একজন রাষ্ট্রপতির আকুতি ও নষ্ট রাজনীতি

অবশেষে সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন গ্রেফতার হলেন। তার লজ্জাবনত মুখ, চোখ দেশবাসী দেখল। কিন্তু একজন সংসদ সদস্য সংসদে নিজের সৌরভ না ছড়িয়ে যখন রাস্তার পাশে থাকা সৌরভ নামের শিশুটিকে লাইসেন্সধারী অস্ত্র দিয়ে গুলি করেন তখন জনগণের হূদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। দিনে দিনে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেছেন, ব্যবসায়ীদের হাতে রাজনীতি চলে গেছে। এখান থেকে রাজনীতিকে বের করে আনতে হবে।
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উঠে আসা গণমানুষের রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ কার্যত দেশের মানুষের কান্না ও আকুতিকে তুলে ধরেছেন। এক অদ্ভুত নষ্ট সময়ের দিকে আমরা ক্রমাগত যাচ্ছি এবং এই নষ্ট সময়ের দিকে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। একে একে দলের ভেতর থেকে গণতন্ত্র চর্চার বাতি নিভতে বসেছে। একে একে দলগুলোর অভ্যন্তরে মূল্যবোধের শুধু অবক্ষয়ই ঘটেনি, মানবকল্যাণের মহান আদর্শের জন্য যে রাজনীতি সেটিকেও লাইনচ্যুত করা হয়েছে। কি ডান, কি বাম, কি মধ্যপন্থি দল কারও মধ্যে হরিলুট, কারও মধ্যে হাপিত্যেশ। আদর্শবানরা হয় ঘরে, না হয় দর্শক গ্যালারিতে। এমন রাজনীতি অতীতে কখনো আসেনি আমাদের দেশে। লাখো শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জনগণের আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি থেকে দিনে দিনে সরে গেছেন রাজনীতিবিদরা। সেনা শাসন জমানায় শত শত তরুণের আত্মাহুতি, আর গণমানুষের নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলেও মানুষের কাছে দেয়া অঙ্গীকার কোনো দল, নেতা বা শাসক রাখেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজের কথা বলে যখন যার যার সুবিধামতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বুকে টেনেছেন কেউ কেউ। মনোনয়ন বাণিজ্যের আড়ালে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছেন দলীয় প্রতীক। মধ্যস্বত্বভোগী দালাল ও সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের ভোগ বিলাসের জীবন-যাপন, আমলাতন্ত্রকে কাছে টেনে সমাজকে বৈষম্যের পাহাড়ে তুলে দিয়েছেন। খুলে দিয়েছেন দুর্নীতির সদর দরজা, দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি। গণতন্ত্রের জমানা শুধু ব্যক্তির শাসনকেই নিরঙ্কুশ করেনি, সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে নব্য একনায়কতন্ত্রের আদলে অদ্ভুত শাসনব্যবস্থা উপহার দিয়েছে জাতিকে। অকার্যকর সংসদই নয়, রাষ্ট্রের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আজ ঘুণে ধরা ভঙ্গুর। রাজনীতি শুধু ব্যবসায়ীদের হাতেই তুলে দেয়া হয়নি, রাজনীতিবিদরাও ভোগ বিলাসের জীবন-যাপনের পথে হাঁটতে গিয়ে ভুলে গেছেন আমাদের মহাকাব্যের সেইসব নায়ক যারা আমাদের ইতিহাসের নায়কের আসনে বসে রাজনীতিকে আত্মত্যাগ ও মানবকল্যাণের পথে মহিমান্বিত ও আলোকিত করেছিলেন। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িটি এখনো সাদামাটা, সাদা-কালো যুগের রাজনীতির গৌরবময় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো বেতের টুপি পরে গরিবের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিবেদিত মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নিরাভরণ জীবন মানবকল্যাণের রাজনীতির প্রতীক হয়ে আছে। এখনো গণতন্ত্রের মানসপুত্র বললেই চোখে ভাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম, কৃষকের বন্ধু বললেই উঠে আসে শেরে বাংলা ফজলুল হকের ছবি। এইসব মহাকাব্যের নায়কদের ছায়ায় এই জনপদে অনেক রাজনীতিবিদ উঠে এসেছিলেন। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা এটাই যে, নিজেদের চেহারা আয়নায় দেখেননি বলে তাদের ছায়ায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেননি। না নিজেরা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে লালন করতে পারলেন, না জনগণের আকাঙ্ক্ষার নেতৃত্বকে উঠিয়ে আনতে পারলেন। দেশ জুড়ে এখন রাজনীতিবিদদের আকাল চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রতিটি সামরিক শাসকের জমানায় হলেও ২৫ বছরেও গণতন্ত্রের জমানায় হয়নি। রহস্যজনক কারণে হয়নি বলেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা নিজেরা নেতৃত্বের সংঘাত দলবাজিতে যেমন নিমজ্জিত হয়েছেন, তেমনি গৌরবময় ছাত্ররাজনীতিকে অসুস্থ ধারায় নিতে নিতে ইনটেনসিভ কেয়ারে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
প্রশাসন নির্ভর রাজনীতি, পেশাজীবী নির্ভর দলবাজি, রাজনীতিকে রাজনীতিতে তারুণ্যের ভেতর থেকে নেতৃত্ব উঠে আসার পথ রুদ্ধ করেছেন। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটলেও স্থানীয় সরকারকে সংসদ সদস্য ও আমলাদের খবরদারিতে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সময়ের স্রোতধারায় নদীগুলো শুধু নাব্যতাই হারায়নি, অতীতের ঐতিহ্য হারিয়ে রাজনীতিও এখন হয়ে পড়েছে এক বন্ধ্যা নদীর নাম। কথা ছিল সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন করবেন, কথা ছিল জাতীয় ইস্যুতে মহান সংসদে যুক্তিতর্কের অবতারণা করে বিতর্কের ঢেউ তুলে নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের মতো তারা অঞ্চল ভিত্তিক শাসন কায়েম করেছেন। সুবিধাভোগী হাইব্রিড কর্মী, দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা, আত্মীয়-স্বজন মিলে সরকারের উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছেন। সরকার একদিকে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন, তারা অনেকে চালিয়েছেন অবাধ লুণ্ঠন। টেন্ডার, বালুমহাল,পাথরমহাল, হাট-মাঠ-ঘাট সব এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। টাকা কামানোর হরিলুটে ব্যস্ত তারা। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো রাতারাতি বিত্তবৈভব গড়ে তুলছেন অনেকে। মানুষ দেখছে। আড়ালে সমালোচনাও করছে। গায়ে মাখছেন না কেউ। সংসদে দাঁড়ালে নেতা বন্দনা, কার্য প্রণালী বিধি লঙ্ঘন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। একপেশে সংসদে একদলীয় ব্যবস্থায়ও কোরাম সংকট দেখতে হয় স্পিকারকে। পূর্বসূরি পার্লামেন্টেরিয়ানরা সংসদের লাইব্রেরিতে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতেন, এখন সংসদ সদস্যরা মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরেন। তদবির তাদের হাতের মুঠোয়। সংসদে কেউ কেউ গানও করেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সংসদীয় গণতন্ত্রের এমন বিবর্ণ চেহারা দেখে মহাকাব্যের যুগের সেইসব পার্লামেন্টেরিয়ান যারা কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত বা পরলোকে চলে গেছেন তাদের আত্মা ক্রন্দন করছে। আর দেশের মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন আর আদর্শনির্ভর দল দৃশ্যমান নয়। আদর্শ, নীতি এখন দলগুলোর আঙিনা ছেড়ে ব্যক্তির কাছে চলে গেছে।
সরকার অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে আকাশ সংস্কৃতির দুয়ারই শুধু খোলেনি, ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই চালায়নি, তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা গ্রামের মানুষের কাছেও পৌঁছে দিয়েছে। এর সুবাদে মানুষের কাছে কোনো কিছুই আর গোপন থাকছে না। রাজনীতি শুধু ব্যবসায়ীদের হাতেই তুলে দেয়া হয়নি, লুটেরা সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয়ার কারণে জায়গায় জায়গায় আধিপত্য বিস্তারের সংঘাত কখনো কখনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও রূপ নিচ্ছে। রাজনীতিকে বাণিজ্যিকীকরণের কারণে সম্ভাবনাময় তরুণ কর্মীদেরকে অনেক জায়গায় এমপিরা বিপথগামী করছেন, ত্যাগের রাজনীতির বিপরীতে ভোগ ও লোভের রাজনীতিকে তুলে আনা হয়েছে। প্রতিবাদমুখর মানুষের দিকে উন্নাসিক এমপিদের কেউ কেউ পিস্তলের গুলি ছুঁড়েছেন অতীতে। কেউ কেউ দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের গায়ে হাত তুলেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে আইন বিধি-বিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে গেলে কোথাও কোথাও এমপিদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে বদলি করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। নিয়োগ বাণিজ্য থেকে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে এমপিদের কর্তৃত্ব নেই। এই অসুস্থ ধারার পথ ধরে গাইবান্ধার উন্নাসিক বেপরোয়া এমপি লিটন বুনো ষাঁড়ের মতো পথের ধারের শিশুটিকে গুলিবিদ্ধ করেছেন। এমন সংসদ সদস্য অতীতে আসেনি আমাদের জীবনে। রাজনীতিকে আদর্শনির্ভর জনগণের আকাঙ্ক্ষার পথে ফিরিয়ে আনতে হলে দলীয় গণতন্ত্র, শৃঙ্খলাবোধ পুনঃপ্র্রতিষ্ঠা জরুরি। একসময় তৃণমূল থেকে না হয় গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির গর্ভ থেকে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর জন্ম হতো। এখন ওপর থেকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জন্ম দেয়া হচ্ছে। শুধু ব্যবসায়ই নয়, চাকরি শেষে অবসরে যাওয়া সামরিক-বেসামরিক আমলারাও রাজনীতিতে এসে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন। রাজনীতির গতিপথ হারিয়ে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে বড় দলগুলোর মধ্যে শুধু সংঘাতই নয় মানুষের সঙ্গেও তাদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। একজন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে মানবকল্যাণের জন্যই রাজনীতি করেছেন। আইনজীবী হিসেবে এলাকায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চলের সংগ্রামমুখর মানুষের জীবনকে কাছে থেকে দেখেছেন। জোছনা রাতে জল তরঙ্গের অপরূপ সৌন্দর্যই অবলোকন করেননি, জোছনার আলোর নিচে হাওড়ের বাঁধ ভেঙে ফসল হারিয়ে যাওয়া কৃষকের চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করতেও দেখেছেন। জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও তার বেদনা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। একজন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ রাজনীতির গৌরবময় সাদা-কালো যুগের যে সহজ সরল পথ মানুষকে দেখিয়েছিলেন সেই আলোর পথটি এখন অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবতে বসেছে। তার রাজনীতির তীর্থস্থান কিশোরগঞ্জের মানুষের সামনে রাজনীতি নিয়ে যে আকুতি জানিয়েছেন তাতে গোটা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। গণমানুষের কল্যাণের আদর্শ নির্ভর রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হলে সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতির দুয়ার শুধু খুলে দিলেই হবে না আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সামনের সারিতে নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। আর এটি করতে হলে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণ প্রজন্মের জন্য আদর্শনির্ভর ছাত্র রাজনীতির দুয়ার খুলতে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গোপন ব্যালটে নেতৃত্ব নির্বাচনই নয় প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটিও করতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির লাগাম টেনে ধরে রাষ্ট্রপরিচালনায় কে সরকারি দলের, কে বিরোধী দলের সেটি নির্ণয় না করে তৃণমূলের মতামতের আলোকে সত্, নির্লোভ, গণমুখী কর্মীদেরই সংসদে তুলে নিয়ে আসতে হবে। পার্টিতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য দলীয় কোর্ট মার্শালে বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কেউ যে সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে নয় সেটি প্রতিষ্ঠা জরুরি।রাজনীতি পীর হাবিবুর রহমান, লেখক :সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments:
Write comments