৮ মাসে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে ২৭ জন খুন আহত ১৫৪৯
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে কোন্দল আরও বাড়বে
দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তৃণমূলে কোন্দল হানাহানি আরও বাড়বে বলে আশাংকা করছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর সরকারের রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে যখন তারা মাঠ ছাড়া তখন স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলে ক্ষমতাসীন দলেই বেশি খুনোখুনির আশংকা রয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য ক্ষমতাসীনরা যেমন তৎপর থাকবে অন্যদিকে কে দলীয় মনোনয়ন পাবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তৈরি হবে ভয়াবহ কোন্দল। এ কোন্দলের জের ধরে বাড়বে হানাহানি। সূত্র জানায়, গত সাড়ে ৬ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনোখুনির ঘটনা ভয়ঙ্কর হারে বেড়ে গিয়েছে। দলীয় সংঘাতের ফলে প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিক নেতাকর্মীর লাশ পড়ছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছে ২৭ জন নেতাকর্মী। এ সময় নিজেদের মধ্যে ১৬১টি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১৫৪৯ জন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। আসকের পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়, গত ছয় বছরে (২০০৯-১৪) সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্তত ১৭২ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলে সরকারি দলের মধ্যেই সংঘর্ষ সংঘাত বাড়বে। এর ফলে মনোনয়ন-বাণিজ্য, টাকার খেলা, পেশীশক্তির ব্যবহার বাড়বে। এতে গণতন্ত্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সূত্র জানায়, স্থানীয় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার দ্বন্ধ, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, পদে যেতে প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেয়াসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-যুবলীগ, ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ওপর যেন নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে ফেলেছে দলটি। এরই মধ্যে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সারা দেশেই সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরো দাবানল ছড়াবে।
গত ১৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর বাড্ডায় গুলী করে হত্যা করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই নেতাসহ তিনজনকে। পশুর হাটের ইজারা, নতুন নেতৃত্ব ও গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসা নিয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামসুদ্দিন মোল্লা, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা ও ফিরোজ আহমেদ ওরফে মানিক।
একই দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিবগঞ্জ পৌর এলাকার মর্দনা গ্রামে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রবিউল ইসলাম (৩০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। একই দিন কুষ্টিয়ায় শোক দিবসের র্যালি শেষে জেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী সবুজ হোসেন নিহত হন।
একই দিনে মজমপুর রেলগেট প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে সবুজ (২৫) এক দলীয় কর্মীর মৃত্যু হয়। সিলেটের মদন মোহন কলেজেও নিজ সংগঠনের ক্যাডারের ছুরিকাঘাতে আবদুল আলীম (১৯) নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছেন।
মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) বিভিন্ন কাজ নিয়ে ক্ষমতানসীন দুই গ্রুপের বিরোধের জের ধরে গত ১০ আগস্ট রাতে রাজধানীর কাজিপাড়ায় নিজেদের কোন্দলে খুন হন কাফরুল থানা সৈনিক লীগের সাধারণ সম্পাদক রুবেল। ৭ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়ন যুবলীগের দফতর সম্পাদক মিলন সরকারকে (২৮) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দেওটি ইউনিয়নের মুহুরীগঞ্জ বাজারের কাছে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মিলন স্থানীয় সারেংবাড়ির নাদেরুজ্জামানের ছেলে। একই দিন বরিশালের আগৈলঝাড়ায় রাসেল ব্যাপারী (২৩) নামে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। ১ আগস্ট সন্দ্বীপ মগধরা ইউনিয়নের নামারবাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুবলীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
৫ জুলাই কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইয়াকুব আলী (৫৮) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। ইয়াকুব আলী উপজেলার কেয়ারী গ্রাম আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ১১ জুলাই রাজবাড়ী সদরের পাঁচুরিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস ছাত্তারকে গুলী করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২১ জুলাই রানীনগরে আমজাদ হোসেন (৩৫) নামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৪ জুলাই পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুরে দানেজ শেখ নমের এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। নিহত ব্যাক্তি আমিনপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ৩১ জুলাই দামুড়হুদা উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক আবদুল হান্নান ছোটকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে দুর্বত্তরা।
৫ জুন ঝালকাঠি সদর উপজেলায় তৌহিদুল ইসলাম সিকদার নামে এক যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তিনি বিনয়কাঠি ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৭ জুন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বালাইশপুর গ্রামে মফিজ উল্লাহ (৫৫) নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতাকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত মফিজ উল্লাহ বশিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯ জুন ফেনীতে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলীতে মোহাম্মদ মানিক (৩০) নামে যুবলীগের এক নেতা নিহত হন ২৮ জুন লালমনিরহাট সদর উপজেলা যুবলীগের সদস্য বুলেটকে (৩২) কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন।
আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা জানান, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রের যুগসন্ধিক্ষণ চলছে। রাজনৈতিক দল, সরকার, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। এর অভাবে এবং অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রে ঘাটতি থাকায় এ ধরনের সহিংসতা চলছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নতুন কিছু হবে না। এটা অনানুষ্ঠানিক ছিল, এখন আনুষ্ঠানিক হয়েছে। আমাদের এখানে প্রশ্ন হলো, এভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা। আগেও হয়নি। এখানে দলীয়ভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে মারামারি হবে। দলের ভেতরে কোন্দল হবে। মনোনয়ন-বাণিজ্য হবে। এগুলো ঠেকিয়ে যদি নির্বাচন করতে পারে তবে ভাল হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তা সুফল বয়ে আনবে না। এভাবে নির্বাচন করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। একই প্রতীকে বারবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে। অতীতেও এটা আমরা দেখেছি জাতীয় নির্বাচনে। এর ফলে মনোনয়ন-বাণিজ্য, টাকার খেলা, পেশীশক্তির ব্যবহার বাড়বে। এতে গণতন্ত্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, দলীয়ভাবে নির্বাচন করার যুক্তি হিসেবে দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলা হলেও তা হবে না। আমাদের দেশে এমনিতেই দলীয় কোনো শৃঙ্খলা নেই। আমরা দেখেছি, দলের কেউ অপকর্ম করলে তার শাস্তি হয় না। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে এটা হবে রাজনৈতিক নির্বাচন। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন কারণে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না, সহিংসতা হয়। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে এসব সংস্কৃতিতে পরিবর্তন হবে না। রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না। এজন্য রাজনীতিতে পরিশুদ্ধি দরকার। নির্বাচনে সরকার নিরপেক্ষ থাকবে কিনা। আইনের শাসন থাকবে কিনা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে কিনা। এবার প্রথমবার হচ্ছে, তাই এসব দেখার বিষয়।
No comments:
Write comments