা ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে হত্যার পর লাশ যেখানে-সেখানে ফেলে রাখছে। শুধু তা-ই নয়, লাশ টুকরা টুকরা করে ফেলে রাখার ঘটনাও ঘটাচ্ছে। গত ২ জুন গোপালগঞ্জের মকসুদপুরে মায়ের প্রেমিককে টাকার বিনিময়ে হত্যা করায় এক প্রবাসী ছেলে। এ খুনের ঘটনা তখন দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ হত্যাকা-ের মামলায় গ্রেপ্তার দুই যুবক টাকার বিনিময়ে হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করেন। এ ধরনের খুনের ঘটনা বৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতারই লক্ষণ। পাশাপাশি মানুষ যে ক্রমেই হৃদয়হীন, যন্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে তারও প্রমাণ মেলে। নানা সমস্যা-সঙ্কটের মধ্যে এ ধরনের হত্যাকা-ে শুধু দেশের মানুষই আতঙ্কিত নয়, ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনকেও।

 চলতি বছরের প্রথমদিকে সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকা-, চিকিৎসক নিতাই হত্যাকা-সহ নিজগৃহে যেসব খুনের ঘটনা ঘটে তার সঙ্গে ভাড়াটে খুনিরা সংশ্লিষ্ট বলে পুলিশ ধারণা করেছিল। এছাড়া গত জুন মাসে সারা দেশে এ ধরনের হত্যাকা- বৃদ্ধি পেলে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যদের ভাড়াটে খুনিদের গ্রেপ্তারে আভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে। কিন্তু বাস্তবতা, এখনো ভাড়াটে খুনিদের হত্যাকা- বন্ধ হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব ভাড়াটে খুনির হাতে নির্মম খুনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ছাত্র ও নারী। আবার অনেকের পরিচয় দীর্ঘদিনেও মেলেনি। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে, ভাড়াটে খুনিরা নিম্ন ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর এবং বেশিরভাগই মাদকাসক্ত হওয়ায় তারা খুন করতে দ্বিধা করে না। রাজনৈতিক বৈরিতা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক কলহ, নারীঘটিত বিষয়, মাদক ও এলাকার আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসায়িক শত্রুতা ছায়াও বিভিন্ন কারণে এসব ভাড়াটে খুনিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। হত্যাকা-ের প্রকারভেদে নূ্যনতম এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকার চুক্তিতে খুনিরা তাদের কাজ করে থাকে। সন্দেহভাজন ভাড়াটে খুনিদের ওপর গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ নজরদারি থাকলেও এসব সন্ত্রাসী নানা কৌশল অবলম্বন করে একের পর এক হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে। আর বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক পরিবেশ।
দেশে যে হারে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, আমরা ক্রমেই এক অস্থিতিশীল পরিবেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অথচ একটি গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে এমনটি কারো কাম্য হতে পারে। এ ধরনের খুনের ঘটনা দেশের সামাজিক অস্থিরতারও একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে বলে আমাদের ধারণা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় দেশে অপরাধমূলক কর্মকা-ের বৃদ্ধি ঘটছে। আইনি দুর্বলতার কারণে অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো অপরাধমূলক কাজে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ জন্য আইনি ফাঁকফোকর ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সমভাবে দায়ী। দেশে নেতিবাচক কর্মকা- বৃদ্ধি পেলে সরকারকে দোষারোপ করা হবে এটিই স্বাভাবিক। ফলে এসব ব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভাড়াটে খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া যারা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের শান্তি বিনষ্ট করতে উদ্যত তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। হত্যাকা- রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরো সক্রিয় হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

Thursday, 27 December 2012

সংখ্যালঘু পরিবারের ভিটেমাটি রক্ষা করুন

সংখ্যালঘু পরিবারের ভিটেমাটি রক্ষা করুন
 
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার ৫নং নীলগাছ ইউনিয়নের পাখীমারা গ্রামের হতদরিদ্র মাখন লাল বিশ্বাস ওরফে মাখন লাল বৈরাগীর ভিটেবাড়ি ও গাছপালা দখল করেছে প্রতিবেশী প্রভাবশালী একটি মহল। মাখন লাল এখন ভিটেমাটি রক্ষায় প্রশাসনের কাছে বিষয়টি জানালে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে এখন মাখন লালের বাড়িঘর দখল ও গাছপালা কেটে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তারা দীর্ঘদিন থেকেই পরিবারটি উচ্ছেদ করে ভিটেমাটি দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। একের পর এক হয়রানি-নির্যাতন করে যাচ্ছে এই সংখ্যালঘু পরিবারটির ওপর। পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র হওয়ায় কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। নতুনভাবে এই পরিবারটিকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। মাখন লালের পরিবারকে হত্যা করে লাশ গুম করারও হুমকি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরিবারটি এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নির্যাতন সত্ত্বেও ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে পরিবারটি পড়ে আছে। হতদরিদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি পরিবারের ওপর এ ধরনের নির্যাতন ও ভিটেমাটি দখল করার চেষ্টা খুবই দুঃখজনক ও অমানবিক। এই পরিবারটিকে রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা

 

Thursday, 13 December 2012

কোটা


সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দাবি-দাওয়া, আবেদন-নিবেদন করা গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে তা আদায়ে জোর খাটানো বা হুমকি-ধমকি দেওয়া কেবল অগণতান্ত্রিক পন্থাই নয়, রীতিমতো অপরাধ। সম্প্রতি রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে শতভাগ 'বোন কোটা' আদায়ের জন্য হুমকি-ধমকি দিয়েছে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা 'অভিভাবক ফোরাম'। এ ব্যাপারে সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
'বোন কোটা'র অর্থ হচ্ছে, কোনো পরিবারের এক মেয়ে স্কুলের ছাত্রী হলে তার অন্য বোনকেও ভর্তির সুযোগ দিতে হবে। এ নিয়ম আগে থেকেই ভিকারুননিসা নূন স্কুলে রয়েছে। গতবার বোন কোটা ১ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়। আর এবার বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। অভিভাবক ফোরামের দাবি_ বোন কোটা শতভাগ করতে হবে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্য, তাদের দাবি অনুযায়ী শতভাগ বোন কোটায় যদি ভর্তি করতে হয়, তবে প্রথম শ্রেণীর এক হাজার ৪৪০টি আসনের মধ্যে বোন কোটায় ৭৮১ জনকে ভর্তি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অন্যরা বঞ্চিত হবে। কিন্তু বোন কোটার দাবি জানিয়ে 'অভিভাবক ফোরাম' অধ্যক্ষকে হুমকি দিয়েছে। অধ্যক্ষ শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে রমনা থানায় জিডি করেছেন। পরিস্থিতিও সামাল দিয়েছেন।
ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহলের চাপ কেবল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজেই নয়, সব নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর রয়েছে। চালু রয়েছে বিভিন্ন ন্যায্য ও অন্যায্য কোটাপ্রথা।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকরির ক্ষেত্রে অবারিত প্রতিযোগিতাই উৎকৃষ্ট মডেল। নারী, আদিবাসীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য বিশেষ সুযোগের যৌক্তিকতা অগ্রাহ্য করা যায় না। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি? অধিকারবঞ্চিত নয়, বরং অধিকারভোগী অগ্রসর অংশ নিয়ম করে কিংবা নিয়মবহির্ভূতভাবে অধিকতর সুযোগ গ্রহণ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সুযোগ-সুবিধাকে বৈধতা দিতে অন্যায্য ও অযৌক্তিক কোটাপ্রথাও চালু করা হয়েছে। নতুন করে চালুর উদ্যোগও রয়েছে। ইতিপূর্বে রাজধানীর স্কুলগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে সাংসদদের জন্য কোটা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছে, নাগরিকদের প্রতিবাদের মুখে সেটি কার্যকর হতে পারেনি। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমপি-মন্ত্রী-সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীদের অলিখিত কোটা রয়েছে। আইডিয়াল ও ভিকারুননিসায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য শতকরা ২ ভাগ কোটা রয়েছে। এটি কোন যুক্তিতে সমর্থনযোগ্য?
অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ওই দুই নামি স্কুলে সন্তান ভর্তি করার প্রবল আগ্রহ আছে। আগ্রহ আছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষেরও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকরির সুবাদে সে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যদি স্কুলে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয় আর এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যদি অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুযোগ গ্রহণ করতে থাকেন, তবে গণতন্ত্রের স্থলে এখানে এক ধরনের নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি কায়েম হবে, যা সংবিধান নির্দেশিত সমতাভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বড় হুমকি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোটা রয়েছে। যৌক্তিক কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সন্তানদের কোটাপ্রথা বিবেচনা করা যায়; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ক্ষেত্রে তা কেন প্রযোজ্য হবে, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
সবচেয়ে অভিনব মনে হয়েছে, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফ্রি বিদ্যুৎ পাওয়ার বিষয়টি। প্রশ্ন হচ্ছে, উৎপাদিত বিদ্যুতের মালিক কে? জনগণ না বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা? মালিককে দফায় দফায় বর্ধিত বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে, আর তাদের নিয়োজিত কর্মচারীরা নিখরচায় আলোতে ভাসবেন, এ কেমন কথা? ভাবছি, এ নিয়ম সব ক্ষেত্রে চালু হলে কেমন হয়? পেট্রোবাংলার কর্মচারীরা বিনা পয়সায় গ্যাস পাবেন, ওয়াসার কর্মচারীরা বিনা পয়সায় পানি পাবেন, বন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা বিনা পয়সায় কাঠ পাবেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা বিনা পয়সায় চাল-আটা পাবেন, মৎস্য অধিদফতরের কর্মচারীরা বিনা পয়সায় মাছ খাবেন আর জনগণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে? কী মজার গণতন্ত্র!
চাকরির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথাকে আমি অস্বীকার করছি না। আদিবাসী, দলিত, মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই কোটার যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে তা যেন মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতার দ্বার রুদ্ধ না করে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির ক্ষেত্রে পোষ্য কোটার যৌক্তিকতাও অস্বীকার করার জো নেই।
বিসিএস ক্যাডারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শতকরা ৫৫ ভাগ কোটাভিত্তিক আর মেধাভিত্তিক শতকরা ৪৫ ভাগ এবং সরকারি অন্যান্য চাকরিতে কোটাভিত্তিক ৪৫ শতাংশ। বিসিএসের ক্ষেত্রে জেলা কোটা ১০, মহিলা কোটা ১০, আদিবাসী কোটা ৫ এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ ভাগ রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোটার এমন আধিক্য চালু থাকলে প্রশাসনের দক্ষতা কি বাড়িয়ে তোলা সম্ভব? মেধাবী প্রশাসক পেতে কোটার চেয়ে মুক্ত প্রতিযোগিতার সুযোগ বাড়ানো উচিত।
বলা প্রয়োজন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই তা পূরণ হয় না। এ প্রসঙ্গে আমি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার একটি অভিজ্ঞতার উল্লেখ করতে চাই। ওই এলাকার যুবকরা লন্ডনমুখী হওয়ায় শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিভাগের কোটা শূন্য থেকে যায়। পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা-নোয়াখালী থেকে এসে যুবকরা স্থানীয় চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট নিয়ে জেলা কোটায় শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার ক্ষেত্রে ব্যাপার খানিকটা একই রকম।
মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই গরিব, কারণ ১৯৭১-পূর্ব সময়ে অধিকাংশ ধনী অভিজাত পরিবার পিডিপি-মুসলিম লীগের সমর্থক ছিল। আর মধ্যবিত্ত কৃষকের সন্তানরা স্বাধিকার আন্দোলনে অগ্রণী হয়েছিলেন। একাত্তরের পাক হানাদারদের হামলার মুখে এসব রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্রকর্মী গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তখন গ্রামের কৃষকের বাড়ি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মীদের আশ্রয়স্থল। অচিরেই কৃষকের গৃহ পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধের দুর্গে। সাহসী কৃষক-ক্ষেতমজুর যুবকরা হালের লাঙল ছেড়ে রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পর এসব বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার মুখে হাসি ফোটেনি, তাদের সুদিনও আসেনি। বরং অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। এই মুক্তিযোদ্ধাদের ক'জনের সন্তানই-বা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায়? তাই উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত সন্তানের বাবার কাছে বিসিএস ক্যাডার বা সরকারি চাকরিতে কোটার বিশেষ মূল্য নেই। আমার এলাকার অনেক সহযোদ্ধা এসে বলেন, 'ভাই ছেলেটাকে পড়াতে পারিনি। ওর জন্য দারোয়ান বা পিয়নের চাকরির ব্যবস্থা করে দিন।' এটাই বাস্তবতা। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের চাকরির কোটার চেয়ে দরকার ছিল তাদের অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন, যেটি আজ অবধি হলো না। দাবি করা হচ্ছে, তাদের ভাতা দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ এটি দেশের কর্তাদের একজনের একবেলা চা-নাশতার অর্থও নয়। তাই নাতি-পুতি চাকরি পাবে এমন ঘোষণার চেয়ে তাদের পুনর্বাসনের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা কি দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করা রাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন কিছু? যে দেশে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়, সেই দেশের স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের সারথিরা অনাহারে-অর্ধাহারে প্রাণ হারাবে, তা কি মেনে নেওয়া যায়?
এ প্রসঙ্গে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের উক্তি উল্লেখ করতে চাই, 'মুক্তিযোদ্ধাদের কপালে আরও দুঃখ আছে। কিন্তু গৌরবের কথা হলো_ মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করায় অবদান রেখেছেন, সেটিই তাদের জন্য বড় পাওনা। এই সুযোগ অন্যরা পাননি, বাকি কিছুর জন্য দুঃখ করবেন না।' (১৭ ডিসেম্বর, প্রথম আলো)। আমার মনে হয়, দেশের স্বাধীনতা আনার চেয়ে বড় গৌরবের আর কী হতে পারে? তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই? তবে প্রজন্মান্তরে কোটা ব্যবস্থা কোনো সমাধান নয়। বর্তমানে এমন কোটার টোপ ঝুলিয়ে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করা হচ্ছে। আর এই কোটায় লাভবান হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও সেই সুযোগ গ্রহণ করছে। এ নিয়ম যদি বংশানুক্রমিকভাবে চালু রাখা হয়, তবে সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধার স্থানটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তাই মুক্তিযুদ্ধের একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সন্তান পর্যন্তই রাখা যেতে পারে, এর অধিক প্রলম্বিত করার উচিত হবে না।
সমাজের নারী-আদিবাসী-দলিতসহ পিছিয়ে পড়া অংশকে এগিয়ে এনে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে সমতাভিত্তিক ব্যবস্থায় যেতে হবে, সেখানে কোটার আর প্রয়োজন হবে না। তবে আজকের বাস্তবতায় নারী-আদিবাসী-দলিত-মুক্তিযোদ্ধাদের যৌক্তিক কোটা রেখে সকল অযৌক্তিক কোটার বিলোপ খুবই জরুরি। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য দেওয়া সুযোগে যেন সুবিধাভোগীরা লাভবান না হয়, সেটিই নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় আনা উচিত।

Monday, 10 December 2012

বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ


চট্টগ্রামবেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ শিক্ষকদের বলা হয় জাতির বিবেক। শিক্ষক সমাজ হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। সেই শিক্ষকই যদি সময়মতো সঠিক বেতন না পান, তখন সঠিক পাঠদান কি সম্ভব? শিক্ষক সমাজ মাথার মণি, তাদের স্কুল ছেড়ে রাজপথে মিছিল করা অশোভন দেখায়। ভারত শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের পর শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়া বন্ধ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টোটা। এ ছাড়া আমাদের দেশে শিক্ষকতায় সরকারি-বেসরকারি তফাতটা বেশ। সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন দু'জন শিক্ষক। উভয়ই একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু এই সরকারি-বেসরকারি অজুহাতে শিক্ষকদের সঙ্গে বেতন-বৈষম্যের বিষয়টি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা আবশ্যক।

Sunday, 2 December 2012

মালালার প্রতি ভালোবাসা

মালালার প্রতি ভালোবাসা

পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইকে ৯ অক্টোবর মাথায় গুলি করে তালেবান জঙ্গিরা। সোয়াত উপত্যকায় এই ঘটনার পরই বিদ্যুতের মতো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের নারী শিক্ষার পক্ষে সোচ্চার কর্মী মালালা। মালালার এ ঘটনায় সবাই তার পক্ষে এগিয়ে এসেছে। ব্রিটেনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মালালার অবস্থা উন্নতির দিকে। ইতিমধ্যে মালালা দিবস ঘোষণা করেছে। এ উপলক্ষে পাকিস্তান সরকার সেদেশের শিক্ষাবঞ্চিত মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর পদক্ষেপও নিয়েছে। দ্রুত সুস্থ হয়ে মালালা নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসুক, নারী শিক্ষা আন্দোলনের কর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখুক। মানুষের জন্য কাজ করবে মালালা। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা।

Wednesday, 14 November 2012

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ

বাউবির অনার্স আবেদন সহজ হোকবাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বছর মেয়াদে অনার্স (সম্মান) কোর্স চালুর জন্য সম্প্রতি জাতীয় কয়েকটি পত্রিকায় ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেছে কর্তৃপক্ষ। তাতে শুধু ঢাকা কলেজ কেন্দ্র থেকে ফরম সংগ্রহ করে সে কেন্দ্রেই জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর কেবল জনতা ব্যাংক ঢাকা কলেজ কেন্দ্রে ভর্তি ফরমের টাকা জমা দেওয়ার উল্লেখ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আবেদন, বিভাগীয় শহরে কেন্দ্রের মাধ্যমে এবং ওই ব্যাংকের বিভাগীয় শাখা থেকে ফরম জমা ও গ্রহণ করার সুযোগ দান করুন। তা না হলে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট ও বরিশাল কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের সম্মান কোর্স পড়ার ইচ্ছা থাকলেও রাজধানী কেন্দ্রে গিয়ে ফরম গ্রহণ ও জমা দান দুরূহ হয়ে পড়বে। দেশের সব এলাকার শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বিভাগীয় শহরের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

Tuesday, 6 November 2012

পরিকল্পিতভাবে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হত্যা চলছে!

পরিকল্পিতভাবে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী হত্যা চলছে!
আজকের লেখার শুরুতেই  উল্লেখ করতে চাই মহান বিজয় দিবসের পূর্বক্ষণে যেভাবে দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। আজকের প্রেক্ষাপটের সাথে বিশ্লেষণ করলে কোনো তফাত খুঁজে পাওয়া যায় না। কারাগারগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ স্মরণ করিয়ে দেয় দেশকে মেধা ও বুদ্ধিহীন করার চক্রান্ত চলছে। তাই আজ স্মরণ করছি, সংবাদপত্র বন্ধ, সাংবাদিকের ওপর নির্যাতন, হত্যা ও হামলা মামলার প্রথম শিকার হয় স্বাধীনতার স্থপতি রূপকার স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ‘হক কথা'।  তারই একটা পত্রিকার মালিকানা রাতারাতি পরিবর্তন করে অন্যজনকে মালিক করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি যিনি  রাজপথে থাকলে বলতেন পৃথিবীতে দুটি গোষ্ঠী রয়েছে। একটা শোষক অন্যটা শোষিত আমি শোষিতের পক্ষে কিন্তু ক্ষমতায় গেলে বেমালুম ভুলে যেতেন। ক্ষমতায় গেলে  শোষক হতেন। তারই আচরণ পরবর্তীতে তার অনুসারী কর্তৃক ধারাবাহিকতাভাবে অব্যাহত রয়েছে। আজকে স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও সাংবাদিক সমাজকে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায়  হয়রানি, আইন-শৃংখলা  রক্ষাকারী বাহিনী এবং সন্ত্রাসীদের আক্রোশমুক্ত থাকতে দেয়া হচ্ছে না। কালো অর্থের মালিকদের হাতে মিডিয়া তুলে দেয়া হচ্ছে। এর সাথে  যোগ হয়েছে আদালত অবমাননার অভিযোগ! যে আদালত সংবাদের অংশ বিশেষের ওপর নিজের কিংবা শাসকের স্বার্থের বিষয় হলে স্বউদ্যোগে রুল জারি করে কিংবা  পেপার কাটিং বা কারো জবানবন্দীকে স্বাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে সমাজহিতৈষী দায়িত্বশীলদের নাস্তানাবুদ করে। যাদের বিবেকে একটু দংশন করে না এ মানুষগুলো না থাকলে সমাজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। তাদের কাছে  বস্তুনিষ্ঠ সংবাদকর্মীরা চক্ষুশূল  হবে এটাই স্বাভাবিক! আজকের লেখাটা শুরুর  আগে আদালত কর্তৃক স্বউদ্যোগে সাংবাদিক ও দেশের রাজনীতিবিদদেরসহ সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে  কোনো রুল জারি করছে কিনা পত্রিকার পাতায় খুঁজে না পেয়ে লিখতে বসতেই হলো। যশোর জেলার নওয়া পাড়ার সাত সংবাদকর্মী শিল্প ও বাণিজ্য শহর নওয়া পাড়ায়  হরতালের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হওয়ার বিষয়টি দিয়ে। আক্রান্ত সংবাদকর্মীরা উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের  সাহায্য চেয়েও পাননি।  সন্ত্রাসীরা তাদের কাছ থেকে তিনটি ক্যামেরা ও ক্যাসেট ছিনিয়ে নেয়। হামলায় আহত সংবাদকর্মীরা হলেন,  দেশ টিভির যশোর জেলা প্রতিনিধি আমিনুর  রহমান মামুন,  চ্যানেল আই প্রতিনিধি আকরামুজ্জামান, দিগন্ত টিভির স্টাফ রিপোর্টার তরিকুল ইসলাম তারেক, ক্যামেরাম্যান জুবায়ের আহমেদ, মাছরাঙ্গা টিভির রাহুল রায়, বাংলাভিশনের ক্যামেরাম্যান এসএম ফরহাদ ও স্থানীয় সাংবাদিক আশরাফুল হক মামুদ। এদের মধ্যে দিগন্ত টিভির ক্যামেরাম্যান আহমদকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে  এলোপাতাড়ি সন্ত্রাসীরা পিটানোর  কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৬ মে নড়াইল আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সাত সংবাদকর্মীকে আহত করে। ৮ মে ২০১২ কক্সবাজার মডেল থানার পাশেই দৈনিক কক্সবাজার বাণীর অফিসে ৭/৮ জনের একদল তরুণ অস্ত্রসহ প্রবেশ করেই সাংবাদিক আতাহার ইকবাল ও ফরিদুল মোস্তফাকে এলোপাতাড়ি শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক কক্সবাজার বাণীর প্রধান সম্পাদক আতাহার  ইকবাল এবং সম্পাদক ফরিদুল মোস্তফা খান। মডেল থানা সংলগ্ন এবং প্রত্যক্ষদর্শী  পুলিশ থাকার পরও তাদের আটক না করার পিছনে নিশ্চয়ই কোন রহস্য নিহিত রয়েছে। নড়াইলে  সাত সাংবাদিক আহত করার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার না করা ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিরাপত্তা দেয়ায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাদের অল্প সময়ের মধ্যে হয়তোবা পুরস্কৃত করা হবে। এমন  মন্তব্য বিভিন্ন মহলে শুনা যাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ  অনুযায়ী সাত সাংবাদিকের ওপর আক্রমণের সময় যশোরের ‘খ' সার্কেল-এর এসপি আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক  পুলিশ ছিল! আর আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা মেইন রোডের পাশে বিভিন্ন গলিতে অবস্থান করছিল।  পুলিশ বেষ্টনির মধ্যেই আওয়ামী লীগের আশ্রিত কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুলের নেতৃত্বে ৩০/৪০ জন যুবক সাংবাদিকদের মারধর করে। এ দুটি সংবাদ পড়ে আমার এক বন্ধুর কলেজ পড়ুয়া ছেলে বললো, কাকু আমরাতো উন্নয়নশীল দেশ-এর নাগরিক! তার ওপর আবার বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির কারণে ঋণ প্রত্যাহার করলো! এমন অবস্থায় পুলিশ বাহিনী বিলুপ্ত করে সন্ত্রাসীদের হাতে জনগণের জানমালের  নিরাপত্তার দায়িত্ব দিলে বোধহয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন পত্রিকা খুললেই খুন, গুম, অপহরণ ও মাদক বিক্রির সংবাদ পড়ে সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হওয়ার কোন সুযোগ থাকবে না! দেশের একমাত্র সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্কে একটা  কিশোর বাচ্চার মন্তব্য শুনে জানি না সরকার কিংবা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধান ও এ্যাটর্নি জেনারেল লজ্জা পাবেন কিনা! এমন  সময় আমার দেশ পত্রিকার সিটি এডিটর আবদুল্লাহর বাসায় পুলিশ ঘেরাওয়ের সংবাদ দেখে কোমলমনের বাচ্চাটা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো! বলে  উঠলো পুলিশ বা র‌্যাবের ভিতরে বিশেষ কোন দেশের বাহিনী কাজ করছে কিনা সাংবাদিকদের  অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।  একদম পরিকল্পিতভাবে মেধাসম্পন্ন স্বচ্ছ প্রতিনিধিত্বশীল মানসিকতার  শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী, ছাত্রদের চিহ্নিত করে গুম, খুন, হত্যা, অপহরণ, বানোয়াট ও পেইন্ডিং মামলা দেয়া হচ্ছে। দেশ থেকে বুদ্ধিজীবী নিশ্চিহ্ন করার জন্যই কি?  সে আক্ষেপ করে বলতে থাকল, কাকু যখন স্কুলে পড়তাম তখন নেকড়ে বাঘ ফখরুদ্দিন, মঈন উ আহম্মেদ এর ভয়ে এখনকার শাসক দলের অনেকেই ইঁদুরের মত গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল।  আবার  কেউ ফখরুদ্দিন- মঈনের সাথে ষড়যন্ত্র করে কারাগারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন রাজনীতিবিদ ও দেশের জন্য কান্ডারী  হিসাবে যে কয়েকজনের আবির্ভাব হয় তার অন্যতম আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত  সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরিবর্তে যে  শাসক বর্বর আচরণ করে বিচারক মনে করার কারণেই তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশ না হওয়ায় বিচার সম্পর্কে জনমনে কি প্রশ্ন জাগতে পারে তারা কি একবারও চিন্তা করে দেখেছেন? দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আবারও নিজেকে জাতিকে দায়বদ্ধ করেছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণমাধ্যমের বিকল্প নাই! ইতোপূর্বে লিখেছিলাম মাহমুদুর রহমান ডেইলী স্টারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের ঐক্যের চেষ্টার সূচনা করলেন। ঘান টানা শেষ হলেই সংগ্রাম এর সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক  বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আবুল আসাদকে গ্রেফতার করা হলো। নির্যাতনের জন্য রিমান্ডে দেয়া হলো। কিন্তু অবশেষে সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে মুক্তি পেলেন।  নিউ এইজ এর সম্পাদক নুরুল কবীর ও বিশেষ প্রতিনিধিও আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি! কিশোর ভাতিজা আবার বললো কাকু আপনার একটা লেখার ঐ অংশ এখনো আমার মনে পড়ে আওয়ামী লীগের সাবেক শাসক আমলের এপিপি  হয়ে ঢাকার আন্তর্জাতিক এযারপোর্টের চোরাচালানের বিষয় মামলা দেখার দায়িত্ব পেয়ে নিজেই  সোনা চোরাকারবারীর সাথে জড়িয়ে পড়ে ঢাকায় আলীশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এমন মানুষ বিচারপতি হলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। তার আক্ষেপের শেষ নাই। আবারো বকবক করতে লাগলো বললো, কাকু এই যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার। যদি তাই হয় তাহলে পুলিশ আর শাসক জোটের সন্ত্রাসীরা  বাধা দেবে কেন? তার এ প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত কোন উত্তর আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব হলো না!  যাই হোক বন্ধুর বাসা থেকে বের হয়ে এক কিশোরের চিন্তা-ভাবনা দেখে মনে হলো মাহমুদুর রহমানদের আত্মত্যাগের সুফল জাতি ভোগ করবে। কারণ শাসকদের মিথ্যাচার পর্দার আড়াল থেকে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, খুন, গুম অপহরণ নিয়ে আজকের প্রজন্মের সন্তানরা চিন্তিতই শুধু নয় প্রতিহত করার মানসিকতা পোষণ করছে।  বন্ধুর বাসা থেকে ফিরতে একজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো। তিনি সালাম বিনিময় শেষে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যা মামলা ধামাচাপা পড়ে গেলো কিনা জানতে চাইলেন! তার পর নিজে থেকেই বললেন, ১৯৯৬-২০০১  ঐকমত্যের শাসন আমলে টাইমস, দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা বন্ধ ও মালিকানা  পরিবর্তন হলো। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ না করা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা জাতিকে। বিএনপির মহাসচিব ১৮ দলের অন্যতম সমন্বয়ক মির্জা ফখরুল  ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীরসহ ১৮ দলের শীর্ষ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলার পরিবেশ সৃষ্টি করে মামলা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বাসায় পুলিশী তল্লাশি ও আদালতে আশ্রয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের সকল ফটকে পুলিশ-র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার অবস্থান দেশবাসীকে বিব্রত করে তোলে।  অনেককেই মন্তব্য করতে শুনা গেছে এটাকি বর্বর আদিযুগের জালেমদের রাজত্ব হতে যাচ্ছে! এখনো মানুষের মন্তব্য হাইকোর্ট বেঞ্চের বিভক্ত আদেশ বিব্রত হওয়া আর খারিজ করা কি শাসক দলের  প্রভাবের কারণে ঘটছে। কোন বিচারকের কেউ কেউ মহান পেশার আত্মমর্যাদা পদদলিত করতে প্রভাবিত হচ্ছেন। দেশে যা ঘটছে ২০০৯ সালে বিচার বহির্ভূত ১৫৪, ২০১০ এ ১২৭ জন, ২০১১তে ৮৪ জন কারাগারে নিহত, ২০০৯, ৫০ জন, ২০১০ ৬০ জন, ২০১১, ১০৫ জন।  রাজনৈতিক গুম ২০০৯, ২৫১ জন  ২০১০, ২২০ জন, ২০১১তে ১৩৫ জন। সাংবাদিক  আক্রমণের শিকার ২০০৯তে ১৪৫ জন, ২০১০এ ১৭৮ ও ২০১১ এ ২০৬ জন। এ ছাড়াও আরো অনেক হত্যা নির্যাতন হলেও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচারের সম্মুখীন করার নজির হয় তো বা হাতে গুনে বের করা যাবে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা, সৌদি কূটনীতিক হত্যা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি এম ইলিয়াস আলী গুম! শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে অপহরণের পর লাশ উদ্ধার হলেও হত্যাকারী চিহ্নিত না হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের মন্তব্য হচ্ছে শাসকজোটের পরোক্ষ মদদে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ মামলার পরিবেশ সৃষ্টি করে ভিন্নমতের স্বচ্ছ, দক্ষ, দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিকদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া কিনা? '৭২-৭৫ বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হিসাবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিল। এবার দুর্নীতির অভিযোগে  বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণ প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। শাসকচক্রের অজ্ঞাত কারণে দেশে মানবিক, নাগরিক, আইনী, ন্যায় বিচার ও  সাংবিধানিক অধিকার থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে! বিরোধী দলের কর্মসূচীতে  আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় সরকারি দলের ক্যাডারদের অবাধ বিচরণ ও হামলা দেশকে অকার্যকর, মেধাহীন করার ষড়যন্ত্র হিসাবে এখন যত্রতত্র আলোচনা শুরু হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে মেধা ধ্বংসের জন্য সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের তালিকা অনুযায়ী প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বিভিন্ন মহলে জনশ্রুতি আছে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ তালিকায় নাম উঠছে ও চাকরি দিতে সুপারিশপত্রে লেখা হচ্ছে দলীয় স্বার্থে উল্লিখিত প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হোক? এদিকে যুদ্ধাপরাধের ক্যাসেট জনগণ শুনতে চাচ্ছে না বলে বিরোধী দলীয় নেতা ও তার ছেলেরা দুর্নীতির ক্যাসেট বাজারে ছাড়তে শুরু করেছে! অথচ কালো বিড়ালসহ আটক মালিকদের চরিত্র অপ্রকাশিত রাখতে কত না নাটক করা হচ্ছে! পুলিশ সরকারি দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পাহারা দেয়ায় হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি প্রতারণা করে অর্থ আদায়ের দায়দায়িত্ব সরকারের ঘাড়েই পড়ে। সম্প্রতি সাবেক ছাত্র নেতা ও সাবেক ভিপি খায়রুল কবীর খোকনকে পুরাতন মামলায় রিমান্ডে নেয়ায় দেশের অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে আত্মঘাতীমূলক চক্রান্ত চলছে কিনা তা নিয়ে জনগণ সমালোচনা করছে! এম ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য ৩০ হাজার অজ্ঞাত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে সুখের খবর সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন গুমকারীদের চিহ্নিত ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকে কেউ ব্যর্থ হিসাবে দেখতে চায় না। তাদের  ধারণা ইলিয়াস আলীসহ এ যাবৎ যত গুম হয়েছে সরকারের পরোক্ষ মদদ রয়েছে। অপরদিকে এম ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার ঘটনা ও ক্রসফায়ার নিয়ে সংবাদ করায় দৈনিক ভোরের ডাক-এর সিনিয়র রিপোর্টার তুহিন সানজিদকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে র‌্যাব  ইলেকট্রিক শকসহ নানা ধরনের নির্যাতন করে আবার রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়। এবারো আল্লাহ পাক আমার দেশ-এর  সিটি এডিটর এম আব্দুল্লাহকে হেফাজত করেন। ইতোপূর্বে তার উপর হামলা করলে পালিয়ে বাঁচেন। আমাদের কষ্টার্জিত অর্থে লালিত ডিবি পুলিশের  পরিদর্শক স্বল্প সময়ের মধ্যে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে  অবস্থিত সচিবালয়ের ভিতরে  বোমা নিক্ষেপ ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সামনে গাড়ি পোড়ানোর সাথে জড়িতদের স্বল্প সময়ের মধ্যে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এতে যাদের আসামী করা হয়েছে তাতে  বিচারকরা  উন্মাদের গল্প ফাদার অপরাধে তদন্ত কর্মকর্তাকে তিরস্কার করবেন  নাকি পর্দার আড়ালে থাকা মুখোশধারীদের পালানোর পথ বন্ধ হবে  তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা  দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই ফোন করে মন্তব্য করে একদিকে রাজনীতিবিদদের সামরিক জান্তা বানিয়ে যুদ্ধাপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের নামে প্রহসন করছে। অপরদিকে বাকি যারা স্বচ্ছ দেশপ্রেমিক আছে তাদের নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মত আদর্শবান পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদকে যারা পরিকল্পনাকারী সাজাতে পারে তাদের পক্ষে ভাল কিছু করা সম্ভব এটা বলা কঠিন!  একই সাথে এমকে আনোয়ার এমপি  ও খন্দকার মোশাররফ  হোসেন, ড. কর্নেল (অবঃ) অলি আহম্মেদ এমপি ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) জেনারেল হান্নান শাহ, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সফল মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, পরিচ্ছন্ন দেশপ্রেমিক নেতা রুহুল কবীর রিজভী, আদর্শ সমাজ গড়ার নেতা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মোঃ মকবুল আহমেদ পরিকল্পনাকারী।  বাস্তবায়নকারীরা হচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী মির্জা আববাস, সাবেক মন্ত্রী বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদকে গদিচ্যুত করতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বপ্ন সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ছাত্রদের মধ্যে যিনি সিপাহসালারের  ভূমিকা পালন করেন তিনি ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি, বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ এমপি, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির চেয়ারম্যান শেখ  শওকত হোসেন নিলু, সাবেক ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান রতন, বিএনপির স্বনির্ভর সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস দুলু, বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীন উদ্দিন  চৌধুরী এ্যানি (এমপি) স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে দেয়া চার্জশিট নিয়ে গত ক'দিন বিভিন্ন জায়গায় রসালো আলাপ জমে উঠেছে। তাদের ভাষায় গত ৩/৪ মাসে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা চাঞ্চল্যকর হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ এমনকি পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে বিরোধীদলের কর্মসূচিতে শাসক দলের ক্যাডাররা হামলা করার পরও তাদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে এ সরকার মেধাহীন সন্ত্রাস নির্ভর রাজনীতি করতে চায় চার্জশিট গোয়েন্দা সংস্থার ডিবিকে অযোগ্য প্রমাণ করছে। ধর্ষণ  প্রায় ২৪ দিন আগে সিলেটের জননন্দিত নেতা এম. ইলিয়াস আলী, সৌদি কূটনৈতিক হত্যা ও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকারীদের যারা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ডিবি অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে গাড়ি পোড়ানো ও  বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসাবে চিহ্নিত করতে সফল হয়েছে এটা নাকি পাগলেও বিশ্বাস করবে না? এদিকে রসালো গল্পের মধ্যেই অনেকে দাবি করেন এম, ইলিয়াস আলী গুম, সাগর-রুনি হত্যা ও সৌদি কূটনীতিক হত্যাসহ খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজীসহ দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের সাথে শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের অভিযুক্ত করে ফেলে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এমন সময় এক আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আমাদের আড্ডায় যোগ দিতে এসে বিপদে পড়ে গেলেন। তার কাছে চার্জশিট সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলো সকলে! তিনি নাম প্রকাশ ও পরিচয় প্রকাশ হবে না এমন শর্তে বললেন, পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির আছে কি? সেই দেশের দুইজন মেধাবী ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার পর আদালতে আবেদন করার পর নিখোঁজ দুই ছাত্রের সন্ধান চাইতে আইজিপিকে আদালতে সশরীরে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আর এ্যাটর্নি জেনারেল এই আদেশ স্থগিত করতে আপিল করে স্থগিত করালেন। আমরা কেউ এখন আর স্বাধীন আছি কি?  মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা কূটনৈতিক শিষ্টাচার শুরু করেছে তারও কি কেউ প্রতিবাদ করছে বলেই তিনি বিদায় নিলেন। ঐ কর্মকর্তা  চলে গেলে বিশ্লেষণ করে একটা জায়গায় ঐক্যমত হলো। বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যদি বৃটিশ মার্কিন ভারত ও পরোক্ষভাবে ইসরাইলের ওপর নির্ভর করে ফেলা হয় তাহলে হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।  জাতীয় নেতৃবৃন্দের নামে এরপর হয়তো চোরাই মামলা দেয়া হবে।  সংবাদকর্মীদের  জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি। পাবে দেশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে  উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এরশাদুল বারীর বিরুদ্ধে  আরেক শিক্ষক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারীর আবেদন করলে আদালত ১৪ জুন শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছে এ আলামত কিসের? এ থেকে মুক্তির জন্য দেশপ্রেমিক সকল রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য পেশার সংগঠন ঐক্যবদ্ধ  করে তাবেদার  প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলে আমাদের পরাধীনতার জিঞ্জির পরতে হবে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। সময় থাকতে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠার জন্য সকলের প্রতি অসহায় সাধারণ নাগরিকের আহবান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশর ব্যবসায়ী মহলের হরতালের বিকল্প পথ অনুসন্ধানের দাবির কথা  শুনে সাধারণ মানুষ মন্তব্য করছে মানববন্ধনে সরকারের হুঁশ হয় না। এটা শাসক দলের মন্তব্য তারপরও মানববন্ধনেও পুলিশি বাধা দেয়া হয়।  ব্যবসায়ী মহল যদি হরতাল বন্ধের পথের সন্ধান করতে চান তাহলে প্রথমে তাদের বিবেচনায় নিতে হবে হরতাল বিরোধীদল কেন করছে?  শাসক জোট কর্তৃক যদি হরতাল করতে পরিবেশ সৃষ্টি করে তাহলে শাসক দলকে ঐ আচরণ পরিত্যাগে বাধ্য করতে হবে। বর্তমান বিরোধীদল হরতাল করছে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালককে সুস্থ অবস্থায়  তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলের যে সমস্ত শীর্ষ নেতাকে সাজানো মামলার আসামী করে অবৈধভাবে আটক করেছে তা থেকে তাদের নিঃশর্ত মুক্তির জন্য।  এছাড়াও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা থেকে বিরত ও সন্ত্রাসী এবং উপদেষ্টাদের সংযত ভাষায় বক্তব্য দেয়া জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য।  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস ও মোঃ ওয়ালিউল্লাহ ৩ মাসের অধিক সময়  নিখোঁজ থাকায়। হাইকোর্টে তার সন্ধান চেয়ে আবেদন করলে নিখোঁজ দুই ছাত্রের  সন্ধানের জন্য পুলিশের আইজিপিকে হাইকোর্টে তলব করে। রাষ্ট্রের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়া পুলিশের আইজিপিকে তলব স্থগিত করতে রাষ্ট্র প্রধানের এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম ও ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল রাশেদ জাহাঙ্গীর শুনানির মাধ্যমে  স্থগিত করে  গোটা দেশের আইন শৃংখলা অবনতির সাথে শাসক জোট জড়িত এটা কেন প্রমাণ করার  উদ্যোগ নেয়া হলে এর সদুত্তর জনগণকে জানানো প্রয়োজন।  তবে আল্লাহ পাক যাদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তাদের সাথে বন্ধুত্ব করলে আরো ভয়াবহ পরিণতির দিকে তারা নিয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালার  নির্দেশ মানলে দেশে ন্যায়বিচার, মানবিক, নাগরিক,  আইনী, সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হতে পারে।  তা না হলে সন্ত্রাসীর আক্রমণের শিকার হতে হবেই।মুহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন চৌধুরী

Monday, 5 November 2012

অনলাইন গণমাধ্যম আইন বনাম মত প্রকাশের স্বাধীনতা

জর্ডানে সম্প্রতি অনলাইন ভিত্তিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন একটি আইন অনুমোদন করেছেন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ। এতে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, ইলেকট্রনিক প্রকাশনার জন্য ওয়েবসাইটকে অবশ্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এই আইন অনুযায়ী ওয়েবসাইট বন্ধ ও অনলাইনে প্রকাশিত যেকোনো বিষয় কাটছাঁট করার ক্ষমতা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ বা লেখার জন্য প্রকাশিত পাঠক মন্তব্যের জন্য দায়ী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানের মালিককে আটক করার বিধানও রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ বিধানের সমালোচনা করে বলেছে, সরকার বিরোধী মতাবলম্বী ও সমালোচকদের হেনস্তা করতে এ আইন প্রয়োগ করবে। গণমাধ্যমের কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের তাদের মন্তব্যের জন্য এ আইনের অধীনে অভিযুক্ত করে শাস্তির মুখোমুখি করার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, নতুন এই আইনের কারণে দেশটির প্রায় ৪০০ ওয়েবসাইট ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
 জর্ডানের মতো একই কায়দায় বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন মতামতের উপর হস্তক্ষেপ করার পাঁয়তারা চলছে। সরকার অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে আগামী অক্টোবরের মধ্যেই নীতিমালার আওতায় আনতে চায়। এ জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। চলতি মাসের  ১২ তারিখে কতিপয় অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ডেকে এ তথ্য জানিয়েছেন তথ্যসচিব, প্রস্তাবিত নীতিমালা সরবরাহ করে তাদের মতামত জানতে চেয়েছেন। খুব দ্রুত ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মতামত দিতে হবে। সভায় তথ্য সচিব বলেন, সরকারি হিসেবে সারা দেশে ২০০ অনলাইন সংবাদপত্র রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনলাইন সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার জন্য দেশে কোন আইন, নীতিমালা ও অধ্যাদেশ নেই। সে কারণে নীতিমালা জরুরি। তিনি জানান, বিভিন্ন   দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আলাদাভাবে আলোচনায় বসা হবে। সরকারি হিসাব মতে দেশে ২শ' অনলাইন গণমাধ্যম থাকলেও মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মাত্র ১১ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন!
কোনো গণমাধ্যমের ওপর সরকারকে নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দন্ডবিধি প্রণয়ন চলতে না পারলেও  অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা তৈরিতে এমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নীতিমালাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার বর্তমান সরকারের ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও অনলাইনের সঙ্গে যুক্ত সম্পাদকগণ। খসড়ায় বলা হয়েছে, অনলাইন গণমাধ্যমের লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে এককালীন পাঁচ লাখ টাকা তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। পরে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকায় লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে। ইত্যাদি। মন্ত্রণালয়ের করা নীতিমালয় অসঙ্গতি থাকায় বৈঠকেই এর বিরোধিতা করেন সম্পাদক ও অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা। তারা জানিয়েছেন, ‘নিয়ন্ত্রণ' আরোপের উদ্দেশ্যে এই নীতিমালা করা হলে দেশের অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সরকার ‘ডিজিটাল' বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়েছে এই খসড়া সরকারের এই লক্ষ্যের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সরকার যে পদ্ধতিতে নীতিমালা করতে যাচ্ছে এই পদ্ধতিটিই ভুল। নীতিমালা করার আগে যারা এই অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নিয়ে খসড়া তৈরি করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে খসড়া করে তার ওপর মতামত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া লাইসেন্স নেয়া এবং নবায়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয়েছে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতোই।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন সময় সরকার হঠাৎ করে অনলাইনের ওপর ক্ষেপে গেল কেন? তাড়াহুড় করে দ্রুত সময়ের মধ্যে অনলাইন পরিচালক/সম্পাদকদের পরামর্শ দিতে বলা হলো কেন? এই অসম অবাস্তব নীতিমালা তৈরি করতে গিয়েই কিন্তু সরকার ধরা খেয়ে গেছে। একথা না বললেও চলে যে,  গত কয়েক বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে অনলাইন গণমাধ্যম ও কমিউনিটিগুলোতে। অনলাইনে খুব দ্রুত জনমত গড়ে উঠছে। কারো মতে, বস্তাভর্তি টাকার গোপন রহস্য যাতে উদঘাটিত হতে না পারে অথবা কালো বিড়াল সাদা করতেই অনলাইন গণমাধ্যম বন্ধ করার ফ্যাসিবাদী উদ্যোগ! সোনার ছেলেদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি আর অস্ত্রের মহড়ার সচিত্র প্রতিবেদন জনসম্মুখে মুহূর্তেই উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাই এদের মুখটা বন্ধ করার জন্য এখনই উদ্যোগ নেবার সঠিক সময়। সরকারি হিসাবে সারা দেশে ২ শতাধিক অনলাইন সংবাদপত্র রয়েছে। যাদের অনেকেই ‘ডিজিটাল কারচুপি'র অন্তরায় হবে সম্ভবত এই জন্যই সময়মতোই ব্যবস্থা আর শায়েস্তা! সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা সম্পর্কে ঘোষণাটি আসার পর থেকে এ যাবত ফেসবুক ও বিভিন্ন অনলাইনে যেসব মন্তব্য বিশ্লেষণ আমার নজরে পড়েছে, এর নির্যাস হলো যে বা যারাই খসড়া নীতিমালাটি উপহার দিয়েছেন, তারা আর যাই হোন, অন্তত সোশ্যালমিডিয়ার সাম্রাজ্যের কিছুই জানেন না বা বুঝেন না, এটা প্রমাণিত সত্য। অনলাইন গণমাধ্যম ‘‘সম্প্রচার, প্রকাশনা, প্রদর্শন ও পরিচালনা সম্পর্কিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এ লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তার অধিকাংশই বিরক্তি সৃষ্টিকারক ও একই সাথে ব্যাপক হাস্যরসের ব্যবস্থা রয়েছে নীতিমালাটিতে। কারণ, সরকার একদিকে বলছে ডিজিটাল বাংলার কথা অন্যদিকে স্ববিরোধী কর্মসূচি প্রণয়ন। নীতিমালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এর লাইসেন্স ফি, নবায়ন ফি ইত্যাদি। যেমন লাইসেন্স নিতে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে, ২ লাখ দিতে হবে জামানত, ৫ লাখ টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট রাখতে হবে, ৫ হাজার টাকা দিয়ে আবেদন ফরম নিতে হবে! যেখানে প্রিন্ট পত্রিকা বের করতে লাইসেন্স ফি দিতে হয় না সেখানে অনলাইন পত্রিকার জন্য ৫ লাখ টাকা লাইসেন্স ফি, সম্ভবত নীতিমালা লেখকরা এটাকে টিভি বা তার চেয়ে ব্যয়বহুল বা আরও জটিল কোনো গণমাধ্যম মনে করেছেন। খসড়া নীতিমালা যারা তৈরি করেছেন অনলাইন গণমাধ্যম সম্পর্কে তাদের ধারণা কতটুকু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এই খাতে সরকারের কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই। তার পরও কেন এতো কড়াকড়ি তা বোধগম্য নয়। শুধু বর্গীর মতো খাজনা আদায়ে মত্ত না হয়ে এই শিশু শিল্পের বিকাশে সরকারি সহায়তা-পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। আর যদি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্যই ৫ লাখ আর ২ লাখ করে নেয়ার পরিকল্পনা হয়ে থাকে তাহলে মন্ত্রী-এমপিদের অন্তত এক বছরের বেতন ভাতা কর্তন করা হোক, সচিবগণ সপ্তাহের একদিনের বেতন-ভাতা রাষ্ট্রিয় কোষাগারে জমা দিন। আর এটাই হবে দেশপ্রেমের উজ্বল দৃষ্টান্ত!
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো অনলাইনের সাথে পরিচিত নয়। তাই অনলাইন পত্রিকাগুলো জন্মকাল থেকে বিজ্ঞাপনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। যা পাওয়া যায় তা দিয়ে ডোমেইন হোস্টিংয়ের দামও উঠে না। ইন্টারনেট হল অনলাইনের প্রধান কাঁচামাল। এতো বছরেও এটা সরকার সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে এনে দিতে পারলো না। হোস্টিং ও ডোমেইনের দাম পরিশোধ করার জন্য বিদেশে থাকা বন্ধুদের সহায়তা নিতে হয়। অনলাইনে সরকার এখনো বিজ্ঞাপন দেয় না, উপরন্তু সরকার বিজ্ঞাপন ফ্রি দেবার আবদার করেছে। অনলাইন গণমাধ্যম এখনো টাকা কামানোর উৎস হয়ে উঠতে পারেনি, কোন সুদূর ভবিষ্যতে পারবে তা অনিশ্চিৎ। বাংলাদেশের কোনো অনলাইন গণমাধ্যম এখনো লাভের মুখ দেখেনি। দুই/চারটা অনলাইন পত্রিকা বড় কোনো বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রচার ও প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে চালু হয়েছে, সেগুলোর লাভের মুখ দেখা খুব প্রয়োজনীয় নয়। বাকিগুলোও অলাভজনকভাবে কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে, বেশিরভাগ স্থানীয়ভাবে চলছে, নিজের জেলা বা উপজেলাকে তুলে ধরার জন্য, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশীরা উপকৃত হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ' গঠনের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি ভূমিকা রাখছে এসব অনলাইন গণমাধ্যমগুলো। অনলাইন মাধ্যমগুলোর লাভ তো দূরে থাক খরচের ১০%ও উঠে না, এরা কিভাবে ৭,০০,০০০ টাকা সরকার কে দিবে, কেন দিবে?
অনলাইন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী যেমন (অফিস অবকাঠামো, মোট জনবল ও নির্ধারিত ব্যাংক ব্যালেন্স, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতার সনদপত্র এসব বিষয় চাওয়ার কিছুটা যুক্তি থাকলেও নীতিমালায় এমন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক। সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ‘সকল অনলাইন গণমাধ্যম বাংলাদেশে স্থাপিত সার্ভারে হোস্টিং করতে হবে। ডিএনএসআই (ডোমেইন নেইম সার্ভার ইন্টারনেট প্রটোকল) সম্পর্কে তথ্য মন্ত্রণালয় অবহিত থাকতে হবে।' এমন নীতি মেনে চলতে অসুবিধা নেই। তবে বাংলাদেশে হোস্টিং খরচ তাছাড়া দেশের হোস্টিংগুলোর মান উন্নয়নে যত্নশীল হতে হবে। ‘অনলাইন গণমাধ্যমের অন্য কোন দেশী বা বিদেশী গণমাধ্যম লিংক করা যাবে না।' এমন নীতিও সঠিক নয়। এই খসড়া নীতিমালা বাস্তবায়িত হলেই তো ৩/৪ অনলাইন সংবাদপত্র টিকে থাকবে, ফলে জাতি আরেকটি... দেখতে পারবে।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আর দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণের বিষয়ে পৃথক আইন কেন? এটাও বোধগম্য হচ্ছে না। ‘‘অনলাইন সংবাদপত্র যদি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালন করে, তাহলে বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। সকল অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে সে সকল পত্রিকা প্রচলিত প্রিন্ট মিডিয়ার ডিক্লারেশন নীতিমালার আলোকে আরো সহজ শর্তে অনুমোদন দেয়া দরকার। এছাড়া অনলাইন পত্রিকা অনুমোদনের জন্য কোন জামানত কিংবা ফি গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না।
 ‘‘তথ্য মন্ত্রণালয় শুধু একটা কাজ করতে পারে। সংবাদপত্র প্রকাশের নীতিমালা অনুসরণ করে আবেদনকারীকে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশনার জন্য একটা ‘ডিক্লারেশন' দিতে পারে। প্রকাশক যদি ডিক্লারেশন পাওয়ার যোগ্য হন, তাহলে ছাড়পত্র দিয়েই তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শেষ'' হতে পারে। আমাদের ধারণা ছিল ডিজিটাল বাংলা গড়তে সরকার অনলাইন মিডিয়ার বিকাশ সাধনে একে প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করা। কিন্তু আমরা একি দেখছি!  জানি না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই নীতিমালাটি পড়েছেন কি না? ভালো করে অধ্যয়ন করলে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পারবেন তার সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলার' স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর এই নীতিমালা স্ববিরোধী।  আপনার সরকারের আমলে অবাধ তথ্য প্রযুক্তির সুযোগ দিয়ে দেশকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার এক যুগান্তকারী ইতিহাস সষ্টি করলেও অনলাইন মিডিয়ার নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। এজন্য অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। চূড়ান্ত নীতিমালা প্রস্তুতের জন্য মোস্তফা জববার, জাফর ইকবাল প্রমুখের নেতৃত্বে দক্ষ লোক নিয়োজিত করা হোক।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে আইপিআইয়ের একটি প্রতিনিধিদল দেখা করতে এলে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়নি।’’ গণমাধ্যমগুলোর বিকাশে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। সংবাদটির শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি ছিল, ‘‘বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের হয়রানিতে বিশ্বাস করে না। গত তিন বছরে সরকার কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটিও মামলা করেনি।’’ (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১২)
বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার' চিত্রটা কেমন? বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার ৩ বছর শাসনকালে ১৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত ঘটনাটি হলো মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন নিউজ' এর সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি'র হত্যাকান্ড। সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে অনেক আন্দোলন হয়েছে। যা এখনো চলছে। কিন্তু ফলাফল কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাওয়া হয়েছিল, এর জবাবে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘‘কারো বেডরুম পাহারা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের নয়।’’ এই মহাসত্য ভাষণ থেকেই বুঝা যায় দেশে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা কেমন নিরাপদে! আমাদের দেশে সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ক্ষমতাসীনদের রোষানলে নতুন নয়। শুধু সাংবাদিকরাই ছিলেন তা নয়। সাথে আছেন দেশের প্রখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরাও। বিভিন্ন সময়ে তারা সরকারের মদদপুষ্ট মহলের হামলা-হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সরকারের আমলে দু'টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ হয়েছে। সরকার অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০১০ সালের ২৭ এপ্রিল চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। এতে প্রায় সহস্রাধিক মিডিয়াকর্মী বেকারত্বের ফলে চরম মানবেতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এছাড়া আরো একাধিক চ্যানেলের উপর যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার খড়গ নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। সরকারি হস্তক্ষেপে জোর করে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। ২০১০ সালের ১ জুন সরকার আমার দেশের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। ৪৭ দিন পর আদালতের রায় পেয়ে পুনঃপ্রকাশিত হয় পত্রিকাটি।
২০১১ সালে ৩১ জুলাই গ্রেফতার করা হয় জনপ্রিয় অনলাইন দৈনিক শীর্ষনিউজডটকম ও সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে। তার গ্রেফতারের কয়েকদিনের মাথায় সরকারের চাপে কর্তৃপক্ষ শীর্ষনিউজডটকম বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তখনই বাতিল করা হয় সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ-এর ডিক্লারেশনও। এছাড়া সাংবাদিক সমাজের বারবার অনুরোধের পরও সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রকাশনার ৬১ বছরের মাথায় এ সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের প্রাচীনতম জাতীয় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার। গত ১২ মার্চ ২০১২ তে বিরোধী দলগুলো মিলে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার বিরোধী মহাসমাবেশ আয়োজন করে। ঐ সমাবেশ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি সমাবেশের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিলে প্রায় সব বেসরকারি টিভি তা সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আগের দিন রাতে সব টিভিকেই সরাসরি প্রচার না করার জন্য বলে দেয় সরকার। অন্যরা তা মেনে নিলেও একুশে টিভি, বাংলা ভিশন ও আরটিভি সরকারের সতর্কতা না মানার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সরকারি কর্তৃপক্ষ সমাবেশ চলাকালিন কয়েকঘণ্টা এই তিন টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বন্ধ করে দেয়। সাধারণ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাতেই বর্তমান সরকারের ‘মিডিয়া দমন' সীমাবন্ধ নেই। বিকল্প গণমাধ্যমও বাদ যায়নি এই দমন-পীড়ন থেকে। সরকারের সমালোচনা ও শেখ হাসিনাকে হুমকি দেয়ার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৯ মে বাংলাদেশে সরকার বন্ধ করে দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক। অবশ্য পরে খুলে দিতে বাধ্য হয়। শেষতক কঠোরতার মোড়কে চলছে, অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। জানি না কতটুকু সফল হবে সরকার।

Saturday, 20 October 2012

রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাস, বাঙালি হত্যা, আদিবাসী সমাচার

রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাস, বাঙালি হত্যা, আদিবাসী সমাচার
পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষার উপায় কি?
 
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশের এক- দশমাংশ অঞ্চল ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল ঘিরে অবস্থান করছে চেঙ্গী, মাইনী, কাছালং বিধৌত প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের সুদর্শন ক্ষেত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের অনতিদূরে পাহাড়ঘেরা তিনটি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। বিগত তিন যুগ ধরেই পাহাড়ে বিস্তার করছে দারুণ অস্থিরতা। জনসংখ্যার ৪৮% বাঙালি ও ৫২% উপজাতীয় সম্প্রদায়। তারা সবাই কতিপয় উপজাতীয় নেতার একগুঁয়েমি, হামবড়া মনোভাব, উচ্চাভিলাষ ও রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটির শিকার। কিন্তু সাধারণ উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী ক্রমশই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ঐসব মতলববাজ নেতাদের কাছ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তারা চায় দেশের অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করতে, বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পাহাড়ে চালুর মাধ্যমে মানবাধিকার ও নাগরিক সমঅধিকারই তাদের একমাত্র প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাস : পাহাড়ে ভিন্নমাত্রায় ছড়িয়ে আছে রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাস। এতে তারা একঢিলে দুইটি করে পাখী মারছে। একদিকে খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাস, মুক্তিপণ, বন্দুকযুদ্ধ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে জনমনে ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। বাঙ্গালীরা ভীত ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। পার্বত্যবাসী বাঙালি ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কগ্রস্ত রাখা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের পেশীশক্তি ও অর্থভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তারা বরাবরই বলে আসছে বহিরাগত, মুসলিম অনুপ্রবেশকারী, রিফুজী, সেটেলার, দখলদার বাংলাদেশী সামরিক জান্তা ইত্যাদি নামে। বিভিন্ন সমাজবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজেদের অর্থবল ও জনবলকে সমৃদ্ধ করছে। অন্যদিকে চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ সন্ত্রাস ইত্যাদি আতঙ্কে থেকে বাঙালি জনগোষ্ঠী পাহাড়ে বসবাসের ঝুঁকিমুক্ত হতে সমতলে ফেরত যাবার মানসিকতা তৈরিও এর আরেকটি উদ্দেশ্য। পাহাড়ে বরাবরই জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ-এর অস্ত্রধারী ক্যাডাররা ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির স্পট দখলে নেয়া এবং নিজেদের দল ভারী করা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও এসব সন্ত্রাসী তথাকথিত জুমল্যান্ড নামে পৃথক রাষ্ট্র কায়েম ও বাঙালি বিদ্বেষী রোডম্যাপ বাস্তবায়নে দারুণভাবে ঐক্যবদ্ধ। নীতিগত কোন বিরোধ তাদের নাই, তাদের বিরোধ হল অর্থের লালসা ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য।
বাঙালি হত্যা : পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসীদের হাতে (শান্তিবাহিনী) এ যাবত প্রায় ৩৫  হাজার বাংলাদেশীকে জীবন দিতে হয়েছে। পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা রাতের অাঁধারে বাঙালিদের ঘরে ঘরে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। ‘তোরা সমতলে চলে যা, বাঙালি আর আর্মি হিলটেকে নো-থাকিব'। বাঘাইছড়ির শতাধিক বাঙালি কাঠুরিয়া হত্যাকান্ড (১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর) তাদের বৃহত্তম হামলার অন্যতম। শুধুমাত্র সেদিনকার শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়টি রাজনৈতিক এজেন্ডায় অগ্রাধিকার প্রদান কর্মসূচিতে না নেয়াতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে লংগদু থানায় বসবাসরত শতাধিক বাঙালি শ্রমিককে চাঁদা নির্ধারণের জন্য আলোচনার ফাঁদে ফেলে সেদিন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদেরকে চোখ বেঁধে, দুইহাত পিছমোড়া করে পাকুয়াখালীর গহীন জঙ্গলে ৫ জন করে এনে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিল সন্তু লারমা বাহিনী। পাহাড়ের নিচে বিশাল খাদে ফেলে দেয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত হাত-পা, চোখ কান, ছেঁড়া মরদেহ সেলাই করে লংগদু থানা পরিষদ মাঠে জানাযা করা হয়েছিল। তন্মধ্যে ৩৪টি লাশ ৩৪টি কবরে শায়িত করে লংগদু মাঠে গণকবর দেয়া হয়, যার জীবন্ত আলামত আজো সেখানে রক্ষিত আছে। এছাড়া আরো বহু বাঙালি হত্যাকান্ড ঘটেছে যার লোমহর্ষক বর্ণনা আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহী সশস্ত্র সন্ত্রাসকে রিষ্ট-পুষ্ট করে।
আদিবাসী সমাচার : পাহাড়ে উচ্চমানের চক্রান্ত শুরু হয়েছে আদিবাসী নামকরণটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এজন্য সন্তু লারমা, দেবাশীষ রায় গং জাতিসংঘে পর্যন্ত গিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর বা দক্ষিণ সুদানের মতোই জাতিসংঘকে ব্যবহার করে বিনা রক্তপাতে গণভোটের মাধ্যমে জুমল্যান্ড হাসিল করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কোথাও সন্তু লারমারা নিজেদের আদিবাসী বলে উল্লেখ করে নাই, বলেছে- উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকা বলে। যদিওবা সেটাও বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি করে এখনো যাবতীয় বে-আইনী অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সশস্ত্র ক্যাডাররা আত্মসমর্পণ না করেই তারা সরকারি ১০০% সুযোগ সুবিধা লুটে নিচ্ছে। অথচ সরকারকে না জানিয়ে গোপনে তথাকথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্যকে জাতিসংঘ আদিবাসী ফোরামের প্রতিনিধি বানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করানো হয়েছিল। তাদের মনগড়া একপেশে ফরমায়েশী রিপোর্ট জাতিসংঘে জমা দিয়ে কাকতালীয়ভাবে পাহাড়ের বাঙালি জনগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীকে অভিযোগের কাঠগড়ায় এনে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনী পাঠানোর আবদার করা হয়েছে ঐ রিপোর্টে। আজ আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবির পেছনে সন্তু লারমাদের মূল উদ্দেশ্য যে কত জঘন্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আলামতের বিষয়, তা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশী প্রতিনিধি ও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি অাঁচ করে ইতোমধ্যেই যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা দেশবাসী ঈগল দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছে ও সাধুবাদ জানিয়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইকোনোমিক কমিশন (EEC), ইউএনডিপি, ডানিডা, একশন এইড, কতিপয় দূতাবাস ও এনজিও তথাকথিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের একতরফা দাবি তুললেও তারা কখনো জেএসএস বনাম ইউপিডিএফ রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ ও শান্তিচুক্তির বহুশর্ত লঙ্ঘনের জন্য সন্তু বাবুদের মোটেও জিজ্ঞাসাবাদ করে না। পার্বত্যাঞ্চলে শতাধিক খৃস্টান প্যাগোডা তৈরি হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে খৃস্টধর্মে দীক্ষিতকরণ প্রবণতা বেশি হলেও তা নিয়ে সন্তু লারমাদের কোন প্রতিবাদ নাই। বরং তারা মাঝে মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামাইজেশন করা হচ্ছে, জোর করে উপজাতীয়দের মুসলিম বানানো হচ্ছে ইত্যাদি ভুয়া ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে মিসগাইড করে আসছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় খৃস্টানে দীক্ষিতকরণ প্রক্রিয়াকে ইউএনডিপি অধিকাংশ ইউরোপিয়ান দেশ ও এনজিও উৎসাহ দিয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ইতোমধ্যেই স্বশাসনের আড়ালে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্থানীয় প্রশাসন ক্রমশ সরে যাচ্ছে। তথাকথিত শান্তিচুক্তির কারণে অনেকগুলো সরকারি বিভাগ পাহাড়ের আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। সন্তু লারমা এখনো সেই পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে থেকে, প্রজাতন্ত্রের লাভজনক যাবতীয় সুবিধাদি ভোগ করছেন এবং সকল অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তি, অর্থবল, জনবল ও সামগ্রিক শক্তি ব্যয় করছেন হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। সর্বশেষ জাতিসংঘে আদিবাসী ফোরামের মাধ্যমে, আইএলওকে ব্যবহার করে জাতি ও সরকারকে ঘুমন্ত রেখেই তারা লক্ষ্য পূরণের অপচেষ্টা করেছে। বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে মূলত সরকারি প্রশাসন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সন্তু লারমা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সেখানকার সরকার বাংলাদেশ সরকার না হয়ে (Govt. of Santu Larma, By the Santu Larma, for the Santu Larma) বলেই কাজ চালাচ্ছে। শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর প্রশাসনই তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে ও পাহাড়ে ঝুঁকির মধ্যে সিভিল প্রশাসনের অনুরোধে জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করে আসছে। এমতাবস্থায় যদি সমস্ত সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়, তবে ছলেবলে কৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে হয়তো বা জুমল্যান্ডের ভাগ্যই বরণ করতে হতে পারে। তাই দেশের এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কবল থেকে রক্ষার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়াবলী বাস্তবায়নের আহবান জানাচ্ছি:
১। অবিলম্বে বৃটিশ হিলট্র্যাক্টস মেনুয়েল এক্ট ১৯০০ বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
২। প্রথাগত ভূমি অধিকারের নীতি রহিত করে পাহাড়ে ভূমি জরিপ (Cadastral Survey) শুরু করতে হবে।
৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব ধারা পবিত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, সেগুলোকে সংশোধন/পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
৪। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদকে নতুনভাবে নির্বাচন দিয়ে নবতর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিতে হবে।
৫। পাহাড়ের সাজেক, পানছড়ি, নানিয়ারচর, দীঘিনালা, রাজস্থলী, কুতুবছড়ি, মানিকছড়ি, রামগড়, বরকল, থানছি, লামা, রুমা, কাউখালী, ঘাগড়া, জুরাছড়ি ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের স্থল থেকে চিহ্নিত পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের আটক ও সকল বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।
৬। সকল বিদেশী দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত, বিদেশী সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন ইত্যাদির কাছে মাঝে মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বাস্তব চিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং যারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ভূ-সন্ত্রাসীদের বাঁচাতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে জোরদার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
মনিরুজ্জামান মনির : লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

Tuesday, 9 October 2012

নারী ও ধর্মব্যবসায়ী পশ্চাৎগামী চিন্তা চেতনা

ঐতিহাসিক ভাবেই পুরুষরা নারীদের সকল অধিকার খর্ব করে গৃহ অভ্যন্তরে নিরাপদ উৎপাদন যন্ত্র হিসাবে নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে চিরকাল। সে কূট উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয় নি। এসব কথা এখন ফেলে আসা নারী ইতিহাসের লোনা জলের নীরব স্বাক্ষি। মানুষের মনোজাগতিক চিন্তা চেতনা ক্রম বিবর্তনের হাত ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী ইতিমধ্যে লাভ করেছে সমঅধিকার।উন্নত দেশগুলোতে নারীরা আস্বাদন করেছে সম অধিকারের পূর্ণ স্বাদ। ১৯২৩ সালে আমেরিকা এক আইন বলে নারী পুরুষ সমঅধিকার ধারনাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এর পরে পশ্চিমা দেশ গুলোতে নারীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়ে যায় দ্রুত। কর্মক্ষেত্রেগুলোতে নারীরা পেয়ে যায় স্থান, দক্ষকর্মী হিসাবে নারী অবস্থান নিয়েছে দ্রুত, পেয়েছে সুখ্যাতি। বাস, ট্রাম রাস্তা ঘাট, সাগর পাড়, পার্ক সর্বত্রই দিনে রাতে নারীরা মুক্ত চলাফেরার স্বাধীনতা লাভ করে। সেসব দেশগুলোতে নারীরা আজ বিমান নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে সুনীল আকাশে, ডুবুরির পোষাক চেপে চষে বেড়াচ্ছে সাগর গর্ভে, বিজ্ঞানী হয়ে বুদ হয়েছে আবিষ্কারের নেশায়, ডাক্তার হয়ে সেবা দিচ্ছে, আইনজ্ঞ হয়ে করছে বিচার, তুলির আঁচড়ে আঁকছে ছবি, কাদামাটি দিয়ে তৈরী করছে ভাষ্কর্য, প্যরাসুট নিয়ে শূণ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাজার ফুট উপর থেকে, রাস্ট্র নায়ক হয়ে শাসন করছে দেশ। আর কি চাই!

এতো গেল পশ্চিমা নারীদের কথা। এবার আমাদের দেশের নারীদের ভূমিকা একটু খতিয়ে দেখি।
দুই দুইবার নির্বাচিত সরকার প্রধান শেখকন্যা একজন চটুল কথার বলিস্ট নারী, বিরোধী দলের অনমনীয় কান্ডারী যার ভান্ডারে সঞ্চিত আছে দুইবার ক্ষমতারোহনের টাটকা স্বাদ ভক্তকুলের নিকট তিনিও একজন আর্দশনারী, জৌলুসহীন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন নারী, আবার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন উচ্চশিক্ষিত নারী, সফল কৃষিমন্ত্রী রাজপথের অগ্নিশিখা যার আছে স্বাধীনতাত্তর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তিনিও একজন ইস্পাত কঠিন নারী। একি সময়ে ক্ষমতার শীর্ষে এতগুলো নারীর উপস্থিতি বিশ্বের আর ২য় কোন দেশে আছে কিনা এই অধমের স্বল্প জ্ঞান পরিসীমায় সেই তথ্য এখনো অধরা। তাছাড়া বিরোধী দলের ডাকা হরতাল পালনের উছিলায় প্রায় রাজপথ দাপিয়ে বেড়াতে দেখি বেশ কিছু সাহসী নারীকে।


আমাদের নিতান্তই দূর্ভাগ্য সুজলা বঙ্গভূমির কলুষিত রাজনৈতিক অঙ্গনে একসঙ্গে এত ক্ষমতাধর নারী প্রতিনিধির অবস্থান থাকার পরেও অবাধ মুক্ত রাজনীতি চর্চার সুযোগ নিয়ে হু হু করে বাড়ছে পশ্চাৎমুখি ভাবধারার লোকজনের সংখ্যা যারা নারীদের ঘরের ত্রিসীমায় আটকে রাখতে বিশেষ পছন্দ করে। নিজেদেরকে দাবি করে ধর্ম রক্ষার সোল এজেন্ট। ধর্ম রক্ষার খাতিরে স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারের কাছে পেশ করেছে অত্যাধুনিক চিন্তাচেতনা সম্বলিত ১৩ দফা। যার মধ্যে অন্যতম- ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা’।
বহু ঘাত প্রতিঘাত, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অপমানের জ্বালা সহ্য করে যুগ যুগ ধরে নিরন্তর সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আমাদের দেশের অবদমিত, অবহেলিত নারী সমাজ যখন সবে ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি মারতে শিখছে, নারী পুরুষ সমঅধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠার কন্ঠস্বর যে সময়ে ক্ষীণ থেকে জোড়ালো হচ্ছে ঠিক সেই মূহুর্তে ধর্ম রক্ষার আড়ালে- প্রকাশ্যে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করা- এই অদ্ভুত দাবী চোখ কপালে ঠেকেছে প্রগতিশীল নারী সমাজের। মানসিক নির্যাতনের নতুন ধারালো খড়্গ তারা ঝুলতে দেখছে চোখের সামনেই। বিপরীত চিত্রও একেবারে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে না তা নয়, আমাদের দেশনেত্রী খালেদা ও তাঁর অনুসারীরা এই দাবীর বিপক্ষে টুশব্দ করতে হুঁশ যেন হারিয়ে ফেলেছেন। বেহুঁশ হয়ে ভাবছেন দানাই পানাই করে আগে ক্ষমতার মসনদে উঠি তারপর এই সব পশ্চাৎগামী স্বপ্নদ্রষ্টাদের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ভাবা যাবে! তাঁর বোধ উপলব্ধিতে জাগ্রত হচ্ছে না ক্ষমতার লোভে এই সব গোষ্ঠিকে ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি নিজেই ব্যবহৃত হচ্ছেন পুনঃপুনঃ এই চক্রের কাছে।
বি এন পির এই নীরব সমর্থনের অনুকূল্য পেয়ে অতীতে আমরা দেখেছি জঙ্গি আর্দশে উজ্জীবিত মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নেপথ্য নায়ক শায়ক আব্দুররহমান ও বাংলাভাইয়ের উত্থান পর্ব, রাজাকারদের দেশ শাসন, গো আজমের নাগরিকতা প্রাপ্তি।
ঋদ্ধ নিকট অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষা দেয় এখনি যদি এই সব ধর্মব্যবসায়ী পশ্চাৎগামী চিন্তা চেতনা স্বপ্ন দ্রষ্টাদের রাস টেনে ধরতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয় তাহলে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট, অনুশোচনার সাথে সাথে অগুনিত প্রাণ যাবে মুক্তচিন্তা চর্চাকারী নারী-পুরুষ উভয় সম্প্রদায়ের। যার চিত্র আমরা দেখি পশ্চাৎমুখি ভাবনা সমৃদ্ধ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মিশর প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠী ইতিহাস পর্যালোচনায়।
আমাদের দেশে নারী পুরুষের সম অধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো কল্প কথায় সীমাবদ্ধ হলেও থেমে থাকেনি নারী অগ্রগতি। কিছু পরিসংখানে তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস পোশাকশিল্প। যেখানে শ্রম দেয় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। এসব শ্রমিকের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। যারা রক্ত ঝরিয়ে বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। যাদের কল্যাণে বাংলাদেশ অর্জন করেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি। দেশ আয় করছে কোটি কোটি বৈদেশিক মূদ্রা।
তাঞ্জিন, সাভারের মত নিয়ত মৃত্যুঝুকি উপেক্ষা করে এসব নারী যদি পুরুষের সাথে অবাধে কাজ করার যুযোগ না পায় তাহলে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে থমকে দাঁড়াবে? কে ঠেকাবে রপ্তানী আয়ের বিপর্যয়? কে দেবে এই সব হতদরিদ্র নারীদের ভাত, কাপড়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা? কি ভাবে ঘুরবে তাদের সংসারের ভগ্ন চাকা?
জনশক্তি খাতে নারীর অবদান বিবেচনা করা যাক, এক হিসাব মতে বর্তমানে ৭৬ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের ১৪৩টি দেশে বৈধভাবে বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। লেবাননে সবচেয়ে বেশি নারী প্রবাসী রয়েছেন। দেশটিতে বাংলাদেশি ৫৬ হাজার ৯৭ জন নারী বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। তারপরই সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫০ হাজার ১৩৫ ও সৌদি আরবে ৩১ হাজার ৪৩৭ জন নারী কাজ করছেন। প্রয়োজনে তারা কিছু টাকা খরচ করলেও সিংহভাগ টাকা কিন্তু তারা দেশে পাঠিয়ে অবদান রাখছে বৈদেশিক মূদ্রার রির্জাভ বৃদ্ধিতে।
কৃষি ক্ষেত্র বিবেচনায় বিচার করি। কৃষিকাজও বলতে গেলে নারীর ভূমিকা ছাড়া প্রায় অচল। শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রায় সকল ধাপে রয়েছে নারীর কমবেশি স্পর্শ। শাখ সবজি ও ফলমূল উৎপাদন এবং গবাদিপশু যেমন- হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল প্রভৃতি লালন পালন ও দেখভালের নারীর ভূমিকা থাকে প্রায় ৪৫ থেকে ৮৫ শতাংশ। এর সুফল ভোগ করছে কাঠ মোল্লা থেকে মৌলবাদী নাস্তিক সকলেই।
বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প। যা গ্রামীন অর্থনীতিতে এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ছোঁয়া। বিস্মকর হলেও সত্য ক্ষুদ্রঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই গ্রাহক নারী। কারণ, ঋণদাতা সংস্থা গুলো নাকি নারী ছাড়া পুরুষকে ঋণ দিতে ঠিক ভরসা পায় না।
এসব ছাড়াও সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নারী উদ্যেক্তা, রয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইন, চলচিত্র, মডেলিং, নাচ গান পেশার কর্ম জীবি মহিলারা যারা অনেকেই সংসারের হাল ধরেছেন, দূর করেছেন দারিদ্রের কালো থাবা, এনেছেন পারিবারিক স্বচ্ছলতা ও গৌরব।
এবার বলুন এত দূর দারিদ্র দূরীকরণের ডিঙ্গি ভাসিয়ে হঠাৎ যদি কেউ আবদার করে বসে নারী পুরুষের অবাধ কাজ করার সুযোগ রহিত করতে হবে। লোকালয় ছেড়ে নারীকে ফিরে যেতে হবে ঘরে। নইলে ক্ষমতায় থাকা যাবে না।
বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন উদ্ভট দাবী নিয়ে কেউ যদি গো ধরে বসে তাহলে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নারী অগ্রগতির ধারক বাহকদের জোড়ালো প্রতিবাদ করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ কী খোলা আছে সামনে?

Friday, 5 October 2012

চাচা-ভাতিজির নির্বাচন কি প্রমাণ করলো ?

সাজানো, পাতানো, প্রহসন কিংবা সুষ্ঠুই হোক গাজীপুর-৪ আসন তথা কাপাসিয়া আসনের উপ-নির্বাচন সমাপ্ত হয়ে গেল। এদেশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি মরহুম তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা হিসেবে সিমিন হোসেন রিমি নির্বাচিত হয়েছেন এতে আমাদের কোন ব্যথা-বেদনা নেই বরং কাপাসিয়াবাসীকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। ধন্যবাদ এ অঞ্চলের লোকেরা ইতোপূর্বেও মরহুম তাজউদ্দিন সাহেবের ছেলেকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে পেয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ যে গুণীজনকে সম্মান কাতে জানে তা আমরা দেখতে পাই বিগত দিনের বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে। যেমন গোপালগঞ্জের মানুষ সে অঞ্চলের গুণী ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়েকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেন। বগুড়া থেকে জিয়াউর রহমানের দলকে বিপুল ভোটে, রংপুর থেকে এরশাদ সাহেবকে বিজয়ী করে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো মরহুম এম এ জি ওসমানী যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করেন, তখন তিনি দেশের আর কোন জেলায় তেমন ভোট না পেলেও তার নিজ জেলা সিলেটে বিজয়ী হয়েছেন। সিলেটবাসীর প্রতি তিনি অত্যন্ত নম্র ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তখন বিভিন্ন মিডিয়া ফলাও করে প্রকাশ করেছিলো ওসমানীর নিজ জেলা সিলেটে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। অতএব বাংলাদেশের মানুষ গুণীজনকে সম্মান করতে জানে। সঙ্গত কারণেই তাজউদ্দিন কন্যা নির্বাচিত হতেই পারেন এবং হওয়াটা উচিতও বটে। যদিও অনেকে মনে করেন রিমি এখনও আওয়ামী লীগকে চিনতে পারেননি, চিনতে পেরেছেন তার ভাই সোহেল।
বর্তমান সরকার যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেন, গাজীপুর-৪ আসনের উপ-নির্বাচন সে বিষয়ে শত প্রশ্নের জন্ম দিল। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুলের কথা এখানে প্রাধান্য দিব না কারণ তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি এবং কারচুপির অভিযোগও তাদের করার কথা নয়। তবে স্বয়ং রিমির চাচা আফসার উদ্দিন সাহেব এটাকে বললেন প্রহসনের নির্বাচন। কারণ কি- এটাই আজ বিশ্লেষণের দাবি রাখে যদি। আমরা সঠিকভাবে এর কারণ অনুধাবন করি তবেই আগামী নির্বাচনে তা কাজে আসবে। বিশ্লেষকগণ মনে করেছেন এখানে ভোট সীল মেরে বাক্সে ভরা হয়ে থাকলে তারও একটা কারণ রয়েছে। যেমন '৭০-এর নির্বাচনে যারা নির্বাচনী কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা দেখলেন কোন প্রতিপক্ষ নেই তবে ভোটারদের জন্য কেন অপেক্ষা করব। আর ভোটারগণ মনে করেছেন প্রতিপক্ষ দুর্বল ভোট দিলেও যা হবে না দিলেও তা হবে। অতএব কি দরকার কষ্ট করার। গাজীপুর-৪ এ এমনটি হওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে এখানে বিএনপি এ নির্বাচন নিয়ে কোন মাথাই খামায়নি। তারাও ধরে নিয়েছে একেবারে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন হলে কেমন হয় তাই চাচাকে তার ভাতিজির বিরুদ্ধে দাঁড় করানো আর কি। এদিকে আফসার উদ্দিন সাহেব বলেছেন, ‘ওরা বলেছে ৫০% ভোট কাস্ট দেখাতে হবে তাই ওই পরিমাণ ভোট সীল মারার পর কেন্দ্র থেকে সবাইকে বের করে দিয়েছে। আমরা সব কথা বিশ্বাস নাই বা করলাম। যিনি হেরে যান তার কত কথাই থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এ নির্বাচন প্রকৃত পক্ষেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে কিনা? যদি তা হয় তবে এমন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নমুনা দেখেও বিরোধীদল নির্বাচনে যাবে কিনা? আবার তারা নির্বাচনে না গেলেও এরশাদ সাহেবকে নিয়ে ওই যে, এরশাদ সাহেবের নিরপেক্ষ নির্বাচন যা জাতি দেখেছে ৯ বছর এমন হবে কিনা। জনাব এরশাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছিলেন সুক্কু মিয়া। যার নাম নির্বাচনের আগেও না আবার পরেও না আমরা আর শুনাতে পাইনি। এরশাদ সাহেব অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক যদি সুক্কু মিয়ার নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় তবে আওয়ামী লীগ বনাম এরশাদ নির্বাচন কেন গ্রহণযোগ্য হবে না? আমরা বড়ই শংকিত দেশটাকে কোন অশুভ ইঙ্গিতের কারণে আমরা ধ্বংস করতে যাচ্ছি কিনা। গাজীপুর-৪ এর উপ-নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলো কারণ প্রতিপক্ষ তা গ্রহণযোগ্য বলেননি। আবার যদি পাতানো নির্বাচন হয় তবে আফসার উদ্দিন সাহেব তো তাদেরই লোক। তবে কেন পূর্বে তাকে বলা হলো না অভিযোগটা হালকাভাবে যেন করেন। যেমন কোথায় কোথায় সমস্যা হয়েছে বলে আমার কাছে খবর আসছে। অন্যদিকে বৃষ্টির জন্য মানুষ আসতে পারেনি এর পরেও ফলাফল যাই হয়েছে, আমি মেনে নিচ্ছি। যেহেতু কারচুপির প্রমাণ আমার নিকট নেই। এমন একটি স্টেটমেন্ট দিলে প্রশ্নটা একটু হালকা হতো। কিন্তু তিনি যে বলিষ্ঠভাবে বলেছেন, এটি প্রহসনের নির্বাচন- এটা মানার প্রশ্নই আসে না। এতে কি বোঝা গেল। অন্যদিকে রিমি বলেছেন, এটা আগেই জানতাম আমি নির্বাচিত হবো। সে কারণে খুব বেশি আশ্চর্য কিছু মনে হচ্ছে না।
অতএব, প্রার্থীর এ আত্মবিশ্বাস থাকারই কথা তিনি নির্বাচিত হবেনই। কিন্তু যেভাবে তিনি বলেছেন, তাতে বোঝা গিয়েছে কি হবে তা তিনি পূর্বেই জানতেন। এ আসনে এক সময় নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আ.স.ম হান্নান শাহ, এত বড় শক্তিশালী নেতারও একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে, যদি আফসার উদ্দিন আহমদ মনে-প্রাণেই সিমিন হোসেন রিমির বিপক্ষে নির্বাচন করে থাকেন তাহলে বিএনপি সমর্থকগণও আফসার সাহেবকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করতে পারতেন। কিন্তু দেখা গিয়েছে, বিএনপি কর্মীরাও এ নির্বাচনকে কোন আমলেই আনেনি। এত কিছুর পরেও জনগণ আফসার উদ্দিন সাহেবকে প্রায় বিশ হাজার ভোট দিয়েছেন। এর কারণ বলে অনেকই মনে করেন আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের এতটাই বিরক্তি যেন তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রার্থী হলেই হয়। সুতরাং আফসার উদ্দিন ভোট যাই পান না কেন, তাও আওয়ামী লীগের জন্য শুভ কোন ইঙ্গিত নয়, কারণ আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। এ নির্বাচনকে নমুনা বানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বিহীন নির্বাচনের টোপ গেলানোও যেন আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেশের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষার জন্য সংলাপ অপরিহার্য।

বিরোধীদলীয় রাজনীতি দমন-দলনের শিকার

বিরোধীদলীয় রাজনীতি দমন-দলনের শিকার
ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে বলেই কি না সেটা একটি বড় প্রশ্ন বটে তবে আওয়ামী লীগ সরকার সম্প্রতি হঠাৎ করেই বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কোনো দলই শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ পর্যন্ত করতে পারছে না। ওদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে ছাত্রলীগের ভয়াবহ সন্ত্রাস। চলছে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের কর্মকান্ডও। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের সর্বশেষ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে গত ২ অক্টোবর। ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা সেদিন রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের মিছিলের ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছে। রামদা দিয়ে কোপানোর পাশাপাশি তারা শিবির কর্মীদের ওপর গুলীও ছুঁড়েছে। এতে গুরুতরভাবে জখম হয়েছেন অন্তত ৩০ জন শিবির কর্মী। কিন্তু পুলিশ তো বটেই, প্রশাসনও বিপন্ন শিবির কর্মীদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। শুধু তা-ই নয়, পুলিশ উল্টো আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সংঘর্ষে অংশ নেয়া ছাত্রলীগের একজন ক্যাডারের দায়ের করা মামলা গ্রহণ করেছে। এতে ছাত্রশিবিরের শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামী করা হয়েছে। শিবিরের ২৮ জনকে এরই মধ্যে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। অথচ হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষও দেখেছেন, রামদা ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হামলা ছাত্রলীগই করেছিল। টিভিতেও সারাদেশের মানুষ সে হামলার দৃশ্য দেখেছেন, সংবাদপত্রগুলোতেও এ সংক্রান্ত অনেক ছবি প্রকাশিত হয়েছে। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানে আক্রান্ত হচ্ছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এরকম একটি ঘটনায় জানা গেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগের ক্যাডার ও সন্ত্রাসীরা। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে পুলিশ মামলা করেছে ছাত্রদলের ২৩ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ ছাত্রলীগ মেরেও জিতছে কেঁদেও জিততে চাচ্ছে!
ওদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে সরকার চরম কর্মকান্ড শুরু করেছে। দেশের অন্যতম প্রধান দল জামায়াতে ইসলামীর কথাই ধরা যাক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই জামায়াতকে কোথাও কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কথিত যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে আটক রাখা হয়েছে। অন্য অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলা চাপিয়ে ধাওয়ার মুখে রাখা হয়েছে। নেতাদের মধ্যে যারা ‘মুক্ত' অবস্থায় রয়েছেন তারাও বহুদিন ধরে এমনকি দলের অফিসে যেতে বা বসতে পারছেন না। কোথাও কোনো কর্মিসভা করলেও তাকে এমনভাবেই ‘গোপন বৈঠক' ও ‘ষড়যন্ত্র' হিসেবে প্রচার করিয়ে দেয়া হচ্ছে যেন জামায়াত কোনো নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন এবং তার নেতা-কর্মীরা অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো বৈঠক করছিলেন! এসব বৈঠক থেকে গ্রেফতারও করা হচ্ছে অনেক নেতা-কর্মীকে। অথচ জামায়াতে ইসলামী এদেশের একটি আইনসম্মত ও নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দল। জামায়াতের জনসমর্থনও ব্যাপক। তাছাড়া অতীতের মতো বর্তমান জাতীয় সংসদেও জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। কিন্তু সে দলটিকেই সরকার রাজপথে দাঁড়াতে পর্যন্ত দিচ্ছে না।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, জামায়াতের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও সম্প্রতি সর্বাত্মক হামলার শিকার হতে শুরু করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে সরকার হঠাৎ ‘হার্ডলাইনে' এগোতে শুরু করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা এবং দলীয় গুন্ডা-সন্ত্রাসী ও পুলিশের হামলার মধ্যেও বিএনপি এতদিন মাঝেমধ্যে মিছিল-সমাবেশ করতে পারতো। এখন আর সে সুযোগটুকুও পাচ্ছে না দলটি। ২ অক্টোববের কথাই বলা যাক। সেদিন পুলিশ শুধু বিএনপির পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ মিছিলকেই ছত্রভঙ্গ করে দেয়নি, নেতা-কর্মীদেরকেও যথেচ্ছভাবে লাঠিপেটা করেছে। তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে। টিয়ার গ্যাসের শেল তো ছুঁড়েছেই। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে যারা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢুকে পড়েছিলেন তারা আর বেরিয়ে আসতে পারেননি। পুলিশ তাদের অফিসের ভেতরেই অবরুদ্ধ করে রেখেছে। পরদিন পর্যন্ত কাউকেই বের হতে দেয়নি পুলিশ। ৪৯ জন নেতার সঙ্গে ‘অজ্ঞাতনামা' আড়াই হাজারজনকে আসামী করে মামলাও ঠুকেছে পুলিশ। দ্বিতীয়দিন অবরুদ্ধ অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য তিনি। কিন্তু পুলিশের লোকজন তাকে এমন জাপটে ধরে নিয়ে গেছে যা দেখে মনে হয়েছে যেন জনাব আলাল একজন খুনী বা সন্ত্রাসী! উল্লেখ্য, জাতীয় পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে পুলিশের এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণ দেখে জনগণের অন্য একটি ঘটনা মনে পড়ে গেছে। সেবার জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে প্রায় প্রাণেই মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। অসংখ্য টিভি ক্যামেরা ও সাংবাদিকের পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের চোখের সামনেই হত্যার চেষ্টা করেছিল দু'জন পুলিশ অফিসার। কিন্তু এত প্রকাশ্যে দৌড়ঝাঁপ করা সত্ত্বেও সে দু'জনকে কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। সরকার উল্টো পদোন্নতি দিয়ে তাদের পুরষ্কৃত করেছে।
সরকারের এই রাজনৈতিক ও মানবাধিকার বিরোধী নীতির কারণে বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন চালানোর ব্যাপারে পুলিশও এতদিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ২ অক্টোবরের সর্বশেষ ঘটনায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মারমুখী অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে পুলিশ আইনের তোয়াক্কা করেনি। অথচ মিছিল-সমাবেশ, পিকেটিং, মানব বন্ধন, হরতাল প্রভৃতি মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু পুলিশকে দিয়ে গণতন্ত্র ও সংবিধানসম্মত সব কর্মসূচীকেও পন্ড করাচ্ছে সরকার। পুলিশ এমনকি আগে থেকে ঘোষিত শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশও করতে দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয় ও ইঙ্গিতে পুলিশ জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও অবমাননাকর আচরণ করছে। ২ অক্টোবর বিএনপির নেতা-কর্মীদের যেভাবে লাঠিপেটা করানো হয়েছে তা দেখে মনে হবে, পুলিশ সরকারের রাজনৈতিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। রাজধানীতে শুধু নয়, দেশের অন্য সব স্থানেও বিএনপির বিরুদ্ধে দমনমূলক কঠোর ব্যবস্থাই নিচ্ছে সরকার। এজন্যই বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা আসলে হার্ডলাইনে হাঁটছেন। দমন-নির্যাতন চালানোর জন্য তারা উপলক্ষও নিজেরাই তৈরি করছেন। যেমন রামুর সহিংসতার পেছনে আওয়ামী লীগের হাত থাকার বিষয়ে এরই মধ্যে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশ সেখানেও আসামী করেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। জামায়াতের নেতা-কর্মীদেরও বাদ দেয়া হচ্ছে না। প্রচারণাও এমনভাবেই চালানো হচ্ছে যেন বিএনপি ও জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়, দল দুটি আসলে জঙ্গি সংগঠন!
আমরা  মনে করি, সরকারের এই নীতি-মনোভাব এবং পুলিশকে দিয়ে দমন-নির্যাতন চালানোর ও মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করানোর ঘটনা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য। আমরা আগেও বলেছি, প্রজাতন্ত্রের পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রসম্মত কর্মসূচী ভন্ডুল করা এবং নেতা-কর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। শিক্ষাঙ্গনে চলমান ছাত্রলীগের সন্ত্রাস সম্পর্কেও একই কথা বলা দরকার। সরকারের উচিত, হত্যা-সন্ত্রাস ও ফ্যাসিস্ট কর্মকান্ড পরিত্যাগ করে সময় থাকতে গণতন্ত্রসম্মত অবস্থানে ফিরে আসা।

Monday, 24 September 2012

গণতন্ত্রের ধারা!

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এরশাদ সাহেবের পতনের পর দেশে গণতন্ত্রের যে ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তা অব্যাহত গতিতে চলবে এমন একটি আশা আমরা পোষণ করেছিলাম। আরম্ভটা ভালোই হয়েছিল। তবুও শেখ হাসিনার সূক্ষ্ম কারচুপি মন্তব্যটি কিঞ্চিৎ প্রশ্নের সঞ্চার করেছিল। তারপর নির্বাচনে একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ, একবার আওয়ামী লীগ অন্যবার বিএনপি ক্ষমতার আসনে বসেছিল। এতে গণতান্ত্রিক চর্চা ভালো হওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয়নি কারণ, পার্টি দুটো গণতন্ত্রের চর্চা করেনি। এক ধরনের 'প্রেসিডেন্টশিয়াল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট' দুটি দলই ক্ষমতার বলে চালিয়েছে। এটি কেন হলো? উত্তরটা সহজ। নেতৃত্বে যিনি সর্বেসর্বা সেই খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দায়ী। কারণ, তারা নির্বাচনে তৃণমূল থেকে পরীক্ষিত কর্মী বা নেতা না নিয়ে নির্বাচনে আমলাদের (সামরিক ও বেসামরিক) প্রাধান্য দিয়ে মনোনয়ন দান করেছিলেন। অর্থ ও ক্ষমতার কথাভেবে এবং এসব নেতা শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। এরা দেশ সেবা করার জন্য দলে যোগদান করেননি। তারা ক্ষমতা ও ধনের জন্য রাজনীতিতে এসেছিলেন। পরীক্ষিত তৃণমূল থেকে নেতাকর্মী না নেয়ার জন্য দল থেকে আদর্শ লোপ পেল। ফলে ঘুষ ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেল দেশ। দলগুলোর অঙ্গসংগঠনগুলো টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে দলবাজি করা শুরু করল। সরকারি জমি দখল হয়ে গেল। দখল হলো রেলওয়ের জমি। নদীও দখল থেকে নিষ্কৃতি পেল না। চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পেল এবং এটা এমন হলো যে বখরা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারি শুরু হলো। এ এক অদ্ভুত চিত্র। দলের শাসন লোপ পেল।

  
বলাবাহুল্য, দুর্নীতির এই বল্গাহীন তা-বে আদর্শবাদ, নৈতিকতা, সততা লোপ পেল। পাল্লা দেয়া শুরু হলো কে কতভাবে দুর্নীতি করতে পারে। ঘুষ গ্রহণ করতে পারে। দুই দলের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুণীজন আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। মরহুম মোজাফফর আহমদ থেকে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক সরকারকে সতর্ক করে দেন। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ভালো কথা কোনো দলই শুনতে রাজি নন।

 আর একটি দিক লক্ষ্য করা যায়। দলের ভেতরেও গণতন্ত্রের চর্চা লোপ পেল। পার্টি প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একজনই। এ ঐতিহ্য বন্ধ হলো না। ফলে একক নেতৃত্বে সর্বেসর্বা ব্যক্তিটি সবার কাছ থেকে যা প্রত্যাশা করেন তা হচ্ছে আনুগত্য। আনুগত্য না দেখালে দলে ঠাঁই নেই কোনোকালেই।

 রাজনীতিতে এইসব চক্র থাকাতে যে গণতন্ত্র অব্যাহত গতিতে চলত তা থেমে গেল। ফলে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দলের সর্বেসর্বা। তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই অন্যান্য নেতা কথা বলে। বক্তব্য রাখে। বিবৃতি দেয়। এছাড়া আরেকটি কারণ আছে, ভোট ধরতে পারবে কে? দুই নেত্রীর কারিশমা ভোট ধরার উপায়। কাজেই দলের নেতারা তাদের ওপর নির্ভরশীল। নির্ভরশীল হলে নেতা বা নেত্রীর মধ্যে 'ইগোইজম' সৃষ্টি হয়।

 তখন সবাই রাজা নন। একজনই রাজা এ রাজার রাজত্বে। আর একটি দিক বিবেচনায় নিতে হয়। ছোট ছোট যে বামপন্থী দল আছে তা দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করেছে। তাদের কোনো নির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। ভোটে দাঁড়ালেও ভোট পাবে কিনা সন্দেহ। তবুও সুধীজনের প্রত্যাশা যতটুকু ক্ষমতা আছে তা নিয়ে এ সব দল লড়বে। কিন্তু না, তারা আত্মসমর্পণ করে। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। বামপন্থী চেতনার অবসান হয়। দক্ষিণমুখী চেতনার জন্য তারা বিসর্জন দেয় আদর্শ। দলে যে ভিড়ল তার প্রধান কারণ, ক্ষমতা, দুএকটা পদ, কিংবা মন্ত্রিত্ব। তাই দিলীপ বাবু কমিউনিস্ট হয়ে আওয়ামী লীগে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। এতে তার আদর্শ তার চোখে বিসর্জিত হয়নি।

 এ প্রসঙ্গে পরিবারতন্ত্রের কথা বলা যেতে পারে। গেল কয়েকবছর ধরে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে 'মাইনাস' করার কথা বলা হচ্ছে। ১/১১-এর সময় বড় করে, এখন ছোট করে। কিন্তু যারা বলছেন তারা হয়তো ভুলে যান এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একদিনে চেপে বসেনি। এটা বলা চলে সেই '৭১-৭২ থেকে। শেষ মুজিবের সময় থেকে। নইলে আওয়ামী লীগের নেতার তো অভাব ছিল না। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, নজরুল ইসলামের পরও অনেক ছিলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীর কথা বলতে পারি। তা কেউ না হয়ে শেখ হাসিনা নেতা হলেন কেন? নেতারাই তো তাকে বানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। গৃহবধূ থেকে টেনে এনে তাকে নেতা বানানো হলো এবং এরা দুজনই নেতা বনে তো গেলেন। নির্বাচনে তাদের নামেই তো ভোট আসে। অন্য কারো নামে নয়। অবশ্য নির্বাচনে যিনি দাঁড়াচ্ছেন তার ওপরও কিছুটা নির্ভর করে। মনে রাখা ভালো, ভারতের মতো দেশেও পরিবারতন্ত্র ঘোচাতে পারেনি। নির্বাচনে নেহরুর বংশই ভোটার টানে। ফলে বিজয়। কাজেই রিস্ক নিয়ে লাভ কী? ওখানে চেষ্টা তো কম হয়নি। সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করা যায়নি বিজেপির জন্য। কিন্তু নেতৃত্ব তো তার হাতে, কংগ্রেসের নেতৃত্বের কথা বলছি।

 এই প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী এরশাদের প্রসঙ্গ আনতে হয়। তার ৯ বছরের শাসনামলে দুর্নীতির যে বিষবাষ্প বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল তার তুলনা হয় না। গণঅভ্যুত্থানে তার পতনের পর তিনি ডাস্টবিনে চলে যাবেন এ রকমই আশা করা হয়েছিল। যে আশা সঙ্গত ও যৌক্তিক কিন্তু না, তিনি অবিশ্বাস্য মেধা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থান করে নিলেন। কাউকে ভাই ডেকে, কাউকে বোন ডেকে। তালবাজ এরশাদ তালমতই শেখ হাসিনাকে বোন ডেকে তার দলে ভিড়লেন। যদিও প্রত্যাশা মেটেনি, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি, তবুও তিনি আছেন এবং তার মর্যাদা বেড়ে গেল ভারতের আমন্ত্রণে। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেসের সভানেত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। নিশ্চিত এটা, ভারত সেকেন্ড ফ্রন্ট খুলেছে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে, আর প্রথম ফ্রন্ট আওয়ামী লীগ। বস্তুত, এরশাদ ধরে নিয়েছেন খালেদা জিয়া যেমন একরোখা তাতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থায় নির্বাচন করবেন না, তখন বিরোধী পক্ষের ভূমিকায় এরশাদ ছাড়া আর কে আছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে আর তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হবেন এবং নেতা হয়েও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যাবেন। রাজনৈতিক দাবাখেলায় সব সময় সব সাধ মেটে না। কিন্তু কখনো কখনো মিটে যায়। কে জানে এরশাদ সাহেবের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কি না।


 দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের বীজটি উপ্ত হয়ে শাখা-প্রশাখা মেলে ফলে ফুলে বৃক্ষ হয়ে উঠবে এ আশা বাতুলতা। তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র নামেই, কারণ একবার নির্বাচন হয়। নির্বাচন শেষে আবার পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন হয়। এর নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের এই ধারা দুটি দলই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মেনে চলে এবং জনগণকে যে সব ওয়াদা দেয় তা অপূর্ণই থেকে যায়। মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, জনসেবা _এর কিছুই পায় না। মানুষ অবাক হয়ে দেখে কীভাবে ক্ষমতাসীন দলটি সব কিছু ভুলে গেল। তাই মাঝে মাঝে শুনতে হয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, ওই দুজন থেকে এরশাদ সাহেবই তো ভালো। কত বড় আঘাত পেলে ও নিরাশ হলে জনগণ এরকম কথা বলতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবশ্য এতে এসে যায় না। তারা ভাবে তাদেরই জয় হবে। জনস্বার্থ রক্ষিত হোক কিংবা না হোক। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে যে 'যুদ্ধ' চলছে কীভাবে তার মীমাংসা হবে সেটাই প্রশ্ন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটার গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে বিশ্বাস হয় না। তাহলে কি সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মীমাংসা হবে। তাতে কি মঙ্গল হবে দেশের?
তা হলে কি গণতন্ত্রের চর্চার সামান্যতম ধারাটি যা আছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে। লাভ হবে কার?

Saturday, 22 September 2012

রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

 সুন্দরবনের খুব কাছে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারত থেকে নিম্নমানের কয়লা আনবার প্রক্রিয়া চলছে বলে অভিযোগ করেছেন দেশের পরিবেশবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও জানিয়েছেন, এতে পরিবেশের যেমন বিপর্যয় ঘটবে, তেমনি দেশের একমাত্র ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারত মাত্র ১৫ ভাগ অর্থ বিনিয়োগ করে ৫০ ভাগ বিদ্যুৎ নিয়ে যাবে। কিন্তু ৭০ ভাগ বৈদেশিক ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। শুধু তাই নয়, কোনও কারণে যদি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব না হয়, তাহলে পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বাংলাদেশকে। চুক্তিতে না কি এমন সব শর্তই জুড়ে দেয়া হয়েছে। আমরা জানিনা, সুন্দরবনের পরিবেশ নষ্ট করে এবং প্রতিবেশী দেশ থেকে নিম্নমানের কয়লা আমদানি করে রামপালে কেন আলোচ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে? আমাদের দেশে প্রচুর কয়লা রয়েছে। এ কয়লা মানের দিক থেকেও ভারত থেকে আমদানির জন্য প্রস্তাবিত কয়লার চাইতে উন্নত। বিশেষত দিনাজপুরের কয়লা ভারতীয় কয়লার চাইতে কোনও অংশে কম নয়। এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারতীয় কয়লা আমদানির তোড়জোড় চলছে কার স্বার্থে? আমাদের কয়লা দিয়ে আমরা কি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি বলে আমরা মনে করতে চাই। এ জন্য দরকার দৃঢ় ইচ্ছা এবং গভীর দেশপ্রেম। সর্বোপরি প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সবার ওপরে দেশ ও জাতির স্বার্থকে বড়রূপে বিবেচনা করতে পারলে অনেক বড় কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব বলে আমরা মনে করতে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা আত্মনির্ভরতাকে পছন্দ করতে পারি না। পরের সাহায্যের প্রতি আমরা চেয়ে থাকি। অন্যরা যে তাদের স্বার্থ ত্যাগ করে আমাদের কিছু দেয় না, দিতে চায় না, একথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। আলোচ্য প্রকল্পের লভ্যাংশের ৫০ ভাগই ভারত নিয়ে যাবে মাত্র ১৫ ভাগ বিনিয়োগের মাধ্যমে। অথচ যদি কোনও কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব না হয় তাহলে পুরো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বাংলাদেশকে। এতেই বোঝা যায় বন্ধুদেশটির উদ্দেশ্য। আসলে আমরা বেনে বন্ধুদের উদ্দেশ্য না বুঝেই বিনিয়োগে রাজি হতে চাই। আমরা নিজেদের তথা দেশ ও জাতির স্বার্থকে বড় করে দেখতে চাই না। যা দেখি তা ব্যক্তিস্বার্থ। উপস্থিত হাতে যা পাই সেটাই বড় করে দেখি। এমন করে কোনও জাতি কখনও বড় হতে পারে না। আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না। কয়লার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের রয়েছে প্রচুর। তা আমরা কাজে লাগাবার চেষ্টা করি না। সঠিকরূপে উত্তোলনের ব্যবস্থা না নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে তা দিয়ে অন্য দেশের বেনেদের পকেট ভর্তি করবার সব রকম ফন্দিফিকির করতে আমরা কসরত করছি ব্যক্তিগত সাময়িক লাভালাভের বিবেচনায়। দুর্ভাগ্য আমরাদের এখানেই। আমরা মনে করি, এখনও সময় আছে আলোচ্য প্রকল্পটি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করবার। প্রকল্পটি যেন পরিবেশ ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে না যায়, এ ব্যাপারে গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। এটি নিয়ে যদি আরও অধিকতর ভাবনা-চিন্তার দরকার পড়ে সে দিকটার প্রতিও নজর দেয়া জরুরি।

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাতিল প্রয়োজন


১। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখন্ডিত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত ডমিনিয়ন নামে দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। যে সব হিন্দুর বাড়িঘর ও ভূ-সম্পত্তি পাকিস্তান ভূখন্ডে পড়ে তা হস্তান্তর করে অনেকে ভারতে চলে যেতে চায় এবং অনুরূপভাবে যে সব মুসলমানের বাড়িঘর, বিষয় সম্পত্তি ভারত ভূখন্ডে পড়ে তাদের মধ্যেও অনেকে তা হস্তান্তর করে পাকিস্তান চলে যেতে চায়। পাকিস্তানের হিন্দু নাগরিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার হিন্দুরা পাকিস্তানকে স্বদেশ যেমন মনে করতো না; তেমনি ভারতের মুসলমানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যার মুসলমানরাও ভাতরকে স্বদেশ মনে করতো না। এই মনোভাব অসন্তোষ ও আন্দোলন আকারে দেখা যায় বা বুঝা যায়।
২। উভয় রাষ্ট্রের জনগণের এই মনোভাব উভয় রাষ্ট্রের সরকার প্রধান বুঝতে পেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন একত্রে মিলিত হয়ে একটা চুক্তি বা প্যাক্ট করেন; যা নূন-নেহরু প্যাক্ট নামে খ্যাত। এই প্যাক্টের ফলে ভারতের মুসলিম নাগরিকদের মধ্যে যারা তাদের বাড়িঘর ও বিষয় সম্পত্তি পাকিস্তানের হিন্দু নাগরিকদের সমমূল্যের বিষয় সম্পত্তির সাথে বিনিময় মূলে হস্তান্তর করতে পারবেন তা চুক্তি হয়। এই নূন-নেহরু প্যাক্টের ফলে পাকিস্তানের হাজার হাজার হিন্দু এবং ভারতের হাজার হাজার মুসলমান মহাজের হয়ে বা হিন্দু বিনিময়কারী ও মুসলিম বিনিময়কারী হয়ে নিজ নিজ সম্পত্তি বিনিময় করেন।
৩। ভারত সরকার এই বিনিময়কে স্বাগত জানালেও পাকিস্তান সরকার সেভাবে স্বাগত জানায়নি। ফলে বিনিময় আমমোক্তার নামা ও বিনিময় দলিল সম্পাদনে ভারত সরকার কোন বাধা সৃষ্টি করেনি। পাকিস্তানের হিন্দুরা ভারতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক অফিসে উপস্থিত হয়ে তাদের পাকিস্তানস্থিত বাড়িঘর ও বিষয় সম্পত্তি বাবদ বিনিময় আমমোক্তার নামা দলিল মুসলিম বিনিময়কারী বরাবর সম্পাদন করে দিয়েছেন এবং ঐ একই সময়ে ভারতীয় মুসলিম বিনিময়কারী তার ভারতীয় সম্পত্তির বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে হিন্দু বিনিময়কারীর বরাবর রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। বিনিময়ের সব ঝামেলা একদিনেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলিম বিনিময়কারী হিন্দু বিনিময়কারীর নিকট হতে সম্পাদিত আমমোক্তার নামা নিয়ে এসে পাকিস্তানের জেলা প্রশাসকের অফিসে তা জমা দিয়ে তা ড্যালিড করার ও বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য আবেদন করেন। মুসলিম বিনিময়কারীর ডিসি অফিস ঘোরার যাত্রা শুরু হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঘুরে ৩০-৪০ বছরেও পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের ডিসি অফিস বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি করে দেয়নি অর্থাৎ মুসলমানদের কিছু বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে এবং কিছু বিনিময় দলিল এখনও রেজিস্ট্রি হয়নি। অনেক বিনিময়কারী নিজে মারা গেছে। অনেকের পুত্র পর্যন্তও মারা গেছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের দুর্নীতিবাজ ডিসি ও এডিসিরা মুসলিম বিনিময়কারীদের বিনিময় দলিল রেজিস্ট্রি না করে বছরের পর বছর তাদের উৎপীড়ন করেছে।
৪। পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের সম্পত্তি হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে ১ নং অর্ডিন্যান্স জারি করে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইউব খান ০৬/০৯/১৯৬৫ ইং তারিখে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন; যা ১৬/০২/১৯৬৯ ইং তারিখে প্রত্যাহার হয়। এই সময়ে যে সব হিন্দু পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে বসবাস করেছে তাদের ভূ-সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শত্রু সম্পত্তি আইনের যাত্রা এখান হতেই শুরু হয়। শত্রু সম্পত্তি আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান শত্রু সম্পত্তি আইনের অবসান না ঘটিয়ে বরং এক ধাপ এগিয়ে তিনি শত্রু সম্পত্তির মালিকানা সরকারের উপর ন্যস্ত করে শত্রু সম্পত্তি আইনের নামকরণ করেন ‘‘অর্পিত সম্পত্তি’’ বা "Vested Property"। শেখ মুজিবুর রহমান ইচ্ছা করলে এই শত্রু সম্পত্তি আইনের অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা দিতে পারতেন যে ‘‘শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা হলো। দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতের বিচারের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তির মীমাংসা হবে।
৫। শেখ মুজিবুর রহমানের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সরকার প্রধান হয়েছেন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু কেউ এই সাধারণ মানুষ বা কৃষকদের দিকে ফিরে দেখেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে যে সব অবাঙালি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল বা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান নিয়েছিল তাদের বাড়িঘর, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ভূসম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা Abandoned Property ঘোষণা করা হয়। অবাঙ্গালীদের এই পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে লুটপাট করতে উপর তলার মানুষের শ্যেনদৃষ্টি থাকায় এই পরিত্যক্ত সম্পত্তির শীঘ্র স্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু হিন্দু মুসলমান সাধারণ নাগরিকদের শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তির মীমাংসা না করে তাকে আরো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বা আরো যুগান্তর কাল ধরে প্রজা উৎপীড়ন করার জন্য রঙিন নাম দেয়া হয়েছে ‘‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন-২০১২।’’
৬। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের By Product হলো পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের By Product হলো শত্রু সম্পত্তি আইন বা অর্জিত সম্পত্তি আইন। ভারত সরকার ভারতীয় মুসলিমদের সম্পত্তি হস্তান্তরের বিরুদ্ধে কোন বাধা সৃষ্টির আইন যথা ১৯৬৪ সালের অর্ডিন্যান্স নং ১ বা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে ‘‘শত্রু সম্পত্তি’’ এই ধরনের উৎপীড়নমূলক আইন পাস করেনি। কিন্তু পাক সরকার বা বাংলাদেশ সরকার করেছে। এই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় ১০ কোটি হিন্দু-মুসলমান Affected হবে বা হয়েছে। কারণ ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রায় ৮০% ভূসম্পত্তির মালিক ছিল মুসলমানরা। বৃটিশ শাসন আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং জমিদার বা জমিদারী সৃষ্টির কৌশলে হিন্দুরা ৮০% ভূসম্পত্তির মালিক হয়। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানের মুসলমানরা জজ, ব্যারিস্টার, সচিব, জেলা প্রশাসক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, এসপি, কর্নেল, মেজর, ব্রিগেডিয়ার ইত্যাদি চাকরি করে ও ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ রোজগার করেছে এবং অর্থশালী হয়েছে। ভারত হতে অনেক মুসলমান তাদের ভারতীয় সম্পত্তি নূন নেহরু প্যাক্টের অধীনে বিনিময় সূত্রে এ দেশের বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছে। এইভাবে মুসলমানরা পুনরায় ৮০% সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সি. এস রেকর্ডে দেখা যাবে ৮০% জমির মালিক হিন্দু এবং আর. এস রেকর্ডে দেখা যায় ৮০% জমির মালিক মুসলমান। সুতরাং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় ১০ কোটি হিন্দু-মুসলমান Affected হবে এবং ৫ কোটি মামলার জন্ম হবে। এই ৫ কোটি মামলার বিচার করতে হাজার হাজার বিচারক নিয়োগ করতে হবে। হিন্দু আইনে ‘‘রিভারসনার’’ নামে একটি শব্দ আছে। এই রিভারসনার আইনের আওতায় বাংলাদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ হিন্দু ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের অর্পিত সম্পত্তি ‘‘স্বার্থাধিকারী’’ হিসাবে প্রত্যর্পণ আইনে দাবিদার হতে পারবে। সুতরাং এই আইন অতীত কালের কলেরা বা বসন্ত রোগের মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়বে। লাশ দাফন করার লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ও আদালতে এইসব জটিলতার বিচার হতে পারতো। এই আইন হিন্দু-মুসলমানের সুসম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে। একটি ‘‘নিবর্তনমূলক আইন।’’
৭। যে মুসলমান তার স্বোপার্জিত অর্থ দিয়ে ষাট দশকে হিন্দুর নামীয় এস এ রেকর্ডের ভূমি বা বাড়ি খরিদ করেছেন বা যে ভারতীয় মুসলিম বিনিময়কারী ষাট দশকে হিন্দুর সম্পত্তির সাথে নিজের সম্পত্তির বিনিময় মূলে প্রাপ্ত হয়ে ৪০/৪৫ বছর ভোগ দখল করছে বা ঐ আমলের ৫০০/- টাকা মূল্যের সম্পত্তি বর্তমান আমলে ৫০,০০,০০০/- (পঞ্চাশ লাখ) টাকার সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে সেইসব সম্পত্তি এসএ এবং আরএস রেকর্ডের মালিকানার পরিবর্তনের কারণে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের কাঠামোতে পড়েছে। এই জটিলতা দূর করতে হবে। ৫ কোটি মামলার উদ্ভব। এই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে কোন হিন্দু বা কোন মুসলমানের লাভ নেই বা লাভ হবে না। শুধুমাত্র দুর্নীতির দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার ঘুষের টাকা ডিসি অফিসে, রাজস্ব অফিসে, তহসীল অফিসে দিতে হবে। জুতো ক্ষয় হবে। ডিসি অফিসে কতদিন ধরে ঘুরতে হবে তার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। তাই হিন্দুর কপাল ও মুসলমানের কপাল একসাথে পোড়ার কাজ শুরু হয়েছে।
৮। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন এমনই বিষধর আইন যে, যুগান্তর কালের বিচারাধীন মামলার সম্পত্তির যদি খতিয়ান নং ও দাগ নং গেজেটে প্রকাশিত হয়; তবে সেইসব সম্পত্তির বিচারকার্য সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ বা স্থগিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ আদালতের বিচারাধীন মামলা বা আপিলের বিচার করার এখতিয়ার জজ সাহেব, অতিরিক্ত জজ সাহেব হারিয়ে ফেলবেন। অর্থাৎ এই আইন দ্বারা বিচারকের এখতিয়ার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই আইন মানুষের মৌলিক অধিকার, সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকার হরণ করেছে। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার সুসম্পর্ক বিনষ্ট করে দিবে। আদালতের বিচারকের বিচার ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই বাংলাদেশের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য প্রধান বিচারপতির সদয় দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক এই অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনটি যদি জনকল্যাণকর না হয়ে জন নিবর্তনমূলক মনে হয় তবে তা বাতিল বা রদ, রহিত করার আহবান জানাচ্ছি।

Wednesday, 19 September 2012

দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

হলমার্ক গ্রুপকে দেয়া সোনালী ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকার সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে আমরা ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিই। অথচ মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, পুরো ব্যাংকিং খাতেই ধস নেমেছে। এটা নিয়ে হৈচৈ করারও কিছু  নেই। সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারণা চালিয়ে দেশের ক্ষতি করছে। এটা বড় কিছু নয়। তিনি আরো বলেন, দেশের সংবাদমাধ্যমেরও সংস্কারের (রিফর্ম) দরকার আছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), ইউএসএআইডি, প্রগতি ও এমআরডিআই আয়োজিত ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার' শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রীর এসব বক্তব্য শুনে মনে হয়, তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আর সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হিসেবে তিনি যদি কথাগুলো বলে থাকেন, তাহলে বলতে হবে- কানার হাতে কুড়াল তুলে দেয়া হয়েছে। 
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। এতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া, প্রগতি এবং ইউএসএআইডি'র মিশন ডিরেক্টর রিচার্ড গ্রিন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম, টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসকরা বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ডি. নেটের নির্বাহী পরিচালক ড. অনন্য রায়হান।  আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, বিশ্বব্যাংকের সততা বিভাগ জিহাদি মনোভাব নিয়ে কাজ করে। এই জিহাদি মনোভাব নিয়ে কাজ করা যাবে না। বিশ্বব্যাংক যা বলে, তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য ও জবাবদিহিহীন। এটি দুর্নীতি প্রতিরোধের বিরোধী হিসেবে কাজ করে। ওই সেকশনটাকে সংশোধন করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, কালো টাকা বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা। কালো টাকা থাকবেই। এটা মেনে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।'
আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, শেয়ারবাজারে যে দুর্নীতি হয়েছে, এ জন্য দুদকে কেউ সাক্ষী দিচ্ছে না। সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা দুর্নীতি বন্ধে আইসিটি বা তথ্য প্রক্রিয়া সাহায্য করবে। কিন্তু সিস্টেমেটিক দুর্নীতি বন্ধে আইসিটি কি করবে- এমন প্রশ্ন রেখে হাসানুল হক ইনু বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বন্ধে যদি অনুমতি নিতে হয় তাহলে দুর্নীতি কিভাবে বন্ধ হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত হলে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিচারপতিকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ছোট ধরনের দুর্নীতি কমে এসেছে, এখন বড় ধরনের দুর্নীতি কমানোর জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। গোলামুর রহমান বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হতে পারে। দুর্নীতি এক দিনে আসেনি। তাই দুর্নীতি একদিনে, এক মাসে বা এক বছরে কমে যাবে না। যদি বছরে ১০০ জনের শাস্তি হয়, তাহলে এটা একটা উদাহরণ হতে পারে।' গোলামুর রহমান শব্দের অর্থ রহমানের গোলাম, দাস, বান্দাহ। কিন্তু জাতির আশা-ভরসার স্থলে বসার পর এই রহমানের গোলাম সরকারের গোলামে পরিণত হয়েছে। যেখানে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রীকে পাহাড়সম অপকর্মের জন্য জিজ্ঞাসিত হতে হবে, সেখানে তাকে প্রধান অতিথি করে যে নজির স্থাপন করেছে, তা অবাক করার বিষয় বটে। যে মন্ত্রী তার কৃতকর্ম ও বেফাঁস বক্তব্যের জন্য সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছেন, সে অর্থমন্ত্রীকে ওই অনুষ্ঠানে কি তোয়াজই না করছেন দুদকের এই অপরিণামদর্শী কর্তাব্যক্তি। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার এটি অনন্য নজির নয় কি। সচেতন মানুষ তো এমনটাই মনে করছে। সর্বত্র যা টক অব দ্য টাউনে পরিণত।
দুর্নীতি ও জালিয়াতির এ ঘটনাটি মিডিয়া উপস্থাপনে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে। এ জন্য পুরো মিডিয়া যেখানে ধন্যবাদ পাবে, সেখানে অর্থমন্ত্রী উল্টো মিডিয়াকে এক হাত দেখানোর অপচেষ্টা করেছেন। তিনি এতে দেশের ক্ষতি হয়েছে বলে অপরিণামদর্শী মন্তব্য করেছেন। দিনি রিফর্ম বা সংস্কারের কথা বলে সেটা দুর্নীতি সহায়ক মিডিয়া সংস্কারের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন নিশ্চয়। মিডিয়াকে সঠিক, বাস্তব সত্য পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে নিয়ে  যাওয়ার ব্যাপারটিই তার বক্তব্যে উঠে এসেছে। তার কথায় তাকে অর্থমন্ত্রী না বলে অথর্ব মন্ত্রী বলাই মনে হয় অধিক যুক্তিযুক্ত। সংসদে তার এসব কথা নিয়ে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাই তাকে তুলোধুনো করেছেন। ফলে তিনি দেশ ও জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে নিষ্কৃতির পাওয়ার চেষ্টা করছেন। দুর্নীতি তো দুর্নীতিই, সেটা এক টাকা হোক আর ৪ হাজার কোটি টাকা হোক। একে ভিন্ন চোখে দেখা আর উপস্থাপনের চেষ্টা দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয়, সহযোগিতা ও লালনের নামান্তর। এটা সত্য, এটাই বাস্তব। এটা সবাই জানে-বোঝে। এটা বুঝতে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। লবণ-ভাত খাওয়া যে কেউ তা সহজে বুঝতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদের মতে, এ ক্ষেত্রে এভাবে ঋণ দেয়ায় সঠিক নিয়ম পালন করা হয়নি। তাই এটি স্পষ্ট দুর্নীতি। তার মতে, ব্যাংককে এমনিতেই তারল্য সংকট চলছে, তার ওপর এমন ঘটনা ব্যাংকে লেনদেনকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে। এতে মানুষ ব্যাংক বিমুখ হওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি। তার মতে, অর্থ নিরাপত্তা খোঁজে। সেখানে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাধার প্রাচীর তৈরি হয়েছে। অনেকের মতে, অর্থমন্ত্রী ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনাকে তেমন কিছু ঘটনা নয় বলে উড়িয়ে দেয়ায় জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, তবে কি তিনি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন? ২ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করা হবে, আর বাকি টাকার কি হবে, তা কিন্তু তিনি বলেননি। তা হলে কি সেটা দুর্বৃত্তরা হজম করবে নেবে? এভাবে জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ হবে?      
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিলে এবং পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার নির্দেশ দিলেও তা ওই ব্যাংকের কাজ নয় বলে মন্ত্রী কেন হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, এখন আর সেটাও বোদ্ধাদের কাছে অজানা নয়। কেন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে কথা বলেছিলেন, সেটা তো আজ ষোলো আনা পরিষ্কার। হঠাৎ কেন তিনি মিডিয়ার সংস্কার দাবি করলেন, সেটা  বুঝতে কারো জজ-ব্যারিস্টার হতে হবে না। দুদক কেন সঙ্গে সঙ্গে হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের কাগজপত্র তৎক্ষণাৎ সিজ না করে অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে সেমিনারে মনোনিবেশ করেছে-সে এক প্রশ্ন বটে। অনেকের মতে, দুদক সময়ক্ষেপণ করে দুর্নীতিবাজদের কাগজপত্রের বৈধতা নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই কাগজগুলো সিজ করলে ঘটনাটি কিভাবে সংঘটিত হয়েছে, তা জানা যেত। এখন সুযোগ পেয়ে তারা আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র তৈরি করে নেবে। এতে বেঁচে যাবে রাঘব-বোয়ালরা। কাগজপত্র সঠিক না থাকলে কার কথা, কার ফোন এবং কার নির্দেশে এমনটা করতে হয়েছে- তা বেরিয়ে আসত। কাগজ ঠিক থাকলে সেখানে ইচ্ছা থাকলেও কারো কিছু করার নেই। সোনালী ব্যাংকের অডিট কেন এবং কার কারণে ঢিলে হয়েছে- খুঁজে বের করতে হবে তাও। কে বা কারা এ জন্য কলকাঠি নেড়েছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। হলমার্কের কর্ণধার বলেছেন, তিনি এর ২০ গুণ অর্থের মালিক। ভালো কথা। তিনি এ অর্থের মালিক হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে তা তিনি বৈধ না অবৈধ পথে কামিয়েছেন, তা দেখার আছে বটে। আর বৈধ হলে সেটায় তিনি ট্যাক্স দিয়েছেন কিনা, তা এনবিআরকে ক্ষতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
আশার কথা, দেশে আইন করে যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার বাবার ছবি টাঙ্গানোর নিয়ম করা হয়েছে, সেখানে হলমার্কের কর্ণধারের অফিসে তা না করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার ছবি টাঙ্গানোর মাজেজা দেশ ও জাতি জানতে চায়। একটা লোন পেতে তার সমপরিমাণ সম্পদ বা তারও বেশি সম্পদ ব্যাংককে গ্যারান্টি হিসেবে দিতে হয়। দেখা হয় ব্যাংক লেনদেনের ইতিবৃত্ত। ম্যানেজার, অফিসার, পরিচালক, পরিচালনা পর্ষদ-কার কত লোন দেয়ার এখতিয়ার, সে সীমাও বেঁধে দেয়া আছে। এটার বদৌলতে লোন পাওয়া যায়। হলমার্কের ক্ষেত্রে সেটা মানা হয়েছে কিনা, তা খোলাসা হয়নি আজও। সেখানে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে মানুষ বলাবলি করছে। করছে সন্দেহ। হলমার্কের লোকজনের বৈশাখী টিভির সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়া এবং পরে হাতে-পায়ে ধরার পর সেই সন্দেহ আরো বেড়েছে। হলমার্কের লোকজনের মিডিয়ার ওপর হামলে পড়া আর অর্থমন্ত্রীর সংস্কারের প্রস্তাবের মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল যাওয়া যায়। আর সেটা হলো, আসল রহস্য উ ঘাটনে বাধার প্রাচীর তৈরি করা। সাংবাদিকরা এমনটাই মনে করছেন। তারা আরো মনে করছেন, কাজটা করেছে ওপর তলার লোকজন। অথচ এ জন্য বলি দেয়া হচ্ছে বা হবে অসহায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে আসল চোরের দল। ঘটনার পেছনের চোররা ধরা না পড়লে এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এমন ঘটনা রোখা যাবে না। তবে সন্দেহ করা হয়, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এমন একজন সদস্যকে টিভিতে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। ঘটনার পর তার চেহারায় চোর চোর ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে মানুষ বলাবলি করছে। পাশাপাশি তার কথায় রহস্যের গন্ধ মিলছে। ঘটনা অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না'-এর মতো। যিনি কথায় কথায় দেশ ও জাতিকে নীতিবাক্য শোনান, তার আমলে এমন ঘটনা ঘটল, আর তিনি তা জানেন না- এটা কোনো বেকুফও বিশ্বাস করবে না। শুধু পরিচালনা পর্ষদ নয়, পুরো পারিষদকে এ জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সময়ের দাবি। এখানে কারো দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, অর্থমন্ত্রী, গবর্নর থেকে লোন পাস করা পরিষদবর্গ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে, এমন লোকজন লোনের জন্য নির্দেশ বা চাপ দিলে তা না দিয়ে পারে।
সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার এ জালিয়াতির ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক বুঝতে পেরেছিল গত এপ্রিলেই। ফলে রূপসী বাংলা শাখার ওপর তদন্ত করতে গত মে মাসে পরিদর্শক দল পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তদন্ত চলাকালে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রূপসী বাংলা শাখায় উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। তিনি তদন্ত দলের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। উপদেষ্টার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করার কথা বলে তিনি তাদের নিজের বিজনেস কার্ডটিও দেন। রূপসী বাংলা শাখায় গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন কার্যক্রম চালালেও সে সময় হলমার্ক জালিয়াতির ঘটনাটি রহস্যজনক কারণে প্রকাশ করা হয়নি। বলা যায়, হলমার্ক জালিয়াতির ঘটনাটি সে সময়ই উন্মোচিত হতে দেয়া হয়নি ওপর মহলের হস্তক্ষেপে। এই জালিয়াতি ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, এ জন্য ওই মহলটি শুধু সোনালী ব্যাংকেই হস্তক্ষেপ করেনি, বাংলাদেশ ব্যাংককেও প্রভাবিত করেছে। সোনালী ব্যাংক হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের প্রতিটি শাখা বছরে দুবার নিরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় নিরীক্ষা করা হয়নি! নিরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। নিয়মিত নিরীক্ষা করা হলে অনিয়ম বেরিয়ে আসত। আবার নিয়মানুযায়ী, কোনো কর্মকর্তার এক শাখায় তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয়। রূপসী বাংলা শাখার উপমহাব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমানকে পদোন্নতি দেয়ার পরও রূপসী বাংলা শাখায় রাখা হয়। প্রায় পাঁচ বছর তিনি একই শাখায় কর্মরত থাকেন। তাকে রেখে দেয়া হয় জালিয়াতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনরা।
সরকারের স্বার্থ রক্ষাকারী দুদককে মনে রাখতে হবে, অভয় দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য নিতে হবে। আর ধরতে হবে সেই চোরদের, যার প্রভাব খাটিয়ে এই অপকর্ম সংঘটিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ঘুণে ধরা এ সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমাতে হলে ধরতে হবে সমাজের ওপর তলার চোরদের। ছিঁচকে চোরদের ধরে লাভ নেই। বরং এদের ফাঁসিয়ে এরা পার পেয়ে যায়। আর এভাবে পার পেয়ে যায় বলেই সমাজে অপরাধ বাড়ছে বৈ কমছে না। অপরাধ কমাতে হলে একটু কষ্ট হলেও দায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে নির্মোহভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এমন ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা থাকবে না। দেশের মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ পাবে না দুর্বৃত্তরা। দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলে দুদককেই নিয়ামক শক্তি মনে করে দেশবাসী। এত কিছুর পরও মানুষ ভরসা করতে চায় যে, দুদক ঘুরে দাঁড়াবে। পরিচয় দেবে মেরুদন্ড সোজা আছে এখনো। নখর-দন্তসম্পন্ন বাঘ বলতে যা বোঝায়, তার পুরোটা নিয়ে দুদক কাজ করছে। দুদকের দায়িত্বশীলদের মাথায় রাখতে হবে, দুর্নীতি যে করে, তাকে পদ দিয়ে যতদিন বিচার করা হবে, দেশে ততদিন দুর্নীতি থাকবে। দুর্নীতিবাজ যত ক্ষমতাশালী হোক না কেন, তাকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দম্ভকে গুঁড়িয়ে দেয়া যাবে না- ততক্ষণ পর্যন্ত এ দেশ ও জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ উপহার দেয়া যাবে না। আর সেটা না পারলে যারা এ জায়গায় বসে আছেন, তারা জাতির অন্ন ধ্বংস ছাড়া আর কিছু করছেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।                                         

Wednesday, 12 September 2012

প্রধানমন্ত্রীর ঠাট্টা

 
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দেশকে নিয়ে এমনই খেলা খেলছেন যে, এখন কখনও কখনও মনে হয় তিনি বোধ করি অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলোপ করতে চান। যে দেশের জনগণ তার পিতার হত্যার বিচার করেনি বা চায়নি সেদেশের অস্তিত্বের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি যে কি করছেন এবং কি করছেন না সেটি এক বিশাল সমস্যার ব্যাপার। হীরক রাজার মতো যখন যা খুশি তাই করছেন এবং বলছেন। যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা তার হাতে, তার পুরোটা ব্যবহার করে তিনি বিরোধীদল ও জনগণের উপর চূড়ান্ত দমননীতি চালাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তার চোখের পাতা পড়ে না।
২০০১-২০০৬ সালে যখন তিনি বিরোধীদলে ছিলেন তখন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে তার প্রধান অভিযোগ ছিল ঐ সরকার মহাদুর্নীতিবাজ, ‘চোর, চোর, মহাচোর'। এখন নিজেই দুর্নীতির গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে যাচ্ছেন। তিনি সমস্ত লীগ-অনুলীগকে তো দুর্নীতির ওপেন জেনারেল লাইসেন্স (ওজিএল) দিয়ে দিয়েছেন। আর বাংলাদেশে যে এসব লীগের সংখ্যা কত তা বোধ করি কেউ হিসাব করে বের করতে পারবে না। ঘাট-শ্রমিক লীগ, রিকশা-শ্রমিক লীগ, আওয়ামী প্রাক্তন-সৈনিক লীগ এমন সব নামে রাস্তা-ঘাটে নানান চিকা ও ডিজিটাল ব্যানার দেখা যায়। আর অনুমোদিত লীগগুলোর তো কোনো কথাই নেই। তারা টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মাঝে-মধ্যেই বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। মহামান্য প্রধানমন্ত্রী নির্বিকার। হাতে যথেষ্ট টাকা পয়সা না থাকলে ওরাই বা চলবে কি করে? মিটিং-মিছিলই বা কেমন করে করবে?
যদিও এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণত টেলিকনফারেন্স করেন। যদিওবা কখনও ঘর থেকে বের হন তাহলে তার জন্য থাকে সীমাহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আজকাল ঘর থেকে কমই বাইরে বের হন তিনি নিরাপত্তার ভয়ে। এবং তিনি কেন যে তার নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী বাদ দিয়ে পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করেছেন সেটা বোধগম্য নয়। তবে কি সেনাবাহিনীকে তার বড় ভয়? প্রথমে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন কর্মকর্তা খুন হয়েছেন বিডিআর বিদ্রোহে। সেখানে আলোচনার নামে যা ঘটেছে তাকে কেউ অনুমোদন করে না। সেনাবাহিনীর অনেক অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা টেলিভিশনে আলোচনা করেছেন যে, যদি তাদের অভিযান চালানোর ক্ষমতা দেয়া হতো তাহলে এত অফিসারের প্রাণহানি হতো না। কিন্তু আলোচনা ও সাধারণ ক্ষমার নামে সময়ক্ষেপণের নামে সেনাবাহিনীর এত সংখ্যক অফিসার বিডিআর বিদ্রোহে প্রাণ দিতে হয়েছে।
বিডিআর বিদ্রোহ যে কী সেও এক ধূম্রজাল। বিদ্রোহের আগে তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাদের দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এইভাবে বিডিআর সদস্যরা তাদের অফিসারদের খুন করতে পারে-এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এবং এই প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হয়েছে যে, সত্যি কি বিডিআর সদস্যরাই এই সেনা কর্মকর্তাদের বেছে বেছে খুন করেছে? নাকি এর পেছনে অন্য কারো মদত ছিল? সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। আনিসুজ্জামানের তদন্ত রিপোর্ট সরকার গিলে ফেলেছে, প্রকাশ করেনি। আনিসুজ্জামান তদন্ত রিপোর্ট দিয়েই বিদেশে চলে গেছেন। আর ফিরেছেন কিনা সে রকম রিপোর্ট সংবাদপত্রে দেখি না। সেখানে অনেক প্রশ্নবোধক কথা ছিল। তার জবাব দেয়ারও প্রয়োজন সরকার অনুভব করেনি। ফলে বিডিআর বিদ্রোহ এখন পর্যন্ত প্রশ্নবোধকই রয়ে গেছে।
সেনাবাহিনী বলেছিলো, বিডিআর সদস্যরা যেভাবে প্রশিক্ষিত তাতে একজন বিডিআর জওয়ান তিনজন ভারতীয় বিএসএফ সদস্যকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে। ফলে সবসময়ই ভারতের বিডিআর-ভীতি ছিল। আর এ কারণেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশী প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যখন ভারত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তখন সেই চুক্তির একটি শর্ত ছিল যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকারকে বিডিআর বাহিনী বিলুপ্ত করে বর্ডার গার্ড বাহিনী করতে হবে। জানা যায় যে, ঐ চুক্তি স্বাক্ষরের পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পিতা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।
পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই চুক্তি তিনি মানেন না এবং মানবেনও না। শেখ হাসিনা তার পিতাকে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কী না করছেন! এখন চতুর্দিকে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান যে চুক্তি প্রত্যাখ্যাত করেছিলেন, সেই চুক্তি তিনি বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন। বিডিআর বিদ্রোহের দায়ে হাজার হাজার সদস্যকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। যাতে তারা আর কোনোদিন এই বাহিনীতে ফিরতে না পারে। নতুন মুখ চাই যারা সরকারের অনুগত ও ভক্ত। এরা শুধু পাহারাদার হিসেবে লাঠি নিয়ে সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর বিএসএফ থাকবে বন্দুক নিয়ে। ফলে এখন প্রতিদিন বিএসএফ একজন না একজন বাংলাদেশীকে খুন করছে। বিগত সাড়ে তিন বছরে সরকার একবারের জন্যও তার কোনো প্রতিবাদ করেনি। যে বাংলাদেশের মানুষ শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করেনি, তাদের যদি বিএসএফ গুলি করে থাকে, সরকারের বিবেচনায় সম্ভবত তারা ভাল কাজই করেছে। ‘জয় বাংলা' ধ্বনি দেবো। সব শেষ।
আসলে এই প্রসঙ্গে আমি আলোচনা করতে চাইনি। আমি আলোচনা করতে চেয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর ঠাট্টা বিষয়ে। আমাদের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কত কথাই না বলেছেন। চারদলীয় জোট সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখন সেই সরকারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অভিযোগ ছিল যে, এরা জনগণকে বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। অতএব এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। এরপর তিনি আরও বলেছিলেন যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলেই বাংলাদেশের সকল গ্যাসের উৎস শুকিয়ে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সব কূপ গ্যাসে ভরে যায়। এর অর্থ হলো এই যে, বিএনপি একটি অভিশপ্ত রাজনৈতিক দল। আপনারা তাদের ভোট দিয়েন না। কিন্তু শেখ হাসিনা খেয়াল করছেন না যে, তিনি কিভাবে ক্ষমতাসীন হলেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার অাঁতাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। কথাটা শেখ হাসিনার পছন্দ হয়নি। সেই কারণে তিনি এত বড় পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিলকে ‘যাও বাচ্চা, শো রাহো' বলে বিশ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
জলিল অবশ্য এখন দু'চার কথা বলেন। জনসমক্ষে বলেন, সংসদেও বলেন। আওয়ামী লীগের সেনাবাহিনীর সঙ্গে অাঁতাতের মাধ্যমে গঠিত সরকার সেটি পরোয়াও করে না। এই সরকার যে অাঁতাতের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল সেটা আমার বক্তব্য নয়, সেটা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের বক্তব্য। জলিলকে যেসব কারণে বিশ্রামে যেতে হয়েছে তার প্রধান কারণ সম্ভবত তার বক্তব্য।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যর্থ হলেও, দেশকে দুর্নীতিতে সয়লাব করে দিলেও শিক্ষা দিতে ভালই পারদর্শী। তিনি বলেছিলেন, বিএনপিকে তিনি শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন। শিক্ষা তিনি দিয়েছেনও বটে। বিএনপি'র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গাড়ি পোড়ানো কিংবা সচিবালয়ে বোমা মারার দায়ে অভিযুক্ত করে জেলও খাটিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায়ই শেখ মুজিবুর রহমান জাসদ নেতাদের জেলে পুরেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে টাঙ্গাঈলের কাগমারিতে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। কিন্তু এই শিক্ষা দেয়ার পরিণতি শেখ মুজিবের জন্য শেষ পর্যন্ত সুখকর হয়নি। জোট সরকারের দুর্নীতি, দুর্নীতি বলে শেখ হাসিনা ও তার চ্যালা-চামুন্ডারা সারা বিশ্ব সরব করে তুলেছিলেন। এখন তো মনে হয়, তার সে অপপ্রচারে বিশ্ববাসী খানিকটা বিভ্রান্তও হয়েছিল। কিন্তু এখন দাঁড়িয়েছে কী? এখন বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্র হিসেবে সারা পৃথিবীতে ঘৃণিত ও নিন্দিত হচ্ছে। এর সবই আবার সপ্রমাণ। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, কুইক রেন্টালে লুট, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, সুরঞ্জিতের বস্তাভর্তি টাকা এগুলো এখন আর বিশ্বের কারো কাছে অজানা নেই। হলমার্ক কেলেঙ্কারি তার দুর্নীতির সর্বশেষ উদাহরণ। এর কোনোটাই অসত্য নয়। সবই তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ঘরানার বলে এদের কেউ এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। অথচ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ তারা করেছে, তার একটিরও কোনো প্রমাণ নেই। শুধুই চাপা, বগি আওয়াজ।
এবার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, বুয়েট ছাত্রদের বিরুদ্ধে কিভাবে কঠোর হতে হয় তা দেখিয়ে দেবেন। পেটোয়া পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে তিনি ইতিমধ্যেই জনসাধারণ বিভিন্ন অংশকে শিক্ষা দিয়েছেন। বিদ্যুতের দাবিতে সাধারণ মানুষ যখন বিক্ষোভ করেছে তখন তাদের পুলিশ দিয়ে লাঠিপেটা করেছেন। আর বলেছেন এ ধরনের বিক্ষোভ করলে যেটুক বিদ্যুৎ দেয়া হয়, তাও বন্ধ করে দেয়া হবে। কী শাসন! বুয়েটের ছাত্ররা কেন নিজের শরীরের রক্ত ঢেলে ভিসি-প্রোভিসি'র অপসারণ চাইলেন? তখন তিনি তার গোপালী ভিসিকে রক্ষার জন্য ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর হবার ঘোষণা দিয়েছেন। আর ঐ রক্ত ঢেলে প্রতিবাদ জানানোকে বিকৃত মানসিকতা বলে অভিহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এই কথা উপলব্ধিই করতে পারছেন না যে, অবিরাম জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, জনগণকে শায়েস্তা করে তার শেষরক্ষা হবে না। কোনো দেশে কারোরই তা হয়নি।
বিদ্যুতের দাবিদারদের তিনি অবিরাম নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেই যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে লোডশেডিংও। বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে আর কোনো চিন্তা নেই। বিদ্যুতে সয়লাব হয়ে যাবে গোটা দেশ। কিন্তু তা তো হয়ইনি বরং সে উৎপাদন আরও কমেছে। তাও প্রধানত দুর্নীতির কারণে। কয়েকদিন আগে বলেছেন, লোডশেডিং হতেই থাকবে। তা না হলে লোডশেডিং কি জিনিস জনগণ ভুলেই যাবে। দুর্নীতির মহাযজ্ঞস্থল কুইক রেন্টাল। এর মাধ্যমে আওয়ামী চাঁমিরা ইতিমধ্যেই ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, এই হাতানোর সুযোগ আরও বহুদিন অব্যাহত থাকবে। আর এই কুইক রেন্টালের যারা সমালোচনা করবে, তাদের বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ সাতদিনের জন্য বন্ধ করে রাখার নির্দেশ দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের বিরুদ্ধে সরকারের এখন যুদ্ধ চলছে। ঠাট্টা-মশকারা আর জনগণকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা প্রধানমন্ত্রী যতটা সহজ ভেবেছেন, সম্ভবত সেই কাজটা অত সহজ নয়।
Hey, we've just launched a new custom color Blogger template. You'll like it - https://t.co/quGl87I2PZ
Join Our Newsletter