ক্ষমতার চরম অস্ত্রসন্ত্রাস
আলমগীর মহিউদ্দিন
এমন বিভ্রান্তিকর অবস্থা গত সাড়ে পাঁচ দশকের সংবাদপত্রের ইতিহাসে দেখেছি কি না মনে পড়ে না। চার দিকে ধরপাকড় চলছে, অনাচার-নৈরাজ্য যেন সাধারণ ব্যাপার। ক্ষমতাসীনদের একাংশ বলছে এক কথা, আবার অপরাংশ বলছে এর বিপরীত। আবার এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললে সবাই মিলে প্রশ্নকারীকে আক্রমণ করছে। এবারের ধরপাকড়, সরকারি কর্মকাণ্ড সেই পুরনো বিষয় নিয়েই। সন্ত্রাস। এতে নতুন মাত্রা জুটেছে, বিদেশী হত্যা। কোনো বিদেশী গত কয়েক দশকে এমনভাবে মৃত্যুবরণ করেননি। বিভ্রান্তি এখানেই। ‘আইএসআই’ বলে কথিত সন্ত্রাসীরা কয়েক মিনিটের মাঝেই বিশ্বের আর এক প্রান্ত থেকে এই অপরাধের ঘটক বলে নাকি দাবি করেছে। সরকারের দায়িত্বশীলেরা বললেন, আইএসআই বলে কিছু এ দেশে নেই। আবার একাংশ বলছে, তারাই এটা করেছে। আবার সরকারই বলল, এ হত্যাকাণ্ডে বিরোধী দলের হাত রয়েছে।
কয়েক মাস আগে ঠিক এমনি তৎপরতা চলছিল। তখন ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একটি উদ্বেগ এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম। তারা বলছিলেন ওরা (আইএসআই ইত্যাদি) বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে অথবা এসে পৌঁছেছে। কিছু সংবাদমাধ্যমও এ নিয়ে বিশেষ আলোড়ন করতে থাকে। ধরপাকড়, বক্তব্য ইত্যাদি চলতে থাকে।
তখন এই আইএস-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। এই আইএস বা ইসলামিক স্টেট কী, কারা, কেন তাদের অভ্যুদয়, কে তাদের কর্মকাণ্ডে লাভবান হচ্ছে, তাদের সমর্থন কে করছে, তাদের খবর পশ্চিমা মাধ্যমে এত দ্রুত কেমন করে পৌঁছায়, এত অর্থ, অস্ত্র, জনবল সংগ্রহ ও ব্যবহার কেমন করে সম্ভব? এমন প্রশ্ন অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমও করেছে। তবে এর সঠিক জবাব পাওয়া যায়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা এই অনাচার-হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে বেশির ভাগ সময়ই সমালোচক-বিরোধীদের নির্মূল-নিশ্চুপ করে দেয়ার কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে থাকে।
সন্ত্রাস নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া গেছে। তাই এখানে ‘টেররিজম’ বা সন্ত্রাসের ইতিহাস একটু আলোচনা করা যায়। সন্ত্রাস বিশারদ (Terrorism expert) ড. অ্যামি জালমান তার দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সিকারি (Sicarii) নামে পরিচিত (সিকারী অর্থ-চাকুওয়ালা) ইহুদি গোষ্ঠী রোমের শাসক কর্মচারীদের গুপ্তহত্যা-আক্রমণ করতো ছোট ছোট চাকু দিয়ে। রোমানরা তার প্রতিদানও দিত একই উপায়ে। তখনই এই ইহুদি হত্যাকাণ্ড সন্ত্রাসের জন্ম দেয়।
ড. জালমান লিখেছেন, আসলে ‘সন্ত্রাস’ বলতে বর্তমানের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ১৭৯৩ সালে। ফরাসি বিপ্লবের নেতা ম্যাক্সমিলিয়ান রোবেসপিয়ার তার অনুসারীদের দিয়ে বিরোধীদের নির্মূলের লক্ষ্যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। তার অনুসারীদের বলা হতো ‘টেরোরিস্ট’ (শব্দটিও ফরাসি থেকে উদ্ভূত) এবং এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ১৭৯৫ থেকে। কারণ এই অনুসারীরা সরকারি লোক। আর এই টেরোরিস্টরা ভয়ের ও সম্মানের লোক ছিল। রোবেসপিয়ার তার এই হত্যা ও ভীতির কৌশল সমর্থন করে বলেছেন, এ ছাড়া ফরাসি রাজশাসন করা সম্ভব ছিল না। ফরাসি বিপ্লব ত্রিমুখী ছিল। বিপ্লবীদের দু’দল-গিরনডিন ও জ্যাকোবিন এবং রাজা। বিপ্লবীরা জিতে গেলে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে ‘জাতীয় ক্ষুর’ (national razor) বলে আখ্যায়িত ‘গিলোটিনে’ যা আজো প্যারিসের উপকণ্ঠে স্মৃতি হিসেবে আছে। এই গিলোটিনে প্রাণ যায় বহু বিখ্যাত ব্যক্তিরও। যেমন রাজা ষষ্ঠদশ লুই রানী, ম্যারি অ্যানতোনিয়ে, ডিউক অব অরলিয়ানস, মাদাম রোঁলা; এমনকি বিজ্ঞানী ল্যাভয়শিয়ের।
[উল্লেখ্য, ‘টেরর’ শব্দটি ল্যাটিন ‘টেরিও’ থেকে উদ্ভূত। অর্থ ‘আমি ভয় দেখাই’ (I frighten)। সে সময় এ কাজটি শুধু সরকারের (বা ক্ষমতাসীনদের) করার অধিকার ছিল।
ড. জালমান মন্তব্য করেছেন, ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত সন্ত্রাস-পরবর্তী যুগগুলোর এবং সফল স্বাধীনতাকামীদের পথপ্রদর্শক হয়ে রইল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তার মর্যাদা হারিয়ে অন্যায় ও অপমানজনক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হলো যখন জ্যাকোবিনরা ফ্রান্সে ক্ষমতাচ্যুত হলো। জালমান লিখেছেন, ইহুদি পরিচালিত এবং প্রধানত পশ্চিমা বিশ্বের রফতানিকৃত এই কর্মকাণ্ড নানা বর্ণে ও আকারে ঊনবিংশ শতাব্দীর পরে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রধান বাহন পশ্চিমা সাম্রাজ্যশক্তি। এ শক্তি সর্বত্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রচণ্ড ব্যবহার করতে থাকে। তবে জালমানের মূল বক্তব্য হলো সন্ত্রাসের জন্ম আন্তর্জাতিক নেশনস্টেট পদ্ধতির মধ্য দিয়ে হলেও, এর সফলতা নির্ভর করে সংবাদমাধ্যমের ওপর। তারা ভীতির রাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মাঝে। ফলে সৃষ্ট হতে থাকে জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার প্রচেষ্টা। প্রচলিত পথ ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আসে ‘নৈরাজ্য’ (অ্যানারকি)। কেউ কেউ একে সাম্প্রদায়িকতা বলেন, আবার কেউ বলেন নেতৃত্বহীন স্বাধীনতা (গ্রিক শব্দ অ্যানারকস বা নেতাহীনতা)। এই সন্ত্রাসের মাধ্যমে ১৮৮১-১৯০১ সালের মধ্যে রাশিয়ার জার (১৮৮১), ফরাসি প্রেসিডেন্ট মারি ফ্রাসোয়া সাদি কারনট (১৮৯৪) ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ম্যাককিনলেকে হত্যা করা হয় এবং গ্রিনউইচ অবজারভেটরি আক্রমণ করা হয়েছে।
সন্ত্রাস নিয়ে সবচে’ বেশি আলোড়িত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর একটি কারণ, বিশ্বে প্রায় ১২০০ সামরিক ঘাঁটি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। দ্বিতীয়ত, একক পরাশক্তি হওয়ার কারণে বিশ্বের সব খবরদারি সে করে থাকে। তৃতীয়ত, প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী শক্তি এবং সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক বলে দোষারোপ করা হয়। ফলে পশ্চিমা শক্তিবর্গ এই কর্মকাণ্ডের মূলে কে, তা নির্ণয়ের নামে প্রায়ই তারা সরকার ও শক্তিকে অভিযুক্ত করার প্রয়াস দেখায়।
কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসের মূলে ধর্মের প্রেরণা আছে বলে ব্যাপক প্রচারণা চলছে। বিশেষ করে ‘ইসলামি সন্ত্রাস’ বলে কথাটি বেশি প্রচলিত। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এর প্রচার বেশি করে আসছে। ড. রবার্ট পাপে অক্টোবর ২০০৫ সালে পিউ ফোরামের জন্য ‘হোয়েদার ইসলামিক টেরোরিজম মটিভেটস টেরোরিজম’ (ইসলামি চরমপন্থা সন্ত্রাসের প্রেরণা জোগায় কি না) বলে এক অনুসন্ধান চালান এবং ৪৬২টি সুইসাইড টেরোরিস্টকে পরীক্ষা করেন। তার অনুসন্ধানের ফল হলো, ইসলাম কোনো সুইসাইড বা আত্মঘাতী সন্ত্রাসে প্রেরণা জোগায়নি। এই ৪৬২ জনের অর্ধেকের বেশি হলো সেকুলারপন্থী ও অন্যান্য। ‘জিহাদি’ বলে অভিহিত টেরোরিস্টরা মুসলমান বলে পরিচিত হলেও, তারা কেউই ইসলাম প্রতিপালন করে না। এদের বেশির ভাগ মদ ইত্যাদি নেশায় অভ্যস্ত, যা সত্যিকারের মুসলমানেরা এড়িয়ে চলে। সুইসাইড টেরোরিজমের নেতৃত্বে ছিল শ্রীলঙ্কার এলটিটিই যাদের সবাই হয় মার্ক্সিস্ট, নয় হিন্দু ও সেকুলার। এ ছাড়া ৯৫ ভাগ সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রেরণা এসেছে সেকুলার উদ্দেশ্য থেকে; কোনো ধর্মীয় আবেদন থেকে নয়। এ তথ্যগুলো ড. পাপে (Dr. Robert Pape) তার অনুসন্ধানে পেয়েছেন।
সম্ভবত সন্ত্রাসের ওপর সবচে’ চমৎকার তথ্য এসেছে অধ্যাপক এম হারম্যানের ‘দি রিয়াল টেরর নেটওয়ার্ক : টেরোরিজম ইন ফ্যাক্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা বইতে। তিনি বলেছেন, গত দুই দশকের সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা সামরিক অভিযান এবং তার কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই এসব সন্ত্রাসের জন্ম।
লেখক ড. রবার্ট জে বারোজ আরো ঋজু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস পশ্চিমা এলিটদের মোক্ষম অস্ত্র (Terrorism ultimate weapon of the global elite)। তিনি বলেছেন, এই সন্ত্রাস তাদের (পশ্চিমা এলিটদের) ভৌগোলিক কৌশলগত ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ (geostrategic events) করে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা পরিচালনার সুযোগ দেয়। বিশ্বের সব সম্পদকে তারা সহজেই কুক্ষিগত করতে পারছে।
তাই সন্ত্রাসের চর্চা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এত প্রিয়। এবং এ বীভৎস ঘটনাগুলোর বিশদ তাৎক্ষণিক বিবরণ সবাইকে চমৎকৃত করে থাকে। এটা তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ বলে তারা হাজির করে। তবে যদি কেউ এই গল্পের মাঝে ফাঁক বের করে দেয়, তখন তার রক্ষা থাকে না।
ড. বারোজ বলেছেন, সন্ত্রাসের ভয় দেখিয়ে এই এলিটরা তাদের নিজেদের মানুষকেও বশে রাখে এবং বিশ্বের সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোতে গত ৫০ বছর ধরে নানা অজুহাতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে শুধু এ সম্পদ দখল-নিয়ন্ত্রণ-ভোগের জন্য। (By harping on threat of terrorism to scare domestic population, western elites and their allies are able to maintain perpetual war)
আবার কখনো কখনো কোনো হত্যাকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাস’ বলে দাবি করে জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। যেমন, ফ্রান্সের শার্লি এবদো ব্যঙ্গ ম্যাগাজিনের অফিসে হামলার ঘটনার পর যে বিশাল আক্রমণ পরিচালিত হয়, তার রেশ এখনো রয়েছে। খোদ ফরাসি সরকারই তাদের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রতিবাদের ব্যবস্থা করে এবং সাথে সাথে অন্তত ৫৫টি মসজিদ, মুসলিম লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। অথচ আজো জানা যায়নি, কে শার্লির ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল? যদিও শত শত প্রমাণ বিভিন্ন জন পেশ করে বলেছেন, এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড শুধু মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আর ভয়ের মাঝে রাখা এবং তথ্য বিভ্রান্তি ঘটানোর জন্য।
প্রফেসর এমিরিটাস এডওয়ার্ড হারমান (পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত লেখক) তার বই ‘রিয়েল টেরর নেটওয়ার্ক’-এ দেখিয়েছেন কেমন করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সরকারি বক্তব্যকে কোনো প্রশ্ন না করে ব্যাপক প্রচার করে সারা বিশ্বে ভীতির সৃষ্টি করছে। তিনি বলেছেন, তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই সন্ত্রাস প্রচারের ব্যাপারে।
গত সপ্তাহে ‘কাউন্টারপাঞ্চ’ ওয়েবে দার্শনিক আঁদ্রে ভিল্টচেক এবং নোয়াম চমস্কির এক আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে এই সন্ত্রাস ভীতির ওপর। এ প্রবন্ধের প্রথম প্যারাই পশ্চিমা শক্তির মানসিকতার প্রকাশ ঘটায়। 'Southeast Asian elites forgot those tens of millions of Asian people murdered by the Western Imperialism at the end of and after WWII. They forgot about what took place in the northÑ about the Tokyo firebombing, about Hiroshima Nagasaki atomic bombs, about barbaric liquidation of Korean civilians. But they forgot... the millions of those who were blown to pieces by chemicals or directly liquidated .... in Vietnam, Cambodia, Laos, Indonesia, Phillippines... তা সত্ত্বেও অধ্যাপক ড. তেরেসা এস এনকারনাসিও টাডেম (ফিলিপাইন ডিলিমা বিশ্ববিদ্যালয়) এক সাক্ষাৎকারে প্রচলিত প্রবাদের ব্যাখ্যা করেন। প্রবাদ হলো, ফিলিপিনোরা মার্কিনিদের এত ভালোবাসে (এত হত্যা-অনাচার-অত্যাচারের পর) যে, মার্কিনিরা নিজেদেরও এত ভালোবাসে না। অধ্যাপক টাডেম বলেন, ‘এর কারণ, মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রচার।’ এ প্রচারে মার্কিন হত্যাকাণ্ড ও দখলকে সুস্থ, সুন্দর গণতান্ত্রিক জীবন ধারার জন্য প্রয়োজন ছিল বলে দাবি করা হয়। ৫০ বছর ধরে হলিউড এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এ এলাকার মানুষের মগজ ধোলাইতে সক্ষম হয়েছে বলে অধ্যাপক টাডেম উল্লেখ করেছেন।
তার সাথে একই বক্তব্য দিয়েছেন ড. বারোজ।Needless to say, the (Western) elite makes good use of its paid agents in academia, think tanks, the corporate media and elsewhere to make sure that you are kept carefully misinformed and told what to think and how to react. অর্থাৎ চিন্তার ইচ্ছাটুকুও নিয়ে নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়টি- নৈতিকতার শিক্ষাকে কৌশলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এখন কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কোনো মুসলিম নাম পেলে হুলস্থূল পড়ে যাচ্ছে- ‘ইসলামিক টেরোরিজম’। কিন্তু যখন হিসাব নিতে যাওয়া হয় এবং তা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গের মাঝ দিয়ে, তখন দেখা যায়, সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। শার্লি এবদো নিয়ে হইচই হলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগন কলেজে ১০ জন ছাত্র হত্যাকে একটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দাবি করা হচ্ছে। অধ্যাপক ড. হেনরি এ জিরো (Henry A Giroux, McMaster University Chair and Distinguished Visiting Professor) গত সপ্তাহে তার ‘হোয়াই পলিটিশিয়ানস হ্যাভ ব্লাড ইন দেয়ার হ্যান্ড’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ওরিগনের এই হত্যাকাণ্ড ৪১টি স্কুলে এর আগে ঘটেছে। ২০১২ সালে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ১৪২টি স্কুলে এমন গোলাগুলি হয়। এ বছর মোট ৩০০ এমন গোলাগুলি হয়েছে। তবুও এগুলো সন্ত্রাস নয়। আবার নর্থ ক্যারোলিনার চ্যাপেল হিলে তিনজন মুসলিম ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করা হলে এটা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বলায়, তড়িঘড়ি করে সরকারিভাবে বলা হলো, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সন্ত্রাস নয়। আসলে, অধ্যাপক জিরো বলেছেন, "Violence (in the West) is treated as a sport, a pleasure-producing industry, a source of major profits for defense industries and a corrosive influence upon democracy."
সাবেক CIA অফিসার ও কাউন্সিল অব ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের ডাইরেক্টর ফিলিপ জিরালডি (Philip Giraldi) তার আমেরিকান কনজারভেটিভ ম্যাগাজিনে "How governments twist terrorism" প্রবন্ধে একটি মোক্ষম বক্তব্য দিয়েছেন। "Governments are aware of what can be accomplished by invoking the word terrorism... frequently hides behind this label... and justifies... (their) violent response." সরকার সন্ত্রাসের (দমন ইত্যাদি) নামে যে কর্মকাণ্ড চালায়, তার খবর জিরাল্ডিই সবচেয়ে ভালো জানেন। তার ভাষায়, যখনই সরকার কোনো হত্যাকাণ্ড বা এমন ঘটনাকে সন্ত্রাস বলে চালাতে চায় তখনই বুঝতে হবে, হয় সে তার অপকর্ম ঢাকতে চাইছে নতুবা তার প্রতিপক্ষ, বিরোধী দল বা সমালোচকদের স্তব্ধ বা নির্মূল করতে চাইছে।
আসলে ক্ষমতাসীনেরা যুগে যুগে জনগণকে নিষ্পেষণের নিগড়ে বদ্ধ রাখতে এমন কৌশল বারবার আবিষ্কার করেছে। সন্ত্রাসের বিষয়টি সর্বশেষ। হয়তো বা আরো আসবে। যারা বিশ্ব খেলোয়াড় তারা কোনো জাতিকে তাক করে, যেমন এখন মুসলমানেরা। আর যারা সরকারে থাকে, তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে। আর তাদের মোক্ষম অস্ত্র হলো সন্ত্রাসের জিগির।
কয়েক মাস আগে ঠিক এমনি তৎপরতা চলছিল। তখন ভারত ও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একটি উদ্বেগ এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম। তারা বলছিলেন ওরা (আইএসআই ইত্যাদি) বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে অথবা এসে পৌঁছেছে। কিছু সংবাদমাধ্যমও এ নিয়ে বিশেষ আলোড়ন করতে থাকে। ধরপাকড়, বক্তব্য ইত্যাদি চলতে থাকে।
তখন এই আইএস-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। এই আইএস বা ইসলামিক স্টেট কী, কারা, কেন তাদের অভ্যুদয়, কে তাদের কর্মকাণ্ডে লাভবান হচ্ছে, তাদের সমর্থন কে করছে, তাদের খবর পশ্চিমা মাধ্যমে এত দ্রুত কেমন করে পৌঁছায়, এত অর্থ, অস্ত্র, জনবল সংগ্রহ ও ব্যবহার কেমন করে সম্ভব? এমন প্রশ্ন অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমও করেছে। তবে এর সঠিক জবাব পাওয়া যায়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা এই অনাচার-হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে বেশির ভাগ সময়ই সমালোচক-বিরোধীদের নির্মূল-নিশ্চুপ করে দেয়ার কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে থাকে।
সন্ত্রাস নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া গেছে। তাই এখানে ‘টেররিজম’ বা সন্ত্রাসের ইতিহাস একটু আলোচনা করা যায়। সন্ত্রাস বিশারদ (Terrorism expert) ড. অ্যামি জালমান তার দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সিকারি (Sicarii) নামে পরিচিত (সিকারী অর্থ-চাকুওয়ালা) ইহুদি গোষ্ঠী রোমের শাসক কর্মচারীদের গুপ্তহত্যা-আক্রমণ করতো ছোট ছোট চাকু দিয়ে। রোমানরা তার প্রতিদানও দিত একই উপায়ে। তখনই এই ইহুদি হত্যাকাণ্ড সন্ত্রাসের জন্ম দেয়।
ড. জালমান লিখেছেন, আসলে ‘সন্ত্রাস’ বলতে বর্তমানের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ১৭৯৩ সালে। ফরাসি বিপ্লবের নেতা ম্যাক্সমিলিয়ান রোবেসপিয়ার তার অনুসারীদের দিয়ে বিরোধীদের নির্মূলের লক্ষ্যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। তার অনুসারীদের বলা হতো ‘টেরোরিস্ট’ (শব্দটিও ফরাসি থেকে উদ্ভূত) এবং এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ১৭৯৫ থেকে। কারণ এই অনুসারীরা সরকারি লোক। আর এই টেরোরিস্টরা ভয়ের ও সম্মানের লোক ছিল। রোবেসপিয়ার তার এই হত্যা ও ভীতির কৌশল সমর্থন করে বলেছেন, এ ছাড়া ফরাসি রাজশাসন করা সম্ভব ছিল না। ফরাসি বিপ্লব ত্রিমুখী ছিল। বিপ্লবীদের দু’দল-গিরনডিন ও জ্যাকোবিন এবং রাজা। বিপ্লবীরা জিতে গেলে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে ‘জাতীয় ক্ষুর’ (national razor) বলে আখ্যায়িত ‘গিলোটিনে’ যা আজো প্যারিসের উপকণ্ঠে স্মৃতি হিসেবে আছে। এই গিলোটিনে প্রাণ যায় বহু বিখ্যাত ব্যক্তিরও। যেমন রাজা ষষ্ঠদশ লুই রানী, ম্যারি অ্যানতোনিয়ে, ডিউক অব অরলিয়ানস, মাদাম রোঁলা; এমনকি বিজ্ঞানী ল্যাভয়শিয়ের।
[উল্লেখ্য, ‘টেরর’ শব্দটি ল্যাটিন ‘টেরিও’ থেকে উদ্ভূত। অর্থ ‘আমি ভয় দেখাই’ (I frighten)। সে সময় এ কাজটি শুধু সরকারের (বা ক্ষমতাসীনদের) করার অধিকার ছিল।
ড. জালমান মন্তব্য করেছেন, ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত সন্ত্রাস-পরবর্তী যুগগুলোর এবং সফল স্বাধীনতাকামীদের পথপ্রদর্শক হয়ে রইল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তার মর্যাদা হারিয়ে অন্যায় ও অপমানজনক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হলো যখন জ্যাকোবিনরা ফ্রান্সে ক্ষমতাচ্যুত হলো। জালমান লিখেছেন, ইহুদি পরিচালিত এবং প্রধানত পশ্চিমা বিশ্বের রফতানিকৃত এই কর্মকাণ্ড নানা বর্ণে ও আকারে ঊনবিংশ শতাব্দীর পরে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রধান বাহন পশ্চিমা সাম্রাজ্যশক্তি। এ শক্তি সর্বত্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রচণ্ড ব্যবহার করতে থাকে। তবে জালমানের মূল বক্তব্য হলো সন্ত্রাসের জন্ম আন্তর্জাতিক নেশনস্টেট পদ্ধতির মধ্য দিয়ে হলেও, এর সফলতা নির্ভর করে সংবাদমাধ্যমের ওপর। তারা ভীতির রাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মাঝে। ফলে সৃষ্ট হতে থাকে জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার প্রচেষ্টা। প্রচলিত পথ ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আসে ‘নৈরাজ্য’ (অ্যানারকি)। কেউ কেউ একে সাম্প্রদায়িকতা বলেন, আবার কেউ বলেন নেতৃত্বহীন স্বাধীনতা (গ্রিক শব্দ অ্যানারকস বা নেতাহীনতা)। এই সন্ত্রাসের মাধ্যমে ১৮৮১-১৯০১ সালের মধ্যে রাশিয়ার জার (১৮৮১), ফরাসি প্রেসিডেন্ট মারি ফ্রাসোয়া সাদি কারনট (১৮৯৪) ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ম্যাককিনলেকে হত্যা করা হয় এবং গ্রিনউইচ অবজারভেটরি আক্রমণ করা হয়েছে।
সন্ত্রাস নিয়ে সবচে’ বেশি আলোড়িত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর একটি কারণ, বিশ্বে প্রায় ১২০০ সামরিক ঘাঁটি আছে যুক্তরাষ্ট্রের। দ্বিতীয়ত, একক পরাশক্তি হওয়ার কারণে বিশ্বের সব খবরদারি সে করে থাকে। তৃতীয়ত, প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী শক্তি এবং সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক বলে দোষারোপ করা হয়। ফলে পশ্চিমা শক্তিবর্গ এই কর্মকাণ্ডের মূলে কে, তা নির্ণয়ের নামে প্রায়ই তারা সরকার ও শক্তিকে অভিযুক্ত করার প্রয়াস দেখায়।
কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসের মূলে ধর্মের প্রেরণা আছে বলে ব্যাপক প্রচারণা চলছে। বিশেষ করে ‘ইসলামি সন্ত্রাস’ বলে কথাটি বেশি প্রচলিত। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এর প্রচার বেশি করে আসছে। ড. রবার্ট পাপে অক্টোবর ২০০৫ সালে পিউ ফোরামের জন্য ‘হোয়েদার ইসলামিক টেরোরিজম মটিভেটস টেরোরিজম’ (ইসলামি চরমপন্থা সন্ত্রাসের প্রেরণা জোগায় কি না) বলে এক অনুসন্ধান চালান এবং ৪৬২টি সুইসাইড টেরোরিস্টকে পরীক্ষা করেন। তার অনুসন্ধানের ফল হলো, ইসলাম কোনো সুইসাইড বা আত্মঘাতী সন্ত্রাসে প্রেরণা জোগায়নি। এই ৪৬২ জনের অর্ধেকের বেশি হলো সেকুলারপন্থী ও অন্যান্য। ‘জিহাদি’ বলে অভিহিত টেরোরিস্টরা মুসলমান বলে পরিচিত হলেও, তারা কেউই ইসলাম প্রতিপালন করে না। এদের বেশির ভাগ মদ ইত্যাদি নেশায় অভ্যস্ত, যা সত্যিকারের মুসলমানেরা এড়িয়ে চলে। সুইসাইড টেরোরিজমের নেতৃত্বে ছিল শ্রীলঙ্কার এলটিটিই যাদের সবাই হয় মার্ক্সিস্ট, নয় হিন্দু ও সেকুলার। এ ছাড়া ৯৫ ভাগ সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রেরণা এসেছে সেকুলার উদ্দেশ্য থেকে; কোনো ধর্মীয় আবেদন থেকে নয়। এ তথ্যগুলো ড. পাপে (Dr. Robert Pape) তার অনুসন্ধানে পেয়েছেন।
সম্ভবত সন্ত্রাসের ওপর সবচে’ চমৎকার তথ্য এসেছে অধ্যাপক এম হারম্যানের ‘দি রিয়াল টেরর নেটওয়ার্ক : টেরোরিজম ইন ফ্যাক্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা বইতে। তিনি বলেছেন, গত দুই দশকের সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা সামরিক অভিযান এবং তার কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই এসব সন্ত্রাসের জন্ম।
লেখক ড. রবার্ট জে বারোজ আরো ঋজু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস পশ্চিমা এলিটদের মোক্ষম অস্ত্র (Terrorism ultimate weapon of the global elite)। তিনি বলেছেন, এই সন্ত্রাস তাদের (পশ্চিমা এলিটদের) ভৌগোলিক কৌশলগত ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ (geostrategic events) করে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা পরিচালনার সুযোগ দেয়। বিশ্বের সব সম্পদকে তারা সহজেই কুক্ষিগত করতে পারছে।
তাই সন্ত্রাসের চর্চা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এত প্রিয়। এবং এ বীভৎস ঘটনাগুলোর বিশদ তাৎক্ষণিক বিবরণ সবাইকে চমৎকৃত করে থাকে। এটা তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ বলে তারা হাজির করে। তবে যদি কেউ এই গল্পের মাঝে ফাঁক বের করে দেয়, তখন তার রক্ষা থাকে না।
ড. বারোজ বলেছেন, সন্ত্রাসের ভয় দেখিয়ে এই এলিটরা তাদের নিজেদের মানুষকেও বশে রাখে এবং বিশ্বের সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোতে গত ৫০ বছর ধরে নানা অজুহাতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে শুধু এ সম্পদ দখল-নিয়ন্ত্রণ-ভোগের জন্য। (By harping on threat of terrorism to scare domestic population, western elites and their allies are able to maintain perpetual war)
আবার কখনো কখনো কোনো হত্যাকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাস’ বলে দাবি করে জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। যেমন, ফ্রান্সের শার্লি এবদো ব্যঙ্গ ম্যাগাজিনের অফিসে হামলার ঘটনার পর যে বিশাল আক্রমণ পরিচালিত হয়, তার রেশ এখনো রয়েছে। খোদ ফরাসি সরকারই তাদের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রতিবাদের ব্যবস্থা করে এবং সাথে সাথে অন্তত ৫৫টি মসজিদ, মুসলিম লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। অথচ আজো জানা যায়নি, কে শার্লির ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল? যদিও শত শত প্রমাণ বিভিন্ন জন পেশ করে বলেছেন, এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড শুধু মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আর ভয়ের মাঝে রাখা এবং তথ্য বিভ্রান্তি ঘটানোর জন্য।
প্রফেসর এমিরিটাস এডওয়ার্ড হারমান (পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত লেখক) তার বই ‘রিয়েল টেরর নেটওয়ার্ক’-এ দেখিয়েছেন কেমন করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সরকারি বক্তব্যকে কোনো প্রশ্ন না করে ব্যাপক প্রচার করে সারা বিশ্বে ভীতির সৃষ্টি করছে। তিনি বলেছেন, তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই সন্ত্রাস প্রচারের ব্যাপারে।
গত সপ্তাহে ‘কাউন্টারপাঞ্চ’ ওয়েবে দার্শনিক আঁদ্রে ভিল্টচেক এবং নোয়াম চমস্কির এক আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে এই সন্ত্রাস ভীতির ওপর। এ প্রবন্ধের প্রথম প্যারাই পশ্চিমা শক্তির মানসিকতার প্রকাশ ঘটায়। 'Southeast Asian elites forgot those tens of millions of Asian people murdered by the Western Imperialism at the end of and after WWII. They forgot about what took place in the northÑ about the Tokyo firebombing, about Hiroshima Nagasaki atomic bombs, about barbaric liquidation of Korean civilians. But they forgot... the millions of those who were blown to pieces by chemicals or directly liquidated .... in Vietnam, Cambodia, Laos, Indonesia, Phillippines... তা সত্ত্বেও অধ্যাপক ড. তেরেসা এস এনকারনাসিও টাডেম (ফিলিপাইন ডিলিমা বিশ্ববিদ্যালয়) এক সাক্ষাৎকারে প্রচলিত প্রবাদের ব্যাখ্যা করেন। প্রবাদ হলো, ফিলিপিনোরা মার্কিনিদের এত ভালোবাসে (এত হত্যা-অনাচার-অত্যাচারের পর) যে, মার্কিনিরা নিজেদেরও এত ভালোবাসে না। অধ্যাপক টাডেম বলেন, ‘এর কারণ, মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রচার।’ এ প্রচারে মার্কিন হত্যাকাণ্ড ও দখলকে সুস্থ, সুন্দর গণতান্ত্রিক জীবন ধারার জন্য প্রয়োজন ছিল বলে দাবি করা হয়। ৫০ বছর ধরে হলিউড এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এ এলাকার মানুষের মগজ ধোলাইতে সক্ষম হয়েছে বলে অধ্যাপক টাডেম উল্লেখ করেছেন।
তার সাথে একই বক্তব্য দিয়েছেন ড. বারোজ।Needless to say, the (Western) elite makes good use of its paid agents in academia, think tanks, the corporate media and elsewhere to make sure that you are kept carefully misinformed and told what to think and how to react. অর্থাৎ চিন্তার ইচ্ছাটুকুও নিয়ে নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয়টি- নৈতিকতার শিক্ষাকে কৌশলে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এখন কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কোনো মুসলিম নাম পেলে হুলস্থূল পড়ে যাচ্ছে- ‘ইসলামিক টেরোরিজম’। কিন্তু যখন হিসাব নিতে যাওয়া হয় এবং তা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গের মাঝ দিয়ে, তখন দেখা যায়, সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। শার্লি এবদো নিয়ে হইচই হলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগন কলেজে ১০ জন ছাত্র হত্যাকে একটি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দাবি করা হচ্ছে। অধ্যাপক ড. হেনরি এ জিরো (Henry A Giroux, McMaster University Chair and Distinguished Visiting Professor) গত সপ্তাহে তার ‘হোয়াই পলিটিশিয়ানস হ্যাভ ব্লাড ইন দেয়ার হ্যান্ড’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ওরিগনের এই হত্যাকাণ্ড ৪১টি স্কুলে এর আগে ঘটেছে। ২০১২ সালে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ১৪২টি স্কুলে এমন গোলাগুলি হয়। এ বছর মোট ৩০০ এমন গোলাগুলি হয়েছে। তবুও এগুলো সন্ত্রাস নয়। আবার নর্থ ক্যারোলিনার চ্যাপেল হিলে তিনজন মুসলিম ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করা হলে এটা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বলায়, তড়িঘড়ি করে সরকারিভাবে বলা হলো, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সন্ত্রাস নয়। আসলে, অধ্যাপক জিরো বলেছেন, "Violence (in the West) is treated as a sport, a pleasure-producing industry, a source of major profits for defense industries and a corrosive influence upon democracy."
সাবেক CIA অফিসার ও কাউন্সিল অব ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের ডাইরেক্টর ফিলিপ জিরালডি (Philip Giraldi) তার আমেরিকান কনজারভেটিভ ম্যাগাজিনে "How governments twist terrorism" প্রবন্ধে একটি মোক্ষম বক্তব্য দিয়েছেন। "Governments are aware of what can be accomplished by invoking the word terrorism... frequently hides behind this label... and justifies... (their) violent response." সরকার সন্ত্রাসের (দমন ইত্যাদি) নামে যে কর্মকাণ্ড চালায়, তার খবর জিরাল্ডিই সবচেয়ে ভালো জানেন। তার ভাষায়, যখনই সরকার কোনো হত্যাকাণ্ড বা এমন ঘটনাকে সন্ত্রাস বলে চালাতে চায় তখনই বুঝতে হবে, হয় সে তার অপকর্ম ঢাকতে চাইছে নতুবা তার প্রতিপক্ষ, বিরোধী দল বা সমালোচকদের স্তব্ধ বা নির্মূল করতে চাইছে।
আসলে ক্ষমতাসীনেরা যুগে যুগে জনগণকে নিষ্পেষণের নিগড়ে বদ্ধ রাখতে এমন কৌশল বারবার আবিষ্কার করেছে। সন্ত্রাসের বিষয়টি সর্বশেষ। হয়তো বা আরো আসবে। যারা বিশ্ব খেলোয়াড় তারা কোনো জাতিকে তাক করে, যেমন এখন মুসলমানেরা। আর যারা সরকারে থাকে, তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে। আর তাদের মোক্ষম অস্ত্র হলো সন্ত্রাসের জিগির।
No comments:
Write comments