আ’লীগ বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে দিতে চায় না
ঘরোয়া বৈঠক থেকেও এখন গণগ্রেফতার চলছে
বাংলাদেশে বিরোধী দলের রাজনীতি কি নিষিদ্ধ? এমন প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপি আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে দিবে কি-না তা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে। জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের দমন পীড়ন, গণগ্রেফতার ও গণহারে মামলা দেয়ার প্রেক্ষিতে দেশে-বিদেশেও এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দেখামাত্র গ্রেফতার, গুলী, সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া এবং গণহারে মামলা দিয়ে কারাগারে আটক রাখার পর এবার বিএনপিকে সভা সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি ঘরোয়া সভা বা বাড়িতে বসেও বৈঠক করতে দেয়া হচ্ছে না। সাংবাদিক সম্মেলন করতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। এখন সরকার বিএনপির ঘরোয়া বৈঠক থেকেও পাইকারি হারে গ্রেফতার করছে। দলের শীর্ষ নেতাসহ অজ্ঞাতনামা অসংখ্য নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। দেখামাত্র গ্রেফতার করছে। এছাড়া ‘অজ্ঞাতনামার’ নামে যাকে ইচ্ছে তাকে গ্রেফতার করার সুযোগ রাখছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তারা বিরোধী দলকে দেশে রাজনীতি করতে না দিয়ে একতরফা শাসন চালিয়ে যেতে চায়। দেশকে প্রকারান্তরে বাকশালে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে তথা দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং জাতিকে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা এবং গভীর সংকটে ফেলছে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পর বিরোধী দলকে দায়ী করে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীসহ শাসকদলের শীর্ষ নেতারা। এই ঘটনার পরপরই বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হলেও এটা নিয়ে নেতিবাচক রাজনীতিতে মেতে উঠে সরকার। সরকার বিরোধী মতকে দমনে উঠেপড়ে লেগেছে। গত কয়েকদিনে দেশে বিভিন্ন স্থানে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। যাকে ইচ্ছে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। গত দুই-তিন দিনে দলীয় সভায় উপস্থিত ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং অন্য এক স্থানের অনুরূপ সভা থেকে ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রংপুরে জাপানী নাগরিক হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে বিএনপির দুই নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে জামায়াতের খুলনার কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে। এখনো গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সরকারের দমনপীড়নের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর খুলনা উত্তর জেলা আমীর মাওলানা এমরান হোসেন, খুলনা সদর থানা আমীর শেখ মোঃ ওলিউল্লাহ ও দৌলতপুর থানা জামায়াতের সাবেক আমীর আলফিদা হোসাইনসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে ও সকালে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সোনাডাঙ্গা মডেল ও খুলনা সদর থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। তাদেরকে বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতার অভিযোগে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ আল ফারুক দাখিল মাদরাসায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা এমরান হোসেন ও মাদরাসার ছাত্র মেহেদী হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দৌলতপুর থানার সাবেক আমীরকে গ্রেফতার করা হয়। খুলনা সদর থানা পুলিশ নগরীর গগনবাবু রোডে অভিযান চালিয়ে সদর থানা জামায়াতের আমীর মাওলানা ওলিউল্লাহকে গ্রেফতার করে। রেলওয়ে লোকো কলোনি থেকে সোনাডাঙ্গা মডেল থানা পুলিশ যুবদল নেতা আসাদুজ্জামান মিঠুকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল-ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) এর যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান খোকন এবং দক্ষিণখান থানা সভাপতি নবী হোসেনকে।
বিষয়টি সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তদন্ত না করেই সরকার বিরোধী দলকে বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ত করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার বরাবরের মতোই তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে বিরোধী দল ও মতকে দমন করতে চাইছে। সরকারের এই অপচেষ্টা দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ইতালী ও জাপানী নাগরিকের নৃশংস, ঘৃণ্য খুনের পরপরই সরকার এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত না করেই বিরোধী দলকে ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য অপপ্রচার শুরু করেছে এবং বিরোধী দল ও মতকে দমন করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা আরোপ করছে। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা বিদেশী নাগরিকদের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছি এবং অবিলম্বে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছি। সরকার বরাবরের মতোই তাদের ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে বিরোধী দল ও মতকে দমন করতে চাইছে। ইতিমধ্যে বিরোধী দলের নেতাদের হয়রানি ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, বিরোধী দলকে রাজনীতি বিমুখ করতে ইতিমধ্যে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ শতাধিক নেতা-কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে এবং যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদক সাবেরুল হক সাবুসহ যশোরের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমাইল, রংপুর মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুল হক লাকু, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাশেদুন্নবী বিপ্লব এবং বগুড়া জেলা যুবদল সভাপতি সিপার আল বখতিয়ারসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার ও শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে বিরোধী দল দমন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ, এতে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এটা বাংলাদেশের জন্য অশুভ ইঙ্গিত। এমনতিইে নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলও বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে। সরকারের কর্মকাণ্ডে গার্মেন্টের বিদেশী ক্রেতাদের ওপরও প্রভাব পড়েছে। তারা ঢাকায় স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে ২৫০০ কোটি ডলারের এ শিল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে যে অস্থিরতা চলছে তার জন্য সরকারই দায়ী। তারা কোনো ঘটনা ঘটলেই তা বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে দিয়ে পার পেতে চায়। এতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের এমন দুঃসময়ে সরকারের উচিত বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করা। ঐক্যবদ্ধভাবে চলমান সংকটের সমাধান করা। কিন্ত তা না করে তারা উল্টো দমনপীড়নের পথ বেচে নিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আতাউর রহমান বলেন, বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন জঙ্গি তৎপরতায় শুধু রসদ যুগিয়েছে। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, অনেক মানুষের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামপন্থিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলকে একপেশে করে রাখা হয়েছে। এতে বেপরোয়া হত্যাকা- উসকে দিয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের স্থান যতই সংকুচিত হবে, ততই জঙ্গি তৎপরতার বিস্তার ঘটবে।
সূত্র মতে, সরকার অঘোষিতভাবে বিরোধী জোটকে সভা সমাবেশ করতে দিচ্ছে না সরকার। সেপ্টম্বরে তৃণমূল থেকে কমিটি করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িবাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের বাধার মুখে বিএনপি কোথাও সম্মেলনও করতে পারছে না। সর্বশেষ ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন উপজেলায় মানিকা ইউনিয়নে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে তাদের দলীয় ও কমিটি নবায়ন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে একটি মিটিং শুরু করা হয়। মিটিং চলাকালে পুলিশের একটি টিম মিটিংকারীদের আটক করে। পুলিশের দাবি মিটিকারীরা নাশকতা করার জন্য একত্রিত হয়েছে। তৃণমূল নেতারা বলছেন, দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে কোন প্রস্তুতি সভা করলেও তাতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ।
লক্ষ্মীপুরে জেলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিজানের বাড়ীতে একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের সম্মেলনে হামলা চালানো হয়েছে। জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুর রহমানের গাড়ী ভাংচুর করেছে। বিএনপি কর্মী আবু তাহের দোলন, করিম, মানিকসহ ৫ জন আহত হয়েছে ঐ হামলার ঘটনায়। কমলনগর উপজেলার যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মেজবাহউদ্দিন ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বিপ্লবের নেতৃত্বে এ হামলা পরিচালিত হয়। এ ধরনের ঘটনা লক্ষ্মীপুর থেকে শুরু করে সারা দেশেই সংঘটিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে শিবচর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাজমুল হুদা চৌধুরী (মিঠু) বলেন, তাকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়ার পর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করা হয়েছে। উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার দু/তিনটি বাদে সবগুলোর কমিটি শেষ করা হয়েছে। কমিটি করতে গিয়ে কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের বাধার মুখেও পড়েছি।
দল পুনর্গঠন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার দেশব্যাপী ধরপাকড় শুরু করেছে বলে জানান বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জমান রিপন। তিনি বলেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি-বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিল ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার প্রাক্কালে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সরকার বিরোধী মতকে দলন করার নীতি থেকে এখনও সরে আসেনি এবং বিরোধী রাজনীতির চর্চার পথকে আরো সংকুচিত করার অপপ্রয়াসকে আমরা নিন্দা জানাই। কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার জন্য সরকার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্বিচারে ব্যবহার করছে এবং এর পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের নামিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের কাউন্সিল অনুষ্ঠানে হামলা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন নির্বিচারে গ্রেফতার করে বিরোধী জোটের আন্দোলন ঠেকাতে চায়। নতুন বছরের শুরু থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে বিরোধী জোটের এমন ঘোষণার পর থেকেই ধরপাকড়ে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি দেশব্যাপী এ গণগ্রেফতারের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তাদের টার্গেট হচ্ছে, আন্দোলনকে দমন করা। বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দেয়া। বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের এমন পাইকারী গ্রেফতার অতীতে কেউই দেখেনি। তারা বলছেন, দেশব্যাপী সরকারের এমন ধরপাকড় জনগণকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেবে। এর পাশাপাশি সর্বস্তরে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পর বিরোধী দলকে দায়ী করে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীসহ শাসকদলের শীর্ষ নেতারা। এই ঘটনার পরপরই বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হলেও এটা নিয়ে নেতিবাচক রাজনীতিতে মেতে উঠে সরকার। সরকার বিরোধী মতকে দমনে উঠেপড়ে লেগেছে। গত কয়েকদিনে দেশে বিভিন্ন স্থানে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। যাকে ইচ্ছে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। গত দুই-তিন দিনে দলীয় সভায় উপস্থিত ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং অন্য এক স্থানের অনুরূপ সভা থেকে ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রংপুরে জাপানী নাগরিক হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে বিএনপির দুই নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে জামায়াতের খুলনার কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে। এখনো গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সরকারের দমনপীড়নের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর খুলনা উত্তর জেলা আমীর মাওলানা এমরান হোসেন, খুলনা সদর থানা আমীর শেখ মোঃ ওলিউল্লাহ ও দৌলতপুর থানা জামায়াতের সাবেক আমীর আলফিদা হোসাইনসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে ও সকালে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সোনাডাঙ্গা মডেল ও খুলনা সদর থানা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। তাদেরকে বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতার অভিযোগে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশ আল ফারুক দাখিল মাদরাসায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে জেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা এমরান হোসেন ও মাদরাসার ছাত্র মেহেদী হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে দৌলতপুর থানার সাবেক আমীরকে গ্রেফতার করা হয়। খুলনা সদর থানা পুলিশ নগরীর গগনবাবু রোডে অভিযান চালিয়ে সদর থানা জামায়াতের আমীর মাওলানা ওলিউল্লাহকে গ্রেফতার করে। রেলওয়ে লোকো কলোনি থেকে সোনাডাঙ্গা মডেল থানা পুলিশ যুবদল নেতা আসাদুজ্জামান মিঠুকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দল-ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) এর যুগ্ম আহ্বায়ক জিল্লুর রহমান খোকন এবং দক্ষিণখান থানা সভাপতি নবী হোসেনকে।
বিষয়টি সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তদন্ত না করেই সরকার বিরোধী দলকে বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ত করার জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার বরাবরের মতোই তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে বিরোধী দল ও মতকে দমন করতে চাইছে। সরকারের এই অপচেষ্টা দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ইতালী ও জাপানী নাগরিকের নৃশংস, ঘৃণ্য খুনের পরপরই সরকার এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত না করেই বিরোধী দলকে ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য অপপ্রচার শুরু করেছে এবং বিরোধী দল ও মতকে দমন করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা আরোপ করছে। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা বিদেশী নাগরিকদের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছি এবং অবিলম্বে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছি। সরকার বরাবরের মতোই তাদের ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে বিরোধী দল ও মতকে দমন করতে চাইছে। ইতিমধ্যে বিরোধী দলের নেতাদের হয়রানি ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, বিরোধী দলকে রাজনীতি বিমুখ করতে ইতিমধ্যে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ শতাধিক নেতা-কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে এবং যশোর জেলার সাধারণ সম্পাদক সাবেরুল হক সাবুসহ যশোরের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমাইল, রংপুর মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুল হক লাকু, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাশেদুন্নবী বিপ্লব এবং বগুড়া জেলা যুবদল সভাপতি সিপার আল বখতিয়ারসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার ও শতাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে বিরোধী দল দমন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ, এতে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এটা বাংলাদেশের জন্য অশুভ ইঙ্গিত। এমনতিইে নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলও বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে। সরকারের কর্মকাণ্ডে গার্মেন্টের বিদেশী ক্রেতাদের ওপরও প্রভাব পড়েছে। তারা ঢাকায় স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে ২৫০০ কোটি ডলারের এ শিল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে যে অস্থিরতা চলছে তার জন্য সরকারই দায়ী। তারা কোনো ঘটনা ঘটলেই তা বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে দিয়ে পার পেতে চায়। এতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের এমন দুঃসময়ে সরকারের উচিত বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করা। ঐক্যবদ্ধভাবে চলমান সংকটের সমাধান করা। কিন্ত তা না করে তারা উল্টো দমনপীড়নের পথ বেচে নিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আতাউর রহমান বলেন, বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন জঙ্গি তৎপরতায় শুধু রসদ যুগিয়েছে। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, অনেক মানুষের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামপন্থিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলকে একপেশে করে রাখা হয়েছে। এতে বেপরোয়া হত্যাকা- উসকে দিয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের স্থান যতই সংকুচিত হবে, ততই জঙ্গি তৎপরতার বিস্তার ঘটবে।
সূত্র মতে, সরকার অঘোষিতভাবে বিরোধী জোটকে সভা সমাবেশ করতে দিচ্ছে না সরকার। সেপ্টম্বরে তৃণমূল থেকে কমিটি করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িবাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের বাধার মুখে বিএনপি কোথাও সম্মেলনও করতে পারছে না। সর্বশেষ ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন উপজেলায় মানিকা ইউনিয়নে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে তাদের দলীয় ও কমিটি নবায়ন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে একটি মিটিং শুরু করা হয়। মিটিং চলাকালে পুলিশের একটি টিম মিটিংকারীদের আটক করে। পুলিশের দাবি মিটিকারীরা নাশকতা করার জন্য একত্রিত হয়েছে। তৃণমূল নেতারা বলছেন, দল পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে কোন প্রস্তুতি সভা করলেও তাতে বাধা দিচ্ছে পুলিশ।
লক্ষ্মীপুরে জেলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিজানের বাড়ীতে একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের সম্মেলনে হামলা চালানো হয়েছে। জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুর রহমানের গাড়ী ভাংচুর করেছে। বিএনপি কর্মী আবু তাহের দোলন, করিম, মানিকসহ ৫ জন আহত হয়েছে ঐ হামলার ঘটনায়। কমলনগর উপজেলার যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক মেজবাহউদ্দিন ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বিপ্লবের নেতৃত্বে এ হামলা পরিচালিত হয়। এ ধরনের ঘটনা লক্ষ্মীপুর থেকে শুরু করে সারা দেশেই সংঘটিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে শিবচর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাজমুল হুদা চৌধুরী (মিঠু) বলেন, তাকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়ার পর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করা হয়েছে। উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার দু/তিনটি বাদে সবগুলোর কমিটি শেষ করা হয়েছে। কমিটি করতে গিয়ে কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীনদের বাধার মুখেও পড়েছি।
দল পুনর্গঠন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার দেশব্যাপী ধরপাকড় শুরু করেছে বলে জানান বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জমান রিপন। তিনি বলেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি-বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিল ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার প্রাক্কালে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সরকার বিরোধী মতকে দলন করার নীতি থেকে এখনও সরে আসেনি এবং বিরোধী রাজনীতির চর্চার পথকে আরো সংকুচিত করার অপপ্রয়াসকে আমরা নিন্দা জানাই। কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার জন্য সরকার আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্বিচারে ব্যবহার করছে এবং এর পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের নামিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের কাউন্সিল অনুষ্ঠানে হামলা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন নির্বিচারে গ্রেফতার করে বিরোধী জোটের আন্দোলন ঠেকাতে চায়। নতুন বছরের শুরু থেকেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে বিরোধী জোটের এমন ঘোষণার পর থেকেই ধরপাকড়ে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি দেশব্যাপী এ গণগ্রেফতারের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। তাদের টার্গেট হচ্ছে, আন্দোলনকে দমন করা। বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দেয়া। বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের এমন পাইকারী গ্রেফতার অতীতে কেউই দেখেনি। তারা বলছেন, দেশব্যাপী সরকারের এমন ধরপাকড় জনগণকে আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেবে। এর পাশাপাশি সর্বস্তরে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল
No comments:
Write comments