এটিএম শামসুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের শুরুর দিকে। তার এবং কমিশনের অন্য সদস্যদের নিয়োগে ক্ষমতার দাবিদার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না। এ কমিশন ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় বেশ কিছু সংস্কার সাধন করতে সক্ষম হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করতে পারা ছিল তাদের বড় সাফল্য। এরপর প্রায় তিন বছর কমিশন রাজনৈতিক দলীয় সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করে। সংবিধান অনুযায়ী কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংস্থা। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ সত্তা বজায় রাখা সহজ কাজ নয়। তবে বর্তমান কমিশন এ আমলেই জাতীয় সংসদের একাধিক আসনে উপনির্বাচন, দেশব্যাপী পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ কাজে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহায়তাও ছিল লক্ষণীয়। এখন কমিশন তার পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ প্রান্তে উপনীত এবং এ সময়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কিছু সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে আগ্রহী। কমিশনের সম্ভাব্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে : সংসদ নির্বাচনের প্রচার কাজে দলগুলোকে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ প্রদান, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার, সিইসি ও নির্বাচনী কমিশনার নিয়োগ আইন এবং নির্বাচনী আসনের সীমানা নির্ধারণে আইন ও বিধিমালার সংস্কার, নির্বাচনে জামানত ও ব্যয়সীমার অঙ্ক বাড়ানো প্রভৃতি। কমিশন তাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার জন্য রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। তবে তাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আলোচনায় অংশ নিলেও সংস্কারের বিষয়ে কোনো লিখিত পরামর্শ কিংবা প্রস্তাব রাখেনি এবং বিএনপি আলোচনাতেই অংশ নেয়নি। অথচ সংস্কারের জন্য আইন প্রণয়ন হবে জাতীয় সংসদে এবং এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি বর্তমান জাতীয় সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান বাতিল করায় পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান দুরূহ হবে এবং হলেও তার বিশ্বাসযোগ্য দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং এ ইস্যুতে তারা রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয়। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নেও তারা সরকারকে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দিতে রাজি নয়। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব জাতীয় সংসদে অনুমোদন নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তা অতিক্রমে রাজনৈতিক সমঝোতা অবশ্যই প্রধান শর্ত। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান। নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের প্রতিটি প্রস্তাব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কোনো কোনোটি হয়তো ভবিষ্যতের জন্যও তোলা রাখা থাকবে। কিন্তু জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ সৃষ্টির এ উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং তাতে সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ইতিবাচক সাড়া দিতেই হবে।
Thursday, 29 December 2011
Tuesday, 27 December 2011

শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত ইতিবাচক ফল মেলেনি
তারল্য সংকট দূর করে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার উদ্যোগে এখনও পর্যন্ত ইতিবাচক ফল মেলেনি। বাজারে পুঁজিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি। এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আতঙ্ক যেমন কাটছে না, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও এখনও পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগে ইতিবাচক মনোভাব নেয়নি। শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংকটের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পুঁজির জোগান বৃদ্ধির চেয়েও আস্থার সংকটকেই বেশি দায়ী করেছেন। গত সোমবার সিপিডি আয়োজিত এ সম্পর্কিত গোলটেবিল আলোচনায় আলোচকরা শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় সে জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও রেখেছেন। ব্যাংকার ও শেয়ারবাজার সম্পর্কিত তদন্ত কমিটির প্রধান ইব্রাহিম খালেদ শেয়ারবাজারে এহেন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাজারে আস্থার ভাব ফিরে আসছে না বলে মন্তব্য করেছেন। আমরাও তার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। অধিকন্তু তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম দোষীদের তালিকায় রয়েছে তাদের কাউকে কাউকে দিয়ে বাজারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টাটা অপরাধীকে পুরস্কৃত করার সমতুল্য। শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থাটাই পুঁজি সংগ্রহের এই আর্থিক ব্যবস্থার প্রধান শক্তি। যারা শেয়ারবাজার সংকটের জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কি বাজারকে স্থিতিশীল করা যায়! এর আগেও একবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছে। তখনও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরপর দুটি সরকার চলে গেলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পেরেছে। এবারও সে ধরনের অবস্থাই সৃষ্টি হচ্ছে বলে ধারণা করাটা অমূলক নয়। সরকার শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বাজারে আস্থার সংকট দূর করতে পারবে না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেউই সহসা বাজারে পূর্ণোদ্যমে ফিরবে না। এতে শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য পুঁজি সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে শেয়ারবাজার তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারবে না। শেয়ারবাজারের ওপর ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ যাতে বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে সত্যি সত্যিই বৃদ্ধি পায়, তা নিশ্চিত করাও দরকার। আর বাজারে অহরহ হস্তক্ষেপ করার অভ্যাস ছাড়তে হবে। বাজারকে তার নিজস্ব নিয়মে চলতে দিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করতে হবে।
Tuesday, 6 December 2011

মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ
মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে
দেশব্যাপী সন্ত্রাস নৈরাজ্য দুর্নীতি চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারি ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে মানুষ যখন দীর্ঘদিন ধরে যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থতার মানদন্ডে মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন ও রদবদলের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন তখন সরকার তার মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছেন। বলাবাহুল্য দীর্ঘদিন ধরেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিযোগ অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় এমন অনেক মন্ত্রী আছেন যাদের কৃতিত্বের মাত্রা যেমন শূন্যের কোঠায় আবার এমন মন্ত্রীও আছেন যারা তাদের পদ পদবীর অপব্যবহার করে অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় গড়ার অপদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেকে আবার অতি কথনের যেমন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, তেমনি এটাও দেখা গেছে যে এক মন্ত্রী যা বলছেন আরেক মন্ত্রীর বক্তব্যে তার ঠিক উল্টো কথাও বেরিয়ে আসছে। সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, সার্বিকভাবে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাদের অনেকেই এমন সব বিষয়ে বক্তব্য রাখেন যা তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত।
উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম যখন মন্ত্রিসভা গঠন করেন তখন এই সভায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অজ্ঞাত অখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই এতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিস্মিত হয়েছিলেন এবং এই নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহে অনেক কথা বার্তা হয়েছে। তখন ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে এই মর্মে সাফাই গাওয়া হয়েছিল যে, দলটি তরুণদের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব দিয়ে দলে পরিবর্তন ও গতিশীলতা আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এর সাথে সাথে পুরাতনদের মধ্যে অনিয়ম দুর্নীতির যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় অনভিজ্ঞ ও তরুণ মন্ত্রীরা তা থেকে মুক্ত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা গঠনের পাশাপাশি একটি উপদেষ্টা সভাও গঠন করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই যে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল যে মন্ত্রিসভার কিছু তরুণ সদস্যের পাশাপাশি প্রবীণ উপদেষ্টাদের যোগ্যতা ও ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আবার এই প্রশ্নটিও প্রকট হয়ে দেখা দেয় যে, মন্ত্রীরা নয় উপদেষ্টারাই দেশ চালাচ্ছেন যাদের দেশ ও দেশবাসীর সমস্যা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান নেই, এমনকি উপদেষ্টাদের কোন কোন সদস্য বিদেশী স্বার্থের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করার অভিযোগ উঠে। ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন এমপি পার্লামেন্টে এই অভিযোগও তুলেছেন যে, মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছে। এই নিয়ে সংশ্লিষ্ট এমপির মানসিক ভারসাম্যহীনতার প্রশ্ন তুলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হলেও গত প্রায় তিন বছরে এই মন্ত্রিসভার কার্যাবলী দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিছু কিছু মন্ত্রীর দুর্নীতি ও অপকীর্তি দেশ বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ তথা ভাব-মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ উঠেছে। একজন মন্ত্রীর দুর্নীতির দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবির মত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। ঐ মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সুশীল সমাজের তরফ থেকে ঈদের দিনে ঈদ অনুষ্ঠান বর্জন করে শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘটও পালন করা হয়েছে। দেশের মহাসড়কসমূহের দূরবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের ন্যায় ঐ সরকারের আমলে বাসমালিকরা ধর্মঘট পালন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এমপিরাই পার্লামেন্টেও সরকারের সমালোচনা করেছেন কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। বরং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতারা দলীয় মন্ত্রীদের দুর্নীতির সমালোচনা করে শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। দেশের মানুষ এতে হতবাক হয়েছে। তারা আরো হতবাক হচ্ছে এজন্য যে, মন্ত্রিসভা এমনসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যার সাথে বাস্তব অর্থে জনগণের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। অনেকে এও বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেয়ার মত ব্যক্তি বা মন্ত্রী কেবিনেটে নেই অথবা থাকলেও তাদের সাহস নেই। ফলে সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদা ভুলে গিয়ে এমন সব কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছেন যাতে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের বুকে এই সরকারই শেষ সরকার এবং তাদের পর আর কোন সরকার আসবে না। রাজনৈতিক দলন-নিপীড়ন, একনায়কসূলভ আচরণ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিদ্বনদ্বী দলসমূহকে নিশ্চিহ্নকরণের প্রবণতা এবং দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিবেশীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া প্রভৃতি এরই অংশ। আমরা এর নিন্দা জানাই।
মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে সরকার বাবু সুরঞ্জিত দাসগুপ্ত এবং ওবায়দুল কাদেরকে কেবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ডা. হাসান মাহমুদকে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ণ মন্ত্রী করেছেন। আমরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পর্যবেক্ষণযোগ্য বলে মনে করি। নতুন যে দু'জনকে মন্ত্রী করা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে এই দু'জন সরকারের মন্ত্রীদের কিছু কিছু কাজের সমালোচনা করতেন। তাদের মন্ত্রী করার ফলে তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় কিনা তা দেখার বিষয়। সরকারের অভ্যন্তরে থেকে সরকারের অথবা তা কোন অর্গানের সমালোচনা করা কৃতিত্বের বিষয় নয়। বরং যারা সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সহায়তা করেন এবং নিজ নিজ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সেবা তৎপরতাকে শক্তিশালী ও শানিত করে দেশের মানুষের উপকার করতে পারেন তারাই স্বার্থক বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে তাতে সরকার দৈনিক প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ধার করে দেশ পরিচালনায় বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থায় মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে ব্যয়ের পরিসর আরও বৃদ্ধি করার মধ্যে আমরা কোন দূরদর্শীতা দেখতে পাই না। বরং সরকারের উচিত ছিল অথর্ব ও অযোগ্য এবং দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে অভিজ্ঞ, নিষ্ঠাবান এবং সৎ ব্যক্তিদের তাতে অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু তা হয়নি। এই অবস্থায় সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত কি পরিণাম বয়ে আনে তা দেখার জন্যই আমরা অপেক্ষা করতে চাই।
Sunday, 4 December 2011

সমাজতন্ত্র বিদায়ের কুড়ি বছর পরে
সমাজতন্ত্র বিদায়ের কুড়ি বছর পরে
ইতিহাস বলছে কোনও সাম্রাজ্য বা শাসন চিরস্থায়ী হয় না। আর শাসনটি যদি হয় শোষণ ও অত্যাচারে ভরপুর, তাহলে বিদায় বা পতন হয় অতি দ্রুত এবং সেই পতনটি নেমে আসে অতি লজ্জায়, অপমানে, রক্তাক্ত বিয়োগান্ত পরিণতিতে। বিশ্ব বরেণ্য ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন ইতিহাসে কোনও শাসন বা সাম্রাজ্যের গড়পড়তা আয়ু হিসাব করেছিলেন একশত কুড়ি বছর। এই হিসাবটি যান্ত্রিক মনে হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে যে সত্যটি পরিস্ফুট তা হলো, যে কোনও সাম্রাজ্যের কোনও-না-কোনও সময়ে মৃত্যু ও পতন অনিবার্য। বহুবিধ অত্যাচার ও পীড়নের মাধ্যমে কোনও কোনও পতন অগ্রিম চলে আসে; রক্তের বন্যায় ভেসে যায়; জনগণের ঘৃণায় ও প্রতিবাদে জীবন্তসমাধিপ্রাপ্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে, দক্ষিণ এশিয়ায়, বাংলাদেশে উত্থান-পতনের বহু ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাসের অংশ বিশেষ। প্রবল স্বৈরাচারী দম্ভ, একদলীয় বর্বরতা, অতিজনপ্রিয়তা থেকে জনধিক্কার ইত্যাদি রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিদায়, পতন ও অপমানের স্মারক হয়ে কলঙ্কের হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইবনে খালদুন বর্ণিত একশত কুড়ি বছরের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সৌভাগ্যও তখন সেইসব স্বৈরশাসনের হয় না; হয় বেদনাদায়ক ও অপমানের-লাঞ্ছনার পতন। ইতিহাসের সেইসব নির্মম পতনকে স্মরণ করে জনতা তাদের আশপাশে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠার দিবাস্বপ্নে-বিভোর নব্য স্বৈরাচারী-একদলীয়-তা-বতার অপমানকর বিদায় আর আসন্ন পতনেরই অপেক্ষা করতে থাকে।
চলতি ২০১১ সাল ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে সমাজতন্ত্র-পতনের কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ১৯৯১ সালের ৭ আগস্ট ছিল সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের দিন। কতগুলো সম্প্রসারণবাদী অলীক স্বপ্নে কার্ল মার্ক্সের মানসপুত্র ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব করলেন; রাশিয়ার আশপাশের মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহসহ অন্যান্য দেশগুলো দখল করে তৈরি করলেন কল্পিত স্বর্গ: সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারপর সেই স্বর্গকে লৌহ প্রাচীরে আড়াল করে জোসেফ স্টালিন অত্যাচার, নিপীড়ন, হত্যা, নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের রামরাজ্য বানালেন সোভিয়েত দেশকে এবং আরও দখলদারিত্ব চালাতে লাগলেন বিশ্বের দেশে দেশে। পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়ার তথাকথিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতার নামে সামাজিক-সম্প্রসারণবাদেও দানব-ট্র্যাঙ্কে চেপে আগ্রাসন চলে আসে উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চীনে। আগ্রাসী রক্তস্রোত গিয়ে পৌঁছেছিল সুদূর দক্ষিণ আমেরিকাতেও। হুগো শাভেজের ভেনেজুয়েলা বা নেপালের পুকমলদাহাল বা প্রচন্ডের মতোই কিউবাতেও সমাজতন্ত্র বৃদ্ধ-বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর অনুকরণে এখন মৃত্যুশয্যায়। ভিয়েতনামে টিমটিম করে জ্বলছে নিভু নিভু সমাজতান্ত্রিক বাতি। চীনে এক ধরনের ‘সিউডো কমিউনিস্ট' কাঠামোর মধ্যে এবং উত্তর কোরিয়ায় রাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শুধু কয়েকটি অক্ষরের সমাবেশে নামমাত্র নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে অন্তঃসারশূন্য-সমাজতন্ত্র। এমন কি, পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুদৃঢ় ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের পতন দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বেঁচে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনাটিকেও এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়ে গেল বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনের কুড়ি বছর পূর্তির সময়ে।
এ যেন তাসের ঘরের মতো পতন, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে একে একে সবগুলো লাল দূর্গের ধ্বংস-এর মূল কারণ কি? আসলে মানুষ সমাজতন্ত্রের ফাঁকা বুলির মধ্যে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম-সাম্যবাদ ইত্যাদিতে অতি নাটকীয় রোমান্টিকতা আছে; আছে শিহরণ ও উত্তেজনা এবং এহেন স্বৈরতন্ত্রী-একদলীয় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের স্বাধীন মত ও বিশ্বাসের চর্চা ও প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এমন কি, সমাজতন্ত্রে কথিত প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার তত্ত্বের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিক, আদর্শিক, ধর্মীয়, মানবিক, আত্মিক স্বভাবের এক ধরনের তীব্র-বিরোধ আছে। যে পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, বিলাসী, অপচয়ী, অমানবিক ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের কথা বলা হলো, সেই সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই অসৎ নেতৃত্বের হাতে পড়ে সুবিধাবাদে রূপান্তরিত হয়। (বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রীরা কি হয়েছেন সেটা আরও চমকপ্রদ গবেষণার বিষয়!) মানুষ তখন বাধ্য হয়েই পুঁজিবাদের মতো সমাজতন্ত্র থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সমাজতন্ত্রের খোলসে সুবিধাবাদের খেলা মানুষ শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চায়নি বলেই সারা পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের এই পতন ও পলায়নী পরিণতি। সর্বশেষ বিয়োগান্ত ও লজ্জাজনক পতনচিহ্নিত বিদায়টি ঘটলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, গত ১৩ মে, ২০১১ সালে।
সমাজতন্ত্রের করুণ পতনে বা গণধিক্কারে সারা পৃথিবী লজ্জা পেলেও সোভিয়েত ইউনিয়নে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা বিন্দুমাত্র লজ্জিত বোধ করবার প্রয়োজনই মনে করলো না। পতনকালী সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ বেহায়ার মতো বলছিলেন, ‘এর নাম পতন নয়, এর নাম গ্লাসনস্ট, পেরেস্ত্রোইকা।' বাংলাদেশে গর্বাচেভপন্থী পেরেস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্টিরা কমিউনিস্ট পার্টির অফিস ও সম্পদ ভাগ করে নিল। এই চক্রের যে তিন পালা, যাদেরকে সাধারণভাবে ডাকা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ‘কুচক্রী তিন ম' নামে, তারা সেই বাটোয়ারায় জেহাদি উত্তেজনায় অংশ নিয়েছিল। সর্বপ্রথম আলো জ্বেলে গর্বাচেভকে ‘সাধু-সাধু' ধ্বনি দিয়েছিল তারই। তারা সব সময়ই লাভ ও লোভের ক্ষেত্রে প্রথম হতে ভালোবাসে। গর্বাচেভিয় প্রথম আলোটি প্রথম ছড়ানোর মতোই তারা প্রথম সুযোগেই লাফ দিয়ে পশ্চিমা গোষ্ঠী, পুঁজিবাদ ও মাল্টিন্যাশনালের কোলে গিয়ে ওঠলো। তারপরের কাহিনী সকলেরই জানা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতা-কার্টুন আঁকা (নাউযুবিল্লাহ) থেকে শুরু করে ১/১১-এর যাবতীয় দেশ-জাতিবিরোধী শাঠ্য-ষড়যন্ত্রেও তারা প্রথম বা অগ্রগামী হয়ে রইলো এখন পর্যন্ত। হালে তাদের প্রতিদ্বনদ্বী এক মিডিয়া গ্রুপ অস্ত্র-জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের সঙ্গেও এই চক্রের নানা সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রচার করছে। চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ‘কুচক্রী গ্রুপ'-এর যেমন সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, বাংলাদেশেও জাতি-ধর্ম-শিষ্টাচার বিরোধী সমাজতন্ত্রে আলখাল্লাধারী এই কুচক্রীদের সাম্প্রতিক সময়ে খুবই তৎপর দেখা যাচ্ছে। (এদের নিয়ে বিশদে লিখার সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে, এখানে আজকের মূল বিষয়কে ব্যাখ্যা করার স্বার্থে সেদিকে আলোকপাত করা হচ্ছে না। ভবিষ্যতে আলাদাভাবে দেশ ও জাতিবিরোধী কুচক্রী গোষ্ঠীর চরিত্র ও কর্ম চিত্রণ করা হবে।)
সোভিয়েতের পতিত-সমাজতন্ত্রীদের মতোই সদ্য-পতিত পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজতন্ত্রীরা আরও এক ধাপ বেশি বেহায়াপনা করলো। পতনের সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু নির্লজ্জের মতো বললেন: ‘কেউ হারলে যেমন তাকে সমবেদনা জানানোর কিছু নেই, তেমনই জিতলে তাকে নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করারও কিছু নেই!' তার মানে কি ? পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের এতো কা- কিংবা সোভিয়েতে ১৯১৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের কোনও দায়-দায়িত্বই নেই? সব খালাস? এরচেয়ে বড়ো দম্ভোক্তি ও অগণতান্ত্রিক হুঙ্কার আর হতে পারে না। যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জুজু দেখিয়ে সমাজতান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িকতা প্রতিটি নির্বাচনে ‘সংখ্যালঘু কার্ড' ব্যবহার করেছে; মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে রেখে ভোট দিতে বাধ্য করেছে, সেটার কি হবে? সমাজতান্ত্রিক ধর্মহীনতায় মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দিয়ে বিগত ৩৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গের সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্রের কোনও লাভ-ক্ষতি করুক বা না করুক, মুসলমানদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। হিন্দু-মুসলিম বিবাহ, মুসলিম ধর্ম-সংস্কৃতি-মূল্যবোধকে ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ করার কাজটি তারা এতই যোগ্যতার সঙ্গে করেছে যে, ইসলাম এখন পশ্চিমবঙ্গে এক অতি কোনঠাসা, অতি প্রান্তিক, অতি কোণঠাসা ধর্ম। মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ওয়াকফ ইত্যাদি ব্যবস্থাকেও তছনছ করে দিয়েছে সমাজতন্ত্রীরা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মহাস্লোগান দিয়ে পুঁজিবাদের একটি লোমও ছিড়তে পারেনি তার। অথচ মুসলমানদের চরম ক্ষতিসাধন করেছে এই সমাজতন্ত্রীরা। (পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের তাবেদার বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রী নামধারীরা পুঁজিবাদের কিছু করতে না পারলেও এদেশে ঠিকই ইসলামের বিরুদ্ধে বন্য মোষের মতো তেড়ে আসতে পারে!) একদা অবিভক্ত বঙ্গে যে মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার পশ্চিমবঙ্গ অংশে এখনও রয়ে গেছে মুসলিম ঐতিহ্য, শিক্ষা, শাসনের অনেক স্মৃতি ও প্রত্ন নিদর্শন; সেই পশ্চিমবঙ্গে সমাজতন্ত্রীরা মুসলমানদের পিষতে পিষতে তলানিতে নিয়ে গেছে। কমিউনিস্ট শাসনের ফলে বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে এমনই যে, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান মানেই দরিদ্র, পশ্চাৎপদ, অবহেলিত, বঞ্চিত, অনাদৃত এবং ধর্মীয় আচার-আচরণে শ্লথ। যদিও বামবাবুরা ধুতি-পাঞ্জাবী চাপিয়ে দিব্যি হিন্দু ধর্ম-কর্ম করছেন। কিন্তু মুসলমানদের বলছেন, ধর্ম মেনো না, ধর্ম পালন করলে সাম্প্রদায়িক (?) হয়ে যাবে!! (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী সুবিধাপ্রাপ্ত একজন সমাজতন্ত্রী অধ্যাপক সর্বদা পূজা কমিটির সভাপতি হয়ে বিশিষ্ট হিন্দু ভদ্রলোকের ধর্মনিষ্ঠ চরিত্র বজায় রেখেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল নামে পরিচিত করেন! তাদের ধর্মপালন প্রগতিশীলতা ও সেকুলারিজমকে ক্ষুণ্ণ করে না। ইসলাম ধর্ম প্রতিপালিত হলেই মুসলমান ব্যক্তিটি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী হয়ে যায়! সেলুকাস আবার এসে দেখে যান, আসলেই কি বিচিত্র এই দেশ!)
সমাজতন্ত্রে ইসলাম ধর্ম কেবল পশ্চিমবঙ্গেই আক্রান্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়নি। বিশ্বব্যাপী পুরো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই হয়েছে। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হন। তাদের আত্মপরিচয় মিটিয়ে দেয়া হয়। এমন কি, তাদের নাম বদলিয়ে রাখা হয় করিমভ, রহিমভ ইত্যাদি। যে মধ্য এশিয়ায় ইমাম বোখারী, নকশবন্দিসহ শত-সহস্র অলিআল্লাহ-বুজুর্গের জন্ম হয়েছিল, সেই সমরকন্দ, বোখরা, তাসখন্দ, ফারগানা তথা উজবেকিদস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কিস্তান, আজারবাইজানের মসজিদগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। পবিত্র কোরআন, হাদিস চর্চা করা হয় নিষিদ্ধ। প্রকাশ্যে আযান দিয়ে নামাজ আদায়কে বন্ধ করে দেয়া হয়। ইসলাম ধর্ম পালনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট-সমাজতন্ত্রীদের মতো এতো বিরাট প্রতিবন্ধতা আর কেউই সৃষ্টি করতে পারেনি। জাগরণের জন্য ইসলাম তীব্র গণআন্দোলনে বার বার ফুঁসে ওঠলেও সাবেক সোভিয়েত স্বৈরশাসন রক্ত ও মৃত্যুর নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনকে। চেচনিয়া যার জ্বলন্ত উদাহরণ।
গত শতাব্দীর ইতিহাস তথাকথিত পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের নামে একটি সাজানো লড়াইয়ের নাটক দেখলেও প্রকৃত পক্ষে সেই ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানগণ। পশ্চিমা সভ্যতার তাত্ত্বিকগণ সুকৌশলে জন্ম দিয়েছে তাদের দুইটি অবৈধ-জারজ সন্তান--- একটি পুঁজিবাদ, আর অন্যটি সমাজতন্ত্র। উদ্দেশ্য, সারা বিশ্বকে, বিশেষ করে মুসলিম জগতকে এমন ফাঁদে ফেলে দেয়া, যাতে তারা হয় পুঁজিবাদ, নয় সমাজতন্ত্রের দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়; স্বাধীনভাবে ইসলাম চর্চা করতে না পারে।
যখন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে পশ্চিমা খ্রিস্ট-ইহুদি জগৎ পুরো পৃথিবীকে অধীনস্ত করে রাখতে পারছিল না, সর্বত্র স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠছিল, তখন পুঁজিবাদের নকল-প্রতিপক্ষরূপে ইসলাম-ঠেকানোর লক্ষ্যে মাঠে ছেড়ে দেয়া হয় ইহুদি কালমার্ক্সের গর্ভজাত সমাজতন্ত্রকে। অর্থডক্স রুশিয় খ্রিস্টান লেনিন এবং স্টালিন সেই সমাজতন্ত্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে আরও সূচারু ও কার্যকর হাতিয়াররূপে নির্মমভাবে ব্যবহার করে। ইসলাম হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আরব থেকে এশিয়ায়, সমগ্র মুসলিম জাহানে পুনরুত্থানের প্রাণাবেগ বেজে ওঠতে থাকলে সমাজতন্ত্রের নানা প্রলোভনের মিথ্যার জালে আটকে দেয়া হয় মুক্তিকামী মুসলিম গণমানুষকে। মুসলমানদের দেশে দেশে একদিকে পুঁজিবাদীরা ইসলামকে দমনের এজেন্ডা দিয়ে যেমনভাবে ইরানের শাহ, মিসরের আনোয়ার সাদাত, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, পাকিস্তানের আয়ুব খানের মতো পদলেহী তাবেদারদের বসিয়ে দেয়; অন্যদিকে তেমনিভাবে সমাজতন্ত্রীরাও বসিয়ে দেয় আলবেনিয়ায় আনভার হোসকা (আসলে আনোয়ার হোজ্জা, কিন্তু কমিউনিস্ট হয়ে ইসলামিক আনোয়ার হোজ্জা বদলে রাখেন সেক্যুলার আনভার হোসকা), আফগানিস্তানে নূর মোহাম্মদ তারাকি কিংবা বারবাক কারমালকে। ধূর্ত পশ্চিমা জগৎ এভাবে একহাতে পুঁজিবাদকে আর অন্য হাতে সমাজতন্ত্রকে ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ফলে সমাজতন্ত্র পতনের কুড়ি বছর পূর্তিতে এবং কুড়ি বছরের মাথায় পাশের পশ্চিমবঙ্গেও সমাজতন্ত্রীদের বিদায়ের ঐতিহাসিক ঘটনা ‘চুপ থাকা বা উল্লসিত হওয়ার' বদলে মুসলিম ব্যক্তি ও সমাজকে প্রবল আত্মসমালোচনা এবং কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রেরণা দিচ্ছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই কালো ইতিহাস, যা অতীতে সমাজতন্ত্রের ভ্লাদিমীর ছদ্মাবরণে এবং বর্তমানে পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের নিধন করতে উদ্যত। আফ্রিকা, এশিয়া, আরব কিংবা যেখানেই ইসলামের বিজয় ও উত্থানের সামান্যতম সুযোগ আর সম্ভাবনাও সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানেই পশ্চিমা বিশ্বের সদস্যভুক্ত দেশসমূহ--- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, ইতালি এবং তাদের গোপন-অবৈধ সন্তান ইসরায়েল এসে তীব্র বেগে হাজির হচ্ছে ইসলামি অভ্যুত্থানকে ঠেকাতে। অস্ত্রের জোরে, প্রচারণার কৌশলে, রাজনীতির মারপ্যাঁচে, অর্থাৎ যেভাবে সম্ভব সেভাবেই দমানো ও ঠেকানো হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের।
বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের পতনের পর পুঁজিবাদী শোষণ-নিপীড়ণকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের মুক্তি ও প্রকৃত স্বাধীনতা আনয়নের একমাত্র বিশ্বব্যাপী শক্তিরূপে ইসলামকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। আর তখনই নতুন করে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ নামক আরোপিত লেবেল দিয়ে দেয়া হয়েছে ইসলাম, ইসলামি আন্দোলন ও মুসলমানদের ওপরে। অতএব সমাজতন্ত্রের বিদায় বা পতনের কুড়ি বছরের প্রাক্কালে প্রতিটি মুসলমানের উচিত আত্মউপলব্ধির আলোয় নিজের কর্ম ও ভবিষ্যতকে নির্মাণ করা। ইসলামের সুমহান আহবানের সঙ্গে আত্মিক ও মানসিক একাত্মতার মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তির আর্দশিক জিঞ্জির ছিন্ন করা। পৃথিবীর মানুষের সামনে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রকৃত রাজতোরণ-ইসলামকে অনুসরণের মাধ্যমে আদিঅন্তহীন মুক্তির মিছিলে এসে সমবেত হওয়া।
মনে রাখা দরকার যে, ইসলামী পুনর্জাগরণ বা ইসলামী গণসচেতনতা কোনও মধ্যযুগীয় ঘটনা নয়। এটি পুরোপুরি সমকালীন বাস্তবতা। আধুনিক পরিস্থিতির ব্যর্থতাজাত সঙ্কটসমূহ এবং সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ-সৃষ্ট সমস্যাসমূহ মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক বিকল্পরূপে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ইসলামী আদর্শ বিশ্ব মানবতার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের চরম ব্যর্থতার পর সাম্প্রতিক সময়ে অর্ধ-ব্যর্থ সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী চক্রের কবল থেকে বিশ্ব ও মানব সমাজকে রক্ষার জন্য প্রায়োগিকভাবে সবচেয়ে সফল, শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ মতাদর্শ হিসাবে ইসলামে উত্থান একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। বস্তুতপক্ষে, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ ইত্যাদি সকল ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার মতাদর্শ বা ইডিয়লজির মতাদর্শিক ও প্রায়োগিক দুর্বলতা-ব্যর্থতা-অসারতা প্রকাশ পাবার পর সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সামনে শ্বাশত সৌন্দর্য ও স্বক্ষমতায় কেবলমাত্র ইসলামই একটি প্রেরণা সৃষ্টিকারী পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শরূপে প্রতিভাত হয়েছে। এটি অবশ্যই একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই সঙ্গে জীবন বিশ্বাসও। এই বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে ইতিহাসচেতনা, বিজ্ঞানবোধ, সাম্যের ভিত্তি, মানবিকতার জয়গান এবং মুক্ত মন; রয়েছে বৈজ্ঞানিক যুক্তি। ইসলাম কেবল স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণকর স্বপ্নের কথা ইসলাম বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করেছে মানুষের পৃথিবীতে, চোখে দেখা বাস্তবতার ও কর্মের মাটিতে। ইসলামের বাস্তব ভিত্তি, বৈজ্ঞানিক যুক্তি, সাম্য, মৈত্রী এবং কল্যাণধারার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পতিত সমাজতন্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত পৃথিবী ও পৃথিবীর মানবমন্ডলী; তাকিয়ে রয়েছে বর্তমানে ফণা-উদ্যত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদের নিত্য ছোবলে রক্তাক্ত-জর্জরিত আজকের পৃথিবী ও পৃথিবীর মানববংশ। ইতিহাসের এই প্রত্যাশাকে সত্যে প্রতিপন্ন করে আজ এবং আগামীর প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির বরাভয় নিয়ে ইসলাম আসবেই। প্রকৃতি, পৃথিবী ও মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য ইসলামকে আসতেই হবে।
Saturday, 3 December 2011

সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না
সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই চরমপন্থীদের আশ্রয়স্থল, ঘাঁটি ও অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। কখনো কখনো তাদের দৌরাত্ম্য বাড়ে, কখনো কখনো কিছুটা কমে। তবে কখনোই অপতৎপরতা নিঃশেষ হয়ে যায় না। অন্তত ১২টি চরমপন্থী সংগঠন এ অঞ্চলে তৎপর রয়েছে। রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে কমিউনিজম বা মাওবাদ পরিত্যক্ত হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকায় কমিউনিজম বা মাওবাদের নামে এসব সংগঠন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। এদের ভয় ও অত্যাচারে কখনো কখনো মানুষ দিশেহারা ও অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
আইন-শৃক্মখলা বাহিনী যখন তৎপর হয়, অভিযান চালায়, তখন তাদের অনেকে আত্মগোপন করে, অনেকে দেশের অন্যত্র কিংবা সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যায়। আইনশৃক্মখলা বাহিনীর তৎপরতা ও অভিযান স্তিমিত হয়ে গেলে আবার তারা ফিরে আসে। এভাবে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে বছরের পর বছর ধরে।
গত ছয় বছর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গণপিটুনি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রায় পাঁচশ' চরমপন্থী ও গ্রুপ লিডার নিহত হলেও পরিস্থিতির তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। অস্ত্র স্থানান্তরিত হয়েছে। নতুন গ্রুপ লিডার ও ক্যাডারের জন্ম হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষ নিহত গ্রুপ লিডারদের স্ত্রীরা সামনে চলে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, চরমপন্থীরা রাজনৈতিক শেল্টারও পাচ্ছে।
অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি চরমপন্থী সংগঠনগুলো ‘ক্যাডার' সংগ্রহেও তৎপর হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে তারা বেকার যুবক এবং বিশেষত মহিলাদেরই প্রাধান্য দিচ্ছে। এপারের চরমপন্থীদের সাথে ওপারের মাওবাদীদের একটা সম্পর্ক বরাবরই রয়েছে। তারা পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।
বিপদাপদে তারা একে অপরকে আশ্রয় ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। নীতি-পদ্ধতির অনুসরণ ও পরস্পরের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ওপারের মাওবাদীরা তাদের তৎপরতায় মহিলা ক্যাডারদের অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করছে। এপারের চরমপন্থীরাও তাদের অনুসরণে মহিলা ক্যাডার সংগ্রহ ও ব্যবহারে প্রাধান্য দিচ্ছে। মেহেরপুরের রিক্তার ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর বিষয়টি প্রথমে নজরে এলেও পরে কুষ্টিয়ার অাঁখি, রানী, চুমকি, চম্পা, নাসরিন, কনা, পাবনার মোর্শেদা, যশোরের হাফিজা, মেহেরপুরের জ্যোৎস্না প্রমুখ মহিলা ক্যাডার আটক হওয়ার ঘটনায় প্রমাণিত হয়, চরমপন্থী গ্রুপগুলোর মধ্যে মহিলা ক্যাডারের সংখ্যা এখন দেড় শতাধিক, দিনে দিনে এই সংখ্যা বাড়ছে।
চরমপন্থীদের সঙ্গে ওপারের মাওবাদীদের সম্পর্ক আছে, নৌদস্যু ও বনদস্যুদের সঙ্গে মিতালী আছে, আছে তাদের অস্ত্রের নির্ভরযোগ্য উৎস। এই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়। এমতাবস্থায় চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্য ও হুমকি থেকে এ অঞ্চলকে মুক্ত করা যে অত্যন্ত কঠিন, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এবং নেপালে মাওবাদীদের হত্যা, সন্ত্রাস ও নাশকতামূলক তৎপরতার কথা কারো অজানা নেই। আমাদের দেশের জন্য বিশেষভাবে বিচলিত হওয়ার বিষয় এই যে, ওপারের মাওবাদীদের সঙ্গে এপারের চরমপন্থীদের সম্পর্ক ও সহযোগিতা ক্রমাগত বাড়ছে।
র্যাব-পুলিশের অভিযানের মধ্য দিয়েও বেশ কিছুদিন স্তিমিত থাকার পর বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের আন্ডার ওয়ার্ল্ড আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে চরমপন্থীরা হত্যা করে বিগত দিনের ন্যায় হত্যার দায় স্বীকার করে লিফলেট বিতরণ করেছে। চরমপন্থীদের নামে মোবাইল ফোনে চাঁদাবাজি চলছে অহরহ। চাঁদা না দিলে শিল্পপতিদের বাড়িতে বোমা হামলা হচ্ছে। জীবন ভয়ে চরমপন্থীদের তাই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ লাখ লাখ টাকা প্রতিনিয়ত চাঁদা দিচ্ছে। এত কিছুর পর র্যাব-পুলিশ-গোয়েন্দারা যেন সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। সন্ত্রাসের ভয়ঙ্কর জনপদ হিসেবে খ্যাত খুরনার নাম কোনভাবেই মোছা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থীরা ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, নতুন করে অস্ত্র সংগ্রহ ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করছে তারা। অস্ত্রের উৎস ভারত। এপার ও ওপারের মধ্যে চোরাচালানিদের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। অস্ত্র যে ব্যাপক হারে ভারত থেকে আসছে, তার প্রমাণ গত দেড় বছরে সহস্রাধিক অস্ত্র উদ্ধার। গত এপ্রিলে যশোরের চাচড়া থেকে পিস্তল ও গুলী উদ্ধার করা হয়। ক'দিন আগে যশোর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ভারতীয় পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এভাবে প্রায়ই ভারতীয় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে।
চলতি বছরের ৬ মাসে শুধু খুলনায় শতাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে প্রায় ৩০টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সব মিলিয়ে চরমপন্থীরা এখন বেপরোয়া। বর্তমান সরকারের আমলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে কোনো বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়নি। এসব হত্যাকান্ডের সাথে কিশোর সন্ত্রাসীরা বিশেষভাবে জড়িত বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।
টপটেরর বা ‘দাদা'রা অনেকেই ক্রসফায়ারে খতম বা অব্যাহত অভিযানে দেশছাড়া। চরমপন্থী অস্ত্রবাজ ও খুনিদের একটি অংশ এখন জেলের ঘানি টানছে। তবুও হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, সন্ত্রাসবাদ থামেনি। কারণ, আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ এখন কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে। ডনদের কাছাকাছি থেকে এরা দেখেছে হত্যাযজ্ঞ ও সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়ার সব অভিনব কলাকৌশল। অস্ত্র হাতেই এরা কথিত নিষিদ্ধ পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রেণী শত্রু খতমের নামে পাখির মতো গুলী করে হত্যা করেছে রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ও সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষকে। দিন দুপুরে জীবনবাজি রেখে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে এনে তুলে দিয়েছে ডনদের হাতে।
আজ তাদেরই সময়ের প্রয়োজনে দলের কান্ডারি হিসেবে সর্বময় দায়-দায়িত্ব তুলে নিয়েছে এরা। চাঁদাবাজি, হুমকি, হত্যা, বোমাবাজি প্রভৃতি অপরাধের বিষয়ে চরমপন্থীদের মুখপাত্র হিসেবে কিশোর সন্ত্রাসীরা এখন লাইমলাইটে।
জানা গেছে, খুলনা মহানগরীসহ বৃহত্তর খুলনার ৩ জেলায় এই কিশোর সন্ত্রাসীরা আন্ডার ওয়ার্ল্ডকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।
এসব সন্ত্রাসীকে গ্রেফতারের জন্য র্যাব-পুলিশ প্রতিনিয়ত ঢিলেঢালা হলেও অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের ওপর র্যাব, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নজরদারি শুরু করেছে। র্যাব-পুলিশ কৌশলগত কারণে এসব বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছে না।
Friday, 2 December 2011

মাটির এই পৃথিবী দানবের জন্য নয়
মাটির এই পৃথিবী দানবের জন্য নয়
দেশ নিয়ে আমরা গর্ব করতে চাই, গর্ব করতে চাই সরকারের সাফল্য নিয়েও। কারণ সরকার সফল হলে দেশ এগিয়ে যায়, জনগণ সুখে থাকে। আর জনগণ যখন সুখে থাকে, তখন তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সন্তুষ্টির কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি এখন তেমন কথা উচ্চারণ করছে? দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী তার এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন মন্ত্রী পরিষদের মাধ্যমে। যেহেতু সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার মূল দায়িত্ব বর্তায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর, তাই মন্ত্রীদের ক্রিয়া-কর্মের ব্যাপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই দৃষ্টিতে কখনো যে তারতম্য কিংবা রকমফের ঘটে না তা কিন্তু নয়। এমন কিছু ঘটলে যে শুধু নীতির লঙ্ঘন হয় তা নয়, এই পথে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, পতনও ঘটে। কিন্তু এই বিষয়টি সবসময় সরকার তথা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করতে সক্ষম হন না। এখানেই সরকারের জন্য সুপ্ত থাকে ট্র্যাজেডির বীজ।
দেশ এখন কেমন চলছে? এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের বক্তব্যে মিল নেই। মিডিয়ায় উভয়পক্ষের বিপরীতমুখী বক্তব্য প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে। তবে জনগণ যাদের বক্তব্যে সায় দেবে আখেরে বিজয় তাদেরই হবে। জনগণ কখনো গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদের রায় প্রকাশ করে, আবার কখনো প্রকাশ করে ব্যালটের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলো জনমত গঠনে কথার মারপ্যাঁচ ও প্রোপাগান্ডা কৌশলকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে এখানে বলে রাখা ভাল যে, দেশ কেমন চলছে প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের মাধ্যমেই জনগণ তা উপলব্ধি করে থাকে। এই উপলব্ধিই জনমত গঠনের আসল নিয়ামক। শুধু কৌশলে জনসমর্থন পাওয়া যায় না, বরং তাতে হিতে বিপরীত হয়। অথচ এই বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদরা, বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা বুঝতে চান না। পরিণামে যা হবার তাই হয়। তখন শত আফসোসেও কোনো কাজ হয় না।
প্রধানমন্ত্রী ২৮ নবেম্বর বললেন, তিন বছরে মন্ত্রীদের কাজে আমি সন্তুষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন। সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা দেশের উন্নয়নে কাজ করছি। তবে কেউ কেউ চোখ থাকিতে অন্ধ। তারা আমাদের অর্জন দেখতে পায় না। প্রধানমন্ত্রী গত তিন বছরে মন্ত্রীদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং সরকারের উন্নয়ন তৎপরতায়ও তিনি গর্ববোধ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণ কি দেশের উন্নয়ন কর্মে মন্ত্রীদের তৎপরতায় সন্তুষ্ট হতে পেরেছে? দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কী অবস্থা? শেয়ারবাজার ও অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন? বেকারদের জন্য কি চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা হয়েছে? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ কেন? আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতিতে জনগণ আতঙ্কিত কেন? সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা বুলি আওড়ালেও স্বয়ং তাদের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে কেন? সরকারের কাছে এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব না থাকলে জনগণ কেমন করে ভাববে, দেশ ঠিকমত চলছে? জনগণ লক্ষ্য করছে, জনদুর্ভোগ দূর করার পরিবর্তে সরকার যেন হামলা-মামলা ও বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের কাজকেই তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমন তৎপরতায় তো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবার নয়। তাইতো দেশ পরিচালনায় কিংবা মন্ত্রীদের তৎপরতায় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও জনগণ তাতে সায় দিতে পারছে না। এমন বক্তব্যকে সরকার বিরোধী দলের প্রোপাগান্ডা হিসেবে হয়তো উড়িয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু বক্তব্য তো শুধু বিরোধী দলই রাখছে না, অন্যরাও রাখছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের বিশ্লেষণ উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৈনিক গালফ নিউজে প্রকাশিত এক লেখায় কুলদীপ নায়ার বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দেশের সর্বত্র দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ভয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের সহায়তা তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে পাঁচ দিন থাকার পর আমার মনে হয়েছে, হাসিনা শুধু যে তার কারিশমাই হারিয়েছেন তা নয়, এক সময় যাদের বিশ্বাস করতেন তাদেরও হারিয়েছেন তিনি। তিস্তার পানি চুক্তি এবং টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যু আগামী নির্বাচনে নিঃসন্দেহে প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন কুলদীপ নায়ার। তিনি উল্লেখ করেন, জনপ্রিয়তা একটি দুর্লভ ব্যাপার। প্রয়োজনের সময় শাসকরা জনপ্রিয়তা পান না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। যখন তার জনপ্রিয়তা আসলেই দরকার তখন তিনি তা হারাচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অপশাসন না হলেও সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন শুধু দুর্বিষহই হয়ে ওঠেছে। আর ক্ষমতায় বসার ৩ বছর পার হওয়ার পরও তিনি তা বুঝতে পারছেন না। জনগণ তার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিল কিন্তু বলার মতো কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ জনগণ দেখতে পাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি বিদ্যুৎ খাতের কথা উল্লেখ করেন। নায়ার বলেন, স্বল্প সম্পদ দিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জের বিষয় কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ বাস্তবতা মানতে নারাজ। তিনি যা করছেন তা নিয়ে তাকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। তিনি একপক্ষীয়ভাবে ভারতের সাথে ট্রানজিটের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন। নায়ার বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গাটি হলো, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, নয়াদিল্লী এবং কলকাতার মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণে চুক্তিটি হচ্ছে না। তবে ভারতের মনিপুরে বরাক নদীর উপরে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প যখন সামনে এলো তখন ঐ বিষয়টি আবারও পেছনে চলে গেলো। মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের এক মাস পর ২৩ অক্টোবর মনিপুর সরকার এবং নয়াদিল্লীর সঙ্গে এই চুক্তিটি হয়। আর এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ বাস্তবিক অর্থেই আঘাত পেয়েছে। কারণ এই চুক্তির ফলে প্রমাণ হয়, নয়াদিল্লী বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাবছে না। ভারতের এ পদক্ষেপে কোণঠাসা হাসিনার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ভারতের সঙ্গে হাসিনার বন্ধুত্বের চেষ্টা উপেক্ষিত হয়েছে। কুলদীপ নায়ার তার লেখায় আরো অনেক কথাই বলেছেন। সেখান থেকে কিছু নেয়ার আছে কি না তা শেখ হাসিনার সরকার ভেবে দেখতে পারে।
এতো গেলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক প্রবীণ সাংবাদিকের বিশ্লেষণ। এবার দেশের লোকের বিশ্লেষণ শুনি। জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, দেশে যে ধরনের গণবিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে তা অতীতে আমরা কেউ দেখিনি। পাপ চরম পর্যায়ে গেলে আল্লাহর তরফ থেকে গজব নেমে আসে। সামগ্রিকভাবে দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অচিরেই আমরা এক ভয়ঙ্কর অবস্থা প্রত্যক্ষ করবো। এ জন্য কোনো দল লাগবে না। সাধারণ মানুষই রাস্তায় নেমে আসবে। অন্যায়-অত্যাচার আজ মাথার তিন হাত উপরে উঠে গেছে। তিনি একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘মানুষের তরে মাটির এ পৃথিবী, দানবের তরে নহে।' গত রোববার রাজধানীতে এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন। জানি না সাবেক এ মন্ত্রীর বক্তব্য আওয়ামী লীগ সরকার কিভাবে নেবে। তবে একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাটির এই পৃথিবী মানুষের জন্যই দানবের জন্য নয়। মানুষ যখন অন্যায়-অত্যাচারের মাধ্যমে দানব চরিত্র অর্জন করে তখন তার বিরুদ্ধে চলে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। মানব জাতির ইতিহাস আসলে এই মুক্তি সংগ্রামেরই ইতিহাস। বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ মাত্রই চান আমাদের এই সমাজ মানুষের বসবাসযোগ্য হয়ে উঠুক। তবে এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রয়োজন সরকার বিরোধী দল এবং নাগরিকদের যথা আচরণ। কারণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথা আচরণের বদলে কোনো সমাজের মানুষ যদি শুধু পরস্পরের বদনাম গেয়ে যায়, তবে তাতে প্রগতি অর্জিত হয় না, পাওয়া যায় না শান্তির নিবাসও। তবে এসব বিষয় উপলব্ধির জন্য নিজের সাথে কথা বলতে হয়, আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত হতে হয়। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এখন এসব বিষয় লক্ষ্য করা যায় না। তাই দেশের অগ্রগতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে যে কর্ম-সংস্কৃতি প্রয়োজন তা এখনই লক্ষ্য করা যাবে কি না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। তবে এ বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করি যে, আরো ক্ষতি থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে এবং জনগণের দুর্ভোগ হ্রাস করতে হলে সরকারের এখনই ভুলপথ পরিহার প্রয়োজন। এমন চিত্র লক্ষ্য করা গেলে বিরোধী দলের ভূমিকায়ও হয়তো পরিবর্তন আসবে। না আসলে তা দেখার জন্য তো দেশের জনগণ রয়েছেই। আর আখেরে রায় তো জনগণই দেবে।
Thursday, 1 December 2011

যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া, বিচারের কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন লক্ষণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরকালে যখন হিল্টন হোটেলে তার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান চলছিল, তখন বিএনপি ও কোয়ালিশন ফর আমেরিকান এসোসিয়েশন হিল্টন হোটেলের পাশেই বিক্ষোভ করছিল। এসোসিয়েশনের ব্যানারে ২০টি সংগঠনের পাঁচ হাজার নেতা-কর্মী বিক্ষোভে মুখরিত করে তোলে পুরো এলাকা। তাদের অভিযোগ, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিরোধী দলীয় নেতাদের নির্যাতন আর হয়রানি করছে এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করছে। সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নামে বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে বিরোধীদলের সব নেতার মুক্তি দাবি করেন। কোয়ালিশন ফর আমেরিকান এসোসিয়েশনের ব্যানারে অংশ নেয় বাংলাদেশ আমেরিকান প্রগ্রেসিভ ফোরাম, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদ, সাঈদী মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ আমেরিকান প্রফেসরস এসোসিয়েশন, এসোসিয়েশন অব আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন নর্থ আমেরিকা, এসোসিয়েশন অব আমেরিকান ব্যাংকার্স ইন নর্থ আমেরিকা, বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশন, টিচার্স এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, বাংলাদেশ আমেরিকান ক্যাবি এন্ড লিমো সোসাইটি, মহিলা কল্যাণ সংস্থা নিউইয়র্ক, ইমাম এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকা, প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা।
উক্ত ট্রাইব্যুনালের ব্যানারে তেমনি গত সোমবার (২৮/১১/১১ইং) যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ দু'দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ পর্যায়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁর সুপারিশধর্মী ঐ বক্তব্যের মধ্য দিয়েও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাঁর ইতোপূর্বে দেয়া সুপারিশ পুরোপুরি গ্রহণ না করাতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মি. স্টিফেন বলেন, ‘‘আমার ১০টি সুপারিশের ৫টি আংশিক গ্রহণ করা হয়েছে। আমি দুঃখের সাথে বলতে চাই যে, গত জুন মাসে বিচার কাজের ধারাসমূহে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে আরও অনেক কিছু আনা সম্ভব ছিল।’’ বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কি তার সঠিক সংজ্ঞায়নও হয়নি বলে স্টিফেন অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ থাকা উচিত। বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র এমনটি দেখতে চায়। ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ সরাসরি রেডিও-টিভিতে প্রচারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের সব মানুষের কাছে এ বিচারপ্রক্রিয়া উন্মুক্ত থাকতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের এ বিচার কাজ সম্পর্কে জানতে দিতে হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে আদালতের অধিবেশনে যোগ দেয়া সহজ ও সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সিয়েরালিয়নে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্যে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে প্রতিদিন যে কার্যক্রম হয়, তা ইংরেজি এবং সে দেশের ভাষায় বিস্তারিত লিখে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশেও এটা করা উচিত। এমনভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করা দরকার, যাতে তা স্বচ্ছ এবং বিশ্বের সবার জন্যে উন্মুক্ত হয়।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে যখনই কোথাও ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি ঘটে, সেখানেই অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এজন্যে বিশ্বের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল দেশে সকল সমাজেই আবহমানকাল থেকেই ন্যায়বিচারের বিষয়টি যেমন সকলের কাঙ্ক্ষিত, তেমনি এর প্রতিষ্ঠার দাবি সর্বত্র অভিন্ন এবং এর চাহিদা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তবে যে-কোন বিচারকার্যের মূল লক্ষ্যে যেমন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও কার্যক্রমের দ্বারা সত্য উ ঘাটন ও সে অনুযায়ী ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণের জন্যে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা বর্জিত মানসিকতা অপরিহার্য, তেমনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বেলায় তা আরও বেশি অপরিহার্য। এক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়াদির ব্যতিক্রম ঘটলে তা যেমন বিচারের নামে হবে প্রহসন, তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোথাও তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। মাঝখানে জাতীয় ঐক্য-সংহতি বিনষ্ট হয়ে জাতীয় জীবনের অশান্তিই বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের উন্নতি অগ্রগতির পথে হবে প্রতিবন্ধক। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও এর সুষ্ঠু কার্যক্রমের ব্যাপারে উত্থিত প্রশ্নাবলীর নিরসনকল্পে যেসব প্রস্তাব ও পরামর্শ দিয়েছেন, এসব প্রস্তাব-পরামর্শ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা বিশ্বজনীন স্বীকৃত। দেশে-বিদেশে এ ট্রাইব্যুনালের বিচারের গ্রহণযোগ্যতার জন্যে স্টিফেন জে. র্যাপের প্রদত্ত প্রস্তাবাবলীর আলোকে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত ও সে অনুযায়ী এর কার্যক্রম নিশ্চিত করা উচিত। তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধিই পাবে। এই সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যায়ভাবে বিরোধী দলীয় যেসব নেতাকে গ্রেফতার ও এ মামলায় জড়ানো হয়েছে, তাদের আশু মুক্তিদান গণতন্ত্র, মানবতা ও মানবাধিকারের দাবি বলে আমরা মনে করি।
Sunday, 30 October 2011

প্রেম অপ্রেমের কাব্য
প্রেম অপ্রেমের কাব্য
প্রতিদিন ভোরের গন্ধে লুকানো কত অভিমান!
ভালোবাসার খোঁজখবর? তুমি ভুলেই গেছ,
আমি ফাঁদ পেতেছি, আনমনে পা বাড়াও,
ভালোবাসার খোঁজখবর? তুমি ভুলেই গেছ,
আমি ফাঁদ পেতেছি, আনমনে পা বাড়াও,
তোমার ছায়ারা গিলেছে আমার আবদ্ধ ক্ষুধার্ত যৌবন,
শেষ
বারের মত জ্বলজ পা দু’খানি
মেলে,
উৎসবের সূচীপত্রে গোধূলীর শেষে একটিবার দাড়াও।
Monday, 10 October 2011

জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ
জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ
বছরের অন্যতম ঋতু বর্ষা চলছে। এরই মধ্যে টানা ও ছাড়া ছাড়া বৃষ্টিপাতে রাজধানী ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশের অধিকাংশ এলাকায়ই সৃষ্টি হয়েছে প্রকট জলাবদ্ধতার। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যাটি অনেক পুরনো এবং অনেকটা যেন দুরারোগ্য ও নিরাময়ের অযোগ্য ব্যাধির মতো। ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে ঢাকা মহানগর পানিতে ৯ দিন তলিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন, এরপরও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের টনক নড়েনি কেন? গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর বেশিরভাগ এলাকায় মারাত্মক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। এর ফলে সর্ব সাধারণের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে হয়েছে ব্যাহত। রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল হয়েছে বিঘ্নিত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারেনি। অফিস-আদালত-ব্যাংক-বীমার স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। রাস্তায় নজিরবিহীন যানজটে জনদুর্ভোগ উঠেছে চরমে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় সীমাহীন দুর্গতি হয়েছে লাখ লাখ বস্তিবাসীর। লাখ লাখ খেটে খাওয়া মানুষ কাজের সন্ধানে বেরুতে পারেনি। হাট-বাজারে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষকে অনাহারে থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এর অর্থ দাঁড়ায় একটাই- আধুনিক যুগে এসেও আমরা নিজেদের স্বাভাবিক বর্ষা ও বৃষ্টির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। বরং সর্বতোভাবেই ব্যর্থ হয়েছি। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কী?
সুষ্ঠু ও সমন্বিত পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা যেকোনো আধুনিক নগর স্থাপত্যবিদ্যা ও পরিকাঠামোর জন্য অবশ্য পালনীয় শর্ত। সত্যি কথা হলো, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র পরিচালকরা এবং তাদের আজ্ঞাবহ প্রজাতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল আমলারা মিলে ৪০ বছর ধরে একটি আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য কোনো মাস্টারপ্ল্যান কিংবা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেননি। ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই এক সময় প্রবহমান ছোট-বড় ৫৩টি খাল বিলীন বা বেদখল হয়ে গেছে। সরকারের অসংখ্য সংস্থার চোখের সামনে প্রতিদিন নতুন নতুন বহুতল ভবন, স্থাপনা ও হাউজিং কোম্পানিগুলোর অসংখ্য আবাসিক ভবন গড়ে উঠছে। কোনো সন্দেহ নেই, এটি একটি আধুনিক নগর উন্নয়নের ভিত্তিকেই চিহ্নিত করে। তবে সেটি কোনো অবস্থাতেই একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার ইঙ্গিত বহন করে না। রাজধানী ঢাকা এখন ইট-বালি-সিমেন্ট-পাথর মিশ্রিত লাখ লাখ দালান-কোঠা শোভিত একটি বিশাল মহানগর হিসেবে গড়ে উঠলেও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তথা বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ইত্যাদি পরিকাঠামোর দিক থেকে বলা যায় রয়ে গেছে প্রায় মান্ধাতা আমলেই। মহানগরীর খালগুলোর একে একে ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে। যে দু'চারটি এখনো টিকে আছে, সেগুলো শুধু নামেই খাল। অথচ সেগুলো উদ্ধারের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার ভূগর্ভস্থ নর্দমা ও ডিসিসি'র ভূউপরিস্থিত ড্রেন মিলিয়ে পানি নিষ্কাশনের লাইন মাত্র আড়াই হাজার কিলোমিটার। প্রতি দিনের নিক্ষিপ্ত পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনায় সেগুলোর বেশিরভাগই থাকে বন্ধ। এর ওপর রয়েছে যখন-তখন যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়া-খুঁড়ির উপদ্রব। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাসহ নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কোনোটির সাথে কোনোটির সমন্বয় নেই। কয়েকটি পয়েন্টে স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন ও পাম্প মেশিন বসানো হলেও সেগুলো বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা কারণে কাজ করে না। ফলে নগরীতে একবার জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে তা সেরে উঠতে সময় লেগে যায় কয়েকদিন। বর্ষা-বৃষ্টিতে পানিবন্দি জীবন কাটাতে হয় নগরবাসীকে। গত ক'বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, একটি সমন্বিত মেট্রোপলিটন কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা। তবে কোনো সরকারই এতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেননি। মহানগরবাসীকে প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে নিক্ষেপ করাটাই কী গণতান্ত্রিক রীতি হয়ে গেলো, তার জবাব দেবেন কে?
Sunday, 2 October 2011

বিদেশী আইনজীবীদের এত ভয় কেন?
বিদেশী আইনজীবীদের এত ভয় কেন?
আমার পাশের বাড়ির ভদ্রলোক আমার সাথে জমির সীমানা নির্ধারণের সময় অত্যন্ত ভদ্র ও নরম কণ্ঠে বলেছিলেন ‘‘আপনি আর আমি থাকলেই হবে অন্যলোকের কি দরকার’’ আমি সরল মনে তাকে ভদ্রলোক মনে করে একমত হলাম। পরে দেখি লোকটি চতুরতার সাথে আমার জমির মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গেছেন। অর্থাৎ আমার বেশ খানিকটা জায়গা হজম করে ফেলেছেন। আমার সরলতাকে দুর্বলতা ভেবে চতুরতার সাথেই কাজটি করেছেন। দুদিন পরেই এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমাকে বললেন, একি? আপনার জায়গায় উনি ঢুকে পড়েছেন। পরে অবশ্য আমার অংশ দখল পেয়েছি। কথাগুলো বললাম এজন্য যে, যারা সমাজ সচেতন এবং বিজ্ঞ ব্যক্তি তারা যদি ফয়সালা করেন তাহলে দুর্বল লোকেরা সঠিক বিচারটা পায়। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল তথা ক্ষমতায় চিরদিন থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা জানে সরকারের অন্যায় ও অনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম আর আন্দোলন কারা করতে পারে। এরশাদ সরকারের সময় জনাব এরশাদ বিদেশ সফরে যাওয়ার সময় বিমান বন্দরে সাংবাদিকগণ জিজ্ঞেস করেছিল আপনি বিরোধীদলের আন্দোলনকে ভয় পান কি না? উত্তরে জনাব এরশাদ বলেছিলেন ‘‘কেবল জামায়াতকে ভয় পাই’’। সত্যি কথাটাই বলেছিলেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। জামায়াত যে কি জিনিস তিনি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা এ দেশবাসী জানে। জামায়াতের প্রশংসা করতে গিয়ে জনাব এরশাদ বলেন, ‘‘জামায়াত একটি সুশৃক্মখল দল। জনাব আববাস আলী খানের জানাযায় গিয়ে আমি দেখেছি, মাওলানা নিজামী যখন বললেন, আপনারা দুপা পিছনে যান অমনি সবাই পিছনে চলে গেলেন, মনে হল যেন কোন সেনাবাহিনীর কমান্ডার নির্দেশ দিচ্ছেন’’ কথাগুলো জনাব এরশাদ বলেছিলেন আল-ফালাহ মিলনায়তনে, আববাস আলী খান (র.) এর দোয়া অনুষ্ঠানে। উপরোক্ত কথাগুলো বললাম এজন্য যে, জনাব এরশাদ যে জামায়াতকে চিনেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি সে জামায়াতকে চিনতে পারেননি? চিনেছেন। আর চিনেছেন বলেই জামায়াতকে কোণঠাসা করে রেখে ক্ষমতায় থাকতে চান। এ দলের শীর্ষ নেতাদের উপর নির্যাতনের পর নির্যাতন করে যাচ্ছেন। জামায়াত নেতাদের সাথে আলোচনা করে দেখা গেছে তারা আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, তাই তারা সবকিছুকেই আইনের মাধ্যমে এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে চান। এদেশের বর্তমান সরকারের সাজানো ট্রাইব্যুনালে যেন জুলুমের শিকার হতে না হয় সে জন্য তারা প্রয়োজনে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন এটা তাদের যেমন মৌলিক অধিকার তেমনি বিচার আন্তর্জাতিক মানের হওয়ার জন্যেও জরুরি। আন্তর্জাতিক মানের বিচার হবে আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষক থাকবেন না, আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবী নিয়োগ দেয়া যাবে না, কেবল আমাদের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে বিচার মঞ্চ তৈরি করবে তাই সবাইকে আন্তর্জাতিক মানের বিচার বলে মেনে নিতে হবে বিষয়টি কি এমনই? ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও চিটাগাং হিলট্রাক্টস কমিশনের কো-চেয়ারম্যান লর্ড এরিক অ্যাভেবুরি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে বলেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে সম্পূর্ণরূপে অনীহা প্রকাশ করেছে। ট্রাইব্যুনাল যদি নিজেদের দেশীয় বিচার ব্যবস্থার একটি অঙ্গ মনে করেন তবে তাদের দেশীয় আইন মেনে চলা উচিত। আর যদি তারা এটাকে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল মনে করেন তাহলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা উচিত। কিন্তু তারা এ দুটির একটির মধ্যেও নেই।’’ লর্ড এরিক আরো অনেক কথা বলেছেন, অনেক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ তো পারলে লর্ড এরিককে জামায়াতে ইসলামীর রুকন বানিয়ে ফেলবে। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে হয় দেশদ্রোহী, না হয় রাজাকার অথবা জঙ্গি কিংবা স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী। প্রশ্ন হলো, একজন আসামী তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে না এটা কেমন জুলুম? লর্ড এরিক যথার্থই বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল যদি তাদেরকে দেশীয় আদালতের একটি অংশ মনে করে তাহলে দেশের আইন মানতে হবে আর যদি নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল মনে করে তবে আন্তর্জাতিক আইন মানতে হবে। অথচ তারা কোনটার ধার ধারছে না। গায়ের জোরে আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহংকারে যেন কিছুই মানতে চাইছে না। বিদেশী আইনজীবীকে এতো ভয় কেন? তবে কি সরকারের সকল প্রকার বেআইনি তৎপরতা বিদেশীরা জেনে ফেলবে তাই? আজ না জানুক কাল জানবে কোন কিছু কি গোপন থাকার কথা? জামায়াতের মতো একটি দেশপ্রেমিক সুশৃক্মখল দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে এ আচরণ এর কি কোন প্রতিকার হবে না? দলটির প্রথিতযশা নেতারা আজ কারাগারে। আর তাদের পক্ষে বলিষ্ঠভাবে যদি কথা বলা হয় ঐ নেতাকেই টার্গেট করে সরকার কিভাবে তাকে দমানো যায়? হয় গাড়ি ভাঙ্গার মামলা অথবা গ্রেনেড হামলা কিংবা রাষ্ট্রপতির গাড়ি বহরে বাধাদান, আরো আছে পুলিশের কাজে বাধাদান, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া কত কি। শোনা যাচ্ছে, আগামীতে নাকি মোবাইল চুরি, সরকারের সমালোচনা, রাষ্ট্রপতির সমালোচনা ইত্যাদি কারণেও মামলা দেয়া হবে। জামায়াতের এক নেতা ডাঃ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের এক বক্তৃতায় সরকারের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। এতো ভয় যাদের ভিতর তারা সাঈদী-নিজামীর মতো মহান ব্যক্তিত্বের সাথে এ ন্যক্কারজনক আচরণ করে কি করে? তা অনেক বিশ্লেষকেরই নাকি বুঝে আসে না। এমন একটি দলের লাখ লাখ কর্মী বেঁচে থাকতে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর কিছু হবে আর তারা ঘরে বসে থাকবে বিষয়টা কি এমন? এ ধরনের কথাই মনে হয় ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছিলেন। এর অর্থ কি সরকারকে হুমকি দেয়া? এটা একটা সাধারণ কথা ‘‘যদি অন্যায়ভাবে নিজেদের ইচ্ছে মতো আইন শানিয়ে দেশের বরেণ্য আলেমদের ওপর কোন নির্যাতন চালানো হয় তাহলে জামায়াত-শিবিরের কয়েক লক্ষ নেতাকর্মী বসে থাকবে না।’’ এমন কথার অর্থইকি কাউকে মেরে ফেলার হুমকি? বাংলা ব্যাকরণ অধ্যয়ন করলে কি তাই অনুভব হয়? না এর অর্থ নেতার জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। প্রয়োজনে নিজেদের জীবন ও সম্পদের সর্বোচ্চ কুরবানী দিবো এমনটি বুঝায়? আর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের জন্য তো এটা খুবই স্বাভাবিক। যারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আন্দোলন করে তাদের দ্বারা কোন অন্যায় তো প্রশ্নই আসে না তবে ন্যায়সঙ্গতভাবে তারা সব কিছু ত্যাগ করতে পারবে। অতএব আন্তর্জাতিক আইন মেনে আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল করে যেকোন অপরাধীদের বিচার করার ক্ষেত্রে জামায়াতের কোন আপত্তি নেই বলে তারা বলে যাচ্ছেন। সরকার কেন এদিকে যাচ্ছে না? আন্তর্জাতিক মান কি জামায়াতের পকেটে? বিশ্ববিবেক কি একচেটিয়া জামায়াতের দখলে? বিদেশীরা জামায়াতের বন্ধু আর সরকারের শত্রু? যদি নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার সরকার চায় তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সমস্যা কোথায়? আর আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখলেই তো আসামী পক্ষকে প্রয়োজনে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। সরকার কেন তা চাচ্ছে না ভয়টা কোথায়?
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের নেতাদের নির্যাতনে যত অর্থ ও সময় ব্যয় আর অপকৌশল চালিয়েছে তার কিঞ্চিৎ যদি দেশের জনগণের দুর্দশা লাঘবে ব্যয় করতো তাহলে দেশের জনগণের কত উপকার হতো। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, আইন-শৃক্মখলা, দ্রব্যমূল্যের পাগলাঘোড়া, চুরি, ডাকাতি, অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা, দুর্ঘটনা এগুলো এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যেন মানুষ আজ দিশেহারা অথচ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এমনভাবে কথা বলছে মনে হয় তারা জান্নাতের মধ্যে বসবাস করছে। করবেই তো কারণ তারা যে রঙিন চশমা পরে সবকিছু দেখে- সবুজ অথবা জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে বিরোধীদের সবকিছুতে দুর্গন্ধ অনুভব করে। সরকারকে দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃক্মখলা বজায় রাখার জন্য দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে অন্যথায় দেশের মধ্যে কোন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এর দায়-দায়িত্ব কোনভাবেই সরকার এড়াতে পারবে না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণের মত। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
Tuesday, 12 July 2011

বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ
বিচার বিভাগের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ এবং বিতর্কিত বিচারক নিয়োগের প্রতিবাদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আহূত ‘গণ-অবস্থান' কর্মসূচি গত বুধবার ঢাকায় অভাবনীয় সাফল্যের সাথে সমাপ্ত হয়েছে। এ কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে আর এটি বড় ধরনের রাজনৈতিক জাগরণ দৃশ্যমান হয়েছে। বিএনপি-র আহূত আসছে ২৭ জুন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা ঘোষিত হরতালের প্রতি জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোটের অংশীদার দলসমূহ এবং দেশের সকল জাতীয়তাবাদী ইসলামী শক্তিসমূহ ইতোমধ্যেই সমর্থন ব্যক্ত করেছে। হরতালের কর্মসূচি ঘোষণার সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছিলেন, এ কর্মসূচি সরকারের জন্য সতর্ক সংকেত। সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে বিরোধী দলের আন্দোলনের কর্মসূচির প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া কেমন হবে। হরতাল-পূর্ব কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত বুধবার ঢাকায় বিরোধী দল ও তার সহযোগী দলগুলো গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এ উপলক্ষে সমাবেশে বিরোধী দলীয় নেত্রী ঘোষণা করেছেন, সরকারের দিক থেকে আঘাত আসলে পাল্টা আঘাত হানা হবে।
উল্লেখ্য, আসন্ন হরতালসহ বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ আন্দোলন দুর্বল ও বানচাল করতেই সরকার সম্প্রতি ‘দৈনিক আমার দেশ' এর ডিক্লারেশন বাতিল করেছে, সম্পাদককে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং পত্রিকার বেশ কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এদিকে সরকারি দল সংসদকে একটি একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলায় বিরোধী দল সংসদের বাইরে সাংবাদিক সম্মেলন করে একটি বিকল্প বাজেট পেশ করেছে। সরকারি দল একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে একটি জনকল্যাণমুখী সমন্বিত বাজেট তৈরির সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে রাজনৈতিক বাহাস শুরু করেছে। সরকারি দলের কোন কোন সংসদ সদস্য সংসদের বাইরে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাজেটভাবনা পেশ করাকে সংবিধান লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছেন। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই শোভন ও শুদ্ধরীতি। কেননা মিডিয়া হচ্ছে জনগণের পার্লামেন্ট এবং মিডিয়া গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত। সরকারি দল গণতান্ত্রিক সমাজে মিডিয়ার চিরন্তন ভূমিকা দেখতে চায় না বলেই অকার্যকর ও একদলীয় সংসদে গিয়ে বিরোধী দলকে বাজেট-ভাবনা পেশ করার ভাঁওতাবাজির আহবান জানাচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বিরোধী দলের বাজেট-প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের সুপারিশ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত বাজেট তৈরি করতে পারতো। কিন্তু দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সাথে সরকারের গাঁটছড়া বাঁধার কারণে তারা প্রস্তাবিত বাজেট প্যাকেট থেকে সরে এসে বিরোধী দলের সুপারিশকে আত্মস্থ করতে পারছে না।
এদিকে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ এবং বিতর্কিত বিচারক নিয়োগের প্রতিবাদে সম্মিলিত বিরোধী দলের গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সরকার বিচার বিভাগসহ বিচারিক প্রক্রিয়াকে দলীয়করণের কলংকজনক ইতিহাস তৈরিতে চ্যাম্পিয়ান হতে চলেছে। অতীতেও আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপসহ সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং সাংবাদিক নির্যাতনকে তাদের ফ্যাসীবাদী রাজনীতির অনুপান হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৭৫-এর একদলীয় বাকশাল গঠন করে বিচারবিভাগকে কার্যত: দলের শাখা সংগঠনে পরিণত করা হয়েছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তাকে একদলীয় ফ্যাসীবাদী ক্ষমতার উদরে বিলীন করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রাজপথে লাঠিমিছিল পর্যন্ত বের করেছিল। বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাইকোর্টের বিচারিক রায়ের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর নির্দেশনায় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তি বসানোর মতো ঔদ্ধত্যও তারা দেখিয়েছিলেন। বিচার নিত্তিতে হাইকোর্টের বিচারকদের ‘বিব্রত' হবার ঘটনা নিয়ে তারা বিচারকদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানিমূলক কর্মসূচি নিয়েছে। আওয়ামী ঘরানার আইনজীবীদের উস্কানি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে বিচারিক পরিবেশ বিঘ্নিত করা হয়। বিচারকদের জামিন দানের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপসহ তাদের ওপর প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দলীয় ফ্যাসীবাদী নৈরাজ্যের কাছে বিচার বিভাগকে নতি স্বীকার করতে আওয়ামী আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কক্ষের ওপর লাথি মারাসহ অবমাননাকর কার্যক্রম চালিয়েছেন। এসব আইনজীবীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আদালতে মাস্তানী করা এসব আইনজীবী-বিচারবিভাগের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভূমিকা নিয়েও দলীয় বিবেচনায় শাস্তি বা মুচলেকা ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন।
এবারে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোট ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ংকর থাবা বিস্তার করে। কার্যত: বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে বন্দুকের নলের মাথায় অশুভ কাজে এবং রাজনীতিক-ব্যবসায়িক-নাগরিকদের নির্যাতনে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে নির্বাচিত সরকার বিচার বিভাগকে তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে নগ্নভাবে ব্যবহার করে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
বর্তমান সরকার তার এটর্নী জেনারেলের অফিস এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিচারপতিদের ওপর প্রভাব বিস্তার ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বিচার-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষে এটর্নী জেনারেলের অফিসের আইনী প্রক্রিয়া ও আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রকাশ্য এজলাশে হাইকোর্ট বন্ধ করে দেবার কথা বলেছেন। বিচার বিভাগের বর্তমান দুর্গতি দেখে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি দুঃখ করে বলেছেন: ‘‘বিচার বিভাগ কাচের ঘরে বন্দী হয়ে আছে।’’
এদিকে সরকার বিচার বিভাগকে ফ্যাসীবাদী রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে অযোগ্য, বিতর্কিত ও মামলার আসামীদেরও বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি উচ্চআদালত সরকারের প্রতি রুল জারী করে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং বিচারবিভাগকে প্রশাসন তথা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসীবাদী আচরণে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে। ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতগুলোকেও মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী স্বাধীন ও বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোকে সরকার তার রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মিথ্যা-বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলায় যাকে তাকে গ্রেফতার এবং দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সহায়তা করাই যেন নিম্নআদালতের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ করা হচ্ছে যে, উচ্চআদালতের কোন নিয়ন্ত্রণ নিম্নআদালতে কার্যকর নেই। বরং সরকারই তার পুলিশী নির্যাতন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থে ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতগুলোকে ব্যবহার করছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে।
বিচারিক প্রক্রিয়াকে সরকার দলীয় বিবেচনায় কত নোংরাভাবে প্রভাবিত করছে, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিগত সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক যেসব মামলায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জব্দ করা হয়েছিল, ঐসব মামলা থেকে বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চালু রেখে সরকার দলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীদের প্রায় সকল মামলা ঢালাওভাবে ক্ষমতার জোরে তুলে নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত তারা ১,৭৪৬টি মামলা প্রত্যাহার করে দিয়েছে, যার মধ্যে বিরোধীদলের মাত্র ২টি মামলা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সবকটি মামলা থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু একই সময়ে ও প্রক্রিয়ায় দায়ের করা বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুরনো মামলা ছাড়াও নতুন নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা সাজানোর পাঁয়তারা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া ও বিচার বিভাগের ওপর সরকারের অব্যাহত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাবার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেবার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এটাই ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নমুনা। সরকারের এই হিংস্র ও নিপীড়নকারী-ফ্যাসীবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে একটি প্রবাহে, একই কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হবার মধ্য দিয়েই বিচারবিভাগের স্বাধীনতাসহ নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, আসন্ন হরতালসহ বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ আন্দোলন দুর্বল ও বানচাল করতেই সরকার সম্প্রতি ‘দৈনিক আমার দেশ' এর ডিক্লারেশন বাতিল করেছে, সম্পাদককে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং পত্রিকার বেশ কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এদিকে সরকারি দল সংসদকে একটি একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক মঞ্চ হিসেবে গড়ে তোলায় বিরোধী দল সংসদের বাইরে সাংবাদিক সম্মেলন করে একটি বিকল্প বাজেট পেশ করেছে। সরকারি দল একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে একটি জনকল্যাণমুখী সমন্বিত বাজেট তৈরির সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে রাজনৈতিক বাহাস শুরু করেছে। সরকারি দলের কোন কোন সংসদ সদস্য সংসদের বাইরে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বাজেটভাবনা পেশ করাকে সংবিধান লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছেন। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই শোভন ও শুদ্ধরীতি। কেননা মিডিয়া হচ্ছে জনগণের পার্লামেন্ট এবং মিডিয়া গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত। সরকারি দল গণতান্ত্রিক সমাজে মিডিয়ার চিরন্তন ভূমিকা দেখতে চায় না বলেই অকার্যকর ও একদলীয় সংসদে গিয়ে বিরোধী দলকে বাজেট-ভাবনা পেশ করার ভাঁওতাবাজির আহবান জানাচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বিরোধী দলের বাজেট-প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের সুপারিশ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত বাজেট তৈরি করতে পারতো। কিন্তু দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সাথে সরকারের গাঁটছড়া বাঁধার কারণে তারা প্রস্তাবিত বাজেট প্যাকেট থেকে সরে এসে বিরোধী দলের সুপারিশকে আত্মস্থ করতে পারছে না।
এদিকে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ এবং বিতর্কিত বিচারক নিয়োগের প্রতিবাদে সম্মিলিত বিরোধী দলের গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি সরকার বিচার বিভাগসহ বিচারিক প্রক্রিয়াকে দলীয়করণের কলংকজনক ইতিহাস তৈরিতে চ্যাম্পিয়ান হতে চলেছে। অতীতেও আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপসহ সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ এবং সাংবাদিক নির্যাতনকে তাদের ফ্যাসীবাদী রাজনীতির অনুপান হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৭৫-এর একদলীয় বাকশাল গঠন করে বিচারবিভাগকে কার্যত: দলের শাখা সংগঠনে পরিণত করা হয়েছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তাকে একদলীয় ফ্যাসীবাদী ক্ষমতার উদরে বিলীন করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে রাজপথে লাঠিমিছিল পর্যন্ত বের করেছিল। বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাইকোর্টের বিচারিক রায়ের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর নির্দেশনায় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তি বসানোর মতো ঔদ্ধত্যও তারা দেখিয়েছিলেন। বিচার নিত্তিতে হাইকোর্টের বিচারকদের ‘বিব্রত' হবার ঘটনা নিয়ে তারা বিচারকদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানিমূলক কর্মসূচি নিয়েছে। আওয়ামী ঘরানার আইনজীবীদের উস্কানি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে বিচারিক পরিবেশ বিঘ্নিত করা হয়। বিচারকদের জামিন দানের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপসহ তাদের ওপর প্রশাসনিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দলীয় ফ্যাসীবাদী নৈরাজ্যের কাছে বিচার বিভাগকে নতি স্বীকার করতে আওয়ামী আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কক্ষের ওপর লাথি মারাসহ অবমাননাকর কার্যক্রম চালিয়েছেন। এসব আইনজীবীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। আদালতে মাস্তানী করা এসব আইনজীবী-বিচারবিভাগের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভূমিকা নিয়েও দলীয় বিবেচনায় শাস্তি বা মুচলেকা ছাড়াই মুক্তি পেয়েছেন।
এবারে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোট ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণে সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ংকর থাবা বিস্তার করে। কার্যত: বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে বন্দুকের নলের মাথায় অশুভ কাজে এবং রাজনীতিক-ব্যবসায়িক-নাগরিকদের নির্যাতনে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে নির্বাচিত সরকার বিচার বিভাগকে তার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে নগ্নভাবে ব্যবহার করে সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
বর্তমান সরকার তার এটর্নী জেনারেলের অফিস এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিচারপতিদের ওপর প্রভাব বিস্তার ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বিচার-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। সরকারের পক্ষে এটর্নী জেনারেলের অফিসের আইনী প্রক্রিয়া ও আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে প্রকাশ্য এজলাশে হাইকোর্ট বন্ধ করে দেবার কথা বলেছেন। বিচার বিভাগের বর্তমান দুর্গতি দেখে একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি দুঃখ করে বলেছেন: ‘‘বিচার বিভাগ কাচের ঘরে বন্দী হয়ে আছে।’’
এদিকে সরকার বিচার বিভাগকে ফ্যাসীবাদী রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে অযোগ্য, বিতর্কিত ও মামলার আসামীদেরও বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সম্প্রতি উচ্চআদালত সরকারের প্রতি রুল জারী করে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা সম্পর্কে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায়ের ভিত্তিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং বিচারবিভাগকে প্রশাসন তথা নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসীবাদী আচরণে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হতে বসেছে। ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতগুলোকেও মাসদার হোসেন মামলার রায় অনুযায়ী স্বাধীন ও বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোকে সরকার তার রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মিথ্যা-বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলায় যাকে তাকে গ্রেফতার এবং দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সহায়তা করাই যেন নিম্নআদালতের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ করা হচ্ছে যে, উচ্চআদালতের কোন নিয়ন্ত্রণ নিম্নআদালতে কার্যকর নেই। বরং সরকারই তার পুলিশী নির্যাতন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থে ম্যাজিস্ট্রেসী আদালতগুলোকে ব্যবহার করছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে।
বিচারিক প্রক্রিয়াকে সরকার দলীয় বিবেচনায় কত নোংরাভাবে প্রভাবিত করছে, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিগত সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক যেসব মামলায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জব্দ করা হয়েছিল, ঐসব মামলা থেকে বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চালু রেখে সরকার দলীয় নেতা-নেত্রী-কর্মীদের প্রায় সকল মামলা ঢালাওভাবে ক্ষমতার জোরে তুলে নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত তারা ১,৭৪৬টি মামলা প্রত্যাহার করে দিয়েছে, যার মধ্যে বিরোধীদলের মাত্র ২টি মামলা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সবকটি মামলা থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু একই সময়ে ও প্রক্রিয়ায় দায়ের করা বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুরনো মামলা ছাড়াও নতুন নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা সাজানোর পাঁয়তারা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া ও বিচার বিভাগের ওপর সরকারের অব্যাহত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাবার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেবার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এটাই ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের নমুনা। সরকারের এই হিংস্র ও নিপীড়নকারী-ফ্যাসীবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে একটি প্রবাহে, একই কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হবার মধ্য দিয়েই বিচারবিভাগের স্বাধীনতাসহ নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
Tuesday, 28 June 2011

মুজিবের বাকশাল আর নিজে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নীতি-নৈতিকতা পদদলিত করলেন তিনি
মুজিবের বাকশাল আর নিজে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নীতি-নৈতিকতা পদদলিত করলেন তিনি
দু'জন বিচারপতিকে সুপারসিড করে এবিএম খায়রুল হককে দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয় বর্তমান সরকার। তাঁর নিয়োগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যতটুকু না উত্তপ্ত ছিল তার থেকে অনেক বেশি উত্তপ্ত ও সরগরম ছিল সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ। তাও মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কারণ অধিকাংশ রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর সমাধান এ সময় আদালতই নিত্তি করেছে। ফলে আদালতই হয়ে ওঠে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। যদিও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তা কারোই কাম্য নয়। তা ছাড়া এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতির দিকও কম নয়। প্রতিটি নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। আর রাজনৈতিক ইস্যুগুলোই যখন আদালত সমাধানের উদ্যোগ নেয় তখন স্বভাবতই সমালোচনার মুখে পড়ে আদালত। এদিক থেকে অবশ্য জনাব হকের জুড়ি তিনি নিজেই।
অথচ এই বিতর্কের জন্য রয়েছে সংসদ। কিন্তু সেইরকম অনেকগুলো মামলার রায় হয়েছে প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হকের সময়ে। এই বিচারপতিকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই এবং আপাতদৃষ্টিতে সহজে থামারও কোন সম্ভাবনা নেই। বরং ক্রমান্বয়ে দেশ সংঘাতমুখী হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যতগুলো জটিল মামলার রায় দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই তিনি অনেক দুঃসাহসিক মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো ঝুঁকি তিনি দেশ, জাতি ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়েছেন, নাকি প্রধান উপদেষ্টার পদটি গ্রহণ করার জন্য- সেই প্রশ্নটি এখন সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে প্রধান উপদেষ্টা যেই হোক না কেন জনাব হক যে এই মহান দায়িত্বের জন্য নৈতিকভাবে অযোগ্য এটি এখন দেশের মানুষ কারোই অজানা নয়। এখন রায় সংসদের মাধ্যমে বাতিল না করলে পরিস্থিতি অনেক জটিল হবে। আর যিনি এতগুলো সংকটের নেতৃত্ব দিলেন তাঁর ব্যাপারে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের মতো বিচারপতি শতাব্দীতে একজনই জন্মান। খায়রুল হক ছিলেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অন্যতম কান্ডারি।
আমি এটর্নি জেনারেল সাহেবের কথাকে একটু শুধরিয়ে বলবো, বিচারপতি হক বিচার বিভাগকে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করাননি, বরং জনাব হক প্রত্যেকটি মামলার রায় আওয়ামী লীগ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অন্যতম কান্ডারিই শুধু নয়; দিকপাল হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। আমি মনে করি বিচারপতি হক যদি এমন ভূমিকা না রাখেন তাহলে দু'জন বিচারপতিকে সুপারসিড করে তাঁকে প্রধান বিচারপতি করে আওয়ামী লীগের লাভ কী? এই আনুগত্যপরায়ণ মানুষ আওয়ামী লীগের সমপরিমাণ আর কোন রাজনৈতিক দলেই নেই। তিনি ১০০% দলীয় আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এদিক থেকে অবশ্য জনাব হক মোবারকবাদ পাবার যোগ্য। বিএনপি এইদিক থেকে অনেক পেছনের সারিতে অবস্থান করছে। যদি আওয়ামী লীগের মতো দলীয় আনুগত্যপরায়ণ আরও কিছু মানুষ এ দলে থাকতো তাহলে বিএনপির এ জনসমর্থন নিয়ে তাদের ভাগ্য আজ অন্যভাবে লেখা হতো।
বিচারপতি হকের মতো এত বিতর্কিত ও সংঘাতমুখী রায় আর কেউ দিয়েছেন কিনা তা আইনজীবীরাই ভাল বলতে পারবেন। যেমন : তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলা, ৫ম সংশোধনীর রিভিউ'র (পর্যালোচনার) মামলা, ৭ম সংশোধনীর মামলা, ফতোয়ার মামলা, ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অব্যাহতি প্রদানের মামলা, খালেদা জিয়ার বাড়ির মামলাসহ সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলাগুলো বিশেষ উদ্দেশে নিজ ইচ্ছায় তিনি আগে নিত্তি করেছেন। তা ছাড়া সরকারের বিপক্ষে সোচ্চার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষে স্টে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপানোর পর পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের জেল ও একলাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের সাজা দেন। একলাখ টাকা জরিমানার বিধান আইনে না থাকলেও এটা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মনে করেন আইনজীবীরা। দেশের ১৮তম প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম সরকারের নিয়োগ দেয়া হাইকোর্টের দু'জন বিতর্কিত অস্থায়ী বিচারপতিকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত ছিলেন। কারণ হিসেবে ওই দু'জন বিচারপতির মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কক্ষে লাথিমারা ও ভাংচুর চালানোর অভিযোগ এবং অপরজন রাবিতে শিবির নেতার খুনের মামলার আসামী ছিলেন। জনাব হক গত বছর ১ অক্টোবর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ওই দু'জন বিচারপতির শপথ পড়ান।
এছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে এবিএম খায়রুল হক ২০০৯ সালে জনস্বার্থের একটি মামলায় জিয়াউর রহমানের স্থলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছেন। এ ধরনের রায়কে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন আইনজীবীরা। এ রায়ের মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু জাতির জনক। তিনি কখনোই স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না। জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।’’
২০০৫ সালে তিনি ৫ম সংশোধনী বাতিল করে ওই রায় দেন। পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণার রায় বহাল রেখে গেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, বঙ্গবন্ধু যেখানে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন সেই স্থানের সংরক্ষণ, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের স্থান সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থান সংরক্ষণের রায়ও তিনি দিয়ে গেছেন। এতসব রায় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হয় বলে মনে করা হয়।
কিন্তু তার বিদায়ের মাত্র কিছু আগে রাজধানীর কাকরাইলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের জন্য বহুতল বাসভবন ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মধ্যে যে বাদানুবাদ হয়েছে তা যেন পূর্ববর্তী সকল সন্দেহ সত্য প্রমাণের সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন তিনি।
আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে বললেন ‘‘২০০৭ সালের নবেম্বরে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু তাতে বিচারের কাজে মোটেও অগ্রগতি হয়নি’’। এরপর আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে হক বলেন, ‘তিনি কি জানেন, চারজন ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি কোর্ট ব্যবহার করতে হয়? এর উত্তর কে দেবে? আমরা স্বাধীন হয়েছি, কী রকম স্বাধীন? আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে। এ রকম স্বাধীন আমরা হয়েছি! কাজেই মাননীয় আইনমন্ত্রী আপনার ঘর আগে সামাল দেন।’’ প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর এই বাদানুবাদের সময় অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধান অতিথির চেয়ারে বসা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পাঠকবৃন্দ লেখার কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে আমি বাদানুবাদ বিস্তারিত উল্লেখ করলাম না। তাহলে এই প্রশ্ন যদি স্বয়ং আইনমন্ত্রীর আর জনাব হকের বাদানুবাদের ভাষা হয় এমন, তাহলে আমাদের জনসাধারণের আর কী বলার আছে? তাহলে এখন কি জনমনে প্রধান বিচারপতি হকের রায় নিয়ে প্রশ্ন আসবে না? তিনি কি তাহলে কারো রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন? ‘‘আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে’’। কথাগুলো যেন তাঁর অনেক অর্জনকেই ম্লান করেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে বিরোধীদল থেকে তাহলে হাত-পা বাঁধা বিচারপতির রায় কতটুকু স্বাধীন ও কার্যকর। তাহলে তিনি কতটুকু যোগ্য ও সাহসী ?
জনাব হক আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলার সময় তাঁকে অনেক ক্ষুব্ধ মনে হয়েছে। অথচ বিচারপতিরা যখন শপথ নেন তখন বলেন, আমি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছুই করবো না। আইনজীবীদের মতে, তিনি এ শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি বিশেষ উদ্দেশে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিচারপতি যারা নিরপেক্ষভাবে রায় দিতেন, সরকারের বিপক্ষে রায় দিতেন তাদের বেঞ্চ ভেঙে দিতেন। তিনি জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ বিচারপতিদের মূল্যায়ন না করে জুনিয়র বিচারপতিদের গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চের দায়িত্ব পালন করতে দিতেন। যার ফলে শুধু বিচারপ্রার্থীরাই নয়, আইনজীবীরাও ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর এরকম শপথ ভঙ্গকারী ব্যক্তি কি প্রধান উপদেষ্টার জন্য যোগ্য হতে পারেন? যিনি আদালতে ন্যায়বিচার করতে পারলেন না তিনি ষোল কোটি মানুষের জিম্মাদারি পালন করতে পারবেন কি?
ন্যায়বিচার করার শপথ নিয়ে যিনি বিচারকের আসনে বসেন তাঁর দায়িত্ব কত কঠিন-জটিল তা কি আমাদের অনেক বিচারকই উপলব্ধি করেন না। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন, ৬৫ বছরের নফল ইবাদত অপেক্ষা একটি ন্যায়বিচার শ্রেষ্ঠ। ‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আউফা (র.) বলেন, রাসুূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকার্যে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্ধ্বে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায়।’’ (তিরমিযী, ইবনে মাযা) ‘‘হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ’’ (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ন্যায়বিচারক কেয়ামতের দিন এই আকাঙ্ক্ষা করবেন যে, দু'ব্যক্তির মধ্যে সামান্য খেজুরের ফয়সালাও যদি তাকে পৃথিবীতে না করতে হতো, তবে কতই না ভাল হতো।’’ (মুসনাদে আহমদ) এই চেতনা নিয়ে আদালত বিচার করতো তাহলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো কি?
আজ সর্বস্তরের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালতও বিতর্কিত হতে শুরু করেছে। বিরোধী পক্ষ একদিকে বিতর্কিত রায় ও দলীয়করণের অভিযোগ এনে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করছে এবং জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনকেও স্বাগত জানায়নি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি। বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে না মানার ঘোষণাও দিয়েছে বিরোধীদল বিএনপি। তাহলে আমরা কি আবার কেএম হাসানকে কেন্দ্র করে যেমনি ২৮ অক্টোবর রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে আওয়ামী লীগ মানুষ হত্যা করেছে সেই ভয়াবহতার দিকেই রওয়ানা হয়েছি? রাজনীতির এ খেলা বন্ধ হবে কবে?
রাজনীতির কালোছায়া আজ যেন আমাদের বিচার বিভাগকেও বিতর্কিত করছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিবিদদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে উচ্চ আদালতকেই গণ্য করা হতো। অনেক সমস্যা ও সংকটের পরও আটক অবস্থায় দুই নেত্রী ও দেশের রাজনীতিবিদরা উচ্চ আদালতেই গিয়েছিলেন। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর বাড়াবাড়ির কারণে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষের আর দাঁড়ানোর জায়গাটুকু থাকবে কি? আমরা দেশের আইন বিশেষজ্ঞদের, রাজনীতিবিদদের নিকট থেকে আবারও আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আবারও লগি-বৈঠা আর রাজপথে মানুষের রক্ত আর গোলাবারুদের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি। তাহলে এর সকল দায়দায়িত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সাহেব বহন করবেন কি? জনাব হক সবার শাসন অবৈধ ঘোষণা করে নিজের শাসন পাকা করার স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে তো?
জনাব হকের সময়কে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘‘সবচেয়ে খারাপ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ড কাম্য নয়।
ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলোর দূরদর্শিতা এবং আইনজীবীদের বিচক্ষণতার অভাবে হঠাৎ করে চরম অবস্থানের তৈরি হয়েছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষের অকল্যাণই হবে।’’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘‘সুপ্রিমকোর্টে রাজনৈতিক মেরুকরণ আগেও ছিল, বর্তমানে এটা চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। এজন্য সব দলই কমবেশি দায়ী’’। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘‘তিনি তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণের উপকারের পরিবর্তে দেশে সাংবিধানিক সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে গেছেন। এসব কর্মকান্ডের জন্য একদিন তাকে জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’’
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি সুপ্রিমকোর্টকে রাজনৈতিক দল ও সরকার এবং পার্লামেন্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি একটি রায়ের মাধ্যমে দিতে হবে-এটা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। জাতীয় পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘‘আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রত্যাশায় বিদায়ী প্রধান বিচারপতি আদালতের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে গেছেন। তিনি ইতিহাসে বিতর্কিত ও খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।’’
আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা এবিএম খায়রুল হক বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সর্বশেষ কর্মদিবসটিও শেষ করলেন আওয়ামী লীগের কল্যাণে। জনাব হক মুখে বিচার বিভাগের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির ব্যাপারে সোচ্চার থাকার কথা বললেও আপিল বিভাগে ১০ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন থাকলেও এ ব্যাপারে তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি।
যেসব রাজনৈতিক রায়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে তিনি সংবিধানরক্ষাকর্তা বীরবিচারক ও শতাব্দীর সেরা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দলটির প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করার জন্য সংবিধানের যেই সংশোধন করেছিলেন- সেই চতুর্থ সংশোধনটির গা বাঁচিয়ে অন্যান্য প্রায় সব সংশোধনীকে আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা করতে জনাব হকের অবদান অনন্য ও অবিস্মরণীয়। জনাব হক বাংলাদেশের দীর্ঘ ৩৫ বছরের শাসন অবৈধ ঘোষণা করলেন শেখ মুজিবের বাকশালকে নিরাপদ রেখে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ করলেন কিন্তু নিজের জন্য প্রধান উপদেষ্টার পথটি নিরাপদ খোলা রেখে। সত্যিই বলতে হয় জনাব এবিএম খায়রুল হকের তুলনা ইতিহাস তিনি নিজেই। এক সময় ইতিহাসই তার বিচার করবে, ঠিক করবে ইতিহাসে তার অবস্থান।
শেষ কর্মদিবসে তার উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে (ট্রুথ কমিশন) অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখা এবং পঞ্চাশজন বিচারকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে আপিল বিভাগে সরকারের নিয়োগ দেয়া দুই বিচারকের শপথদান। যাদের মধ্যে একজন বিচারক একসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গোপালগঞ্জ জেলার সভাপতি ছিলেন। এর আগেও সরকার কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত দু'জন বিচারক যাদের একজন সুপ্রিমকোর্টে একটি ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং আরেকজন একটি দন্ডযোগ্য হত্যা মামলার অভিযুক্ত ছিলেন- এমন দুই বিচারককে শপথ দিয়েছিলেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি।
সর্বশেষ গত ১১ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে তার দেয়া রায়ে বেসিক স্ট্রাকচার তত্ত্বানুযায়ী তিনি একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অন্যদিকে আগামী দুইটি সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনীয় বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেই প্রয়োজনীয়তার মতবাদ দেখিয়ে। অর্থাৎ তারই দেয়া রায় অনুযায়ী ‘অসাংবিধানিক' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পথ খোলা রাখলেন শুধুমাত্র নিজের জন্য। যার মধ্যে প্রথমবার এই অনির্বাচিত সরকারের প্রধান হওয়ার সুযোগটি পাচ্ছেন জনাব এবিএম খায়রুল হক নিজেই।
অবশ্য সুযোগটি তিনি নিজে একাকী তৈরি করতে পারেননি। সরকার জনাব হকের প্রতি উপহার স্বরূপ আবারো সুপারসিডের পথ অনুসরণ করলেন? জনাব হকের উত্তরসূরী হিসেবে যদি জ্যেষ্ঠ বিচারক শাহ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে যথানিয়মে নিয়োগ দেয়া হতো তবে জনাব রহমানই হতেন আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কারণ, সেক্ষেত্রে জনাব হক নন, বরং জনাব রহমানই হতেন আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। কাজেই আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু জনাব রহমানের জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে রাষ্ট্রপতি একজন কনিষ্ঠ বিচারককে ২০তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেই আশঙ্কা বা সম্ভাবনা দূর করেছেন। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি জনাব মোঃ মোজাম্মেল হোসেন অবসর নেবেন ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। ফলে সর্বশেষ আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে প্রধান বিচারপতি হিসেবে সবশেষে অবসর নেয়া জনাব হকই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ পেতে যাচ্ছেন?
একই সাথে এই তত্ত্ব ও মতবাদের যুগলে আগামীতে যে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এখন মনে হচ্ছে জনাব হক এক লাঠিতে অনেক সাপ মারলেন কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেননি। আওয়ামী লীগের নিকট এখন জনাব হক সাহেবের সকল রায় ও সমীকরণ পক্ষে মনে হলেও একসময় দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির নায়ক হিসেবে জনাব হককে জাতি চিহ্নিত করার সম্ভাবনাও কি উড়িয়ে দেয়া যায়? সংসদকে পাশ কাটিয়ে জনাব হকের এত অতি উৎসাহী রায়কে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতারাই পছন্দ করছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণে জনাব হক যদি প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন, তাহলে গ্রাম্য প্রবাদ ‘‘আমও গেল ছালাও গেল’’ সেই প্রবাদই কি জনাব হকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে?
অথচ এই বিতর্কের জন্য রয়েছে সংসদ। কিন্তু সেইরকম অনেকগুলো মামলার রায় হয়েছে প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হকের সময়ে। এই বিচারপতিকে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই এবং আপাতদৃষ্টিতে সহজে থামারও কোন সম্ভাবনা নেই। বরং ক্রমান্বয়ে দেশ সংঘাতমুখী হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যতগুলো জটিল মামলার রায় দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই তিনি অনেক দুঃসাহসিক মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো ঝুঁকি তিনি দেশ, জাতি ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়েছেন, নাকি প্রধান উপদেষ্টার পদটি গ্রহণ করার জন্য- সেই প্রশ্নটি এখন সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহলে প্রধান উপদেষ্টা যেই হোক না কেন জনাব হক যে এই মহান দায়িত্বের জন্য নৈতিকভাবে অযোগ্য এটি এখন দেশের মানুষ কারোই অজানা নয়। এখন রায় সংসদের মাধ্যমে বাতিল না করলে পরিস্থিতি অনেক জটিল হবে। আর যিনি এতগুলো সংকটের নেতৃত্ব দিলেন তাঁর ব্যাপারে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের মতো বিচারপতি শতাব্দীতে একজনই জন্মান। খায়রুল হক ছিলেন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অন্যতম কান্ডারি।
আমি এটর্নি জেনারেল সাহেবের কথাকে একটু শুধরিয়ে বলবো, বিচারপতি হক বিচার বিভাগকে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করাননি, বরং জনাব হক প্রত্যেকটি মামলার রায় আওয়ামী লীগ স্বর্ণযুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে অন্যতম কান্ডারিই শুধু নয়; দিকপাল হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। আমি মনে করি বিচারপতি হক যদি এমন ভূমিকা না রাখেন তাহলে দু'জন বিচারপতিকে সুপারসিড করে তাঁকে প্রধান বিচারপতি করে আওয়ামী লীগের লাভ কী? এই আনুগত্যপরায়ণ মানুষ আওয়ামী লীগের সমপরিমাণ আর কোন রাজনৈতিক দলেই নেই। তিনি ১০০% দলীয় আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এদিক থেকে অবশ্য জনাব হক মোবারকবাদ পাবার যোগ্য। বিএনপি এইদিক থেকে অনেক পেছনের সারিতে অবস্থান করছে। যদি আওয়ামী লীগের মতো দলীয় আনুগত্যপরায়ণ আরও কিছু মানুষ এ দলে থাকতো তাহলে বিএনপির এ জনসমর্থন নিয়ে তাদের ভাগ্য আজ অন্যভাবে লেখা হতো।
বিচারপতি হকের মতো এত বিতর্কিত ও সংঘাতমুখী রায় আর কেউ দিয়েছেন কিনা তা আইনজীবীরাই ভাল বলতে পারবেন। যেমন : তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলা, ৫ম সংশোধনীর রিভিউ'র (পর্যালোচনার) মামলা, ৭ম সংশোধনীর মামলা, ফতোয়ার মামলা, ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অব্যাহতি প্রদানের মামলা, খালেদা জিয়ার বাড়ির মামলাসহ সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলাগুলো বিশেষ উদ্দেশে নিজ ইচ্ছায় তিনি আগে নিত্তি করেছেন। তা ছাড়া সরকারের বিপক্ষে সোচ্চার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘চেম্বার জজ মানেই সরকার পক্ষে স্টে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপানোর পর পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের জেল ও একলাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের সাজা দেন। একলাখ টাকা জরিমানার বিধান আইনে না থাকলেও এটা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মনে করেন আইনজীবীরা। দেশের ১৮তম প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম সরকারের নিয়োগ দেয়া হাইকোর্টের দু'জন বিতর্কিত অস্থায়ী বিচারপতিকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত ছিলেন। কারণ হিসেবে ওই দু'জন বিচারপতির মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কক্ষে লাথিমারা ও ভাংচুর চালানোর অভিযোগ এবং অপরজন রাবিতে শিবির নেতার খুনের মামলার আসামী ছিলেন। জনাব হক গত বছর ১ অক্টোবর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ওই দু'জন বিচারপতির শপথ পড়ান।
এছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে এবিএম খায়রুল হক ২০০৯ সালে জনস্বার্থের একটি মামলায় জিয়াউর রহমানের স্থলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছেন। এ ধরনের রায়কে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন আইনজীবীরা। এ রায়ের মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুকে খাটো করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু জাতির জনক। তিনি কখনোই স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না। জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক।’’
২০০৫ সালে তিনি ৫ম সংশোধনী বাতিল করে ওই রায় দেন। পাশাপাশি প্রধান বিচারপতি থাকাকালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণার রায় বহাল রেখে গেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, বঙ্গবন্ধু যেখানে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন সেই স্থানের সংরক্ষণ, পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের স্থান সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থান সংরক্ষণের রায়ও তিনি দিয়ে গেছেন। এতসব রায় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হয় বলে মনে করা হয়।
কিন্তু তার বিদায়ের মাত্র কিছু আগে রাজধানীর কাকরাইলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের জন্য বহুতল বাসভবন ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের মধ্যে যে বাদানুবাদ হয়েছে তা যেন পূর্ববর্তী সকল সন্দেহ সত্য প্রমাণের সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন তিনি।
আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যে বললেন ‘‘২০০৭ সালের নবেম্বরে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু তাতে বিচারের কাজে মোটেও অগ্রগতি হয়নি’’। এরপর আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে হক বলেন, ‘তিনি কি জানেন, চারজন ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি কোর্ট ব্যবহার করতে হয়? এর উত্তর কে দেবে? আমরা স্বাধীন হয়েছি, কী রকম স্বাধীন? আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে। এ রকম স্বাধীন আমরা হয়েছি! কাজেই মাননীয় আইনমন্ত্রী আপনার ঘর আগে সামাল দেন।’’ প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর এই বাদানুবাদের সময় অনুষ্ঠানের মঞ্চে প্রধান অতিথির চেয়ারে বসা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পাঠকবৃন্দ লেখার কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে আমি বাদানুবাদ বিস্তারিত উল্লেখ করলাম না। তাহলে এই প্রশ্ন যদি স্বয়ং আইনমন্ত্রীর আর জনাব হকের বাদানুবাদের ভাষা হয় এমন, তাহলে আমাদের জনসাধারণের আর কী বলার আছে? তাহলে এখন কি জনমনে প্রধান বিচারপতি হকের রায় নিয়ে প্রশ্ন আসবে না? তিনি কি তাহলে কারো রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন? ‘‘আমাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেয়া হয়েছে’’। কথাগুলো যেন তাঁর অনেক অর্জনকেই ম্লান করেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে বিরোধীদল থেকে তাহলে হাত-পা বাঁধা বিচারপতির রায় কতটুকু স্বাধীন ও কার্যকর। তাহলে তিনি কতটুকু যোগ্য ও সাহসী ?
জনাব হক আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলার সময় তাঁকে অনেক ক্ষুব্ধ মনে হয়েছে। অথচ বিচারপতিরা যখন শপথ নেন তখন বলেন, আমি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছুই করবো না। আইনজীবীদের মতে, তিনি এ শপথ ভঙ্গ করেছেন। তিনি বিশেষ উদ্দেশে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ বিচারপতি যারা নিরপেক্ষভাবে রায় দিতেন, সরকারের বিপক্ষে রায় দিতেন তাদের বেঞ্চ ভেঙে দিতেন। তিনি জ্যেষ্ঠ, অভিজ্ঞ বিচারপতিদের মূল্যায়ন না করে জুনিয়র বিচারপতিদের গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চের দায়িত্ব পালন করতে দিতেন। যার ফলে শুধু বিচারপ্রার্থীরাই নয়, আইনজীবীরাও ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর এরকম শপথ ভঙ্গকারী ব্যক্তি কি প্রধান উপদেষ্টার জন্য যোগ্য হতে পারেন? যিনি আদালতে ন্যায়বিচার করতে পারলেন না তিনি ষোল কোটি মানুষের জিম্মাদারি পালন করতে পারবেন কি?
ন্যায়বিচার করার শপথ নিয়ে যিনি বিচারকের আসনে বসেন তাঁর দায়িত্ব কত কঠিন-জটিল তা কি আমাদের অনেক বিচারকই উপলব্ধি করেন না। অথচ মহানবী (সা.) বলেছেন, ৬৫ বছরের নফল ইবাদত অপেক্ষা একটি ন্যায়বিচার শ্রেষ্ঠ। ‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আউফা (র.) বলেন, রাসুূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকার্যে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্ধ্বে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায়।’’ (তিরমিযী, ইবনে মাযা) ‘‘হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ’’ (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ন্যায়বিচারক কেয়ামতের দিন এই আকাঙ্ক্ষা করবেন যে, দু'ব্যক্তির মধ্যে সামান্য খেজুরের ফয়সালাও যদি তাকে পৃথিবীতে না করতে হতো, তবে কতই না ভাল হতো।’’ (মুসনাদে আহমদ) এই চেতনা নিয়ে আদালত বিচার করতো তাহলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো কি?
আজ সর্বস্তরের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল উচ্চ আদালতও বিতর্কিত হতে শুরু করেছে। বিরোধী পক্ষ একদিকে বিতর্কিত রায় ও দলীয়করণের অভিযোগ এনে বিদায়ী প্রধান বিচারপতির কুশপুত্তলিকা দাহ করছে এবং জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনকেও স্বাগত জানায়নি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি। বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে না মানার ঘোষণাও দিয়েছে বিরোধীদল বিএনপি। তাহলে আমরা কি আবার কেএম হাসানকে কেন্দ্র করে যেমনি ২৮ অক্টোবর রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে আওয়ামী লীগ মানুষ হত্যা করেছে সেই ভয়াবহতার দিকেই রওয়ানা হয়েছি? রাজনীতির এ খেলা বন্ধ হবে কবে?
রাজনীতির কালোছায়া আজ যেন আমাদের বিচার বিভাগকেও বিতর্কিত করছে। ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনীতিবিদদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে উচ্চ আদালতকেই গণ্য করা হতো। অনেক সমস্যা ও সংকটের পরও আটক অবস্থায় দুই নেত্রী ও দেশের রাজনীতিবিদরা উচ্চ আদালতেই গিয়েছিলেন। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর বাড়াবাড়ির কারণে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষের আর দাঁড়ানোর জায়গাটুকু থাকবে কি? আমরা দেশের আইন বিশেষজ্ঞদের, রাজনীতিবিদদের নিকট থেকে আবারও আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আবারও লগি-বৈঠা আর রাজপথে মানুষের রক্ত আর গোলাবারুদের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি। তাহলে এর সকল দায়দায়িত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সাহেব বহন করবেন কি? জনাব হক সবার শাসন অবৈধ ঘোষণা করে নিজের শাসন পাকা করার স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে তো?
জনাব হকের সময়কে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘‘সবচেয়ে খারাপ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ড কাম্য নয়।
ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলোর দূরদর্শিতা এবং আইনজীবীদের বিচক্ষণতার অভাবে হঠাৎ করে চরম অবস্থানের তৈরি হয়েছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষের অকল্যাণই হবে।’’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘‘সুপ্রিমকোর্টে রাজনৈতিক মেরুকরণ আগেও ছিল, বর্তমানে এটা চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। এজন্য সব দলই কমবেশি দায়ী’’। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘‘তিনি তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনগণের উপকারের পরিবর্তে দেশে সাংবিধানিক সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে গেছেন। এসব কর্মকান্ডের জন্য একদিন তাকে জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’’
সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি সুপ্রিমকোর্টকে রাজনৈতিক দল ও সরকার এবং পার্লামেন্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক স্বীকৃতি একটি রায়ের মাধ্যমে দিতে হবে-এটা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। জাতীয় পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘‘আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রত্যাশায় বিদায়ী প্রধান বিচারপতি আদালতের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে গেছেন। তিনি ইতিহাসে বিতর্কিত ও খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।’’
আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা এবিএম খায়রুল হক বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সর্বশেষ কর্মদিবসটিও শেষ করলেন আওয়ামী লীগের কল্যাণে। জনাব হক মুখে বিচার বিভাগের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির ব্যাপারে সোচ্চার থাকার কথা বললেও আপিল বিভাগে ১০ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন থাকলেও এ ব্যাপারে তিনি কোন ব্যবস্থা নেননি।
যেসব রাজনৈতিক রায়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে তিনি সংবিধানরক্ষাকর্তা বীরবিচারক ও শতাব্দীর সেরা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। দলটির প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করার জন্য সংবিধানের যেই সংশোধন করেছিলেন- সেই চতুর্থ সংশোধনটির গা বাঁচিয়ে অন্যান্য প্রায় সব সংশোধনীকে আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা করতে জনাব হকের অবদান অনন্য ও অবিস্মরণীয়। জনাব হক বাংলাদেশের দীর্ঘ ৩৫ বছরের শাসন অবৈধ ঘোষণা করলেন শেখ মুজিবের বাকশালকে নিরাপদ রেখে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ করলেন কিন্তু নিজের জন্য প্রধান উপদেষ্টার পথটি নিরাপদ খোলা রেখে। সত্যিই বলতে হয় জনাব এবিএম খায়রুল হকের তুলনা ইতিহাস তিনি নিজেই। এক সময় ইতিহাসই তার বিচার করবে, ঠিক করবে ইতিহাসে তার অবস্থান।
শেষ কর্মদিবসে তার উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনকে (ট্রুথ কমিশন) অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখা এবং পঞ্চাশজন বিচারকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে আপিল বিভাগে সরকারের নিয়োগ দেয়া দুই বিচারকের শপথদান। যাদের মধ্যে একজন বিচারক একসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গোপালগঞ্জ জেলার সভাপতি ছিলেন। এর আগেও সরকার কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত দু'জন বিচারক যাদের একজন সুপ্রিমকোর্টে একটি ভাংচুরের ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং আরেকজন একটি দন্ডযোগ্য হত্যা মামলার অভিযুক্ত ছিলেন- এমন দুই বিচারককে শপথ দিয়েছিলেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি।
সর্বশেষ গত ১১ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে তার দেয়া রায়ে বেসিক স্ট্রাকচার তত্ত্বানুযায়ী তিনি একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অন্যদিকে আগামী দুইটি সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজনীয় বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সেই প্রয়োজনীয়তার মতবাদ দেখিয়ে। অর্থাৎ তারই দেয়া রায় অনুযায়ী ‘অসাংবিধানিক' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পথ খোলা রাখলেন শুধুমাত্র নিজের জন্য। যার মধ্যে প্রথমবার এই অনির্বাচিত সরকারের প্রধান হওয়ার সুযোগটি পাচ্ছেন জনাব এবিএম খায়রুল হক নিজেই।
অবশ্য সুযোগটি তিনি নিজে একাকী তৈরি করতে পারেননি। সরকার জনাব হকের প্রতি উপহার স্বরূপ আবারো সুপারসিডের পথ অনুসরণ করলেন? জনাব হকের উত্তরসূরী হিসেবে যদি জ্যেষ্ঠ বিচারক শাহ আবু নাইম মোমিনুর রহমানকে যথানিয়মে নিয়োগ দেয়া হতো তবে জনাব রহমানই হতেন আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কারণ, সেক্ষেত্রে জনাব হক নন, বরং জনাব রহমানই হতেন আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। কাজেই আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু জনাব রহমানের জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে রাষ্ট্রপতি একজন কনিষ্ঠ বিচারককে ২০তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেই আশঙ্কা বা সম্ভাবনা দূর করেছেন। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি জনাব মোঃ মোজাম্মেল হোসেন অবসর নেবেন ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। ফলে সর্বশেষ আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে প্রধান বিচারপতি হিসেবে সবশেষে অবসর নেয়া জনাব হকই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ পেতে যাচ্ছেন?
একই সাথে এই তত্ত্ব ও মতবাদের যুগলে আগামীতে যে রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এখন মনে হচ্ছে জনাব হক এক লাঠিতে অনেক সাপ মারলেন কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেননি। আওয়ামী লীগের নিকট এখন জনাব হক সাহেবের সকল রায় ও সমীকরণ পক্ষে মনে হলেও একসময় দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির নায়ক হিসেবে জনাব হককে জাতি চিহ্নিত করার সম্ভাবনাও কি উড়িয়ে দেয়া যায়? সংসদকে পাশ কাটিয়ে জনাব হকের এত অতি উৎসাহী রায়কে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতারাই পছন্দ করছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণে জনাব হক যদি প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন, তাহলে গ্রাম্য প্রবাদ ‘‘আমও গেল ছালাও গেল’’ সেই প্রবাদই কি জনাব হকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে?
Thursday, 2 June 2011

সমঝোতার সূত্র
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের রায়ের পর দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পয়েন্ট অব নো রিটার্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করছিল। আওয়ামী লীগের তরফে বলা হচ্ছিল, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে এ ব্যবস্থা বহাল রাখার সুযোগ নেই। অপরদিকে বিরোধী দল অনড় প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণ করায় সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত সময়ের পৌনে তিন বছর আগেই রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগে দেশ প্রবেশ করল বলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। তবে দুটি দলের সর্বশেষ অবস্থান পর্যালোচনা করলে টানেলের অপর প্রান্তে খানিকটা আশার আলো হয়তো দৃশ্যমান। বিএনপি ১২ ও ১৩ জুনের হরতালের পর আরও হরতাল ও লংমার্চের কর্মসূচি প্রদানের ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে এসেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন গত ১৬ জুন বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ কী হবে, কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন এবং নির্বাচন কমিশনের প্রধান কে হবেন_ এসব বিষয় নিয়ে তার দল সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনায় রাজি। আমরা এ অবস্থানকে স্বাগত জানাই। দেশবাসীও এ ধরনের অবস্থানে স্বস্তিবোধ করবে। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত আওয়ামী লীগ'_ শুক্রবার এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রদত্ত এ অভিমতকে বিএনপির সর্বশেষ অবস্থানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আশার আলোর শিখা আরও কিছুটা উজ্জ্বল হলো বলেও আমরা ধরে নিতে পারি। সংবিধান সংশোধন কিংবা এ ধরনের যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেই আলোচনা সর্বোত্তম উপায় বলে আমরা মনে করি। সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে তারা জাতীয় সংসদের হাতেই নির্বাচনকালীন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের ভার অর্পণ করেছেন। আদালতের রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশিত হলে বিষয়টি সম্পর্কে সংসদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিএনপিকে তাদের অভিমত তুলে ধরার জন্য সংসদেই যেতে হবে। ১৯৯৬ সালে সফল অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা আপারহ্যান্ড পেলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদেই গৃহীত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে যে নেপথ্যে রাজনৈতিক সমঝোতাও কাজ করেছিল সেটা স্পষ্ট। এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেই সেটা রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতি আনতে পারে না। জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে জাতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, যা আদালতে নাকচ হয়ে গেছে। বিচারকদের বয়স দুই বছর বাড়ানোর জন্য সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল জাতীয় সংসদেই। কিন্তু এর পরিণতিতে রাজনৈতিক অঙ্গন অশান্ত হয়ে উঠেছিল এবং এর মূল খেসারত দিতে হয় তার উদ্যোক্তা দল বিএনপিকেই। নিকট অতীতের এসব অভিজ্ঞতা সব পক্ষই বিবেচনায় রাখবে বলে আমরা আশা করি। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে কতটা অপরিহার্য সেটাও সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং দলীয় মুখপাত্র। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। বিএনপিও রাজপথ উত্তপ্ত করার পরিবর্তে সমঝোতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, এটাই কাম্য। এ ধরনের মনোভাব থাকলে সমঝোতার সূত্র মিলবেই।
Saturday, 28 May 2011

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য
দেশে ক্রমশ প্রশাসনিক নৈরাজ্যের কালোছায়া বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রতি রাজনৈতিক প্রশ্রয় ও মমত্ববোধ প্রশাসনিক শৃক্মখলা ও আইনের শাসনকে বিকল করে দিতে শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে, সরকার প্রশাসনিক পর্যায়ে বা রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় সন্ত্রাসের দানবদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিস্তার শুধু সামাজিক ও প্রশাসনিক শৃক্মখলাকেই বিকল করে দেয়নি। এর কালোথাবা শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষা-প্রশাসনকেও গ্রাস করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘দৈনিক সংগ্রাম' গত মঙ্গলবার ‘শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মুখোমুখি ছাত্রলীগের দু'গ্রুপ যেকোন মুহূর্তে সংঘর্ষের আশঙ্কা' শীর্ষক একটি উদ্বেগজনক খবর প্রকাশ করেছে। এদিকে মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় ক্ষমতাসীন শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ হস্তক্ষেপ করার ফলে ওই কলেজে তিনদিন ধরে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের তান্ডবে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রলীগের তান্ডব এখন আর প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনসমূহের ওপর আধিপত্য বিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি, হল দখল, মাদক ব্যবসা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং টেকনিক্যাল-মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে শুরু করেছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ, সাধারণ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও ফলাফল ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এসব ক্যাডার ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কমান্ডে চলছে। অন্যদিকে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়োগে পেশাগত দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার বদলে দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেয়ায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অধ্যক্ষ-ভিসি কিংবা শিক্ষা-প্রশাসক সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ সদস্যদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন শৃক্মখলাভঙ্গের ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তি যেভাবে তার রাজনৈতিক নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন, একইভাবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররাও সরকারের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় ও আস্কারা পেয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, ঢাকার মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ নিয়ে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপ সংঘর্ষের অবস্থায় উপনীত হয়েছে। যদিও এসব কোন ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের এখতিয়ারে পড়ে না। ছাত্ররা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার জন্য যায়। সেখানে তাদের সুষ্ঠুভাবে একাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে অধ্যয়নকেই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান করা উচিত। কিন্তু কোন শিক্ষার্থী যখন রাজনৈতিক মাস্তানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে পদদলিত করে নিজেরাই বিকল্প প্রশাসক হয়ে ওঠে, তখন সেখানে শিক্ষার কোন পরিবেশ থাকে না। মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের উপ-অধ্যক্ষের পদে কে বসবেন সেটা নির্ধারণ করবে কলেজের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ। এজন্য চলমান বিধি অনুযায়ী ন্যায়ত ও আইনত যার নিযুক্তি পাওয়া উচিত, সেটাই কার্যকর হওয়া দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হস্তক্ষেপেই করছে না। একপক্ষ অন্যপক্ষের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সংঘাতময় অবস্থা তৈরি করেছেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের সন্ত্রাস ও গুন্ডামী করার স্থান হতে পারে না। সরকার প্রশ্রয় না দিলে মেডিকেল কলেজের মতো স্পর্শকাতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা তাদের শিক্ষাজীবনের ওপর কলঙ্কিত ঝুঁকি নেবার মতো অরাজকতায় লিপ্ত হতে পারে না। মিটফোর্ড হাসপাতালে উপ-অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের মাঝে সংঘাতের আশঙ্কা আইনের শাসন ও প্রশাসনিক শৃক্মখলার চরম অবনতির ইঙ্গিত।
উল্লেখ্য, এর আগে সরকারের লালিত ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সন্ত্রাসের তান্ডবে বহু ছাত্রের জীবনহানি ছাড়াও শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে মূল্যবান শিক্ষাবর্ষ খসে পড়েছে। অনেকে মনে করেন, বড় বড় কলেজ, মেডিকেল, টেকনিক্যাল কলেজসহ পাবলিক ইউনিভার্সিটিসমূহে অশান্তি ও নৈরাজ্য জিইয়ে রাখা সরকারের অশুভ ইচ্ছার পরিণতি। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য জিইয়ে রেখে সরকার তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গণআন্দোলন থেকে ছাত্রদের দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও টেকনিক্যাল শিক্ষাক্ষেত্রে একটা নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি করে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বিদেশে, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতে যেতে বাধ্য করতে চায়। তবে কোনভাবেই এই নৈরাজ্যকর অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শান্তিকামী সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নিজেরাও যেমন পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চায় না, তেমনি মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও অধ্যয়ন করে নিজস্ব যোগ্যতায় ডাক্তার হতে দিতে চায় না। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও যারা সরকারি ছাত্রসংগঠনের ক্যাডার-লাঠিয়াল পরিচয়ে পড়াশোনা ছাড়াই ডিগ্রি অর্জন করে ভালো পদ-পদবী পাবার আশা করতে পারে, তবে তারা পড়ালেখা বাদ রেখে কেন হাঙ্গামা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে না? আওয়ামী লীগ সরকারের প্রকট দলবাজি ইতোমধ্যে দেশকে একটা দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে জাতির আর একটি জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সামাজিক শক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের সচেতন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসতে হবে।
Saturday, 21 May 2011

এ কোন আজব দুনিয়ায় বাস করছি।
আমরা বর্তমানে এমন এক আজব দুনিয়ায় বাস করছি সেখানে সব কিছুরই আগেকার সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, মানবতা, মানবাধিকার সবকিছুই যেন একটা বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্নের সম্মুখীন। এতদিন আমরা জেনে এসেছি গণতন্ত্রে জনগণের রায়ই বড় কথা কিন্তু আলজেরিয়াতে আমরা কি দেখলাম? সেখানে কি জনগণের রায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল? জনগণের রায়ের প্রতি কি গুরুত্ব দেখানো হয়েছিল? হয়নি। কারণ আলজেরিয়ার মুসলিম জনগণ সেদিন তাদের আদর্শের পতাকাবাহী দল ‘ইসলামী স্যালভেশন ফ্রন্টে'র পক্ষে রায় দিয়েছিল পরাশক্তির আজ্ঞাবহ শক্তিকে উপেক্ষা করে। পরাশক্তির কাছে সে রায় পছন্দ হলো না। অতএব, সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের ডঙ্কা বাজিয়ে মহা মহা বুলি কপচালেও গণতন্ত্রের পরাশক্তি একচোখা দৈত্যের মতো জগদ্দল পাথর হয়ে আলজেরিয়ার মুসলিম জনগণের উপর চেপে বসেছিল। আলজেরিয়ার সামরিক নেতাদের সাথে বৈঠক করে বিদেশ থেকে নেতা হায়ার করে এনে স্যালভেশন ফ্রন্টের উপর চালানো হয়েছিল নির্যাতনের স্টীম রোলার। এসব কিছুই করা হয়েছিল কেবলমাত্র জনগণের রায়কে ব্যর্থ করে দেবার অসদুদ্দেশ্যে। এক কথায় বলে দেয়া হয়েছিল আলজেরিয়ার জনগণ ইসলামী মৌলবাদী শক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে। প্রশ্ন এখানেই থেকে যায় যে, জনগণ ইসলামী আদর্শের পক্ষে রায় দিলে সেটা কি গণতন্ত্রসম্মত হবে না? গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই কি তাহলে পাল্টে গেল?
এভাবে বর্তমান দুনিয়ায় মানবতা আর মানবাধিকারের সংজ্ঞাও আর টিকে থাকতে পারছে কই। বসনিয়া-হারজেগোভিনা জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সার্বরা মুসলমানদের হত্যা করতে পারলো, নির্যাতন করতে পারলো, ধর্ষণ করতে পারলো। এতে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হলো না একটুও, আর মানবতাও ম্লান হলো না। পক্ষান্তরে, হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সে দেশের মুসলমানরা আত্মরক্ষার অধিকার পেলেই যেন মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়ে যেতো। তাই তো সভ্য জাতি বলে গর্বিত পশ্চিমা শক্তির ইঙ্গিতে মুসলমানদের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। এত কিছু করার পরও সেখানে মানবতা ও মানবাধিকার বিপণ্ণ হয়নি একটুও।
এক সময় বলা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে সমাজতন্ত্রের মৃত্যুডঙ্কা বাজার মধ্য দিয়ে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর মানবাধিকারের বিজয় সূচিত হয়েছে। সেদিন জোর গলায় বলা হয়েছিল, বর্তমানে মানবতা এক মহান সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো। কিন্তু বাস্তবে দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, কথাগুলো আদৌ সত্য নয়। কাশ্মীরের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ভারতীয় নরখাদক সশস্ত্র বাহিনী কাশ্মীরের অসহায় মুসলমানদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নির্যাতন-নিপীড়নের মত নতুন নতুন কলা-কৌশল তারা আবিষ্কার করে চলেছে। সোয়া কোটি কাশ্মীরবাসীকে নির্যাতন আর নিপীড়নে জর্জরিত করে যাবজ্জীবন ভারতীয় জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রাখার লক্ষ্যে প্রতিদিন সেখানে অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। জাতিসংঘ বসনিয়ায় মুসলমানদের জন্য যে ভূমিকা পালন করেছে সেই একই ভূমিকা পালন করছে কাশ্মীরের বেলায়ও। জাতিসংঘ বসনিয়ায় বিরোধীদের সহায়তা করেছে এবং নির্যাতিতদের উদ্ধারে বা আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে কোনো সন্তোষজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তেমনি ১৯৪৭ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীর সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে একাধিক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। শেষ প্রস্তাবটি পাস হয় ১৯৪৯ সালে। তাতে কাশ্মীরের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কাশ্মীরের জনগণের উপর আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই সময়ে ভারত প্রস্তাবটি মেনে নিলেও পরবর্তীতে প্রস্তাবটি ভারত এই বলে নাকচ করে দেয় যে, কাশ্মীর সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরও জাতিসংঘ ভারতের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। তার ফলে কাশ্মীরী যুবকরা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না, শিশুরা মারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে না, নারীরা ধর্ষিতা ও নির্যাতিত হচ্ছে অথচ কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তবুও যেন সেখানে মানবতা ও মানবাধিকারের কিছুই হয়নি।
পশ্চিমা দেশগুলো ও জাতিসংঘ মাঝে মাঝে মানবাধিকার প্রসঙ্গে লম্বা লম্বা কথা বলে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তারা ঠুলি পরে থাকেন, নাকি দেখেও দেখেন না। জাতিসংঘ তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এজন্য যে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যেন ন্যায়নীতি ও সুবিচার থেকে বিচ্যুত না হয়। কেউ সুবিচার করুক আর নাই করুক, জাতিসংঘ সুবিচার করবে এখন ধারণা এক সময় দুনিয়াবাসীর ছিল। কিন্তু এখন আর সে ধারণা পোষণ করা হয় না। বাস্তবে জাতিসংঘ একটা বহুরূপী সংস্থায় পরিণত হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘকে গোখরো সাপের মতো ফণা তুলতে দেখা গেলেও পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের অনুগ্রহভাজনদের বেলায় সে যেন ধোড়া সাপ। ফণা তোলা ভুলে যায়। দংশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। জাতিসংঘের এই বহুরূপী চরিত্রের কারণেই দেশে দেশে মুসলমানদের ওপর বিরোধী শক্তিগুলোর এত আস্ফালন।
চেচনিয়ার ওপর রাশিয়ার নির্যাতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯২২ সালে ককেশীয় এ অঞ্চলের দিকে রাশিয়ার জার শাসকরা প্রথম হাত বাড়ায়। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত ককেশীয় জনগণের সাথে রুশদের যুদ্ধ হয়। ১৪২ বছরের এ যুদ্ধে এই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার একনায়ক যোশেফ স্টালিন এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে তুষার অঞ্চলে ও মরু অঞ্চলে নির্বাসন দেয়। এ নির্বাসনে পাঠানো হয় চেচনিয়ার শতকরা ৫০ ভাগ লোক।
১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকারিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত ঘোষিত হওয়ার পর সংবিধানের ৭২ ধারায় ঘোষণা করা হয় ‘জাতিসমূহের মধ্যে যারা স্বাধীনভাবে থাকতে ইচ্ছুক তাদের সে অধিকার দেয়া হবে।' ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রের জিন্দানখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর চেচেনদের ভোটে দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ পর্যন্ত তিন বছর রাশিয়া কিছু বলেনি। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসীন দুদায়েভের নিকট প্রেরিত এক চরমপত্রে বলেন, চেচনিয়া রুশ ফেডারেশনের একুশটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি। মুজাহিদরা তাদের স্বাধীনতার দাবিতে অটল থাকায় রাশিয়ার সাথে চেচেনদের যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে চেচেন নেতা দুদায়েভ শহীদ হলেও ১৯৯৬ সালে চেচেনরা বিজয়ী হন। রাশিয়া চেচনিয়ায় চরম মার খেয়ে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাশিয়া চেচনিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলে স্বাধীনতাকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য ১৯৯৯ সালের ৭ আগস্ট দাগেস্তানে মুজাহিদদের দমনের অজুহাতে বোমা ফেলে। চেচনিয়া ও আজারবাইজান সীমান্তে এ বোমা হামলায় বেসামরিক জনগণ শহীদ হয়। পরবর্তীতে প্রতিবেশী দাগেস্তানের মুজাহিদদের মদদ দেয়ার মিথ্যা অজুহাতে রাশিয়া চেচেনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে রাশিয়ার সৈন্যদের হাতে হাজার হাজার বেসামরিক লোক শহীদ হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায় নাই। শীতল আবহাওয়া ও চিকিৎসার অভাবে শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। তাতে মানবতা ও মানবাধিকারের ক্ষতি কি! কারণ তারা যে মুসলমান।
কমিউনিস্ট শক্তির পতনের পর আমেরিকাসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং রাশিয়া এখন প্রকাশ্যভাবেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। যে সমস্ত মুসলিম দেশ তাদের আনুগত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত সেই দেশগুলোকে তারা চিহ্নিত করেছে কখনো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আবার কখনো মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে। তারপর তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অবরোধ শুরু করে দেয়। তাছাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ইসলামী সংগঠনও তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এদের প্রচার প্রোপাগান্ডার ফলে দুনিয়ার কোন মুসলিম দেশ বা ইসলামী সংগঠন মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইলে তারা হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী। কিন্তু প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘ইউরোপে কোন মুসলিম দেশ সহ্য করা হবে না'- তখন কিন্তু তিনি মৌলবাদী হন না। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলেও ভারতকে মৌলবাদী রাষ্ট্র বলে কেউ গালাগালি করে না। তাদের চোখে মুসলিম মাত্রই মৌলবাদী।
আসলে চরমপন্থী সন্ত্রাসী কারা? ওকলাহোমায় বোমা বিস্ফোরণকারী টিমোথি মাইকেল ভিগ একজন খৃস্টান, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের হত্যাকারী ইগল আমীর একজন চরমপন্থী ইহুদী। মুসলমানরা তো এরকম কোন অপরাধ করেনি। তবুও পশ্চিমা শক্তি ও তাদের বরকন্দাজদের চোখে মুসলমানরাই শুধু মৌলবাদী, সন্ত্রাসী। বাংলাদেশেও আমরা এই প্রচারণাই লক্ষ্য করছি। তাদের ভাবখানা এমন যে, একবার মুসলিম মৌলবাদী বলে চিহ্নিত করতে পারলেই হলো তখন যেন তাদের ওপর সব রকম নির্যাতন বৈধ হয়ে যাবে। সত্যই আমরা এক আজব দুনিয়ায় বাস করছি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার-নিপীড়ন চলছে সে ব্যাপারে সভ্যতাগর্বী পশ্চিমা দেশগুলো অসম্ভব রকম নীরব। আমাদের দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও নীরব। এরা কথায় কথায় বিবৃতি ঝাড়েন, লম্বা লম্বা বক্তৃতা করেন, কিন্তু হাল আমলের দুনিয়ার বর্বরতম ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর মতোই নীরব। এই নীরবতা থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে এদেশীয় বরকন্দাজদের যোগসূত্রের বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বর্তমানে মুসলমানদের আনুগত্য-অনুসরণ আর চরিত্রের বিচার-বিশ্লেষণ করলে মনে হবে মুসলমানদের সংজ্ঞাও যেন পাল্টে যাচ্ছে।
মোটকথা মানুষের পরিচয় মেলে তার সুসময়ে আর দুঃসময়ে। এই উভয় সময়ে বর্তমানে মুসলমানরা দুনিয়াতে বড়ই দুঃসময়ের সম্মুখীন। এখন মুসলমানদের ওপর হাতছানি দিচ্ছে কখনো আমেরিকা, কখনো রাশিয়া, কখনো ইহুদী চক্র, কখনো আধিপত্যবাদ আবার কখনো ভোগবাদ আর বিভ্রান্তি। আবার কখনো বা দেখা দেয় রক্তচক্ষু ও নির্যাতনের কালো হাত। লোভ-লালসার ছলনাও উঁকি মারে মাঝে মাঝে। এই অবস্থায় মুসলমানের সংজ্ঞাটাই পাল্টে যায় কি না সেটাই চিন্তার বিষয়। তাই বলছিলাম, আমরা এ কোন আজব দুনিয়ায় বাস করছি।
Tuesday, 10 May 2011

আমাদের ‘অনুভূতিগুলো' কি ‘ভোঁতা' হয়ে যাচ্ছে?
মানুষের এখন আর কোথাও কোনো নিরাপত্তা নেই। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। রাস্তা-ঘাটে, গাড়িতে, বাড়িতে, ফ্ল্যাটে, বাজারে, শিক্ষাঙ্গনে প্রতিনিয়ত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সমাজ ও রাষ্ট্র যেন অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। কোনো পদক্ষেপেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার কমছে না। দিন দিন বেড়েই চলেছে। খুন-খারাবি, রাহাজানি, ছিনতাই-এর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অথচ একটি সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করে মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধন এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য জীবনের নিরাপত্তা একান্ত অপরিহার্য। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব পালন শেষ হয়ে যায় না। এসব চাহিদা প্রাপ্তির সাথে সাথে মানুষ যাতে নিরাপত্তার সাথে জীবনযাপন করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করাও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশ সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। কিন্তু আজকে আমরা যে সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করছি তার সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সমাজের সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি কোথাও নেই। সকালে যে লোকটি বাসা থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে সে আবার ফিরে আসতে পারবে কিনা এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এমনকি যে মেয়েটি কলেজে ক্লাস করার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছে সে আবার মান-সম্মান নিয়ে বাসায় আসতে পারবে কি-না সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। একজন শিক্ষক যাকে আমরা মানুষ গড়ার কারিগর বলে মুখে ফেনা তুলি সেই শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারবেন কি-না তাও অনিশ্চিত। হতভাগ্য কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন- পথে-ঘাটেও শিক্ষকরা নিরাপদ নন। ফরিদপুরের চাপা রাণী মেয়েকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই নিহত হয়েছেন। নিহত, আহত কিংবা চরমভাবে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা এবং সন্ত্রাসী তান্ডবের ব্যাপকতা এতই বেড়েছে যে, এগুলো এখন আর মানুষকে আগের মতো বিচলিত করে না।
মানুষের যান্ত্রিক ব্যস্ততা, অন্যের প্রতি উদাসীনতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, আন্তরিকতা, সহানুভূতিশীলতা প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলীর চর্চার অভাবে মানুষের নিকট এখন অতি অস্বাভাবিক ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনার মতো মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কতিপয় সন্ত্রাসী প্রকাশ্য দিবালোকে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একজন স্কুলশিক্ষিকাকে কুপিয়ে হত্যা করে। স্কুলশিক্ষিকা আরিফা খাতুন (২৬)কে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে এলাকা ত্যাগ করে। ঘটনাটি ঘটেছে পাবনার সাঁথিয়ায়। আরিফা সাঁথিয়া উপজেলার ভায়নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। অন্যান্য দিনের মত হতভাগ্য আরিফা স্কুলে যান এবং শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকজন সন্ত্রাসী শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে আরিফাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে চলে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। কত অমানবিক, কত হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য! একটি সভ্য সমাজে এতটা নৃশংসতা কি কল্পনা করা যায়? শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকালে একজন শিক্ষিকাকে রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হলো! অথচ তার বিরুদ্ধে কতটা প্রতিবাদ হলো! আদৌ কোনো প্রতিবাদ হয়েছে কি?
রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার যারা খেলার মাঠে কারো বিরুদ্ধে কোনো রকমে একটা জয় পেলে মুহূর্তের মধ্যে অভিনন্দনের বার্তা পাঠাতে ভুল করেন না তারা কিন্তু আরিফার জন্য এতটুকু সহানুভূতি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। শিক্ষামন্ত্রী যিনি শিক্ষা ও শিক্ষকদের কল্যাণে প্রতিনিয়ত বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন তিনি কিন্তু আরিফার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার আত্মাকে ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ার সুযোগ পাননি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি একজন মহিলা তিনি একথাটিও বলেননি যে, অন্য একজন মহিলা শিক্ষিকাকে তিনি এমনকি শ্রেণীকক্ষেও নিরাপত্তা দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশে বাহারী নামের যে শিক্ষক সংগঠনগুলো রয়েছে তাদের কোনো নেতাও ছুটে যাননি সাঁথিয়ার ভায়নাপাড়ায়।
নারীদের অধিকার নিয়ে যাদের তৎপরতার (!) শেষ নেই সেই সংগঠনগুলোও কি কোনো জোরালো প্রতিবাদ করেছে? এ হলো আমাদের মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ! খুন, জোড়া খুন, হালিতে (২ জোড়া) খুন- এগুলো আমাদের বিবেককে এখন আর তাড়িত করে না! জহির রায়হানের ভাষায় : ‘প্রথম প্রথম কাউকে মারতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রুও হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে।' সময়ের প্রয়োজনে কিংবা নৃশংসতার ভয়াবহতায় জহির রায়হানের মানবিক অনুভূতি হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য ‘ভোঁতা' হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা, আমাদের সমাজ এবং আমাদের রাষ্ট্র-সবাই কি একসাথে অনুভূতিশূন্য হয়ে যাচ্ছি? আমাদের সকলের ‘অনুভূতিগুলো' কি ‘ভোঁতা' হয়ে যাচ্ছে?
মানুষের যান্ত্রিক ব্যস্ততা, অন্যের প্রতি উদাসীনতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, আন্তরিকতা, সহানুভূতিশীলতা প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলীর চর্চার অভাবে মানুষের নিকট এখন অতি অস্বাভাবিক ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনার মতো মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কতিপয় সন্ত্রাসী প্রকাশ্য দিবালোকে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একজন স্কুলশিক্ষিকাকে কুপিয়ে হত্যা করে। স্কুলশিক্ষিকা আরিফা খাতুন (২৬)কে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা বীরদর্পে এলাকা ত্যাগ করে। ঘটনাটি ঘটেছে পাবনার সাঁথিয়ায়। আরিফা সাঁথিয়া উপজেলার ভায়নাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। অন্যান্য দিনের মত হতভাগ্য আরিফা স্কুলে যান এবং শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কয়েকজন সন্ত্রাসী শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে আরিফাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে চলে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। কত অমানবিক, কত হৃদয়বিদারক এ দৃশ্য! একটি সভ্য সমাজে এতটা নৃশংসতা কি কল্পনা করা যায়? শ্রেণীকক্ষে পাঠদানকালে একজন শিক্ষিকাকে রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হলো! অথচ তার বিরুদ্ধে কতটা প্রতিবাদ হলো! আদৌ কোনো প্রতিবাদ হয়েছে কি?
রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার যারা খেলার মাঠে কারো বিরুদ্ধে কোনো রকমে একটা জয় পেলে মুহূর্তের মধ্যে অভিনন্দনের বার্তা পাঠাতে ভুল করেন না তারা কিন্তু আরিফার জন্য এতটুকু সহানুভূতি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। শিক্ষামন্ত্রী যিনি শিক্ষা ও শিক্ষকদের কল্যাণে প্রতিনিয়ত বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন তিনি কিন্তু আরিফার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার আত্মাকে ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়ার সুযোগ পাননি! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি একজন মহিলা তিনি একথাটিও বলেননি যে, অন্য একজন মহিলা শিক্ষিকাকে তিনি এমনকি শ্রেণীকক্ষেও নিরাপত্তা দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশে বাহারী নামের যে শিক্ষক সংগঠনগুলো রয়েছে তাদের কোনো নেতাও ছুটে যাননি সাঁথিয়ার ভায়নাপাড়ায়।
নারীদের অধিকার নিয়ে যাদের তৎপরতার (!) শেষ নেই সেই সংগঠনগুলোও কি কোনো জোরালো প্রতিবাদ করেছে? এ হলো আমাদের মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ! খুন, জোড়া খুন, হালিতে (২ জোড়া) খুন- এগুলো আমাদের বিবেককে এখন আর তাড়িত করে না! জহির রায়হানের ভাষায় : ‘প্রথম প্রথম কাউকে মারতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রুও হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে।' সময়ের প্রয়োজনে কিংবা নৃশংসতার ভয়াবহতায় জহির রায়হানের মানবিক অনুভূতি হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য ‘ভোঁতা' হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা, আমাদের সমাজ এবং আমাদের রাষ্ট্র-সবাই কি একসাথে অনুভূতিশূন্য হয়ে যাচ্ছি? আমাদের সকলের ‘অনুভূতিগুলো' কি ‘ভোঁতা' হয়ে যাচ্ছে?
Thursday, 5 May 2011

শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন কমিশনের নতুন কথা
গত ১৯ এপ্রিল ২০১১ তারিখ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আর ২১ তারিখ বিকালের কয়েকটি চ্যানেলের স্ক্রল বারে দেখা গেল ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' পরে খবরে জানতে পারা যায়, ১৯৬১ সালের নির্বাচন বিধিমালায় এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা আছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেছেন ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।' প্রথমে ধন্যবাদ দিই নির্বাচন কমিশনার সাহেবকে এ ঘোষণার জন্য যে, এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা অনেকাংশে দূর হবে। কারণ, অনেক শিক্ষকই দেশের রাজনীতির সাথে জড়িত। তাই যে কোন নির্বাচনে এক বিরাট অংশ শিক্ষকরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং নির্বাচিত হয়েও থাকেন। তাই এ ঘোষণায় শিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার একটি পথ তৈরি করা হবে, যদি এ আদেশ বহাল রাখা সম্ভব হয়।
অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই আইন জারীর প্রেক্ষিতে আমাদের গ্রামের মসজিদের একজন শ্রদ্ধেয় ইমাম সাহেব (মরহুম)- এর কথা মনে পড়ে গেল। কারণ, কেউ যদি কখনো বলেছেন যে, এটা সঠিক, তাই এ মসলাটি এমন হবে; তাহলে তিনি সহজ মনে বলে দিতেন এটা ঠিক। আবার কেউ পরে সেটি ঠিক নয় বললেই তিনি বলেছেন, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। বলা বাহুল্য, তিনি রাজনীতি বা এ জাতীয় কোন কাজের সাথেই কখনোই জড়িত ছিলেন না। এমনকি ডানে-বামে না তাকিয়ে প্রায় নিচু মুখে পথ চলতেন এবং মসজিদের বাইরেতো কথা বলতেনই না, মসজিদের ভিতরেও প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। তাহলে তিনি যে অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং সহজ মন নিয়েই মানুষের কথায় সমর্থন দিতেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ইমাম সাহেবের কথা মনে পড়ার কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন যে নতুন (যদিও আইনটি পুরোনো বা আগের) আইনের ঘোষণা দিয়েছেন সেটির সাথে এ স্মৃতির কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে'-এ ঘোষণায় বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, আমার ইমাম সাহেব যে সব বিষয় নিয়ে ভাবতেন না, সেগুলো কেউ বলে দিলেই তার মনে হতো যে, এটা বুঝি প্রয়োজনীয়। তাই সেটা সঠিক বলতেন এবং সেভাবেই চলার বা বলার চেষ্টা করতেন। যেমন করে বলেছেন এই নির্বাচন কমিশনার। যদিও নির্বাচন কমিশনার একজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। এ কারণেই তিনি সরল মন নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল সেদিন তার কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তাই হয়তো বাস্তবায়নেরও কথা ভাবেননি। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনকে জানিয়েছেন (পত্রিকা মারফত জানা) ‘দ্যা ইন্টারমিডিয়েট এন্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিনেন্স ১৯৬১ অধ্যাদেশ বলবৎ আছে।' আর এর ৩০(১) ধারার বলেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' তিনি সেদিন শিক্ষা কর্মকর্তার পাঠানো তথ্যের কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেছেন-‘১৯৬১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ এখনো বলবৎ আছে বলে আমরা আজ (২২ এপ্রিল, দৈনিক বাংলাদেশ সময়) খবর পেয়েছি।'
আইন দেশের জন্য প্রয়োজন হোক আর প্রয়োজনের জন্যই আইন হোক, কোন আইন যদি মাঝে মাঝে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটি আর আইন থাকেনা, বরং বেআইনে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালে নির্বাচন সংক্রান্ত এ আইন প্রণীত হয়েছিল এতে হয়তো কারো সন্দেহ নেই, কিন্তু গত অর্ধশতকে বহুবার অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ আইন কতবার মানা হয়েছে তা একবার নির্বাচন কমিশনের তলিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে এ ঘোষণার পর অনেকে মত পোষণ করেছেন। যদিও বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের জন্য হাস্যকর বলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে। কারণ, নির্বাচন সংক্রান্ত আইন আর নির্বাচন অফিসে সেই আইন সংরক্ষিত নেই বা ছিল না বা নির্বাচন কমিশনাররা সেই আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই বলে জনগণ বিশ্বাস করছেন। আর তিনি বা নির্বাচন কমিশনাররা ১৯৬১ সালের আইন বা ২০০৯ সালের আইন কোনটি যে প্রয়োগ করবেন সে বিষয়েও অনেক দ্বিধা-দ্বনেদ্ব ভুগছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। কারণ, গত ২০০৯ সালের পর থেকে ৩টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেছে (একটি আংশিক)। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যে কোন পদে থেকে সরকারি বেতন বা অনুদান গ্রহণ করে নির্বাচন করা যাবে না বলে ঘোষণা দেয়ায় অনেককে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বা শিক্ষকতার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সম্ভবত এটি ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বলেই হয়েছে। কিন্তু এর পরেই আবার নির্বাচন কমিশন হয়তো অনুভব করলো যে, এ আইন থাকা উচিত নয়, তাই ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ নামে একটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। এতে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সংক্রান্ত ১৯ ধারায় বলা হয়েছে ‘এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা স্বীয় পদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন। এছাড়া সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা চাকরি থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ইস্তফা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন।'
এ ধারার বলে প্রথমে গত জানুয়ারি মাসে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এতে মেয়র বা কমিশনার পদে অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অনেকে বিজয় অর্জনও করেছেন। আর দ্বিতীয় দফায় দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেও অনেক শিক্ষক অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয় অর্জন করেছেন বলে শোনা গেছে। এসাথে আসছে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য দেশের অনেক শিক্ষক-কর্মচারী প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে রয়েছেন এবং দীর্ঘ দিন থেকে শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় করে চলেছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন যখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচন থেকে বাদ দেয়ার আইনের কথা ঘোষণা দিয়েছেন, তখন তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। চাল, ডাল, তেল, নুন যোগাড় করে ভাত রান্না করিয়ে নেয়ার পর যদি বলা হয় যে, ভাত খেতে পাবে না, তখন খাওয়ার উদ্দেশ্যে রান্না করা ক্ষুধাতুর মানুষের মনে কি হতে পারে?
আমরা অনেকেই জানি বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন বলে আমাদের দেশে একটি আইন প্রচলিত আছে। সেটাও সম্ভবত ১৯৬১ সালের পাস করা। কিন্তু এই আইন দিয়ে বাল্য বিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আইনটি বাস্তবায়ন করা হয় না এবং এ জন্য দেশের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিও হয়নি। তাই কোন মেয়ের বাল্য বিয়ে হয়ে গেলে এবং সেই মেয়ে এক সময় সন্তান প্রসব করার পর যদি জানা যায় যে, তার বাল্যবিয়ে হয়েছিল, তাহলে তার আর বিয়ে বাতিল করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে নির্বাচনের সুযোগে কোন শিক্ষক যদি ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে আর কিভাবে আগের স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বরং ১৯৬১ সালের আইনটি জানার পর নির্বাচন অফিসের উচিত ছিল সরকারের সাথে ১৯৬১ সালের এবং ২০০৯ সালের আইন নিয়ে আলোচনা করে এ সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। অবশ্য আমরা জানি না যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের সাথে এ বিষয়ে কোন আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা বা নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে কিনা? কারণ, ইতোমধ্যে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিবেন এবং আইনের কাছে আশ্রয় নিলে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। এমনি করে যারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আছেন তাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো এ সুযোগটি নেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আর সে চেষ্টা করুক বা না করুক এ মুহূর্তে অবশ্যই এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ, সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব দলেই শিক্ষকদের মধ্যে থেকে অনেক প্রার্থী তালিকাভুক্ত রয়েছেন। আর যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সাথে জড়িত তারা অবস্থানগত দিক থেকে অনেক উপরে রয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই তারা অবশ্যই এক সময় হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে আইন পাস করানোর কাজে সফল হতে পারেন। আর এ নির্বাচনে শিক্ষকদের প্রার্থী হতে দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে দেয়ার পরে যদি আবারও সেই উপজেলার পর পৌরসভার মতো আইন পাস হয়ে যায়, তাহলে উপজেলার মতো যারা বঞ্চিত হবেন, তাদের কাছে নির্বাচন কমিশন অপরাধী হয়ে থেকে যাবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্নেরও সৃষ্টি হতে পারে।
আমার জানা মতে, একই বিষয়ে যখন নতুন কোন আইন হয়, তখন সে বিষয়ের পূর্বের আইন বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য এ ব্যাপারে রেফারেন্স মূলক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হতে পারে, যদিও সেটিকে অনেকেই প্রয়োজনীয় বিষয় মনে করেন না। কারণ, সময় ও বাস্তবতার প্রয়োজনের জন্যই আইন প্রণীত হয়ে থাকে। তাই ২০০৯ সালের আইন হওয়ার পর ১৯৬১ সালের আইনের আর কার্যকারিতা আছে কি না তা আইন বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখবেন এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে একটি সঠিক নির্দেশনা দিবেন বলে আমি আশাবাদী।
বলা প্রয়োজন যে, দেশের শিক্ষকরা সমাজের আয়না, রাষ্ট্রের বিবেক, মানুষের বন্ধু, সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের বিষয়ে একবার ইতিবাচক আর একবার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষকদের অবমাননা করা হয় বলে শিক্ষক সমাজ মনে করছেন। বরং তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের পর সমাজ সেবার কাজ কতটুকু করতে পারবেন বা আদৌ করতে পারবেন কি না বা তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে পাঠদানে কতটুকু ক্ষতিসাধিত হতে পারে তা বিচার বিশ্লেষণ করে একটি নতুন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে শিক্ষক সমাজের একটি বড় অংশ মনে করছেন।
কাজেই কোন প্রশ্ন যেন সৃষ্টি না হয়, নির্বাচন কমিশন যেন সন্দেহাতীত ও সঠিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ আগামী দিনের যে কোন নির্বাচন সমাপ্ত করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না' এ সংক্রান্ত একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি শুধু শিক্ষকদেরই নয়, সারাদেশের সচেতন জনগণের।
অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের এই আইন জারীর প্রেক্ষিতে আমাদের গ্রামের মসজিদের একজন শ্রদ্ধেয় ইমাম সাহেব (মরহুম)- এর কথা মনে পড়ে গেল। কারণ, কেউ যদি কখনো বলেছেন যে, এটা সঠিক, তাই এ মসলাটি এমন হবে; তাহলে তিনি সহজ মনে বলে দিতেন এটা ঠিক। আবার কেউ পরে সেটি ঠিক নয় বললেই তিনি বলেছেন, হ্যাঁ, এটা হতে পারে। বলা বাহুল্য, তিনি রাজনীতি বা এ জাতীয় কোন কাজের সাথেই কখনোই জড়িত ছিলেন না। এমনকি ডানে-বামে না তাকিয়ে প্রায় নিচু মুখে পথ চলতেন এবং মসজিদের বাইরেতো কথা বলতেনই না, মসজিদের ভিতরেও প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। তাহলে তিনি যে অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং সহজ মন নিয়েই মানুষের কথায় সমর্থন দিতেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ইমাম সাহেবের কথা মনে পড়ার কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন যে নতুন (যদিও আইনটি পুরোনো বা আগের) আইনের ঘোষণা দিয়েছেন সেটির সাথে এ স্মৃতির কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ‘প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেউ নির্বাচিত হয়ে থাকলে তারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে'-এ ঘোষণায় বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, আমার ইমাম সাহেব যে সব বিষয় নিয়ে ভাবতেন না, সেগুলো কেউ বলে দিলেই তার মনে হতো যে, এটা বুঝি প্রয়োজনীয়। তাই সেটা সঠিক বলতেন এবং সেভাবেই চলার বা বলার চেষ্টা করতেন। যেমন করে বলেছেন এই নির্বাচন কমিশনার। যদিও নির্বাচন কমিশনার একজন দক্ষ, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। এ কারণেই তিনি সরল মন নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়ে গেল সেদিন তার কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তাই হয়তো বাস্তবায়নেরও কথা ভাবেননি। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনকে জানিয়েছেন (পত্রিকা মারফত জানা) ‘দ্যা ইন্টারমিডিয়েট এন্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিনেন্স ১৯৬১ অধ্যাদেশ বলবৎ আছে।' আর এর ৩০(১) ধারার বলেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না।' তিনি সেদিন শিক্ষা কর্মকর্তার পাঠানো তথ্যের কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেছেন-‘১৯৬১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নির্বাচন সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ এখনো বলবৎ আছে বলে আমরা আজ (২২ এপ্রিল, দৈনিক বাংলাদেশ সময়) খবর পেয়েছি।'
আইন দেশের জন্য প্রয়োজন হোক আর প্রয়োজনের জন্যই আইন হোক, কোন আইন যদি মাঝে মাঝে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটি আর আইন থাকেনা, বরং বেআইনে পরিণত হয়। ১৯৬১ সালে নির্বাচন সংক্রান্ত এ আইন প্রণীত হয়েছিল এতে হয়তো কারো সন্দেহ নেই, কিন্তু গত অর্ধশতকে বহুবার অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ আইন কতবার মানা হয়েছে তা একবার নির্বাচন কমিশনের তলিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে এ ঘোষণার পর অনেকে মত পোষণ করেছেন। যদিও বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের জন্য হাস্যকর বলে অনেকের কাছে মনে হতে পারে। কারণ, নির্বাচন সংক্রান্ত আইন আর নির্বাচন অফিসে সেই আইন সংরক্ষিত নেই বা ছিল না বা নির্বাচন কমিশনাররা সেই আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই বলে জনগণ বিশ্বাস করছেন। আর তিনি বা নির্বাচন কমিশনাররা ১৯৬১ সালের আইন বা ২০০৯ সালের আইন কোনটি যে প্রয়োগ করবেন সে বিষয়েও অনেক দ্বিধা-দ্বনেদ্ব ভুগছেন বলে অনুমিত হচ্ছে। কারণ, গত ২০০৯ সালের পর থেকে ৩টি স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেছে (একটি আংশিক)। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে যে কোন পদে থেকে সরকারি বেতন বা অনুদান গ্রহণ করে নির্বাচন করা যাবে না বলে ঘোষণা দেয়ায় অনেককে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বা শিক্ষকতার পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সম্ভবত এটি ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ বলেই হয়েছে। কিন্তু এর পরেই আবার নির্বাচন কমিশন হয়তো অনুভব করলো যে, এ আইন থাকা উচিত নয়, তাই ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন-২০০৯ নামে একটি অধ্যাদেশ জারী করা হয়। এতে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সংক্রান্ত ১৯ ধারায় বলা হয়েছে ‘এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা স্বীয় পদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন। এছাড়া সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা চাকরি থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ইস্তফা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বনিদ্বতা করতে পারবেন।'
এ ধারার বলে প্রথমে গত জানুয়ারি মাসে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এতে মেয়র বা কমিশনার পদে অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অনেকে বিজয় অর্জনও করেছেন। আর দ্বিতীয় দফায় দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেও অনেক শিক্ষক অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিজয় অর্জন করেছেন বলে শোনা গেছে। এসাথে আসছে ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য দেশের অনেক শিক্ষক-কর্মচারী প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে রয়েছেন এবং দীর্ঘ দিন থেকে শ্রম, অর্থ ও মেধা ব্যয় করে চলেছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন যখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নির্বাচন থেকে বাদ দেয়ার আইনের কথা ঘোষণা দিয়েছেন, তখন তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। পড়াটাই স্বাভাবিক। চাল, ডাল, তেল, নুন যোগাড় করে ভাত রান্না করিয়ে নেয়ার পর যদি বলা হয় যে, ভাত খেতে পাবে না, তখন খাওয়ার উদ্দেশ্যে রান্না করা ক্ষুধাতুর মানুষের মনে কি হতে পারে?
আমরা অনেকেই জানি বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন বলে আমাদের দেশে একটি আইন প্রচলিত আছে। সেটাও সম্ভবত ১৯৬১ সালের পাস করা। কিন্তু এই আইন দিয়ে বাল্য বিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়নি। কারণ, আইনটি বাস্তবায়ন করা হয় না এবং এ জন্য দেশের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিও হয়নি। তাই কোন মেয়ের বাল্য বিয়ে হয়ে গেলে এবং সেই মেয়ে এক সময় সন্তান প্রসব করার পর যদি জানা যায় যে, তার বাল্যবিয়ে হয়েছিল, তাহলে তার আর বিয়ে বাতিল করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে নির্বাচনের সুযোগে কোন শিক্ষক যদি ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে আর কিভাবে আগের স্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে তা নিয়ে অনেকের মনে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। বরং ১৯৬১ সালের আইনটি জানার পর নির্বাচন অফিসের উচিত ছিল সরকারের সাথে ১৯৬১ সালের এবং ২০০৯ সালের আইন নিয়ে আলোচনা করে এ সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। অবশ্য আমরা জানি না যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের সাথে এ বিষয়ে কোন আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা বা নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে কিনা? কারণ, ইতোমধ্যে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা অবশ্যই আইনের আশ্রয় নিবেন এবং আইনের কাছে আশ্রয় নিলে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। এমনি করে যারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আছেন তাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো এ সুযোগটি নেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আর সে চেষ্টা করুক বা না করুক এ মুহূর্তে অবশ্যই এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ, সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব দলেই শিক্ষকদের মধ্যে থেকে অনেক প্রার্থী তালিকাভুক্ত রয়েছেন। আর যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সাথে জড়িত তারা অবস্থানগত দিক থেকে অনেক উপরে রয়েছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই তারা অবশ্যই এক সময় হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে আইন পাস করানোর কাজে সফল হতে পারেন। আর এ নির্বাচনে শিক্ষকদের প্রার্থী হতে দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে দেয়ার পরে যদি আবারও সেই উপজেলার পর পৌরসভার মতো আইন পাস হয়ে যায়, তাহলে উপজেলার মতো যারা বঞ্চিত হবেন, তাদের কাছে নির্বাচন কমিশন অপরাধী হয়ে থেকে যাবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্নেরও সৃষ্টি হতে পারে।
আমার জানা মতে, একই বিষয়ে যখন নতুন কোন আইন হয়, তখন সে বিষয়ের পূর্বের আইন বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য এ ব্যাপারে রেফারেন্স মূলক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হতে পারে, যদিও সেটিকে অনেকেই প্রয়োজনীয় বিষয় মনে করেন না। কারণ, সময় ও বাস্তবতার প্রয়োজনের জন্যই আইন প্রণীত হয়ে থাকে। তাই ২০০৯ সালের আইন হওয়ার পর ১৯৬১ সালের আইনের আর কার্যকারিতা আছে কি না তা আইন বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখবেন এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে একটি সঠিক নির্দেশনা দিবেন বলে আমি আশাবাদী।
বলা প্রয়োজন যে, দেশের শিক্ষকরা সমাজের আয়না, রাষ্ট্রের বিবেক, মানুষের বন্ধু, সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের বিষয়ে একবার ইতিবাচক আর একবার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষকদের অবমাননা করা হয় বলে শিক্ষক সমাজ মনে করছেন। বরং তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের পর সমাজ সেবার কাজ কতটুকু করতে পারবেন বা আদৌ করতে পারবেন কি না বা তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে পাঠদানে কতটুকু ক্ষতিসাধিত হতে পারে তা বিচার বিশ্লেষণ করে একটি নতুন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে শিক্ষক সমাজের একটি বড় অংশ মনে করছেন।
কাজেই কোন প্রশ্ন যেন সৃষ্টি না হয়, নির্বাচন কমিশন যেন সন্দেহাতীত ও সঠিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ আগামী দিনের যে কোন নির্বাচন সমাপ্ত করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে ‘বোর্ডের অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বা কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণাও করতে পারবেন না' এ সংক্রান্ত একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি শুধু শিক্ষকদেরই নয়, সারাদেশের সচেতন জনগণের।
Subscribe to:
Posts (Atom)