রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে’, তাতে কী?

কাজে যতই লবডংকা হোক, ভালো ভালো কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের কোনো জুড়ি নেই। এখানে খারাপ মানুষরাও ভালো কথা বলার ক্ষেত্রে ওস্তাদ। একজন দাগী অপরাধীকে টিভি-টকশোতে নিয়ে আসুন। দেখবেন তিনিও মনীষীদের মতো কথা বলছেন। তার কথা শুনেও আপনার মনে হবে, ঠিক, তাইতো। ইস্, লোকটা মনে হয় ষড়যন্ত্রের শিকার। এত ভালো ভালো কথা যে বলেন, তিনি কিছুতেই এমন দাগী অপরাধী হতে পারেন না! আহ্, লোকটার সঙ্গে একটা সেলফি তুলে যদি ফেসবুকে কিংবা ইনস্টাগ্রামে আপলোড করতে পারতাম!
তবে কিছু মানুষ আছে, যারা আসলেই ভালো করে এবং ভালো ভালো কথা বলতে পারেন। তাদের ব্যাপারে কারও কিছু বলার নেই। বরং তাদের কথা শোনা বা শুনতে পারাটাও জীবনে একটা পরম পাওয়া। আমাদের পরম পূজনীয় মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর অবশ্য বিভিন্ন জাতীয় দিবসে, উত্সবে-অনুষ্ঠানে জাতির উদ্দেশ্যে ‘বাণী’ এবং কিছু ভালো ভালো কথা বলা ছাড়া অন্য কোনো ব্রতও নেই। যাহোক, আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে, যা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। গত সোমবার বিকেলে নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে নাগরিক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
আবদুল হামিদ বলেন, সততা বজায় না রাখলে একজন রাজনীতিবিদ কিছুই করতে সক্ষম হবেন না। কেউ যদি অর্থ-বিত্ত করতে চান, তাহলে তাদের জন্য অনেক উপায় আছে। তাদের রাজনীতিতে আসা উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমার রাজনীতি মানুষের কল্যাণে। অবৈধভাবে সরকারি কাজ থেকে একটি লাল পয়সাও পকেটে নিইনি।’
মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো নিঃসন্দেহে খুব, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা, ভাবনার কথা। কিন্তু রাষ্ট্রপতি মহোদয় কি ঠিক কথা বলেছেন?
মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে, যা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। রাজনীতি যদি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যায়, তাহলে ক্ষতি কী? ব্যবসায়ীরা কি মানুষ না? তাদের কী সাধ-আহলাদ বলে কিছু নেই? মহামান্য রাষ্ট্রপতি কী তবে চান যে, তাঁর মতো রাজনীতিকরাই কেবল যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দেশ পরিচালনা করুক? রাজনীতি করুক?
ব্যবসায়ীদের পকেটে যদি রাজনীতি চলে যায়, তবে সেটা কলঙ্কজনক অধ্যায় হবে কেন? আর ব্যবসায়ীদের পকেটে তো কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিই যায়নি, বিশ্বরাজনীতিই চলে গেছে। বিশ্ব যদি গোল্লায় যায়, তাহলে বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে কোন মন্ত্রে? নগর পুড়লে দেবালয় বাঁচানোর চেষ্টা কি কখনও সফল হয়?
বর্তমান যুগটাই হচ্ছে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের যুগ। সবখানে ব্যবসা, সবকিছুতে ব্যবসা। আমরা বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও চরিত্রের নড়াচড়া দেখি বটে, কিন্তু আড়ালে সেখানেও আছে ব্যবসা, আছে নানা রঙের ব্যবসায়ী। এই দুনিয়ায় এখন কে যে ব্যবসায়ী আর কে নয়, সেটা একটা কঠিন ধাঁধা। বিল গেটস-জকোবার্গ হলেন তথ্য-প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ী, তালেবান-আইএসসহ জঙ্গিরা হলো ধর্মব্যবসায়ী, আইসিসি-ফিফা হলো ক্রীড়া ব্যবসায়ী, হলিউড-বলিউড হলো সংস্কৃতি ও ফ্যাশন ব্যবসায়ী, আইএমএফ, এডিবি, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থাগুলো হচ্ছে উন্নয়ন ব্যবসায়ী, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রেডক্রসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা মানবাধিকার ব্যবসায়ী। সমাজতন্ত্রী-গণতন্ত্রী, মানবতাতন্ত্রী সবারই কম-বেশি একটাই ধান্ধা—সেটা হচ্ছে ব্যবসা। গোটা দুনিয়ায় এখন একটাই ‘ইজম’ তা হচ্ছে ‘সুবিধাবাদিজম’। ‘আমি-তুমি-সে-তারা’ সবাই পণ্য। রাজনীতিও পণ্য। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের পকেট থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা যাবে কীভাবে? আর সেটা করার দরকারটাই বা কী?
ব্যবসা খুবই ভালো বৃত্তি। ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কথাই হচ্ছে লাভ। যে কোনো উপায়ে লাভ করাই একজন ব্যবসায়ীর প্রধান লক্ষ্য। শুধু লাভ নয়, মহালাভ খোঁজেন তারা। লাভ করতে গিয়ে কোনো ঝুটঝামেলা, ইনকাম ট্যাক্স, সেল্স ট্যাক্স, কাস্টমস, পুলিশ, মামলা, অসন্তোষ, হরতাল, ধর্মঘটে জড়িয়ে না পড়েন—ব্যবসায়ীদের মনে এই আকাঙ্ক্ষাও প্রবলভাবে কাজ করে। তবে ব্যবসা করা সহজ কাজ নয়। অনেক ঝানু ব্যক্তি ব্যবসা করতে গিয়ে ফতুর হয়েছেন, আবার অনেক হাঁদারামও ব্যবসায় সফল হয়ে কোটিপতি বনেছেন। উভয় প্রকার উদাহরণই আমাদের সমাজে ভূরিভূরি আছে। প্রখর বুদ্ধি, কঠোর পরিশ্রম, অমিত আত্মবিশ্বাস, সেইসঙ্গে ভাগ্যদেবীর সুনজর—এসব না হলে ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না।
হ্যাঁ, সেইসঙ্গে সততাও প্রয়োজন। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম দোকানে কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে—সততাই আমাদের একমাত্র মূলধন। আজকাল অবশ্য এরকম কোনো ঘোষণাপত্র কোনো দোকানে বা শোরুমের দেয়ালে দেখা যায় না। পুরো সমাজ থেকেই যেখানে সততা বিদায় হয়েছে, সেখানে দোকানে তা আর টিকে থাকবে কীভাবে? ব্যবসায় সততা বলতে যে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তেমন নয়; সততা এখনও আছে। তবে তা ভিন্ন সংজ্ঞায়, আলাদা মানে নিয়ে।
আমাদের দেশে গত প্রায় দুই যুগ ধরে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বেশ ভালোই লাভ করছে। লবণ, সয়াবিন তেল, তৈরি পোশাক, ঝুট কাপড়, বালু, জমি, ফ্ল্যাট, ইয়াবা থেকে শুরু করে শেয়ার ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত নানা কারসাজিতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণের সরকারি প্রচেষ্টা কোনো কাজে দেয়নি। তবে চোরের ওপর বাটপাড়ি শুরু করেছে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীচক্র। ব্যবসায়ীদের লাভের গুড়ে এই চক্র ভাগ বসাচ্ছে। বনিবনা না হলে দু’একজন মাঝারি গোছের ব্যবসায়ী খুনও হচ্ছেন। সরকার কার পক্ষ নেবে? এই দু’পক্ষই যে তাদের একান্ত আপনজন!
আগে মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করত। তাদের স্বার্থের পক্ষে নীতি ও আইন প্রণয়নের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত। বর্তমানে ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদরাই ব্যবসায়ী। এখন আর তোয়াজ-তোষামোদের বালাই নেই। এখন তারা সর্বেসর্বা। তারা নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন যেমন করছেন, নিজেদের প্রয়োজনে সেই আইনকে বুড়ো আঙ্গুলও দেখাচ্ছেন। দেখারও কেউ নেই আর বলারও কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীসহ দু’চারজন ছাড়া বাকি সবাই প্রায় নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কাজেই তারাই এখন নীতি-নির্ধারক। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আমাদের মতো আমপাবলিকের হারিকেন হাতে নিয়ে বসে থাকা ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, সততা বজায় না রাখলে একজন রাজনীতিবিদ কিছুই করতে সক্ষম হবেন না। কেউ যদি অর্থ-বিত্ত করতে চান, তাহলে তাদের জন্য অনেক উপায় আছে। তাদের রাজনীতিতে আসা উচিত নয়।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি এটা কী বললেন! সততা ছাড়াই যেখানে রাজনীতি করা সম্ভব হচ্ছে, অর্থ-বিত্ত-বৈভব অর্জন করা যাচ্ছে, সেখানে মানুষজন রাজনীতির পথ ছাড়তে যাবে কোন দুঃখে? কেউ যদি বিনাশ্রমে দ্রুত অর্থ-বিত্তের মালিক হতে চান তাদের তো বরং ঝাঁক বেঁধে রাজনীতিতে নামা উচিত। অনেকে তা নামছেনও। রাজনীতি হয়ে উঠেছে টাকা কামানোর সবচেয়ে লাগসই ও কার্যকর মেশিন! সেই ‘অতি লাভজনক’ রাজনীতি ছেড়ে মানুষ টাকা-কামানোর জন্য অন্য পথ ধরতে যাবে? মানুষ কি পাগল না মাথা খারাপ?
মহামান্য রাষ্ট্রপতি নাকি ‘অবৈধভাবে সরকারি কাজ থেকে একটি লাল পয়সাও পকেটে’ নেননি। এটা কী গর্ব করার মতো কোনো বিষয় হলো? বেশিরভাগ রাজনীতিক যেখানে সরকারি তহবিল ও জনগণের জন্য বরাদ্দ টাকা নয়-ছয় করে শুধু পকেট নয়, বিদেশি ব্যাংক ভর্তি করেন, সেখানে কেউ যদি অবৈধভাবে সরকারি কাজ থেকে একটি লাল পয়সাও পকেটে না নেন, সেটা মোটেও সম্মান ও গৌরবের নয়। এটা স্রেফ ব্যর্থতা। মূঢ়তা। ব্যবসায়ীদের কি পেট নেই? বাচ্চাকাচ্চা নেই? তাদের কি খেতে-পরতে, আরাম-আয়েশে থাকতে হয় না? তাদের শখ-ইচ্ছে নেই? অসুখ-বিসুখ নেই? চিত্তবিনোদনের দরকার হয় না? এসব কী হাওয়া থেকে আসে? তাছাড়া রাজনীতি করতে হলে ছোটাছুটি করতে হয়, কর্মী পুষতে হয়। আর এজন্য কাড়ি কাড়ি টাকা লাগে। এই টাকা কোত্থেকে আসবে? রাজনীতিকরা যদি ব্যবসায়ী না হন, তাহলে তাদের ভরণ-পোষণ, কর্মী ও ক্যাডার তোষণের খরচা কে দেবে? ভূতে জোগাবে!
যমুনা নদীর তীরে বসে জল পিপাসায় কেউ যদি মারা যান, তাহলে তাকে আমরা কৃতিত্ব দেব কোন যুক্তিতে? মহামান্য রাষ্ট্রপতি কী তবে আমাদের বোকা হতে উত্সাহিত করছেন?
চিররঞ্জন সরকার, লেখক:কলাম লেখক
No comments:
Write comments