ঘুষের ছোবলে আক্রান্ত সমাজ ব্যবস্থা
মানব সমাজের বিষফোঁড়াগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ঘুষ’। কেউ বলে এটি এখন সমাজের অলিখিত নিয়ম। কেউ বলে এই ঘুষ ছাড়া আমাদের অন্যথা নেই। অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বড় প্রতিটি স্তরেই এই ঘুষের প্রচলন। কেবল পার্থক্য স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এর স্টাইল ও নামকরণ ইত্যাদিতে। ‘ঘুষ’কে শুধু ঘুষ বললে এর প্রকৃত ক্ষেত্র চিিহ্নত হয় না। ঘুষ নানান ক্ষেত্রে নানান রং-এ রং বদলায়ে নানা মূর্তি নিয়ে সমাজে বিরাজ করে। তাই একে সনাক্ত করতে এর অন্যান্য নামগুলোও জানা প্রয়োজন। যেমন : উৎকোচ, মাল, উপঢৌকন, বখশিশ, পার্সেন্টিজ, পাত্তি, টাকা, ডলার, খরচা, টুপাইস, মাসোহারা, চাঁদা, সাহায্য, উপরি আয়, ট্যাক্স, কন্টাক্ট, উপহার, কম্প্রোমাইজ, সম্মানী, এক্সট্রা পারিশ্রমিক, তেল, বখরা ও টিপস।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘুষ বা উৎকোচবিহীন কোনো কাজই সমাধান হয় না। নিরীহ মানুষ যেখানে যায়, সেখানেই ঘুষ দুর্নীতির ভয়াল রূপ দেখতে পায়। কেউ ঘুষ ব্যতীত ন্যায্য কাজ উদ্ধার করতে পারে না। যে কোনো বিভাগ বা দফতরই হোক না কেন? ঘুষের দুর্দমনীয় প্রভাবে নিরীহ জনসাধারণ হাফিয়ে উঠছে। কোথায় যাবে কি করবে, কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। তাই মহান স্রষ্টার কাছে অভিযোগ জানিয়ে হা মুখে ঘরে ফিরছে।
আমাদের সোনার বাংলার অতীত জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগ্রাসী বৃটিশ শাসনামলে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুরু এবং সাধারণ মানুষ সরকারি আমলা ও করণিক নির্ভর হয়ে পড়ে। সে সময় হতেই এ সুশীল দেশে ঘুষ নামক মরণ ফাঁদের যাত্রা শুরু হয়। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোলকাতার গভর্ণর রোজার ড্রেককে মীর জাফর নিজ ভীত টিকিয়ে রাখার জন্যে রাজকোষ থেকে তৎকালীন ২,৮০,০০০.০০ টাকা উৎকোচ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজ উদ্দৌলা পালিয়ে যাবার সময় তাকে ধরে এনে রবাট ক্লাইভের নির্দেশে হত্যা করতে বলা হলে তখন কেউ তাকে হত্যা করতে রাজি না হলেও কৃতঘœ মোহাম্মদী বেগ মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে বাংলার শেষ নবাবকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বৃটিশ আগমনের পূর্বে প্রাচুর্যময় বাংলার কেউ ঘুষ কাকে বলে জানতো না অর্থাৎ ঘুষ ছিল না বললেই চলে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীদের অজানাকে জানতে অতি উৎসাহীরা সামান্যতম সময় ব্যয় করতেও সময়ক্ষেপণ করেনি। কারণ সময়ত্রয়ী মহারথীরা মহামূল্যবান সময়ের অপব্যয় পাপ জানে বলেই দ্বিরুক্তি না করে অতি সহজেই শ্রেয় নীতিবোধ ঘৃতাহুতি দিয়ে প্রাসাদোপম বাড়ি ও বহু মূল্যের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীর মালিক হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। বর্তমানে প্রশাসনিক আমলারা ঘুষ ব্যতীত কোনো কাজ হাতে নিতে মোটেই রাজি নয়। কারণ তাদের কাছে অর্থের এবং সময়ের মূল্য বেশি। তাই সাধারণ মানুষ ন্যায্য কাজটির জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। কারণ হস্ত প্রসারিণী ব্যতীত ফাইলের ওজন ভারী ও কচ্ছপগতি হয়ে যায়। তাই চলনশক্তি পেতে অর্থ ব্যতীত ফাইল নাড়াচাড়া করতে ব্যর্থ।
ক্রমবর্ধমান সময়ে ঘুষ যে বহু মাত্রিক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে আমাদের সোনার দেশটি বিপর্যস্তের স্তরে ধাবিত হচ্ছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। এ বেপরোয়া ঘুষের দাপটে কেউ কাউকে জমা খরচ দিচ্ছে না। তাই পার্শ্বের সৎ ব্যক্তিটিও জ্যোচ্চোরটির জন্য পবিত্র চরিত্রটির উপর কলঙ্ক লেপন করছে। ফলে সে নীতিবোধে থু-থু দিয়ে প্রাসাদোপম বাড়ি করতে পাপ পঙ্কিলে ডুবে মরছে এবং অন্যকে মারছে। অপরদিকে একজন প্রতিভাবান কিংবা যোগ্য প্রাপক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে হা হুতাশ করছে। তাই বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে বলে যে প্রবাদ বাক্যটি আছে, তার দাফন কাফন হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিচার বিভাগের অঙ্গনেও ঘুষ প্রকটাকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সমাজে হতাশা, ক্ষোভ ও নানা প্রকার অপরাধ দুর্ধমনীয় হয়ে ওঠেছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, কারাগারে অপরাধীরা ঘুষের বদৌলতে রাজাসনে থাকছে। যাক ক্ষমতার রজ্জু যার হাতে সেসব কিছুই করতে পারে এবং এটাই স্বাভাবিক। অসম অর্থনীতি সমাজের যাবতীয় কল্যাণবোধগুলোকে যেমন ধ্বংস করে দিচ্ছে। তদ্রƒপ ঘুষ-দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট আবহ যুব সামাজের মনেও ক্ষোভ বিদ্রোহের অভ্যন্তরে বিত্তশালী হবার উদ্রেক কামনায় পাগল পারা হয়ে উঠেছে এবং যত্রতত্র রাহাজানি হানাহানি, কালোবাজারী ও চোরাচালানী এবং মাদক ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়ে রাতারাতি সমাজের প্রতিপত্তিশালীদের দীক্ষায়িত অঙ্ককে আরো দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। ঘুষ শুধু গৃহিতাকে ধ্বংস করে না বরং সমগ্র দেশ ও জাতির মুল্যোৎপাটন এবং জন নিরাপত্তা ধ্বংস করে। যে দেশে বা বিভাগে ঘুষ চালু হয়ে পড়ে সেখানে আইনও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অথচ আইনের ওপরই দেশ ও জাতির শান্তি নির্ভরশীল। আইন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে কারো জান-মাল ও মান-সম্মান নিরাপদ থাকে না।
ঘুষ দিন কাজ নিন। এ শ্লোগান এখন কার্যোদ্ধারের ক্ষেত্রে মামুলি বাক্য। ঘুষ দেয়া ও নেয়া সমান অপরাধ। এটা কম বেশি সবাই জানে। তবু কেন কাজ উদ্ধারকারীরা ঘুষ দেন এবং কাজ দাতারা কেন খান, এর কারণ উদঘাটন ও চিিহ্নতকরণ প্রয়োজন। একক কোনো কারণে মানুষ ঘুষ খায় না। এর পিছনে রয়েছে নানাবিধ দিক। যেমন :
১. দারিদ্র্য : দারিদ্র্য একটি অভিশাপ। বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি চাকরির পর্যায়ে তারা যে বেতন পান তাতে সংসার পরিচালনায় অনেকেই বেসামাল। তাই বাড়তি আয়ের পন্থা খুঁঁজতে গিয়ে অনেকে ঘুষ খাওয়ার আশ্রয় নেন।
২. প্রতিশোধ : প্রতিশোধের বসে অনেকে ঘুষ খান। কারণ ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন তাই ঐ চালান হাতে আনতে অনেকটা প্রতিশোধের মতোই ঘুষ খাওয়া শুরু করেন।
৩. বংশগতি : ঘুষখোর পিতার সন্তান পিতার গুণে গুণান্বিত হয়ে পরবর্তীতে ঘুষখোর হয় এবং কর্মক্ষেত্রে ঘুষ খায়।
৪. অভ্যাস : অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী আছে ঘুষ খেতে খেতে একে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। ফলে ঘুষ খেতে না পেলে এদের পিত্তশুল বাড়ে। পরে বাধ্য হয়েই এরা ঘুষ খায়।
৫. উপরস্থ অফিসারদের চাপ : এদেশে এ এসপি, এসপি, সচিব, এমপি ও মন্ত্রীসহ বহু অসাধু কর্মকর্তা রয়েছেন যারা অধিনস্থ কর্মচারীদের উপর মাসোহারা ধার্য করে দেন বলে অভিযোগ আছে। উপরস্থ অফিসারদের চাপে অনেকে ঘুষ খান।
৬. ব্যবসায়িক মনোভাব : এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা আছেন ঘুষ গ্রহণ তাদের নিকট ব্যবসায়িক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭. অনুকরণ : আজকাল অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী অনুকরণ করে ঘুষ খায়। দেখা যাচ্ছে পাশের টেবিলের কর্তা ব্যক্তি ভালোই কামাচ্ছেন। অতএব তার আর বসে থেকে কি লাভ। তার অনুকরণে সেও এক সময় নেমে পড়ে ঘুষের খুঁজে।
৮. আয়ের সাথে ব্যয়ের গড় মিল : দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মসময়মত বেতন না পাওয়া ও স্বল্প বেতন পাওয়ার ফলে অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের আয়-ব্যয়ে গড় মিল দেখা দেয়। ফলে তারা উৎকোচ গ্রহণের ধান্ধায় নেমে পড়ে।
৯. নৈতিকতার অধপতন : মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। ফলে দিন দিন মানুষ পশুর মতো আচরণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না; লজ্জা পাচ্ছে না। ফলে বেহায়া, বেশরম হয়ে ঘুষের অর্থ গ্রহণ করছে।
১০. এছাড়া উচ্চাবিলাসী মনোভাব, কঠোর আইন না থাকা, আইন বাস্তবায়ন না হওয়া ও যুগের সাথে তাল মিলানোসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে ঘুষের আদান প্রদানে।
ঘুষদাতা ও গ্রহীতার নিকট এটির লেনদেন সহজ বা মামুলী হলেও মানবিক দিক থেকে এটি উভয়ের জন্য একটি আঘাত ও মর্মপীড়াদায়ক। মানবতা কখনো এ ধরনের নীতি বহির্ভূত কাজকে সমর্থন করে না। বিশ্ব মানবতার পথে ঘুষ একটি প্রায় অপ্রতিরোধ্য অন্তরায়। ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত হলে সেখানে ঘুষের প্রশ্নই উঠে না। কারণ এটি সম্পূর্ণ মানবতা বিবর্জিত কাজ।
তাই ইসলাম ঘুষের উৎসমুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পদস্থ কর্মচারী ও শাসকদেরকে প্রদত্ত উপঢৌকনকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ [সূরা বাকারা : ১৮৮] আবদুল্লাহ্ ইবন আমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা এবং গ্রহীতার উপর লা'নত করেছেন।’ [মোসনাদে আহমাদ : ৩৫৪২] এছাড়া ঘুষ গ্রহণের কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম ।’ [বুখারী, মিশকাত/৩৯৯৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘হারাম খাদ্য ভক্ষণ করা শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ [মিশকাত/২৭৮৭]
ঘুষ যেমন ঘুষ গ্রহীতার চরিত্র ধ্বংস করে, তেমনি ঘুষদাতা ও যোগানদারদের চরিত্রও বিনষ্ট করে ছাড়ে। ঘুষ গ্রহণ ও ঘুষ প্রদান প্রক্রিয়ার কোনো অংশই হারামযুক্ত নয়। এই হারামী কর্মকাণ্ডের ফলে ব্যক্তি জীবন হতে শুরু করে পরিবার, সমাজ এবং জাতীয় চরিত্রের সর্বত্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সর্বত্রই অশান্তির প্রবল বন্যা বইতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি অত্যন্ত মূল্যবান সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হারাম ভক্ষণে মানুষের হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, লজ্জাস্থান, পেট, নফস ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিবেকের কথা মানে না। অর্থাৎ বিবেক কু কাজ হতে নিবৃত্ত থাকতে এবং সৎ কাজ করতে আদেশ করে। কিন্তু তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সে আদেশ পালনে মোটেই প্রস্তুত হয় না।’ [এই ইয়াও উলুমুদ্দিন]
ঘুষের আদান-প্রদান প্রক্রিয়া মানুষের সহজাত স্বভাব লজ্জা ও সম্ভ্রমকে ভূলুণ্ঠিত করে এবং লজ্জাহীন কদর্য নিগড়ে আবদ্ধ করে। ঘুষ মানুষের নৈতিকতার যে দিকটাকে সমূলে উৎপাটিত করে দেয় তাহলো-স্বাবলম্বন। নিজের যা আছে, তা নিয়ে কিংবা যা তার অপরিহার্য মজুরি নির্ধারিত আছে, তার ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে জীবন চালনার পথ গ্রহণ করার নামই প্রকৃত স্বাবলম্বন। ঘুষের পয়সা হাতের নাগালে আসার পর ঘুষ গ্রহণকারীর চরিত্র হতে এই গুণটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে এমন এক অতৃপ্তিকর তাড়না সে অনুভব করে, যার নিগড় হতে কোনোক্রমেই নিজেকে বিমুক্ত রাখতে পারে না। পরিণামে যা হবার তাই হয়। ঘুষ গ্রহণকারী ক্রমেই হয়ে উঠে খুবই উদগ্র ও উৎসাহী। তার এই উৎসাহে কখনোই ভাটা পড়ে না। এহেন অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি ঘোলাটে ও ক্লেদাক্ত হয়ে যায়। এরই ফলশ্রুতিতে জীবন যাত্রার সকল স্তরে নেমে আসে অব্যবস্থা ও অনিয়মের ধস। যা গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত করে তোলে।
ঘুষ নামক এই ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে জনগণের মাঝে সচেতনতা জাগ্রত করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আর সকল অবস্থায় ঘুষকে না বলার মাঝেই রয়েছে মুক্তি ও নিষ্কৃতির চাবিকাঠি। এই অভিযাত্রা যতদ্রুত হবে, ততই আমাদের জন্যে মঙ্গল।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘুষ বা উৎকোচবিহীন কোনো কাজই সমাধান হয় না। নিরীহ মানুষ যেখানে যায়, সেখানেই ঘুষ দুর্নীতির ভয়াল রূপ দেখতে পায়। কেউ ঘুষ ব্যতীত ন্যায্য কাজ উদ্ধার করতে পারে না। যে কোনো বিভাগ বা দফতরই হোক না কেন? ঘুষের দুর্দমনীয় প্রভাবে নিরীহ জনসাধারণ হাফিয়ে উঠছে। কোথায় যাবে কি করবে, কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। তাই মহান স্রষ্টার কাছে অভিযোগ জানিয়ে হা মুখে ঘরে ফিরছে।
আমাদের সোনার বাংলার অতীত জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আগ্রাসী বৃটিশ শাসনামলে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুরু এবং সাধারণ মানুষ সরকারি আমলা ও করণিক নির্ভর হয়ে পড়ে। সে সময় হতেই এ সুশীল দেশে ঘুষ নামক মরণ ফাঁদের যাত্রা শুরু হয়। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোলকাতার গভর্ণর রোজার ড্রেককে মীর জাফর নিজ ভীত টিকিয়ে রাখার জন্যে রাজকোষ থেকে তৎকালীন ২,৮০,০০০.০০ টাকা উৎকোচ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজ উদ্দৌলা পালিয়ে যাবার সময় তাকে ধরে এনে রবাট ক্লাইভের নির্দেশে হত্যা করতে বলা হলে তখন কেউ তাকে হত্যা করতে রাজি না হলেও কৃতঘœ মোহাম্মদী বেগ মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে বাংলার শেষ নবাবকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বৃটিশ আগমনের পূর্বে প্রাচুর্যময় বাংলার কেউ ঘুষ কাকে বলে জানতো না অর্থাৎ ঘুষ ছিল না বললেই চলে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীদের অজানাকে জানতে অতি উৎসাহীরা সামান্যতম সময় ব্যয় করতেও সময়ক্ষেপণ করেনি। কারণ সময়ত্রয়ী মহারথীরা মহামূল্যবান সময়ের অপব্যয় পাপ জানে বলেই দ্বিরুক্তি না করে অতি সহজেই শ্রেয় নীতিবোধ ঘৃতাহুতি দিয়ে প্রাসাদোপম বাড়ি ও বহু মূল্যের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীর মালিক হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। বর্তমানে প্রশাসনিক আমলারা ঘুষ ব্যতীত কোনো কাজ হাতে নিতে মোটেই রাজি নয়। কারণ তাদের কাছে অর্থের এবং সময়ের মূল্য বেশি। তাই সাধারণ মানুষ ন্যায্য কাজটির জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। কারণ হস্ত প্রসারিণী ব্যতীত ফাইলের ওজন ভারী ও কচ্ছপগতি হয়ে যায়। তাই চলনশক্তি পেতে অর্থ ব্যতীত ফাইল নাড়াচাড়া করতে ব্যর্থ।
ক্রমবর্ধমান সময়ে ঘুষ যে বহু মাত্রিক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে আমাদের সোনার দেশটি বিপর্যস্তের স্তরে ধাবিত হচ্ছে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। এ বেপরোয়া ঘুষের দাপটে কেউ কাউকে জমা খরচ দিচ্ছে না। তাই পার্শ্বের সৎ ব্যক্তিটিও জ্যোচ্চোরটির জন্য পবিত্র চরিত্রটির উপর কলঙ্ক লেপন করছে। ফলে সে নীতিবোধে থু-থু দিয়ে প্রাসাদোপম বাড়ি করতে পাপ পঙ্কিলে ডুবে মরছে এবং অন্যকে মারছে। অপরদিকে একজন প্রতিভাবান কিংবা যোগ্য প্রাপক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে হা হুতাশ করছে। তাই বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে বলে যে প্রবাদ বাক্যটি আছে, তার দাফন কাফন হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিচার বিভাগের অঙ্গনেও ঘুষ প্রকটাকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সমাজে হতাশা, ক্ষোভ ও নানা প্রকার অপরাধ দুর্ধমনীয় হয়ে ওঠেছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, কারাগারে অপরাধীরা ঘুষের বদৌলতে রাজাসনে থাকছে। যাক ক্ষমতার রজ্জু যার হাতে সেসব কিছুই করতে পারে এবং এটাই স্বাভাবিক। অসম অর্থনীতি সমাজের যাবতীয় কল্যাণবোধগুলোকে যেমন ধ্বংস করে দিচ্ছে। তদ্রƒপ ঘুষ-দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট আবহ যুব সামাজের মনেও ক্ষোভ বিদ্রোহের অভ্যন্তরে বিত্তশালী হবার উদ্রেক কামনায় পাগল পারা হয়ে উঠেছে এবং যত্রতত্র রাহাজানি হানাহানি, কালোবাজারী ও চোরাচালানী এবং মাদক ব্যবসায়ে লিপ্ত হয়ে রাতারাতি সমাজের প্রতিপত্তিশালীদের দীক্ষায়িত অঙ্ককে আরো দীর্ঘায়িত করার প্রচেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। ঘুষ শুধু গৃহিতাকে ধ্বংস করে না বরং সমগ্র দেশ ও জাতির মুল্যোৎপাটন এবং জন নিরাপত্তা ধ্বংস করে। যে দেশে বা বিভাগে ঘুষ চালু হয়ে পড়ে সেখানে আইনও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অথচ আইনের ওপরই দেশ ও জাতির শান্তি নির্ভরশীল। আইন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে কারো জান-মাল ও মান-সম্মান নিরাপদ থাকে না।
ঘুষ দিন কাজ নিন। এ শ্লোগান এখন কার্যোদ্ধারের ক্ষেত্রে মামুলি বাক্য। ঘুষ দেয়া ও নেয়া সমান অপরাধ। এটা কম বেশি সবাই জানে। তবু কেন কাজ উদ্ধারকারীরা ঘুষ দেন এবং কাজ দাতারা কেন খান, এর কারণ উদঘাটন ও চিিহ্নতকরণ প্রয়োজন। একক কোনো কারণে মানুষ ঘুষ খায় না। এর পিছনে রয়েছে নানাবিধ দিক। যেমন :
১. দারিদ্র্য : দারিদ্র্য একটি অভিশাপ। বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি চাকরির পর্যায়ে তারা যে বেতন পান তাতে সংসার পরিচালনায় অনেকেই বেসামাল। তাই বাড়তি আয়ের পন্থা খুঁঁজতে গিয়ে অনেকে ঘুষ খাওয়ার আশ্রয় নেন।
২. প্রতিশোধ : প্রতিশোধের বসে অনেকে ঘুষ খান। কারণ ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন তাই ঐ চালান হাতে আনতে অনেকটা প্রতিশোধের মতোই ঘুষ খাওয়া শুরু করেন।
৩. বংশগতি : ঘুষখোর পিতার সন্তান পিতার গুণে গুণান্বিত হয়ে পরবর্তীতে ঘুষখোর হয় এবং কর্মক্ষেত্রে ঘুষ খায়।
৪. অভ্যাস : অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী আছে ঘুষ খেতে খেতে একে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। ফলে ঘুষ খেতে না পেলে এদের পিত্তশুল বাড়ে। পরে বাধ্য হয়েই এরা ঘুষ খায়।
৫. উপরস্থ অফিসারদের চাপ : এদেশে এ এসপি, এসপি, সচিব, এমপি ও মন্ত্রীসহ বহু অসাধু কর্মকর্তা রয়েছেন যারা অধিনস্থ কর্মচারীদের উপর মাসোহারা ধার্য করে দেন বলে অভিযোগ আছে। উপরস্থ অফিসারদের চাপে অনেকে ঘুষ খান।
৬. ব্যবসায়িক মনোভাব : এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা আছেন ঘুষ গ্রহণ তাদের নিকট ব্যবসায়িক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭. অনুকরণ : আজকাল অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারী অনুকরণ করে ঘুষ খায়। দেখা যাচ্ছে পাশের টেবিলের কর্তা ব্যক্তি ভালোই কামাচ্ছেন। অতএব তার আর বসে থেকে কি লাভ। তার অনুকরণে সেও এক সময় নেমে পড়ে ঘুষের খুঁজে।
৮. আয়ের সাথে ব্যয়ের গড় মিল : দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মসময়মত বেতন না পাওয়া ও স্বল্প বেতন পাওয়ার ফলে অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের আয়-ব্যয়ে গড় মিল দেখা দেয়। ফলে তারা উৎকোচ গ্রহণের ধান্ধায় নেমে পড়ে।
৯. নৈতিকতার অধপতন : মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। ফলে দিন দিন মানুষ পশুর মতো আচরণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না; লজ্জা পাচ্ছে না। ফলে বেহায়া, বেশরম হয়ে ঘুষের অর্থ গ্রহণ করছে।
১০. এছাড়া উচ্চাবিলাসী মনোভাব, কঠোর আইন না থাকা, আইন বাস্তবায়ন না হওয়া ও যুগের সাথে তাল মিলানোসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে ঘুষের আদান প্রদানে।
ঘুষদাতা ও গ্রহীতার নিকট এটির লেনদেন সহজ বা মামুলী হলেও মানবিক দিক থেকে এটি উভয়ের জন্য একটি আঘাত ও মর্মপীড়াদায়ক। মানবতা কখনো এ ধরনের নীতি বহির্ভূত কাজকে সমর্থন করে না। বিশ্ব মানবতার পথে ঘুষ একটি প্রায় অপ্রতিরোধ্য অন্তরায়। ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত হলে সেখানে ঘুষের প্রশ্নই উঠে না। কারণ এটি সম্পূর্ণ মানবতা বিবর্জিত কাজ।
তাই ইসলাম ঘুষের উৎসমুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পদস্থ কর্মচারী ও শাসকদেরকে প্রদত্ত উপঢৌকনকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ [সূরা বাকারা : ১৮৮] আবদুল্লাহ্ ইবন আমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুষদাতা এবং গ্রহীতার উপর লা'নত করেছেন।’ [মোসনাদে আহমাদ : ৩৫৪২] এছাড়া ঘুষ গ্রহণের কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম ।’ [বুখারী, মিশকাত/৩৯৯৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘হারাম খাদ্য ভক্ষণ করা শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ [মিশকাত/২৭৮৭]
ঘুষ যেমন ঘুষ গ্রহীতার চরিত্র ধ্বংস করে, তেমনি ঘুষদাতা ও যোগানদারদের চরিত্রও বিনষ্ট করে ছাড়ে। ঘুষ গ্রহণ ও ঘুষ প্রদান প্রক্রিয়ার কোনো অংশই হারামযুক্ত নয়। এই হারামী কর্মকাণ্ডের ফলে ব্যক্তি জীবন হতে শুরু করে পরিবার, সমাজ এবং জাতীয় চরিত্রের সর্বত্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং সর্বত্রই অশান্তির প্রবল বন্যা বইতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহ আলাইহি অত্যন্ত মূল্যবান সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হারাম ভক্ষণে মানুষের হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, লজ্জাস্থান, পেট, নফস ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিবেকের কথা মানে না। অর্থাৎ বিবেক কু কাজ হতে নিবৃত্ত থাকতে এবং সৎ কাজ করতে আদেশ করে। কিন্তু তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সে আদেশ পালনে মোটেই প্রস্তুত হয় না।’ [এই ইয়াও উলুমুদ্দিন]
ঘুষের আদান-প্রদান প্রক্রিয়া মানুষের সহজাত স্বভাব লজ্জা ও সম্ভ্রমকে ভূলুণ্ঠিত করে এবং লজ্জাহীন কদর্য নিগড়ে আবদ্ধ করে। ঘুষ মানুষের নৈতিকতার যে দিকটাকে সমূলে উৎপাটিত করে দেয় তাহলো-স্বাবলম্বন। নিজের যা আছে, তা নিয়ে কিংবা যা তার অপরিহার্য মজুরি নির্ধারিত আছে, তার ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে জীবন চালনার পথ গ্রহণ করার নামই প্রকৃত স্বাবলম্বন। ঘুষের পয়সা হাতের নাগালে আসার পর ঘুষ গ্রহণকারীর চরিত্র হতে এই গুণটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে এমন এক অতৃপ্তিকর তাড়না সে অনুভব করে, যার নিগড় হতে কোনোক্রমেই নিজেকে বিমুক্ত রাখতে পারে না। পরিণামে যা হবার তাই হয়। ঘুষ গ্রহণকারী ক্রমেই হয়ে উঠে খুবই উদগ্র ও উৎসাহী। তার এই উৎসাহে কখনোই ভাটা পড়ে না। এহেন অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি ঘোলাটে ও ক্লেদাক্ত হয়ে যায়। এরই ফলশ্রুতিতে জীবন যাত্রার সকল স্তরে নেমে আসে অব্যবস্থা ও অনিয়মের ধস। যা গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত করে তোলে।
ঘুষ নামক এই ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে জনগণের মাঝে সচেতনতা জাগ্রত করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আর সকল অবস্থায় ঘুষকে না বলার মাঝেই রয়েছে মুক্তি ও নিষ্কৃতির চাবিকাঠি। এই অভিযাত্রা যতদ্রুত হবে, ততই আমাদের জন্যে মঙ্গল।
No comments:
Write comments