মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক
২০১৫ সালের মেডিক্যাল ও ডেন্টালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রথমে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ও পরে ফেসবুকের মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে যারা মেধাবী কিন্তু ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পায়নি তাদের কেউই- ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
পক্ষান্তরে মেডিক্যালে পড়াকে যারা ব্যবসায়ের দৃষ্টিতে দেখে সেসব অসৎ ধনীর সন্তানরা এবং পড়ালেখার পরিবর্তে ফেসবুকে সময় কাটানো শিক্ষার্থীরা হতে পেরেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকার সমর্থকদের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কারণ পরীক্ষার পূর্বেই ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্নপত্র এবং পরীক্ষা হলে পাওয়া প্রশ্নপত্রের মধ্যে হুবহু মিল পাওয়া যায়। বহু শিক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ফেসবুকেও স্বীকারোক্তি দিয়েছে। র্যাব-এর অভিযানে ঢাকা ও রংপুর থেকে যে ১১ জনকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আলামত থেকেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজের বেশ কয়েকজন ডাক্তার এবং তথাকার দু’টি কোচিং সেন্টার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত। ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত রংপুরের এক রিপোর্টারের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত চক্রের ৪ জন গ্রেফতার হওয়ার পর র্যাব রংপুরে এ ওয়ান নামের কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে তিনজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মনজুর হোসেন, ডা. মোস্তাফিজুর, ডা. জিল্লুর রহমান, ডা. শরিফুল ইসলাম প্রমুখেরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের জালিয়াতি চক্রের সাথে জড়িত। তারা স্বীকার করেছে যে, তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা করে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ডা. মুন্নাফের বাসায় একত্রে বসিয়ে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নপত্রের সমাধান প্রদান করে। তারপরে ডা. মুন্নাফ উক্ত শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার হল পর্যন্ত নিজ দায়িত্বে নিয়ে আসেন। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের মূল হোতাদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। এদিকে র্যাব আবারও প্রাইমেট কোচিং সেন্টার ও ডা. মোস্তাফিজুর রহমান পাভেলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার করে। তবে সংবাদদাতা আরও জানিয়েছেন, র্যাব এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি। পরীক্ষার রেজাল্ট নিজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। গত বছর যেখানে সরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সর্বনিম্ন নম্বর ছিল ৫৭, এবারে তা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে হয়েছে ৭৭। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, এ বছর শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ালেখা করেছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মান বাড়লে স্বল্প বাড়তে পারে, কখনই এমন অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি ঘটতে পারে না। আসলে পড়ালেখার মান না বেড়ে বরং কমেছে। কারণ এ বছর বই-পুস্তক, পড়ার স্থান, যাতায়াতের খরচ, টিউশন-ফিসহ সবকিছুর মূল্যই বেড়েছে। যে কোনো কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তার ব্যবহার কমে, ফলে উৎপন্ন পণ্যের (শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা অর্জন) পরিমাণ কমে যায়। ১৮ সেপ্টেম্বরে পরীক্ষার দিন তেজগাঁও কলেজে গিয়ে দেখা গেল সকাল ৯টা বাজতে না বাজতেই পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করছে। কিছু পরীক্ষার্থীকে দেখতে পাওয়া গেল কলেজের সামনের পার্কে একগাদা বই নিয়ে মোবাইলের ফেসবুক থেকে কিছু একটা বের করে উত্তর খুঁজতে। এই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করে পরীক্ষা শুরু হওয়ার মাত্র দুই এক মিনিট পূর্বে। মনে হয় এরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া ভাগ্যবান শিক্ষার্থী। মাত্র ১৫ টাকায়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশ্ন পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন মানববন্ধনে। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচিত ছিল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ স্থগিত করে নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো কমিটি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা। তারা তা না করে তড়িঘড়ি করে ফল প্রকাশ করল, তড়িঘড়ি করে ভর্তিও শুরু করে দিলো। এমনকি প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ভর্তির কাজ দ্রুততার সাথে সম্পাদনের জন্য তথাকথিত উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মেসেজ পাঠিয়ে ম্যানেজ করার কাজও করা হলো। টিআইবি, সুধীসমাজ ও বিভিন্ন জনপ্রিয় সংগঠনের পুনঃভর্তি পরীক্ষার দাবি উপেক্ষা করে শিক্ষা অধিদফতর শুধু একই ক্যাসেট বাজাচ্ছে যে, পরীক্ষার পূর্বে কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করেনি। হয়তো অভিযোগ করেনি। কারণ তারা মনে করে ফাঁস হওয়ার কারণে শিক্ষা অধিদফতর নিজের গরজে নতুন প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা নিবে। তারা ভেবেছিল সঠিক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়াটাই শিক্ষা অধিদফতরের মাথাব্যথা, টাকার কাছে মাথা বিক্রি করা তাদের কাজ না। পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন পরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন। সেখানে বলা হয়েছে যে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা ভালো ফল করেনি, এই রকম ছেলেমেয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও ভাল ফল করেনি। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যে। আমার জানা একটি মেয়ে ৮৪ নম্বর পেয়ে বগুড়া মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল পেলে ৮৪ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ঢাকার যে কোন মেডিকেলেই জায়গা পেত,তাকে কম খ্যাত বগুড়ায় যেতে হতো না। ক্যামব্রিয়ান কলেজের ছাত্রীটি এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট পেলে হলিক্রস বা রাজউকের মত বিখ্যাত কোন সরকারি বিধিতে চালিত কলেজেই ভর্তি হত। সংস্থাটি আরও বলেছে যে যেসব কেন্দ্রে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সে সব কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা অস্বাভাবিক রকম ভাল ফল করেনি। আসল কথা হল এই ডিজিটাল যুগে একটি কেন্দ্রে প্রশ্ন ফাঁস হলেও মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সারা দেশেই ছড়িয়ে যাবে। র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ইউজিসি কর্মকর্তা ওমর সিরাজের মৃত্যু প্রশ্নপত্র ফাঁসকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা বলে অনেকে মনে করে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বা সরকার নিজেদের ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় আরও বড় ব্যর্থতাকে উপরে টেনে তুলছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই পিএসসি থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উচ্চবাচ্য আসেনি, কারণ এ ফল কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগকে ব্যাহত করেনি। কিন্তু মেডিকেলের মত উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া অনেক বেশি বড় অপরাধ। এ অপরাধ এমনি যে এতে হাতুড়ে ডাক্তার হয়ে যেতে পারে বিলাত ফেরত ডাক্তারে এবং মেধাবী ছেলেমেয়েরা হতে পারে সেই ডাক্তারেরই একজন কম্পাউন্ডার।
শুধু সরকারি মেডিকেল নয়, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারছে না। কারণ শুধু ৪০/৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে না পারা নয়। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সীট সংখ্যা মাত্র ১১,০০০ যার প্রায় সবগুলো ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র অর্জনকারীদের দখলে। দেশের সেরা সন্তানদের সামনে এখন শুধুই অমানিশার ঘোর অন্ধকার। তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন আর সাধনা ধূলায় ধুসরিত। শকুনীর হিংস্র ছোবলে তাদের ফুলের মত কোমল ও নিষ্পাপ মন ও মানসিকতা ক্ষতবিক্ষত। এখানেই শেষ নয়। আন্দোলন প্রতিহত করার নামে তাদের উপরে চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। ৩০ সেপ্টেম্বরে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিনা উষ্কানিতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। পুরুষ পুলিশ দিয়ে দেশরত্ন ছাত্রীদের লাথি মারা হয়। তারা ছাত্রীদের টানা হেঁচড়া করে এবং একজন ছাত্রীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে এবং ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে অমানুষিকভাবে বেদম প্রহার করে। রংপুর মেডিকেল কলেজের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের উপরে গুন্ডাবাহিনী দিয়ে হামলা করা হয়। শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরছে। বরিশালে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের রাস্তায় শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের রক্ত ঢেলে বিক্ষোভ করেছে।
জাতির আশা ভরসার প্রতীক এই সূর্য্য সন্তানেরা যদি পথে পথে অশ্রু আর রক্ত ঝরায়, যদি পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হয়, যদি অন্যায় আঘাত সইতে না পেরে গুমরে গুমরে উঠে, যদি দুমড়ে মুচড়ে খান খান হয়ে যেতে দেখে তাদের কষ্টার্জিত ধন, তাহলে কী মূল্য থাকে আমাদের বেঁচে থাকার? কী অর্থ থাকে আমাদের দেশকে ভালবাসার? তাই আমাদেরকে আজ ফুটতে গিয়েও যে ফুলগুলো পাষাণের আঘাতে ঝরে গেল, তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে, বুক আগলিয়ে তাদের রক্ষা করতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে তাদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানাতে হবে।
মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, এ আন্দোলন রোগে শোকে আক্রান্ত পুরো দেশবাসীর। কেন না অমেধাবীদের ডাক্তার বানালে দেশবাসী শুধু সুচিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হবে না, হবে অপচিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হবে না, হবে অপচিকিৎসা ও প্রতারণারও শিকার। এবারের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয় তবে ভবিষ্যতে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাও ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়েই অনুষ্ঠিত হবে। শুধু তাই নয়, বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, এগ্রিকালচার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হওয়ার ধারায় পতিত হবে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের অপেক্ষায় বসে থাকবে। আন্দোলন ব্যর্থ হলে চাকরি ক্ষেত্রের মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়টিতেও দলীয়করণের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে।
মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা তাদেরকে মেডিকেলের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করা হোক বা তাদেরকে কোন সুযোগ সুবিধা দেয়া হোক এমন দাবি করেনি। তাদের দাবি শুধুই একটি সুষ্ঠু পুনঃভর্তি পরীক্ষা। এ দাবি তারা চালিয়ে যাবেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক দাবি মানতে অস্বীকার করে নিজেদের সততা ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছে মানবাধিকার সংস্থা, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র দল এবং মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা। আপনিও এগিয়ে আসুন। এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর, লেখক একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পিতা।
পক্ষান্তরে মেডিক্যালে পড়াকে যারা ব্যবসায়ের দৃষ্টিতে দেখে সেসব অসৎ ধনীর সন্তানরা এবং পড়ালেখার পরিবর্তে ফেসবুকে সময় কাটানো শিক্ষার্থীরা হতে পেরেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকার সমর্থকদের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কারণ পরীক্ষার পূর্বেই ফেসবুকে পাওয়া প্রশ্নপত্র এবং পরীক্ষা হলে পাওয়া প্রশ্নপত্রের মধ্যে হুবহু মিল পাওয়া যায়। বহু শিক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ফেসবুকেও স্বীকারোক্তি দিয়েছে। র্যাব-এর অভিযানে ঢাকা ও রংপুর থেকে যে ১১ জনকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আলামত থেকেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজের বেশ কয়েকজন ডাক্তার এবং তথাকার দু’টি কোচিং সেন্টার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত। ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত রংপুরের এক রিপোর্টারের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত চক্রের ৪ জন গ্রেফতার হওয়ার পর র্যাব রংপুরে এ ওয়ান নামের কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে তিনজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মনজুর হোসেন, ডা. মোস্তাফিজুর, ডা. জিল্লুর রহমান, ডা. শরিফুল ইসলাম প্রমুখেরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের জালিয়াতি চক্রের সাথে জড়িত। তারা স্বীকার করেছে যে, তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা করে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ডা. মুন্নাফের বাসায় একত্রে বসিয়ে পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্নপত্রের সমাধান প্রদান করে। তারপরে ডা. মুন্নাফ উক্ত শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষার হল পর্যন্ত নিজ দায়িত্বে নিয়ে আসেন। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের মূল হোতাদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। এদিকে র্যাব আবারও প্রাইমেট কোচিং সেন্টার ও ডা. মোস্তাফিজুর রহমান পাভেলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার করে। তবে সংবাদদাতা আরও জানিয়েছেন, র্যাব এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি। পরীক্ষার রেজাল্ট নিজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। গত বছর যেখানে সরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সর্বনিম্ন নম্বর ছিল ৫৭, এবারে তা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে হয়েছে ৭৭। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, এ বছর শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ালেখা করেছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মান বাড়লে স্বল্প বাড়তে পারে, কখনই এমন অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি ঘটতে পারে না। আসলে পড়ালেখার মান না বেড়ে বরং কমেছে। কারণ এ বছর বই-পুস্তক, পড়ার স্থান, যাতায়াতের খরচ, টিউশন-ফিসহ সবকিছুর মূল্যই বেড়েছে। যে কোনো কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তার ব্যবহার কমে, ফলে উৎপন্ন পণ্যের (শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা অর্জন) পরিমাণ কমে যায়। ১৮ সেপ্টেম্বরে পরীক্ষার দিন তেজগাঁও কলেজে গিয়ে দেখা গেল সকাল ৯টা বাজতে না বাজতেই পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করছে। কিছু পরীক্ষার্থীকে দেখতে পাওয়া গেল কলেজের সামনের পার্কে একগাদা বই নিয়ে মোবাইলের ফেসবুক থেকে কিছু একটা বের করে উত্তর খুঁজতে। এই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করে পরীক্ষা শুরু হওয়ার মাত্র দুই এক মিনিট পূর্বে। মনে হয় এরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া ভাগ্যবান শিক্ষার্থী। মাত্র ১৫ টাকায়ও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশ্ন পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে বিভিন্ন মানববন্ধনে। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচিত ছিল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ স্থগিত করে নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো কমিটি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা। তারা তা না করে তড়িঘড়ি করে ফল প্রকাশ করল, তড়িঘড়ি করে ভর্তিও শুরু করে দিলো। এমনকি প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ভর্তির কাজ দ্রুততার সাথে সম্পাদনের জন্য তথাকথিত উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মেসেজ পাঠিয়ে ম্যানেজ করার কাজও করা হলো। টিআইবি, সুধীসমাজ ও বিভিন্ন জনপ্রিয় সংগঠনের পুনঃভর্তি পরীক্ষার দাবি উপেক্ষা করে শিক্ষা অধিদফতর শুধু একই ক্যাসেট বাজাচ্ছে যে, পরীক্ষার পূর্বে কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করেনি। হয়তো অভিযোগ করেনি। কারণ তারা মনে করে ফাঁস হওয়ার কারণে শিক্ষা অধিদফতর নিজের গরজে নতুন প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা নিবে। তারা ভেবেছিল সঠিক প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়াটাই শিক্ষা অধিদফতরের মাথাব্যথা, টাকার কাছে মাথা বিক্রি করা তাদের কাজ না। পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন পরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন। সেখানে বলা হয়েছে যে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা ভালো ফল করেনি, এই রকম ছেলেমেয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও ভাল ফল করেনি। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যে। আমার জানা একটি মেয়ে ৮৪ নম্বর পেয়ে বগুড়া মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল পেলে ৮৪ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ঢাকার যে কোন মেডিকেলেই জায়গা পেত,তাকে কম খ্যাত বগুড়ায় যেতে হতো না। ক্যামব্রিয়ান কলেজের ছাত্রীটি এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট পেলে হলিক্রস বা রাজউকের মত বিখ্যাত কোন সরকারি বিধিতে চালিত কলেজেই ভর্তি হত। সংস্থাটি আরও বলেছে যে যেসব কেন্দ্রে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সে সব কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা অস্বাভাবিক রকম ভাল ফল করেনি। আসল কথা হল এই ডিজিটাল যুগে একটি কেন্দ্রে প্রশ্ন ফাঁস হলেও মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সারা দেশেই ছড়িয়ে যাবে। র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ইউজিসি কর্মকর্তা ওমর সিরাজের মৃত্যু প্রশ্নপত্র ফাঁসকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা বলে অনেকে মনে করে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বা সরকার নিজেদের ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় আরও বড় ব্যর্থতাকে উপরে টেনে তুলছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই পিএসসি থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উচ্চবাচ্য আসেনি, কারণ এ ফল কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগকে ব্যাহত করেনি। কিন্তু মেডিকেলের মত উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া অনেক বেশি বড় অপরাধ। এ অপরাধ এমনি যে এতে হাতুড়ে ডাক্তার হয়ে যেতে পারে বিলাত ফেরত ডাক্তারে এবং মেধাবী ছেলেমেয়েরা হতে পারে সেই ডাক্তারেরই একজন কম্পাউন্ডার।
শুধু সরকারি মেডিকেল নয়, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারছে না। কারণ শুধু ৪০/৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে না পারা নয়। সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সীট সংখ্যা মাত্র ১১,০০০ যার প্রায় সবগুলো ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র অর্জনকারীদের দখলে। দেশের সেরা সন্তানদের সামনে এখন শুধুই অমানিশার ঘোর অন্ধকার। তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন আর সাধনা ধূলায় ধুসরিত। শকুনীর হিংস্র ছোবলে তাদের ফুলের মত কোমল ও নিষ্পাপ মন ও মানসিকতা ক্ষতবিক্ষত। এখানেই শেষ নয়। আন্দোলন প্রতিহত করার নামে তাদের উপরে চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। ৩০ সেপ্টেম্বরে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিনা উষ্কানিতে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। পুরুষ পুলিশ দিয়ে দেশরত্ন ছাত্রীদের লাথি মারা হয়। তারা ছাত্রীদের টানা হেঁচড়া করে এবং একজন ছাত্রীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে এবং ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে অমানুষিকভাবে বেদম প্রহার করে। রংপুর মেডিকেল কলেজের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের উপরে গুন্ডাবাহিনী দিয়ে হামলা করা হয়। শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরছে। বরিশালে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের রাস্তায় শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের রক্ত ঢেলে বিক্ষোভ করেছে।
জাতির আশা ভরসার প্রতীক এই সূর্য্য সন্তানেরা যদি পথে পথে অশ্রু আর রক্ত ঝরায়, যদি পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট হয়, যদি অন্যায় আঘাত সইতে না পেরে গুমরে গুমরে উঠে, যদি দুমড়ে মুচড়ে খান খান হয়ে যেতে দেখে তাদের কষ্টার্জিত ধন, তাহলে কী মূল্য থাকে আমাদের বেঁচে থাকার? কী অর্থ থাকে আমাদের দেশকে ভালবাসার? তাই আমাদেরকে আজ ফুটতে গিয়েও যে ফুলগুলো পাষাণের আঘাতে ঝরে গেল, তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে, বুক আগলিয়ে তাদের রক্ষা করতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে তাদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানাতে হবে।
মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, এ আন্দোলন রোগে শোকে আক্রান্ত পুরো দেশবাসীর। কেন না অমেধাবীদের ডাক্তার বানালে দেশবাসী শুধু সুচিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হবে না, হবে অপচিকিৎসা থেকেই বঞ্চিত হবে না, হবে অপচিকিৎসা ও প্রতারণারও শিকার। এবারের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয় তবে ভবিষ্যতে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাও ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়েই অনুষ্ঠিত হবে। শুধু তাই নয়, বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, এগ্রিকালচার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হওয়ার ধারায় পতিত হবে। শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের অপেক্ষায় বসে থাকবে। আন্দোলন ব্যর্থ হলে চাকরি ক্ষেত্রের মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়টিতেও দলীয়করণের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে।
মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা তাদেরকে মেডিকেলের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করা হোক বা তাদেরকে কোন সুযোগ সুবিধা দেয়া হোক এমন দাবি করেনি। তাদের দাবি শুধুই একটি সুষ্ঠু পুনঃভর্তি পরীক্ষা। এ দাবি তারা চালিয়ে যাবেই। স্বাস্থ্য অধিদফতর শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক দাবি মানতে অস্বীকার করে নিজেদের সততা ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই শিক্ষার্থীদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছে মানবাধিকার সংস্থা, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র দল এবং মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা। আপনিও এগিয়ে আসুন। এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর, লেখক একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পিতা।
No comments:
Write comments